মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১১:৪৯
Home / অনুসন্ধান / অতুলনীয় রাহনুমা মাওলানা শায়খ কাজী আবদুস সুবহান

অতুলনীয় রাহনুমা মাওলানা শায়খ কাজী আবদুস সুবহান

Abdus Subhanআকাবির আসলাফ-১৩

কাজী মুহাম্মদ আবদুর রহমান ::

জন্ম
শ্রদ্ধেয় আব্বাজান মাওলানা শায়খ কাজী আবদুস সুবহান (রাহমাতুলাহি আলাইহি) ১৯৫৩ ঈসায়ী সনের পয়লা নভেম্বর সিলেট জেলার জকিগঞ্জ থানাধীন কলাকুটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও সম্ভ্রান্ত একটি পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। পিতা কাজী জালাল উদ্দীন (রাহমাতুলাহি আলাইহি) নেহায়েত মুত্তাকী, পরহেজগার এবং তাহাজ্জুদগোজার ব্যক্তি ছিলেন।

ছোট্ট বয়সেই শায়খ কাজী আবদুস ‍সুবহান পিতৃহারা হন। তাঁর মাতা একজন “পাক্কা ঈমানদার” ও “আলাহওয়ালা” মহিলা। তাঁর বয়স শত বছরের ও বেশি। আলহামদু লিলাহ! এখনও বেঁচে আছেন। আলাহ তা’লা তাঁকে সুস্থ রাখুন।
বাংলাদেশে ধর্মপরায়ণ মানুষের এলাকা হিসেবে সিলেট জেলা’র সুনাম রয়েছে। আবার সিলেটের মধ্যে জকিগঞ্জ এলাকা ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ইসলামী শিক্ষার দিক দিয়ে ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি জনপদ তা সর্বজন বিদিত। মানুষের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির (ডেভলপমেন্ট) ক্ষেত্রে জায়গার প্রভাব অনেক বেশি হয়ে থাকে। সে মতে হযরত মাওলানা কাজী আবদুস সুবহান (রাহমাতুলাহি আলাইহি) এর জন্মস্থান ও বেড়ে ওঠার জন্য আলিম-ওলামা এবং ওলী-আউলিয়াগণের কেন্দ্রস্থল জকিগঞ্জের মাটি আলাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হওয়াকে একটি শুভলক্ষণই বলতে হয়। এমনিতেও তাঁর পুরো জীবন পরিশ্রম ও সাধনা এবং “জিরো থেকে হিরো” এ পরিণত হওয়ার একটি বাস্তব উদাহরণ ছিল।

শিক্ষাজীবন
জন্মের পরই মাওলানা কাজী আবদুস সুবহান রা.কে ইসলামী শিক্ষায় গড়ে তোলার এবং নবী করীম সালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম এর ওয়ারিস “আলিমে দ্বীন” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মজবুত নিয়ত এবং দৃঢ় সংকল্প করলেন তাঁর আম্মা সাহেবা। উল্লেখ্য, বাড়ির প্রায় সকলেই ছিলেন আধুনিক দুনিয়াবী শিক্ষায় শিক্ষিত। এমতাবস্থায় তাঁর আম্মা’র মনে ছেলেকে দ্বীনের আলিম ও “দাঈ” বানানোর ইচ্ছাটা আরও পাকাপোক্ত হয়। এ উদ্দেশ্য হাসিলের পথে বিভিন্নজনের পক্ষ থেকে তাঁর আম্মাকে (আমাদের দাদী) অনেক নিরুৎসাহিতও হতে হয়েছিল। কিন্তু কারো কথায় কর্ণপাত না করে ছেলেকে পাঠিয়ে দেন ইছাপূর ইবতিদায়ী মাদরাসায়। এখান থেকেই তাঁর নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ইছাপূর ইবতিদায়ী মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ভর্তি হন সিলেট-জকিগঞ্জের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান কালিগঞ্জস্থ ইছামতি সরকারী আলিয়া মাদরাসায়। এখানে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে দাখিল, ফাজিল ও আলিম বিভাগের শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি বিশ্বনাথ আলিয়া মাদরাসায় লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে গমন করেন। বিশ্বনাথ আলিয়ায় যাওয়ার আগে তাঁর পারিবারিক জীবন ছিল দারিদ্রপীড়িত এবং আর্থিক অবস্থা ছিল মারাত্মক শোচনীয়। জীবনের কঠিনতম এই সময়ে তিনি আলাহর উপর দৃঢ়ভাবে তাওয়াক্কুল করেন। এ সময় তাঁর কাছে জকিগঞ্জ থেকে বিশ্বনাথ যাওয়ার ভাড়া পর্যন্ত ছিল না। তাঁর এক চাচা জনাব কাজী আবুল কালাম সাহেব এমন সময় সাধ্যমত তাঁকে সহযোগিতা করেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিশ্বনাথ আলিয়া মাদরাসায় খুব বেশি দিন পর্যন্ত তাঁর পক্ষে থাকা সম্ভব হয় নি। পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে আবার তিনি স্থানীয় ইছামতি আলিয়া মাদরাসায় চলে আসতে বাধ্য হন এবং এখানেই “আলিমিয়্যাহ” সম্পন্ন করে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে “কামিল” এর সনদ অর্জন করেন।

হযরতের পূর্ণ লেখাপড়া যদিও সরকারী আলিয়া মাদরাসাসমূহে সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু তাঁর আন্তরিকতা শুরু থেকেই উলামায়ে দেওবন্দ এর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। বাল্যকাল থেকেই  লেখাপড়া এবং দ্বীনি শিক্ষার প্রতি অনেক আগ্রহী ছিলেন। লেখাপড়ার ব্যবস্থাপনা যেভাবেই হোক, তিনি করে নেয়ার চেষ্টা করতেন। এর একটা প্রমাণ হল যে, তিনি ছাত্রজীবনেই আর্থিক সমস্যা দূর করার জন্য কিছু ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। ব্যবসা দ্বারা যে লাভ-উপার্জন হত, তাঁর কিছু অংশ মা-কে এনে দিতেন এবং বাকি অংশ রেখে দিতেন নিজের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যয়ভার বহনের জন্য। এসব তাঁকে এ জন্যই করতে হয়েছে যে, তাঁর আব্বা যখন তাঁকে ছোটবেলায় রেখে ইন্তেকাল করেন, তখন ঘরের ভিটা ব্যতিত উত্তরাধিকার সূত্রে অন্য কোন সম্পদ রেখে যান নি। এমতাবস্থায় একজন দরিদ্র ছাত্রের পক্ষে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কত যে কঠিন, তা ভূক্তভোগী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে বুঝা অনেক মুশকিল। বস্তুতঃ ব্যবসা এবং লেখাপড়া- দুটো বিপরীতমূখী দায়িত্ব একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া তাঁর জন্য এ কারণেই সম্ভব হয়েছে যে, আলাহর বিশেষ রহমত তাঁর “শামিলে হাল” ছিল, তাঁকে আলাহ তাআলা অসাধারণ মেধা দিয়েছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছা ও সংকল্প অনেক মজবুত ছিল। তাঁর হিফজে কুরআন সম্পন্ন করার ঘটনাটিকে এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উলেখ করা যায়।

১৯৮৬ সালের কথা। তিনি তখন লন্ডন চলে এসেছিলেন। বয়স ছিল তাঁর প্রায় ৪০ বছর। লন্ডনের এনফিল্ড মসজিদে ইমামতি ও মক্তবের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। এমন সময় (ইমামতি ও শিক্ষকতার দায়িত্বে থাকাকালীন পরিণত বয়সের অবস্থায়) তিনি পবিত্র হিফজে কুরআন সম্পন্ন করেন। “হিফজে কুরআন” এর এই বিরল ঘটনা তাঁর একাগ্রচিত্ত্বতা, সদিচ্ছা, মনযোগ, ইলমের লক্ষ্য অর্জনে প্রবল আগ্রহ এবং পবিত্র কুরআনুল কারীমে’র সাথে তাঁর অসাধারণ সম্পর্ক ও ভালবাসা’র সুন্দর প্রমাণ বহন করে। বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রিয় নবী সা.’র হাদীসঃ কুরআন শরীফের সাথে যাঁদের অগাধ ভালবাসাপূর্ণ সম্পর্ক, মর্যাদার দিক বিচারে তাঁরা আল্লহপাকের পরিবারতূল্য এবং নৈকট্যপ্রাপ্ত”। (১) তাঁর উপর পূর্ণরূপে প্রযোজ্য হয়। তাঁর শিক্ষাজীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল তিনি তখনকার একক মুআল্লিম প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা “নাদিয়াতুল কুরআন বাংলাদেশ” এর বিভিন্ন ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করে পরবর্তিতে বিরাট খেদমত আঞ্জাম দেন এবং “নাদিয়ার হুজুর” নামে সুপরিচিতি অর্জন করেন। রাসূলে করীম সা.’র ভাষায় : “তোমাদের মধ্যে সে-ই শ্রেষ্ঠ, যে নিজে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শিখায়” (২) হাদীস খানারও পরিপূর্ণ নমুনা ছিলেন তিনি।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা। বর্তমানে সন্তানরা পরিচালনা করেন
তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা। বর্তমানে সন্তানরা পরিচালনা করেন

কর্ম জীবন
শিক্ষাজীবন চলাকালীন সময়েই হযরত মাওলানা কাজী আবদুস সুবহান রাহ. বিভিন্ন দ্বীনি দায়িত্ব পালন করেন। তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন জকিগঞ্জ থানার ঐতিহ্যবাহী মাইজকান্দী মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে। একই সময়ে তিনি বিখ্যাত আনন্দপুর জামে মসজিদে ইমামতির দায়িত্বও সুনামের সাথে পালন করেন।

১৯৮০ সালে তিনি জকিগঞ্জের খ্যাতনামা শাহবাগ কওমী মাদ্রাসায় (ঘাটের বাজার সংলগ্ন) শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি সেখানেও তিনি স্থানীয় মইদপুর জামে মসজিদে ইমামতী’র খেদমত আঞ্জাম দেন। শাহবাগে দুই বছর পর্যন্ত খেদমত আঞ্জাম দেয়ার পর তাঁর মনে নিজের এলাকায় দ্বীনি খেদমতের ইচ্ছা জাগে। তিনি তাঁর গ্রামের নিকটবর্তী প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইনামতি মাদরাসায় শিক্ষকতার দায়িত্ব নিয়ে চলে আসেন। এখানেও যথারীতি তিনি ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন, এবং এর জন্য স্থান নির্ধারণ করেন কলাকুটা জামে মসজিদ। এরপর ১৯৮৪ সনে তিনি ঐতিহ্যবাহী হাড়িকান্দী মাদ্রাসায়ও কিছুকাল দারস প্রদান করেন। ঐ বছরই সিলেট শহরের “ঐতিহাসিক বন্দর বাজার জামে মসজিদ” এ তাঁকে ইমাম ও খতীব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এখানে তিনি সুনামের সাথে প্রায় দুই বছর “ইমাম ও খতীব” এর দায়িত্ব পালন করেন। এখানে যে বিষয়টি উলেখ করা জরুরী মনে হয় তা হলো, হযরতের কাছে এ দুনিয়ায় সবচে’ প্রিয় জায়গা ছিল মসজিদ। জামাত সহকারে নামাজ আদায় ছিল তাঁর সবচে’ পছন্দনীয় অভ্যাস এবং এই প্রিয় জায়গা-ও পছন্দনীয় অভ্যাসের দাবি পূরণে তিনি মসজিদের “ইমামতী” ও আদর্শ মক্তব শিক্ষার যোগ্য উস্তাদ এর পেশাকে সর্বাধিক প্রিয় পেশা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। বলতে কি! তিনি ইমামতির দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বেশি সময় আল্লাহর ঘরে অতিবাহিত করার সৌভাগ্য অর্জন করতেন এবং এ ক্ষেত্রে তিনি এ হাদীস শরীফে’র বাস্তব নমুনা ছিলেন- “এক ব্যক্তি নবী করীম সা.’র কাছে এসে বললেন, আমাকে এমন একটি কাজের আদেশ দিন, যা আমি পালন করতে পারি। উত্তরে নবী করীম সা. বললেন- “তুমি স্বীয় ক্বাওমের/কমিউনিটি’র ইমাম হয়ে যাও” এর পর নবীজী বললেন- ‘আর না হয় তাদের মুআযযিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করো।’

লন্ডন সফর ও প্রেক্ষাপট
কর্মজীবনে একসময় তিনি বিয়ানী বাজার থানার বিখ্যাত “আকাখাজনা গ্রামের জামে মসজিদে ইমামতী এবং নবীনদের প্রাথমিক ইসলাম শিক্ষা দানের দায়িত্ব পালন করেন। এখানে তাঁর নাদিয়াতুল কুরআন এর বিজ্ঞানসম্মত শিশুশিক্ষা পদ্ধতির যোগ্যতা এলাকায় বিশেষভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। তাঁর মধ্যে শিশু ও নবীনদের মক্তব শিক্ষা’র অপূর্ব এই যোগ্যতা দেখে যাঁদের মনে দাগ কেটেছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মরহুম আলহাজ্ব মুখলিছুর রাহমান রাহ.। আকাখাজনা নিবাসী আলহাজ মুখলিছুর রাহমান মরহুম ছিলেন লন্ডন প্রবাসী এবং উত্তর লন্ডনের স্বনামধন্য এনফিল্ড জামে মসজিদের তৎকালীন সম্মানিত চেয়ারম্যান। তাঁর সুযোগ্য সন্তান জনাব মাওলানা হাফিয মুশফিক উদ্দীন লন্ডন ইবরাহিম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ডাইরেক্টর। উল্লেখ্য আব্বাজান কাজী আবদুস সুবহান-এর কুরআনী মক্তবের কৃতজ্ঞ ছাত্রদের মধ্যে হাফিজ মুশফিক সাহেব বিশিষ্ট একজন। তিনি যখন সিলেট কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ বন্দর বাজার-এ দায়িত্বরত, তখন হাফিজ মুশফিক উদ্দিন সাহেবের আব্বা আলহাজ্ব মুখলিছুর রাহমান সাহেব হযরত মাওলানা কাজী আবদুস সুবহান রা.কে লন্ডন এনফিল্ড মসজিদে ইমাম ও উস্তাদ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিষয়টি তিনি মসজিদ কমিটি’র কাছে পেশ করেছিলেন এবং সদস্যবৃন্দের ঐক্যমতের ভিত্তিতে হযরতকে লন্ডন আনার জন্য স্পন্সর পাঠানো হয়েছিল। যখন চেয়ারম্যান সাহেব কাজী সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে লন্ডন আসার ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে চান, তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, যদি মসজিদ কর্তৃপক্ষ সফরের সকল ব্যয়ভার বহন করেন, তাহলে আমার সম্মতি আছে।

অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর স্পন্সর চলে আসে। আলাহর রহমতে ভিসার কাজ দ্রুত সম্পন্ন হয় এবং তাঁর লন্ডন আসা হয়ে যায়। ইতিপূর্বে তাঁর চিন্তা ও কল্পনা পর্যন্ত ছিল না যে আল্লাহ তাআলা তাঁকে বৃটেন নিয়ে আসবেন। অনেকটা হঠাৎ করেই তাঁর বৃটেন আসার ব্যবস্থা হয়। আল্লাহ তাআলার কাছে তাঁর মাধ্যমে পাশ্চাত্য জগতেও দ্বীনের খেদমত গ্রহণ মনজুর ছিল, বিধায় এমনটি হয়েছে।

বাহ্যিক কারণসমূহের মধ্যে আলহাজ মুখলিছুর রাহমান সাহেবের মনে কাজী সাহেবের প্রতি যে আকর্ষণ ছিল, তা উল্লেখ করা যায়। তবে এই আকর্ষণের পেছনে যে বাহ্যিক কারণ নিহীত ছিল, তা হলো হযরত আকাখাজনা মসজিদে ইমামতীর দায়িত্বকালে নিষ্টা, যোগ্যতা, আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ- এর যথেষ্ট পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ইমামতি ও শিক্ষকতার পাশাপাশি পূরো মসজিদ চত্তর এবং টয়লেট ইত্যাদি নেহায়েত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে অনেক যত্ন নিতেন। বস্তুত তিনি ছিলেন নিম্নে উল্লেখিত হাদীসসমূহের বাস্তব নমুনা। “পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ” এবং “বান্দা যখন কোন কাজ সম্পাদন করে, তখন আল্লাহ তাঅালার কাম্য হলো যে সে যেন খুব সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে কাজটি সম্পাদন করে।”

উলেখিত দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতা’র ফলে কাজী সাহেব সম্পর্কে আলহাজ মুখলিছুর রাহমান সাহেবের মনে যে সু-ধারণার জন্ম হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তা হযরতের দুনিয়াবী উন্নতিরও একটি বড় মাধ্যম প্রমাণিত হয়।

যাইহোক, আল্লাহপাকের ইচ্ছায় কাজী সাহেব ১৯৮৬ সালে বৃটেন তাশরীফ নিয়ে আসেন এবং নর্থ লন্ডনের এনফিল্ড জামে মসজিদে ইমাম, খতীব এবং ইভিনিং মক্তবের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে শুরু করেন। দীর্ঘ ৬-৭ বছর পর্যন্ত এনফিল্ড এলাকায় তাঁর অসাধারণ দ্বীনি খেদমতের সুপ্রভাব পড়তে থাকে। বিশেষতঃ আদর্শ মক্তব শিক্ষার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের প্রচুরসংখ্যক সন্তানেরা, ঈমান এবং ইসলাম সম্পর্কে মজবুত অর্জনে সক্ষম হয় এবং সুরা-ক্বিরাত ও নামাজ-বন্দেগীর সঠিক ও প্র্যাক্টিক্যাল জ্ঞান অর্জন করে। আজ এনফিল্ড এলাকার একটু প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে খোঁজ নিয়ে দেখুন, প্রচুরসংখ্যক যুবক ছেলে ও মেয়েরা হযরতের শিষ্য। নিদ্ধিধায় বলা যায় যে, তিনি ইসলাম ও মুসলমানিত্ব শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে একজন আদর্শ উস্তাদ ছিলেন। তিনি সত্যিকার অর্থেই ছাত্রদের হক্ব আদায় করে শিক্ষাদান করতেন। ইসলামী শিক্ষকদেরকে ছাত্রদের হক আদায় করে পড়ানোর জন্য তিনি বিশেষ নসীহত করতেন, বলতেন- “শিক্ষা দানে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। সপ্তাহ পূর্ণ হলো। পূর্ণ পয়সা নিয়ে নিলে!! পড়ানোর হক কি পূর্ণরূপে আদায় হয়েছে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে!” এই অনুভূতি ও হক আদায়ের চেষ্টা থাকায় আজ তাঁর শত শত ছাত্র-ছাত্রীকে দেখা যায় যে তাঁরা আব্বাজান (রাহমাতুলাহি আলাইহি) এর কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে।

আলাহ তাআলা তাঁর যাবতীয় খেদমত কবুল করে নিন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসে উচ্চ মাকাম দান করুন। সত্য কথা বলা তাঁর নিয়মিত অভ্যাস ছিল। সত্যের প্রক্ষে তিনি তাঁর মতানৈক্য সম্পর্কে ও স্পষ্ট ভাষায় নিজের বক্তব্য তুলে ধরতেন। এক পর্যায়ে এনফিল্ড জামে মসজিদ- এ এখতেলাফ দেখা দিলে তিনি এনফিল্ড থেকে প্রধান ইমাম এর দায়িত্বে অব্যাহতি দিয়ে চলে আসেন নর্থ লন্ডন সেন্ট্রাল মসজিদে। যা ফিন্সব্যারিপার্ক মসজিদ নামে বেশি পরিচিত। মসজিদটি বর্তমানে আরব মুসলমানদের দায়িত্বে রয়েছে। শিশু ও নবীনদের শিক্ষা দানের ধারাবাহিকতা এ মসজিদে আরও সুন্দরভাবে অগ্রসর হলো তাঁর মাধ্যমে। লন্ডন ও বৃটেনে অল্প কয়েকজন ছোট শিক্ষার্থীকে এক সংগে ইসলামী শিক্ষা দান একা একজন উস্তাদের জন্য একটা কঠিন পরীক্ষা। কিন্তু ফিন্সব্যারিপার্ক মসজিদে তিনি একসঙ্গে ৭০ জন ছাত্র-ছাত্রীদেরকে হক্ব আদায় করে পড়ানোর বিরল নজীর স্থাপন করতে পেরেছিলেন। এখানে সুদূর এনফিল্ড, এডমন্টন ও অন্যান্য এলাকা থেকেও লোকজন তাদের সন্তানদেরকে আব্বাজান (রাহমাতুলাহি আলাইহি) এর কাছে পড়ানোর জন্য নিয়ে আসতেন। দুই বছর পর্যন্ত এই মসজিদে খেদমত আঞ্জাম দেয়ার পর ফরেস্ট গেইট জামে মসজিদে ইমামতী’র দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেন। ফরেস্ট গেইট মসজিদের পরে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। এটিই ছিল তাঁর নিয়মিত ইমামতির শেষ মসজিদ। তবে লন্ডন পপলার এলাকার রবিনহুড গার্ডেন মসজিদে শুধু জুমআর খতীব ও মক্তব বিভাগের উস্তাদ হিসেবে তিনি অনেক দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। কোথাও পূর্ণ ইমামতি সম্ভব না হওয়ার কারণ ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে যখন তিনি তাঁর পূরো পরিবারকে বাংলাদেশ থেকে লন্ডন নিয়ে আসেন, তখন নবাগত ও বড় পরিসর এই পরিবারকে “সেটেল” করার জন্য তাঁকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এমতাবস্থায় ইমামতির সুকঠিন দায়িত্ব পালন তাঁর জন্য সম্ভব ছিল না। তবে শিশুদের আধুনিক পদ্ধতিতে ইসলামী শিক্ষাদানের ধারাবাহিকতা তিনি ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত চালিয়ে গিয়েছিলেন। লন্ডনের বার্নার হলেও তাঁর ইভিনিং মক্তব প্রায় দীর্ঘ ১৩-১৪ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

পারিবারিক জীবন
নিয়মতান্ত্রিক লেখাপড়ার জীবন যখন শেষ হয়, তখন পারিবারিক জীবন শুরু করার চিন্তা করেন আব্বাজান হযরত মাওলানা কাজী আবদুস সুবহান (রাহমাতুলাহি আলাইহি)। তিনি তখন এক গ্রামের মসজিদে ইমাম হিসেবে দায়িত্বরত। আলাহর কোন ওলী এবং বুযুর্গ ব্যক্তিত্বের কণ্যা সন্তানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা মনের ভেতর আগে থেকেই তাঁর। আলাহর কি মন্শা! এই গ্রামেই ভক্ত-অনুরক্তদের আবদারে শায়খুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী (রাহমাতুলাহি আলাইহি) এর শিষ্য ও বিশিষ্ট খলীফা, হযরত মাওলানা আবদুল গাফফার শায়খে মামরখানী (রাহমাতুলাহি আলাইহি)র আগমন হয়।

গ্রামের জনৈক ব্যক্তির নিকট আব্বাজান নিজের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। মধ্যস্থ জনৈক ব্যক্তি, যিনি হযরত মামরখানী’র একান্ত ভক্ত ছিলেন। তিনি হযরতের কাছে ইমাম সাহেবের (অর্থাৎ আব্বার) কথা তুলে ধরেন। হযরত শায়খে মামরখানী রাহ. ইমামতী, তিলাওয়াত, কেরাত পাঠ এবং আমল-আখলাকের দিক পূর্ণরূপে যাচাই করার পর অত্যন্ত খুশী হন এবং স্বাদরে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। একজন মস্তবড় আলাহর ওলী’র সুদৃষ্টিতে উত্তীর্ণ হওয়া মামুলী কথা নয়। শায়খে মামরখানী রা. ক্বওমী মাদরাসা ধারার এক মহান কর্ণধার ছিলেন, তাঁর মনে নিজ মেয়েকে সরকারী মাদরাসাসমূহে শিক্ষা অর্জনকারী এক আলিমের সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ইতস্থতা থাকা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কাজী সাহেব-এর আমল-আখলাক্ব, সুন্নতের অনুসরণ এবং নামায-বন্দেগী ও তিলাওয়াত শায়খে মামরখানী’র কাছে পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণেই তিনি নিজ মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন।

সন্তানাদির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান
সন্তানাদির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

কাজী আবদুস সুবহান সাহেব পরিবারের একজন আদর্শ কর্তাব্যক্তি ছিলেন। সত্যিকার অর্থেই তাঁকে পরিবারের জন্য “মুরব্বী” আখ্যায়িত করা যায়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রতি তাঁর তারবিয়্যাতের দৃষ্টি ছিল সু-গভীর। স্ত্রী এবং সন্তানাদীকে কিভাবে আল্লাহ ও রাসূল সা.-এর পরিপূর্ণ অনুসারী বানানো যায়, এ চিন্তা তাঁকে সবসময় বিগলিত করে রাখত। বিশেষতঃ একটি অমুসলিম দেশ ও পরিবেশে ইসলামী তাহযীব ও তমদ্দুনকে ছেলে মেয়েরা কিভাবে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে পারে, এর জন্য কি কি করণীয় এ বিষয়ে তাঁকে রীতিমত একজন গবেষক ও চিন্তানায়ক মনে হত। তিনি সন্তানদেরকে সবসময় নিকট-সান্নিধ্যে রাখার চেষ্টা করতেন। এ ব্যাপারে তাঁর উক্তি ছিল: ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের লোকজন তাঁদের সন্তানদেরকে ছোটবেলা থেকেই একেবারে বগলের নীচে রাখে, যাতে তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে সন্তানেরা দূরে সরে না যায়। ধর্মীয় শিক্ষাও তারা শুরু থেকেই দিতে আরম্ভ করে।

সামাজিক জীবন

হযরত মাওলানা কাজী আবদুস সুবহান (রাহমাতুলাহি আলাইহি) ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে যেমন একজন আদর্শ পুরুষ ছিলেন, তেমনি সামাজিক জীবনেও তিনি সুন্দর আদর্শ রেখে গিয়েছিলেন। মানুষের খোজ খবর নেয়া, মানুষের সাথে হাসি মুখে আলাপ করা, মন ভরে সাক্ষাত করা, সাধ্যমত অসহায় মানুষের সেবায় এগিয়ে আসা, অন্যকে আগে ভাগে সালাম দেয়ার চেষ্টা করা, খুশী মনে কারো হাল-অবস্থা জিজ্ঞাসা করা, শিশু-কিশোরদেরকে সালাম দেয়া, তাদের সাথে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করা, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া পড়শীর খোজ খবর নিয়মিত নেয়া, তাদের অর্থনৈতিক ভাবে সাহায্য করা, কারো সঙ্গে দেখা করতে (সামান্য হলেও) হাদিয়া নিয়ে যাওয়া, এসব সামাজিক গুণাবলী তাঁর নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর এসব অভ্যাস বস্ততঃ জনাব নবী-করীম (সালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) এর সুনড়বত ও অপরিসীম পূণ্যের কাজ। হাদীস শরীফে প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম) সুসংবাদ দিয়েছিলেন: অপর ভাইয়ের কোন প্রয়োজন পূরণে যদি আমি এগিয়ে যাই, তবে তা এই মসজিদে অর্থাৎ মদীনার মসজিদে (নববী) আমার মাসব্যাপী এ’তেকাফ করার চেয়েও আল্লহর কাছে বেশি প্রিয়। অন্য হাদীসে নবীজী (সালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) ইরশাদ করেন: অপর ভাই’র দিকে মুচকি হাসি দিয়ে তাকানো সদকা স্বরূপ। আরেক হাদীসে নবীজী (সালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম) ইরশাদ ফরমান: “যে আলাহ ও আখেরাত দিবসের উপর ঈমান রাখে, তার উচিৎ, সে যেন প্রতিবেশী’র সাথে সদ্ব্যবহার করে”। বলতে দ্বিধা নেই, আব্বাজান (রাহমাতুলাহি আলাইহি) এসব হাদীসের আলোকে সাহায্য-সহযোগিতা ও সেবামূলক কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশে অসংখ্য মানুষের সাহায্য করেছেন। কোথা-ও ঘর-বাড়ি নির্মাণ করিয়েছেন, কোথা-ও নিজে অভিভাবক হয়ে কারো বিয়ে’র ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

রাজনৈতিক জীবন

আব্বাজান মাওলানা ক্বাজী আবদুস সুবহান (রাহমাতুলাহি আলাইহি) আদর্শ ইসলামী রাজনীতিকও ছিলেন। ইসলামী রাজনীতি’র সাথে তাঁর বাস্তব সম্পৃক্ততার ইতিহাস কয়েক যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি “ছিয়াছাত” তথা ইসলামী রাজনীতির গুরুত্ব, প্রয়োজন ও মর্যাদা সম্পর্কে দলীলভিত্তিক জোরালো আলোচনা পেশ করতেন। সবসময় দেশ-জাতীর সার্বিক অবস্থা এবং বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন দৃষ্টি ছিল তাঁর। জাতীয় পর্যায়ে যারা ইসলামী রাজনীতি’র কর্ণধার, তাঁদের অবস্থান, পদক্ষেপ ও কার্যক্রম সম্পর্কে সর্বদা তিনি খোঁজ খবর রাখতেন। পত্র পত্রিকা এবং রেডিও সংবাদ শোনা তাঁর নিয়মিত অভ্যাস ছিল। ছাত্র জীবনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সাথে জড়িত থেকে প্রয়োজনীয় ইসলামী রাজনৈতিক কাজ করে যান। এর পর দলীয়ভাবে না হলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রাম ও কার্যক্রমে’র সাথে জড়িত থাকেন।

১৯৮৯ সনে যখন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী যুব শিবির সম্পূর্ণ একত্রিত হয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস আত্মপ্রকাশ করে এবং হাক্কানী উলামায়ে কেরামের অনেক শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও আধুনিক শিক্ষিত সেরা অনেক ইসলামী বুদ্ধিজীবিগণের সমন্বয়ে এক ব্যতিক্রমী ইসলামী আন্দোলন শুরু হয়, তখন আশা’র আলো সেই সংগঠনের কর্মপ্রয়াস, অনেকের মতই হযরত-এর মনেও আনন্দের সঞ্চার করে। কারণ, এই অনুপম সংগঠনে এক দিকে যেমন ছিলেন দেশের প্রচুর সংখ্যক নেতৃস্থানীয় উলামায়ে কেরাম, অপরদিকে ছিলেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদগণ। এ সংগঠনই ক্বওমী মাদরাসা, আলিয়া মাদরাসা এবং কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্র শিক্ষক এবং আউলিয়ায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দ্বীনগণকে ঐক্যবদ্ধ ফ্লাটফর্মে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। এসব কারণে শুরু থেকেই বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এর সাথে তিনি জড়িত হন। খেলাফত মজলিস গঠনের আগেই তিনি বৃটেনে স্থায়ীভাবে তাশরীফ নিয়ে এসেছিলেন। এজন্য তিনি খেলাফত মজলিস যুক্তরাজ্য শাখার সাথে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি খেলাফত মজলিস যুক্তরাজ্য শাখার কেন্দ্রীয় সহসভাপতি পদে দায়িত্বরত ছিলেন। শুরুতে যখন লন্ডনে খেলাফত মজলিসের কোন অফিস ছিলনা, তখন প্রায় মিটিংই তাঁর বাসায় অনুষ্ঠিত হত। এসব মিটিংয়ে সকলের আদর-আপ্যায়ন করে তিনি মনে পরম আনন্দ অনুভব করতেন। ইসলামী রাজনীতিবিদগণকে তিনি সীমাহীন শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। খেলাফত মজলিসের প্রাণপুরুষ, এশিয়ার বিখ্যাত শায়খুল হাদীস আলামা আজীজুল হক সাহেব (রাহমাতুলাহি আলাইহি) যখন বৃটেন সফরে আসেন, তখন তিনি এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন শহর সফর করেন। এক সফরে শায়খুল হাদীস সাহেব (রাহমাতুলাহি আলাইহি)কে পুরো সপ্তাহ বাসায় রেখে আন্তরিকতার সাথে আদর-আপ্যায়ন করেন।

খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় মহাসচিব ইসলামী আন্দোলনের প্রাণশক্তি বিপ্লবী চিন্তানায়ক অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের এর লন্ডন আগমন হলেই আব্বাজানের দাওয়াতে আমাদের বাসায় তাঁর আসা এবং রাত্রি যাপন নিয়মিত ব্যাপার ছিল। রাজনীতির সাথে সম্পর্কেরই সুবাদে তিনি চারদলীয় জোট ইউকে, বাংলাদেশী মুসলিমস ইউকে ইত্যাদির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। রাজনৈতিক সভা-প্রোগ্রামে তাঁর সুন্দর উপস্থিতি এবং সাহসী বক্তব্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি দেশ ও জাতির সার্বিক অবস্থা, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি এবং সময়ের বাস্তব প্রয়োজন কে সামনে রেখে সকলের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সাধনার প্রয়োজন তিনি তীব্রভাবে অনুভব করতেন। দলীয় সংকীর্ণতা, এক গুঁয়েমী, এখতেলাফের নামে বিচ্ছিন্নতা এবং দলীয় স্বার্থপরতা মোটেও তাঁর পছন্দ ছিল না। সংশোধনের দৃষ্টিতে নিজেদের মঞ্চে নিজেদের ভূল ত্রুটি চিহ্নিত করে শুধরে দেয়া তাঁর সার্বক্ষণিক অভ্যাস ছিল। আলাহর প্রতি রজু ও মনোনিবেশ, নামাজের পাবন্দী এবং মাথা থেকে নিয়ে পা পর্যন্ত পুরো শরীরে সুন্নতের অনুস্মরণ কে তিনি রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য সবচে’ জরুরী কাজ স্বাব্যস্থ করতেন। তিনি বলতেন আলাহর সাহায্য ছাড়া রাজনৈতিক চেষ্টায় সফলতা আসবেনা, আর খোদায়ী সাহায্য পেতে হলে ফরজ-ওয়াজিব পালন, তাকওয়ার অনুশীলন এবং সুনড়বতের অনুস্মরণ পূর্বশর্ত। তিনি মনে করতেন, আজকের যুগে রাজনৈতিক চেষ্টাসাধনায় বিফলতার পেছনে আলোচ্য কারণ সমুহ কার্যকর রয়েছে।

দাওয়াত ও তাবলীগ
দাওয়াত ও তাবলীগের বিশ্বব্যাপি কাজের সাথে ও তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। তিনি আমল আখলাক ও নামাজবন্দে গী বিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তাবলীগের মেহনত ও কার্যক্রমকে সর্বস্থরের মুসলমানদের জন্য এক নেয়ামত মনে করতেন। সাধারণ মুসলমান ও জওয়ানদেরকে আল্লাহর মক্ববুল এই পথে সময় ব্যয়ের মাধ্যমে সংশোধনের উপকরণ সংগ্রহের তাকীদ করতেন তিনি। নিজেও বারবার দাওয়াতের নবুওতী মিশনে প্রচুর সময় দিয়েছেন। এ উপলক্ষ্যে ১৯৯৫ সনে লন্ডন থেকে তাবলীগ জামাতের নিয়মিত কাফেলায় শরীক হয়ে বাংলাদেশের রাজশাহী এলাকায় “চিলা” যাপন করেছেন। আমি অধম (কাজী আবদুর রাহমান) কেও সে সফরে আব্বার সাথে থাকার সুযোগ হয়েছিল।

হযরতের কবরস্থান
হযরতের কবরস্থান

যেভাবে চিরবিদায় নিলেন

বাড়ির দারুল আযকার মসজিদের ইমামকে সফর সংগী করে ট্রেনিং এর জন্য কুমিলার উদ্দেশ্যে সফর করেন। ট্রেনিং এর জন্য সেখানে তিনি নাদিয়ার মাদরাসা ভবনেই অবস্থান করেছিলেন। মাদরাসায় অবস্থানকালে তাঁর তাসবীহ-তাহলীল, নামাজ-বন্দেগী এবং মা’মুলাত নিয়মতান্ত্রিকভাবে অব্যাহত ছিল। দ্বীনী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণরত অবস্থায় মাদরাসা ভবনেই একদিন (১৮/৪/২০১২) তাহাজ্জুদ এবং মা’মুলাত শেষ করে একটু বিশ্রামের জন্য বিছানায় গিয়ে শুঁয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তাহাজ্জুদ বা ফজরের সময়ে তাঁর ব্রেইন স্ট্রোক হয়ে যায়। তিনি ফজরের জন্য আর উঠতে পারেননি। অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে কুমিলা থেকে ঢাকা’য় নিয়ে আসা হয় এবং ঢাকাস্থ ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় এক মাস পর্যন্ত “ল্যাব এইড” এ চিকিৎসা গ্রহণের পর উলেখে যাগ্য কোন উন্নতি পরিলক্ষিত না হওয়ায় তাঁকে কিছু দিনের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও বিশেষ তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি দেখা দিলে তাঁকে পূনরায় ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং এ্যাপোলো হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এর পর সেই নির্ধারিত দিন চলে আসল, যে দিন সকল প্রাণীর জন্যই অবধারিত।
১৬ জুন ২০১২ ইং শনিবার দুপুর ২টার সময় ঢাকা’র এ্যাপোলো হাসপাতালে তিনি এ নশ্বর দুনিয়া চিরদিনের জন্য ত্যাগ করে আখেরাতের পথে রওয়ানা হয়ে যান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। ইন্তেকালের আগে দীর্ঘ ২ মাস পর্যন্ত অজ্ঞান অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। আলাহর পথে সফররত অবস্থায়, “দ্বীনি ইলম” এর জন্য তা’লীম ও তাআল্লুম- এ- মশগুল হালতে এবং আলাহর ইবাদতে ধ্যানমগ্ন সময়ে তিনি ব্রেইনস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে যে অজ্ঞান হয়েছিলেন, সে অবস্থায়-ই তাঁর ইন্তেকাল হয়েছিল। এজন্য নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, আলাহর পথে- দ্বিনী ইলমের পথে তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে এবং আশা করা যায় যে শাহাদাতের মর্যাদা তাঁর ভাগ্যে জুটেছে। কায়মনোবাক্যে আমরা মোনাজাত করি, আলাহ যেন তাঁকে শাহাদাতের মর্তবা দান করেন এবং জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চ মাক্বাম নসীব করেন। আমীন। ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স প্রায় ৬৪ বছর ছিল।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও তাঁর প্রাণপ্রিয় দারুল আযকার মসজিদ এর পশ্চিম পাশে মেহরাব সংলগ্ন মনোরম পরিবেশে এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার নিকট দাফন করা হয়েছে। শায়খ কাজী মাওলানা আবদুস সুবহান সাহেব রাহ.’এর মোবারক কবরের এই সুন্দর অবস্থান, কাজী নজরুল ইসলাম এর পংক্তি স্মরণ করিয়ে দেয়:- “মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই/সু নামাজের আযান আমি শুনতে যেন পাই”। বলতে দ্বিধা নেই ! মসজিদ এবং মাদরাসাই ছিল হযরতের সর্বাধিক প্রিয় স্থান এবং মনের টান! মনে হয় আলাহ তাঁকে তাঁর মনের মত স্থানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

লেখক: মরহুমের জ্যেষ্ঠ পুত্র

আরও পড়ুন

আকাবির আসলাফ-১২, ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আব্দুর রহমান

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...