সোমবার, ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৩:১৪
Home / পরামর্শ / শিক্ষার্থীর পাথেয় -০২

শিক্ষার্থীর পাথেয় -০২

শিক্ষার্থীর পাথেয়এহতেশামুল হক ক্বাসিমী ::

লাভ-ক্ষতির খতিয়ান
মনে করো ১৪৩৬ হিজরী সমাপ্তির আর মাত্র একদিন বা দুই দিন বাকী। আজ ২৮ যিলহজ্ব বুধবার। দিন দুয়েকের পরেই আরেকটি নতুন সন ১৪৩৭ তম হিজরী শুরু হবে। নতুন বছরের সূচনায় প্রত্যেক তালিবে ইলমের জন্য জরুরী হলো-গেলো বছরের হিসাব কষা আর নতুন বছরের টার্গেট ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা। বিশেষ করে বিগত বছর প্রাপ্তির জাম্বিলে কী কী জমা পড়লো আর ঘাটতির তালিকা কতটুকু দীর্ঘায়িত হলো, তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে একটা নতুন সিদ্ধান্ত হাতে নেওয়া। ব্যর্থতাগুলোকে কীভাবে সফলতায় রূপ দেওয়া যায় আর সফলতার গতিকে কীভাবে আরো বেগবান করা যায়, সে ব্যাপারে তালিমী মুরাব্বীর সাথে মতবিনিময় করে নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করা। এটা যারা করবে এবং নিয়মিত প্রতি বছর করে থাকবে, তারা সফল হবেই। সফলতা তাদের পদচুম্বনে অবশ্যই এগিয়ে আসবে।

মেধা ও সাধনা
মেধা নিয়ে ছোট খাটো একটা ইখতেলাফ আছে। কেউ বলেছেন, মেধা জন্মগত। কেউ বলেছেন, মেধা অর্জিত। অতীতে এমন বহু আকাবির অতিবাহিত হয়েছেন, প্রথমদিকে যাদের মেধা একদম ছিলো না। আবার থাকলেও ছিলো নেহায়েত কম। পরবর্তীতে তারা চেষ্টা ও সাধনার জোরে সুপ্ত মেধার বিকাশ ঘটিয়েছেন।
তবে মূলকথা হলো-প্রকৃতিগতভাবে ‘মেধা’ মহান আল্লাহর এক অপূর্ব নেয়ামত। তবে মেধাবী হতে হলে মেধাবিকাশের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। অবিরাম চেষ্টা ও কঠোর সাধনার মাধ্যমেই সুপ্ত মেধার বিকাশ ঘটে। মেধা ও প্রতিভা বিকাশের জন্য তালিবে ইলিমদেরকে প্রাথমিকভাবে নিম্ন বর্ণিত বিষয়াবলির প্রতি লক্ষ্য রাখা খুবই জরুরী।
(১) জীবনের লক্ষ্য স্থির করা।
(২) শেখার আগ্রহ সৃষ্টি করা।
(৩) আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করা।
(৪) লেখাপড়ার পরিবেশ তৈরী করা।
(৫) সাস্থ্য ভালো রাখা।
(৬) তালিমী মুরাব্বীর সংশ্রব গ্রহণ করা।
(৭) রুটিনমাফিক মেহনত করা।

জীবনের লক্ষ্য স্থির কীভাবে করবেন?
কোনো কাজে সাফল্য লাভের জন্য এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য শুরুতেই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ণয় করতে হয়। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে থাকলে ইলিম অর্জনের পথ অনেকটা সুগম হয়ে উঠে। আর লক্ষ্য স্থির না থাকলে তালিবরা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া চাই, “শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে আমি হবো একজন ধীমান ও বিদগ্ধ গবেষক। সাহিত্য ও সাংবাদিকতার অঙ্গনে একজন শক্তিমান লেখক ও সাংবাদিক। যুদ্ধের ময়দানে একজন বীর সেনানী ও বিচক্ষণ সিপাহসালার। রাজনীতি ও সমাজ সংস্কারের প্রাঙ্গণে একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও সংস্কারক। জাতির কল্যাণে জনদরদী সেবক। ইহসান ও আধ্যাত্মিকতার জগতে একজন অন্তরলোকসম্পন্ন মুসলিহ ও মুযাক্কী। ইনাবত ইলাল্লাহর ক্ষেত্রে সবিনয় প্রার্থনাকারী। আর তাকওয়া ও খাওফে এলাহীর তাড়নায় প্রকম্পিত এক বান্দা।
এই প্রত্যয়নগুলোকে নিজেদের লক্ষ্যরূপে দৃঢ়ভাবে লালন করতে হবে।

অন্তত একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হবে
দাওরায়ে হাদীস সমাপন করার পর তাফসীর, হাদীস ও ফেক্বাহ, এই তিন শাস্ত্রের যে কোনো একটির উপর বিশেষজ্ঞ হতে হবে। কারণ, আসল ইলম এই তিনটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সুতরাং রুচি ভেদে যে কোনো একটিকে বাছাই করে তার উপর মেহনত চালিয়ে যেতে হবে সারাজীবন। তবে অপর দুটির সাথে কম করে হলেও চলনসই সম্পর্ক জারি রাখতে হবে। দৈনিক অন্তত একটি আয়াতের তাফসীর, একটি হাদীসের ব্যাখ্যা ও একটি ফেকহী মাসআলা মুতালাআ করতে হবে। এই মেহনত প্রত্যেক নবীন আলেমের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। আামাদের দাওরায়ে হাদীসের শেষ সবকে উপরিউক্ত কথাগুলো বলেছিলেন উস্তাযে মুহতারাম দারুল উলূম দেওবন্দের শায়খুল হাদীস আল্লামা মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপূরী দা. বা.। তিনি আরো বলেছিলেন, একই ব্যক্তি সব বিষয়ে পারদর্শী হতে পারে না। এটা সবার পক্ষে অসম্ভব ও দুরূহ ব্যাপার। সববিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে চাইলে কোনোটাই হাসিল হবে না। কারণ, একটা বিষয়ের উপর আধিপত্য অর্জন করতে হলেও বছরের পর বছর যুগের পর যুগ মেহনত করতে হয়। অধ্যাবসায়ের সাথে অবিরাম সাধনা ও প্রচুর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়। তারপর উক্ত বিষয়ে বুৎপত্তি লাভ করা সম্ভব হয়ে ওঠে।

শেখার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে
কোনো কিছু শিখতে যাওয়া খুবই কঠিন। শুধু যে কঠিন তাই নয়, কখনো কখনো একগেঁয়ে আর সময় সাপেক্ষও বটে। যেমন- কেউ একটি পাঠ ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখস্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। আবার আরেকজন ছাত্র একই পাঠ আধাঘণ্টার মধ্যে মুখস্ত করে ফেলে। পাঠটি সে আর ভুলেও না। এর কারণ হলো- একজনের শেখার আগ্রহ আছে, অন্যজনের তা নেই। কাজেই কিছু শিখতে হলে শেখার আগ্রহ ও আবেগ থাকতে হবে পুরোপুরি। চেষ্টা করতে হবে শতভাগ।

লেখাপড়ায় মন বসে না!
লেখাপড়ায় মন না বসার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন আবেগ ও আগ্রহের অভাব। এর সমাধান হলো- পঠিতব্য বিষয়ের গুরুত্ব ও উপকারিতা মনে বসানো। প্রথমে মূল বিষয়ের ফযীলত মনে বসাও। তারপর তোমার নির্দিষ্ট কিতাবের ভূমিকা পড়ো। এরপর উস্তায মহুদয়ের আলোচনা শুনে বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করো। নিজে নিজেও ঐ বিষয়ের উপকারী দিকগুলো খুঁজে বের করো। আবেগ ও আগ্রহ সৃষ্টি হবে ইনশাআল্লাহ।
লেখাপড়ায় মন না বসার আরেকটি কারণ হতে পারে, তুমি যে জামাতে ভর্তি হয়েছো, সেই জামাতের সিলেবাস বুঝে না আসা। আর সিলেবাস বুঝে না আসার কারণ হলো যতটুকু যোগ্যতা নিয়ে উন্নীত হওয়ার কথা ছিলো ততটুকু যোগ্যতা আদৌ অর্জন করতে পারো নি। তাহলে এখন করণীয় কী? জবাব হলো নিচের কিতাবগুলো অভিজ্ঞ উস্তাযের কাছে পুনরায় পাঠ করা এবং সিলেবাসের কিতাবগুলোর তাকরীর মনোযোগ সহকারে শোনা। পাশাপাশি তাকরার ও মুযাকারার অভ্যাস গড়ে তোলা। এ কাজগুলো নিয়মিত করলে আশাকরি লেখাপড়ায় মন বসবে।
লেখাপড়ায় মন না বসার আরেকটি কারণ হতে পারে, পরীক্ষায় ফেল করা অথবা আশানুরূপ নম্বর না পাওয়া। তো এ সম্পর্কে প্রথম কথা হলো- ফলাফল খারাপ হওয়ার দায়ভার নিজ কাঁধে উঠাও। ভুলগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে নাও। মেহনতের গতি বাড়িয়ে দাও।
দ্বিতীয় কথা হলো- কয়েকবার ব্যর্থ না হয়ে সফল হয়েছেন, অতীতে এমন সফল ব্যক্তি খুব কমই অতিবাহিত হয়েছেন। ব্যর্থতার সিঁড়ি বেয়ে বেয়েই কীর্তিমানরা সফলতার চূড়ায় পৌঁছেছেন। ভাগ্যবান তালিবে ইলিমরা কখনো হতাশ হয় না। ব্যর্থতার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়ও তারা আত্মবিশ্বাস হারায় না। তারা চেষ্টা অব্যাহত রাখে। অবিরাম সাধনায় লেগে থাকে। ফলে একসময় তারা সফলই হয়।

মোবাইল : জ্ঞানার্জনের হাইল
ইলমী নিমগ্নতায় বাধাদানকারী সকল বস্তু থেকে প্রত্যেক তালিবে ইলমকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপূরী দা. বা. বলেছিলেন, “কিয়ামত যতই নিকটবর্তী হচ্ছে, ইলিম অর্জনের প্রতিবন্ধক বস্তু তত বেড়েই চলেছে। বর্তমান যুগে ইলিম অর্জনের পথে সবচে বড় হাইল বা প্রতিবন্ধক হচ্ছে ‘মোবাইল’। এটা ছাত্রদের জন্য ‘যাহরে কাতিল’ বা নির্মম ঘাতক’র নামান্তর”।
মাওলানা আবূ তাহের মিসবাহ বলেন, “তালিবে ইলমের কাছে মোবাইল থাকার সর্বনিম্ন ক্ষতি হলো, এটা ছাত্রদের থেকে তলবের মাদ্দা খতম করে দেয়”।
আজকাল মোবাইল ও ইন্টারনেট মহামারির আকার ধারণ করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়াই কেবল বিলাসিতার জন্যে এগুলো ব্যবহার করে ‘সময়’র মত অতি মূল্যবান সম্পদ অপচয়ে আজ লিপ্ত। সবচে’ আক্ষেপের বিষয় যে, আমাদের তালিবে ইলিমরাও এই মহামারি থেকে নিরাপদ নয়। আজকাল তাদের বেশিরভাগেরই হাতে মুবাইল দেখা যায়। কেউ গোপনে রাখে। কেউ প্রকাশ্যে ব্যবহার করে। অবশ্য এতে অনেক উপকার আছে, তবে এই উপকারিতা সবার জন্য নয়। বিশষকরে যারা শিক্ষানবিশ তাদের অপকারই বয়ে আনে এগুলো। আমার ভাবতে অবাক লাগে যে, ইলম চর্চার অভিনিবেশের সাথে মোবাইল বা ইন্টারনেট চর্চা একত্র হয় কীভাবে! একথা নিশ্চিত যে, তালিবে ইলমের জন্যে এগুলো প্রয়োজনের আওতায় পড়ে না। এগুলো তাদের জন্য অতিরিক্ত জিনিস। এর পেছনে পড়ার মানে হলো-একথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আমি তালিবে ইলম নই।

বিশাল কুতুবখানা কায়েমের ফর্মূলা
একজন ইঞ্জিনিয়ার বা মিস্ত্রির কাছে যেভাবে রকমারি সরঞ্জামাদি থাকে, তদ্রƒপ একজন আলেমে দ্বীনের কাছেও রকমারি কিতাবের আম্বার থাকতে হবে। নিজের চোখের সামনে কিতাবের ভা-ার না থাকলে অধ্যয়নের আবেগ তৈরী হবে না। ধীরে ধীরে ইলমের মুহাব্বাত হৃাস পেতে থাকবে। জ্ঞানের পরিধি যা আাছে তাও থাকবে না। ঝং পড়ে যাবে। বিস্তৃত হওয়াতো দূর কী বাত!
নিজস্ব কুতুবখানা থাকলে নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা কখনো অনুভূত হয় না। অযথা সময় নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না। কিন্তু দেখা যায়, শতকরা ৯৯% আলেমের ব্যক্তিগত কুতুবখানা নেই। দাওরায়ে হাদীস সমাপন করে খালি হাতে বাড়ী ফেরেন। উনি যে একজন আলেম, টুপি পাঞ্জাবী ছাড়া আর কোনো আলামত তার মাঝে মানুষ দেখতে পায় না। ফলে মানুষের কাছে তার আযমত সৃষ্টি হয় না। এরজন্য তিনি নিজেই দায়ী। চেষ্টা করলে একটা লাইব্রেরি কায়েম করতে পারতেন। এটা কোনো কঠিন ব্যাপার ছিলো না। সহনীয় ত্যাগের বিনিময়েই নিজস্ব পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আমরা অযথা অনেক টাকা পয়সা খরচ করে থাকি। আমাদের খরচের খাত থাকে অনেক ও ভিন্ন ভিন্ন। খরচের তালিকা থেকে একটি খাত কমিয়ে নিলে অথবা বাড়িয়ে দিলে একটি নিজস্ব মাকতাবা ধীরে ধীরে গড়ে তোলা সম্ভব। আাকাবির ও আসলাফ এভাবেই ব্যক্তিগত কুতুবখানা কায়েম করেছেন।

লেখক : তরুণ মুহাদ্দিস, গবেষক

আরও পড়ুন

শিক্ষার্থীর পাথেয় – ০১

শিক্ষার্থীর পাথেয় – ০২

শিক্ষার্থীর পাথেয়- ০৩

About Abul Kalam Azad

এটাও পড়তে পারেন

কওমীর নিউ ভার্সন এবং রাষ্ট্র থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন!

সৈয়দ শামছুল হুদা: বাংলাদেশের একটি আলোচিত অন্যতম রাজনৈতিক দলের নাম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সরকারে থাকা ...