আবুল হুসাইন আলেগাজী
অনলাইন ও অফলাইনে আমার সাথে দেশ-বিদেশের মুসলিম-অমুসলিম, সুন্নী-শিয়া ও পুরুষ-নারী অনেক মানুষের কথা হয়। সময়-সুযোগের অভাবে আপনাদের সাথে সবকিছু শেয়ার করতে পারি না। জীবনটা আল্লাহর দেওয়া আমানত। এটিকে যশখ্যাতি, ভোগবিলাস ও গৌরব-অহঙ্কারের সন্ধানে নষ্ট করতে মনে চাই না। কি হবে পাবলিকের লাখো লাইক ও ভক্তি নিয়ে যদি আমি আমার রব/মালিকের সাথে সম্পর্কটা মজবুত করতে না পারি। প্রসঙ্গত, মুমিনদেরে কেউ অন্তরচক্ষু দ্বারা আল্লাহকে না দেখলে কমপক্ষে তাকে সবমসয় এমন ধ্যান-জ্ঞানে থাকতে হবে যে, আল্লাহ তাকে দেখছেন ও তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
ফেসবুকে আসার পর একজন আরব (মৌরিতানিয়ান) আমার কাছ থেকে অনেক জোরাজুরি করে ছাত্রত্ব আদায় করে নিয়েছেন। অনেকে উঞ্চ প্রশংসা করে কমেন্ট করেছেন। মাগুরার এক ভক্ত আলেম একবার বিকাশে ৫০০ টাকা হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। লাইক-কমেন্টের প্রতি উদাসীন অনেকে মেসেজ করে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। আগেই বলেছি, পাবলিকের লাখো লাইক ও ভক্তি আমার কোনই কাজে আসবে না, যদি আমি আমার রবের সাথে সম্পর্ক মজবুত করতে না পারি। কর্মের স্বীকৃতির সাথে মানুষের ভক্তি ও প্রশংসা আল্লাহর একটি পরীক্ষাও বটে। ধন-সম্পদের ন্যায় মানুষের ভক্তি ও প্রশংসাও অনেক সময় মানুষকে সীমালঙ্গনে উদ্বুদ্ধ করে (كَلاَّ إِنَّ الإِنسَانَ لَيَطْغَى * أَنْ رَآهُ اسْتَغْنَى)। ২০১৫ এর জুন মাসে ফেসবুকে আসার পর প্রথমে আরবীতেই পোস্ট দিতাম। বাংলায় লেখার সুযোগ ছিল না। পরে বাংলায়ও লিখতে শুরু করি। শুরুর দিকে لحن الحياة নামের এক আইডি থেকে আরবীতে আমার সাথে কথা বলা হয়। এক পর্যায়ে সে বলল, আপনি আমাকে যেরকম ভেবেছেন, আমি সেরকম নই। বললাম, তার মানে? বলল, আমি একজন নারী। এরপর জিজ্ঞেস করল, আপনি কি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারেন? বললাম, দিই না। তবে আপনার প্রয়োজন হলে চেষ্টা করে দেখতে পারি। সেই যে শুরু হলো, স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাওয়া আর থামলো না। আমার ব্যাখ্যায় সে সন্তুষ্ট হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতো। পরে উত্তর দেওয়া বন্ধ করে দিলাম। তার স্বপ্নের অধিকাংশই ছিল তাদের উপর বিপদ সংক্রান্ত। তার সাথে বিভিন্ন কথা হয়েছে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছাড়াও সে আরো অনেক দীনি বিষয় আমার কাছে জিজ্ঞেস করেছে। আলাপের এক পর্যায়ে সে জানাল, তার নাম আসমা। বাড়ি ফিলিস্তীনের গাজায়। জালিম জায়োনিস্টদের কারণে ঘরহারা হয়ে এখন তারা শেখ জাইতুন পল্লীর উদ্বাস্তু শিবিরে থাকে। জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে তার পরিবার মাসিক রেশন পায়। তার কাছে আমি তার পরিবার ও দেশসহ অনেক বিষয় জানতে চাই। সে অকপটে সব বলে। সে জানায় তার পিতা মসজিদের মুআযযিন ছিল। এখন চাকরী নেই। তার পাঁচবোন দুই ভাই। ভাই-বোনদের মাঝে সেই দীনদার। তার বড় দুই বোন ও ইমেডিয়েট বড় ভাইটা তার মত দীনদার নয়। সে (আসমা) এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ইয়ারে পড়লেও তার বড় দুই বোনের পড়াশোনা বন্ধ। তাদের বিয়েও হচ্ছে না। তার মায়ের আশঙ্কা, সেহের বা ব্লাক ম্যাজিকের কারণে তাদের বিয়ে হচ্ছে না। সে জানালো, সে এখনো গাজার বাইরে কোথাও যায়নি। শহীদ শেখ আহমদ ইয়াসীনকে চিনলেও হামাসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শহীদ আযযামের নাম শুনেনি সে। তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কেও তার কোনো ধারণা নেই। তারা কোন্ মাযহাবের কথা জিজ্ঞেস শাফেয়ী বলে জানাল। ইমাম শাফেয়ী যে গাজায় বড় হয়েছেন, তাও সে জানে। তবে ইরান ও সৌদি আরব সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে। হামাসের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইরানকে সে স্বার্থপর মনে করে। সে গাজার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার প্রতি ভালো ধারণা রাখে। তার জনসেবার কিছু ছবিও পাঠালো। তারা কয় বেলা খায় ও কি খায় জিজ্ঞেস করলাম। খাবারের ছবি দিল। যেই ঘরে থাকে তার ছবিও দিলো। তার পিতা ও ছোট শিশু ভাই ও শিশু বোনের ছবিও দিলো। সে ছাড়া বাকী বোনদের নাম হলো যথাক্রমেঃ ঈমান, ইসরা, শায়মা, ছাবিরীন। আর ভাইদ্বয়ের নাম হলো, বেলাল ও ছিদ্দীক। তাদের ঘরটি একতলা৷ রুম তিনটি৷ একটিতে তার দাদী, আরেকটিতে পিতা-মাতা ও আরেকটিতে তারা বোনেরা৷ ভাইদ্বয় থাকে বারান্দায়৷ সে আল-আকছা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এবং তার সাবজেক্ট হলো فقه العبادة ‘ইবাদত বিষয়ক ফিকাহ’। সে জানালো গাজার অধিবাসীরা বিদ্যুৎ নিয়ে চরম ভোগান্তিতে রয়েছে। ইসরাঈলী অবরোধের কারণে তাদের আরো অনেক সমস্যা হচ্ছে। তার বড় ভাইটা লেখাপড়া করে না। আগে মামার সাথে কাঠমিস্ত্রির কাজ করতো। এখন চাচার ফাস্টফুডের দোকানে অস্থায়ী ভাবে রয়েছে। তার সবচেয়ে বড় বোনটি গান শুনে। নানা কারণে সে তার সাথে কথা বলে না। জানালো ইসরাইলী মুদ্রাই তাদের মুদ্রা। তাদের পাসপোর্ট ইসরাইল না ফিলিস্তীনের নামে জিজ্ঞেস করলে জানালো, ফিলিস্তীনের নামে। খাবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে জানালো, তারা মাছ-গোশত ও শাক-সবজীসহ বিভিন্ন তরকারী দিয়ে তিন বেলা রুটি খায়। ভাত খায় শুধু শুক্রবার দুপুরে।
অন্যদিকে শিয়াবাদ সম্পর্কে জানার জন্য আমি নিজ থেকে মুহাম্মদ হামীদ আবদুল্লাহ নামের এক ইরাকী শিয়ার সাথে ফেসবুকে কথা বলেছি। সে যিকার জেলার একজ অবিবাহিত স্কুল শিক্ষক। সে জানিয়েছে, শিয়ারা নিকাহে মুতআকে হালাল মনে করলেও ইরাকে সেটির প্রচলন নেই। তার কথা, কার মেয়েকে কে এভাবে নিকাহে মুতআ করতে দিবে? উল্লেখ্য, শিয়াদের মতে দুইজন নারী পুরুষ মিলে কোনো রকম সাক্ষী ছাড়াই বিয়ে করতে পারে। সাক্ষী থাকা তাদের মতে মুস্তাহাব/উত্তম; অপরিহার্য শর্ত নয়। হোক সেটি মুতআ বা স্থায়ী বিয়ে। তার এক খালাতো ভাই নাকি দায়েশের হাতে ফালুজায় নিহত হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম আবদুল কাদির জিলানীর প্রতি শিয়াদের সম্মানবোধ আছে কি না জানতে চাইলে হ্যা সূচক জবাব দিল এবং বললো, শিয়ারাই ইমাম জিলানীর মাজারকে দায়েশ থেকে সুরক্ষা দিচ্ছে। তার মতে সালাফী/ওয়াহাবীরা আহলে বাইত বিদ্বেষী হলেও সুন্নীরা আহলে বাইতের প্রতি সম্মান দেখায়। শিয়াদের আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে চাইলে সে আমাকে একটি লেখা পাঠায় যেখানে হযরত আলীকে প্রথম খলীফা মানাসহ ২৭টি ধারা রয়েছে। তার মতে আহলে বাইতের প্রতি ইসলামের শুরু থেকে মুসলমানরা অবিচার করে এসেছে। খাঁটি ভাবে ইসলামকে আকড়ে ধরতে হলে তার মতে শিয়া মতবাদ গ্রহণ করাই বাঞ্জণীয়। সে মালেকী (ইরাকের সাবেক প্রধানমন্ত্রী) না এবাদীর সমর্থক তা জানতে চাইলে এবাদীকেই (ইরাকের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) সমর্থন করে বলে জানায়।
আমি বর্তমান চট্রগ্রাম শহরের যে এলাকায় (আন্দরকিল্লা) রয়েছি, সেখানেই সবচেয়ে বেশি হিন্দু বাস করে। আমার এক যুবক হিন্দু প্রতিবেশী রয়েছে। বাড়ি আমাদের লোহাগাড়ার বড়হাতিয়ায়। সে ডেলটা ফার্মাসিউটিক্যালের একজন এমআর (ওষুধের প্রচার প্রতিনিধি)। তার সাথে আমার মাঝে-মধ্যে কথা হয়। এতে আমার যা মনে হয়েছে, তাহলো সে একজন ধার্মিক হিন্দু। সে জাতে নাথ (হিন্দুদের সর্বোচ শ্রেণী)। ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। সৎ ও দানশীল মুসলমানদের সে প্রশংসা করে। আবার জেনা ও মদখোর হিন্দুদের বদনাম করে। সে জানালো, হিন্দু ধর্মের অফিসিয়াল নাম হলো সনাতন ধর্ম। তার মতে সকল ধর্মই ভালো এবং যে যে ধর্মে জন্মেছে সেটিই তার পালন করা উচিত। সে নাকি গরু ও শূকর বা অন্য কোনো প্রাণীর গোশ্ত খায় না। এটি নাকি তাদের ধর্মে হারাম। সে জানাল, হিন্দুরা ৩৩ কোটি সৃষ্টির সবার পূজা করে৷ সূর্যও নাকি তাদের একটি দেবতা৷ হিন্দুদের আনুষ্ঠানিক পূজা নাকি ১২ মাসে ১৩টি৷ তন্মধ্যে আশ্বীন মাসে ২টি৷ হিন্দুদের মাঝে নাকি ৩৬টি জাত রয়েছে৷ নাথ, সেন, পাল, মল্লিক, মজুমদার ও আরো কত কিছু ৷ যেসব হিন্দু সাদা কাপড় পরে, তারা নাকি ব্রাহ্মণ৷ ব্রাহ্মণরা নামের শেষে আচার্য ও চক্রবর্তী প্রভৃতি লেখে৷ যারা লাল কাপড় পরে, তারা সাধু৷ সাধুরা বিয়ে, উপার্জন ও ঘরে থাকাসহ পার্থিব কোনো কাজকর্ম করতে পারে না৷ তারা আশ্রমে বা পথেঘাটে দিন কাটিয়ে দেয়৷ হিন্দুরা দাদী-নানীকে ঠাকুরমা ও দাদা-নানাকে ঠাকুরদা বলে৷ খালাকে বলে মাসী ও ফুফুকে বলে পিসি ৷ প্রতিবেশী হিন্দুটির মতে স্রষ্টা মানুষকে বানিয়েছে তাঁর আরাধনা করার জন্য। লোভ ও অহঙ্কারসহ বিভিন্ন নেতিবাচক দিক থেকে শুদ্ধ হয়ে পরমাত্মার সাথে মিশে যাবার জন্য। সে জানালো, যারা মন্দ কাজ করবে, তারা দুনিয়াতে বিকলাঙ্গ কিংবা মানুষ ছাড়া অন্যকেনো প্রাণীর আকৃতিতে আসবে। আর যারা সৎ হয়ে চলবে, তারা আরো উন্নত মানুষ হয়ে দুনিয়াতে পুনর্জন্ম নিবে। এটাই নাকি তাদের ধর্মমতে স্বর্গ ও নরক। তবে সে জানাল, সে তাদের ধর্ম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে না। তাদের ধর্মমতে জেনা নিষেধ। সামর্থ থাকলে একজন পুরুষ যতটা ইচ্ছা বিয়ে করতে পারে। বিয়েতে নারীকে যেমন কোনো মোহর দিতে হয় না, তেমনি নারীরা পিতা-স্বামী থেকেও কোনো উত্তরাধিকার পায় না। মেয়েদের বিয়ের সময় তাদের ব্যবহারের সব কিছুই কনের পরিবারের পক্ষ থেকে স্বামীকে দিতে হয়। মরার পর হিন্দুদের দেহ কেন পুড়ে ফেলা হয় জিজ্ঞেস করলে সে একটি মনগড়া উত্তর দিল, যার সাথে সম্ভবত তাদের ধর্র্মগুরুরাও একমত হবেন না। সে জানাল, হিন্দুদের মধ্যে অনেক শ্রেণীর রয়েছে। তন্মধ্যে নাথই হলো সবার সেরা এবং সেও নাকি নাথ। নাথদেরকে পোড়ানো হয় না, মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। তার মতে বৌদ্ধ ধর্ম এসেছে সনাতন ধর্ম থেকে। ৯০% ক্ষেত্রে হিন্দুদের সাথে বৌদ্ধদের মিল রয়েছে। বৌদ্ধরা নাকি একটু সুবিধাবাদী। যাই হোক, সে ভারতের ভক্ত না হলেও ভারতের প্রতি তার বিদ্বেষও নেই। তার এক আত্মীয় নাকি ভারত চলে গেছে। আওয়ামীলীগ-বিএনপির নেতাদের সে পছন্দ না করলেও শেখ হাসিনাকে ভালো পায়। জামায়াতে ইসলামীকে উগ্র মনে করলেও তার মতে জামায়াত-শিবিরেও অনেক ভালো মানুষ আছে। আমেরিকা কেন্দ্রিক হিন্দু সংগঠন ইসকন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, ইসকন হলো একটি উগ্র সংগঠন। এরা হিন্দুদের উগ্র ধার্মিকতায় দীক্ষিত করে। সে জানালো, ইসকনের শিক্ষা মতে না চললে নিজের মায়ের রান্না খেতেও অনুসারীদের নিষেধ করা হয়। মোট কথা, সে অনেক সত্য স্বীকার করার চেষ্টার করে এবং সে নিজেকে ন্যায়পন্থী দাবি করে। সে বার্মায় মুসলিম নির্যাতনেরও বিরোধী। সে জানাল, তারা স্রষ্টাকে ভগবান নামে অভিহিত করে। হিন্দুদের কিছু আঞ্চলিক রীতি-নীতিও রয়েছে৷ যেমন দুর্গাপূজা, হোলিখেলা ও পাঠা কাটা৷ এগুলো হিন্দুদের সবাই করে না৷ সে যাই হোক, তবে সে নিজেকে যতটা সৎ ও সাহসী দাবি করে, বাস্তবে ততটা নয়। সে পরিপূর্ণ সৎ ও সাহসী হলে ইসলাম গ্রহণ করার দুঃসাহস দেখাতো।
আল্লাহ এ লোকটিকে ইসলামের সত্যতা বুঝে মুসলিম হবার তৌফীক দান করুন।
আবুল হুসাইন আলেগাজী
২৪.০৩.২০১৭, চট্রগ্রাম