শামসীর হারুনুর রশীদ::
‘ছাত্রের দূর্বলতা শিক্ষকের মাঝে খুঁজুন’
এই শ্লোগানকে সামনে নিয়েই যখন উন্নত ইলমি পরিবেশ স্থাপনে তাজদিদি ফিকির কিংবা সংস্কারের কথা বলা হয়, ব্যক্তি-গোষ্ঠী-প্রতিষ্ঠানের সমূহ দূর্বলতা-ব্যার্থতা নিজ নিজ আয়নায় মরিচিকা হয়ে ভেসে উঠে! প্রকাশিত হয়ে যায় অযোগ্যতার ভাঁজে ভাঁজে ছড়ানো ধামাচাপা! উন্মোচিত হয় নিজের স্বেচ্ছাচারি ও ভক্তছোট্টা জি হুজুরদের মুখোশ! প্রদর্শিত হয় জ্ঞানতাত্তিক ভূগোলে একাল-সেকালের দৃষ্টিভঙ্গির অসারতা! প্রমাণিত হয় উন্নত ইলমি পরিবেশ স্থাপনে বাঁধা কোথায় ও কারা! তাহলে সংস্কার এটা আর যুদ্ধ না হয়ে পারে?
হ্যাঁ, রীতিমতো জটিল এক যুদ্ধ, যুদ্ধ এবং যুদ্ধ!
সংস্কার কেন প্রয়োজন?
দিন দিন মানুষের আয়ু কমছে। জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে মানুষ!
অন্যদিকে বিশ্বায়নের চটকদার শ্লোগান আচ্ছন্ন করে রেখেছে মন ও মস্তিষ্ক । আকাশ সংস্কৃতির প্রবল এই দাপটের মুখে মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং উন্নয়নশীল জাতিরও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব যখন হুমকির সম্মুখীন । ঠিক তখন কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি নামক নিয়ামতের পেছনে আছে হাজারো চ্যলেঞ্জে। নিজেদের মুরব্বিয়ানা নিজেরা করতে না পারলে কওমির স্বকীয় অস্তিত্বও হুমকির সম্মুখীন হওয়া খুব স্বাভাবিক!
তাই সরকার কর্তৃক চাকরি কিংবা সুযোগ-সুবিধার লোভ এবং কওমি আঙ্গিনা আধুনিকায়নের বাউরি বাতাসে গা ভাসিয়ে বিলিন হওয়ার আগে ফিরে থাকানো দরকার নিজের দিকে। নিজেদের কিছু কাজ নিজেরা করে নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। সময়ের কাজ সময়মত না করতে পারাই আমাদের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ!
স্কুল-ভার্সিটি ও সরকারি মাদরাসাগুলো আদর্শিক যুদ্ধে বিজয় তো দূর কি বাত; কেউ লড়তেই চায়নি? ফলে ইলমি পরিবেশ দুঃখজনক হলেও পশ্চিমাদের মনস্তাত্ত্বিক গোলামি চর্চায় মেতে উঠেছে অনেক আগ থেকেই। একই বাতরুমে ছাত্র-শিক্ষক ধুমপানের অতুলনীয় স্বাদ গ্রহণ করার দৃষ্টান্তত কম নয়। তাদের সোনালি ক্যাম্পাসে সেক্যুলারদের আড্ডা জমে উঠায় এখানে পড়ে শিক্ষিত হচ্ছে ঠিক, কিন্তু মৌলভি-মাওলানা হতে পারছনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া! ঐপাড়ার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে অন্যদিন।
আসি কওমী মাদরাসা প্রসঙ্গে :
মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে খুব সহজে বুঝে নেয়া দরকার যে, মানুষ এখন খুব সচেতন। কিছু দিন আগে যারা নানান রোগের চিকিৎষায়- এক ডাক্তারের হাওয়ালা হতো, তারা এখন বিভাগীয় বিশেষজ্ঞ ছাড়া পা বাড়ায় না! এককালে যারা পুকুর-নালা থেকে পানি পান করতো, তারা এখন ঘরের ভেতর ফিল্টার করা পানি খোঁজে! মানুষের সময়ের মূল্য খুব করে বাড়ছে, বাড়বে এবং বাড়াও উচিত। সময় চলে যায় অবিরাম। দিনের পর মাস। মাসের পর বছর। সময়ের যাতাকলে আপন আঙ্গিনায় উন্নয়নের বদলে কেন অনাগ্রসরতার হাতছানি! সুখপাঠ-পাঠদান প্রক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কিছুতেই নতুনত্ব আনতে কেন আমরা নারাজ?
তারপরও এতদিন জুড়াতালি দিয়ে চলা সহজ হলেও আগামী দিনের পথচলা আগের মতো সহজ হবেনা! দাওরায়ে হাদীসের সনদকে মাস্টার্সের মান ঘোষণায় এখনই লেগে আছে নানা মহলের শ্যেনদৃষ্টি! সময় সময় গিরগিটের মতো তাঁরা রং-রূপ পালঠিয়ে ছদ্মবেশে হামলা করবে, তা মোকাবিলা করার শক্তি কতটুকু আছে এই আমাদের? এসব বুদ্ধিভিত্তিক আগ্রাসন নিয়ে আমরা ক’জনে ভাবছি? পুরনো সনাতনি কায়দায় শিক্ষা ব্যবস্থার অচলতা দিন দিন বাড়ছে! বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের বদলে প্রত্যেক শিক্ষককেই বানিয়ে ফেলছি উস্তাদে কুল অর্থাৎ ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর!
কিন্তু এখানের ছাত্ররা মুখে যদিও বলছে না; খুঁজ নিয়ে দেখুন- তারা এখন এক শিক্ষকের কাছে- কোরআন, তাফসির, হাদীস, ফেকাহ, সারফ, নাহু, আদব, ইনশা, উসুল, বালাগাত, বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গনিত পড়তে ইচ্ছুক নয়? যার ধরুন ছাত্ররা হয় ক্লাস ফাঁকি দেয় না হয় ক্লাসে ঘুমিয়ে দেখে হুজুরের পাঠদান পদ্ধতি কতটুকু কেমন?
গরিবের সন্তান বলে মুখ দিয়ে কিছু না বললেও অন্তর দি ঠিকই অভিশাপ দিচ্ছে! কিছুটা সচ্ছল যাঁরা, তাদের অধিকাংশই এখন ছুম্মাখারার মতো একবছর এক মাদরাসায় ভর্তি হয়, আরেক বছর অন্য্ মাদরাসায়! কখনও সরকারি মাদরাসায়! কখনও এদ্বারা, কখনও বেফাক বা অন্য বোর্ডে চ্যানেল পরিবর্তন করছে!ক্রমান্বয়ে অন্যান্য পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে! কিন্তু ভিন্ন নৌকায় চড়ার কারণে কোন ক্ষেত্রেই সফলতা আসছে না! ফলে মাদরাসা থেকে ফারিগ হচ্ছে অন্ত:সার শুন্য খালি আব্দুল্লাহ হয়ে! এই খালি আব্দুল্লাদের নিয়েই পথচলা অনেকেই এখন নিরাপধ মনে করছেন! ‘অনুর্বর জমিতে উর্বর জমির ফসল ফলাতে’ বড়সড় সাইনবোর্ড, পোস্টার-লিফলেট সাটিয়ে দেন নির্লজ্জের মতো!
প্রমাণ চান দেখুন- অধিকাংশ মাদরাসায় দৈনিকি শায়খুল হাদীস নাই! আছেন সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক! অন্যদিকে হাতেগোনা ক’টি মাদরাসা ছাড়া বাকি মাদরাসাগুলো বছর জুড়েই ভুক্তভোগী ছাত্র খরা, যোগ্য উস্তাদ খরা, নানা সুযোগ সুবিধার খরায়! আর্থিক টানাপোড়েন তো আছেই?
সেকারণে পাঁচ-সাতটি বিষয়ে খুব দ্রুত উন্নত চিন্তা-ভাবনা দরকার 1. বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ 2. শিক্ষক প্রশিক্ষণ 3. শিক্ষকের মান ও জীবন জীবীকার মান 4. আবাসিক মনোরম ব্যবস্থা 5. ছাত্রছাত্রীদের প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত একই ইউনিফর্ম (নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত) 6. শরির চর্চা ও শিশু মনের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ও প্রকাশে নিটোল জায়গা আবিষ্কার 7. দাওরায়ে হাদীস ছাড়া অবশিষ্ট মাদরাসা থেকে ‘জামেয়া শব্দ’ পরিহার করা।
21/ 05/ 2017