তারেকুল ইসলাম ::
মুসলমানরা ভাষা, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অনুসরণ করবে না; কেননা, তা খোদ মুসলমানদের মধ্যেই পার্থক্য ও বিভেদ তৈরি করবে। তবে ঐতিহাসিকভাবে মুসলমানদের রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে খেলাফত। পাশ্চাত্য মডেলের আধুনিক রাষ্ট্র গঠন বা নির্মাণ মুসলমানদের রাজনৈতিক কর্তব্য নয়। পাশ্চাত্য মডেলের রাষ্ট্রদর্শন দিয়ে মুসলমানরা কখনোই রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না। ইতোমধ্যেই তা প্রমাণিত। মুসলমানদের রাজনৈতিক ঐক্যবদ্ধতার ক্ষেত্রে খেলাফতের বিকল্প নেই।
পশ্চিমা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তা অনুসারে—বর্তমান দুনিয়ায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে যে-রাষ্ট্রব্যবস্থা বিদ্যমান, এই ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি রাষ্ট্র একে অপরের বাই ডিফল্ট শত্রু। প্রত্যেকটি রাষ্ট্র সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ইত্যাদি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা করে রেখেছে, যাতে করে অন্য কোনো পাশাপাশি প্রতিবেশী বা দূরতম রাষ্ট্র তাকে আক্রমণ করে না বসে। মুসলমানরাও যদি এটা অনুসরণ করে, তাহলে মুসলিম দেশগুলোও একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করতে ব্যর্থ হবে, হচ্ছেও।
কিন্তু খেয়াল করেন, আধুনিক রাষ্ট্র করে পাশ্চাত্যের দেশগুলো কিন্তু নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২৮-টা রাষ্ট্র নিয়ে ইউনিয়ন করেছে, অনেকটা মুসলমানদের খেলাফতি ব্যবস্থার মতোই। তারা মুসলমানদেরকেই অনুসরণ করে এটা করেছে বলে মনে করি। কারণ ক্রুসেড যুদ্ধে মুসলমানদের কাছে একের পর এক হারের পর তাদের নিশ্চয়ই অভিজ্ঞতা হয়েছিল– মুসলমানরা কীভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিল। ফলে দীর্ঘ খেলাফতকালে মুসলমানদের পরাজিত করা তাদের জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। যখন খেলাফতব্যবস্থা ভেঙে গেছে, তখন মুসলিম জাতির ঐক্যও টুটে গেছে।
ফলত খেলাফত-পরবর্তী যখন থেকে বিস্তৃত মুসলিম ভূখণ্ডগুলোকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তখন থেকেই মুসলমানরা মার খাওয়া শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত মুসলমানরা মডারেট ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেও মার খাচ্ছে কাফেরদের হাতে। মুসলমানরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার দৌড়ে থাকায় বরং তা ইহুদি ও পাশ্চাত্য শক্তির সুবিধা হয়েছে। যতক্ষণ তথাকথিত আধুনিক মডারেট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রদর্শন থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম জাতি নিজেদের একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্রীয় খেলাফতের অধীনে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ না হবে, ততদিন মুসলমানরা মার খেয়েই যাবে—হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ও ইহুদি জায়নিস্ট সভ্যতার হাতে।
আল্লাহর দ্বীনব্যবস্থা বাদ দিয়ে আমরা মুসলমানরা এখন পশ্চিমা গণতন্ত্রের দাস হয়ে মডারেট মুসলিম হয়ে জাতে ওঠার চেষ্টা করছি। সুতরাং, মাইর তো আমাদের প্রাপ্যই। অথচ আল্লাহ তায়ালা কোরআনে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আল্লাহ কখনোই মুসলমানদের ওপর কাফেরদের বিজয় বা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেবেন না।’ (সূরা নিসা: ১৪১ নং আয়াত)। আল্লাহ কিন্তু এখানে দুনিয়ার কথাই বলছেন, পরকালের কথা না। সুতরাং ইহজাগতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানদেরকে সেকুলার হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। আর আমরা কিনা পাশ্চাত্যের গোলামি করে সেকুলার মুসলিম হতে চাই!!
ক্ষমতা, নেতৃত্ব ও আধিপত্য নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা থেকে আমরা ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। শুধুই গৃহপালিত ধর্ম বানিয়ে রেখেছি। কিন্তু ইসলাম মাত্রই রাজনৈতিক ধর্ম। প্রতিটি মুসলিম মাত্রই রাজনৈতিক কর্মী, সৈনিক। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব উচ্চারিত করে ইসলাম মুসলমানদের বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেয়; কিন্তু আমরা তো বেকুব উদাসীন হয়ে ব্যাপক অনৈক্য ও ফ্যাসাদে ডুবে আছি। যতক্ষণ মুসলিম জাতির শিক্ষা হচ্ছে না, ততক্ষণ মাইর খাওন তাদের প্রাপ্যই।
তারেকুল ইসলাম, রাজনীতি বিশ্লেষক