মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
শিক্ষার্থী, দারুল উলূম দেওবন্দ, ভারত
গল্পটি ইসলামের শুরু যুগের৷ প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে একবার ডাকলেন৷ বললেন, ‘কোনো কারণে আজ আমি বড্ডোরকম আনন্দিত৷ এ উপলক্ষ্যে তুমি আমার কাছে যা চাইবে, তা-ই দেবো৷ বলো কী চাও গো তুমি?’
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ভাবনায় পড়ে গেলেন৷ হঠাৎ করে এমন কী চাইবেন! তাছাড়া মনে যা-ই আসে, তা তো আর চাইতে পারেন না তিনি! যদি ভুল কোনো কিছু আবদার করে বসেন! ভয় হয় তার৷ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি কষ্ট পেয়ে যান তাতে? এমন অনেক প্রশ্নই মনে জাগতে লাগলো তার৷
বহু সময় পর মুখ খুললেন হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা—‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি কী আব্বুর কাছ থেকে একটা পরামর্শ নিতে পারি?’ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিলেন৷ বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি তোমার আব্বুর পরামর্শ নিয়েই আমার কাছে চাও।’
হজরত আয়েশা রাদিল্লাহু আনহা তার পিতা ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে তাশরিফ নিলেন৷ কুশলাদি বাদে বললেন পুরো ঘটনাটি৷ ফের চাইলেন কোনো পরামর্শ৷
হজরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘নবীজির কাছে যখন কিছু চাইবেই, তখন মিরাজের রাতে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে তাঁর যেসব গোপন কথা হয়েছিলো, সেসব জানতে চাইতে পারো। তবে আমায় কথা দাও, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলবেন, তা
সর্বপ্রথম আমাকেই জানাবে৷’
পরামর্শ পেয়ে উৎফুল্ল হলেন হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা৷ বাবাকে কথা দিলেন সবার আগে বিষয়টি জানাবার বিষয়ে৷ এলেন হজরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে৷ ফের মিরাজের রাতের এমন কোনো একটি গোপন কথা জানতে চাইলেন, যা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখনও কাউকে বলেননি।
প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন৷ সহধর্মিনীর এমন আবদারে অবাক হলেন৷ বললেন, ‘সেইসব কথা বলে দিলে আর গোপন থাকে কী করে! একমাত্র আবুবকরই পারেন এমন বিচক্ষণ প্রশ্ন করতে।’
এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আয়েশা! আল্লাহ আমাকে মিরাজের
রাতে বলেছেন, হে মুহাম্মদ! তোমার উম্মতের মাঝে যদি কেউ কারো ভেঙে যাওয়া মন জোড়া লাগিয়ে দেয়, তাহলে আমি তাকে বিনে হিসেবেই জান্নাত দান করবো।’
প্রতিশ্রুতি মোতাবিক হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার পিতা হজরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এলেন৷ সালাম দিয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে শোনা কথাগুলি শোনালেন।
হজরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তো কথাগুলি শুনতেই কাঁদতে আরম্ভ করলেন৷ হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বাবার এমন আচরণে অবাক হলেন বেশ৷ বললেন, ‘আব্বু! আপনি তো শতো শতো ভাঙা মন জোড়া লাগিয়েছেন৷ আপনার তো সোজা জান্নাতে যাওয়ার সুসংবাদ এতে, তো কাঁদছেন কেনো?’
হজরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আয়েশা! কথাটির উল্টো দিক নিয়ে খানিকটা চিন্তা করো৷ কারো ভাঙা মন জোড়া লাগালে যেমন আল্লাহ তায়ালা জান্নাত দান করবেন, তেমনি কারো মন ভাঙলেও আল্লাহ যদি সোজা
জাহান্নামে দিয়ে দেন? নিজের অজান্তেই না জানি কতোজনের মন ভেঙেছি আমি। আল্লাহ যদি আমাকে জাহান্নামে দিয়ে দেন, সেই চিন্তায় আমি কান্নায় ভেঙে পড়ছি।’
এই হলো আমাদের ইসলাম, দুনিয়ায় থেকে জান্নাতের সুসংবাদ লাভের পরও এভাবে চিন্তা করতেন সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম। এভাবেই ইসলাম আমাদেরকে শিক্ষা দেয় কাউকে কষ্ট না দিতে; মানুষকে মানুষের বিপদাপদে পাশে দাঁড়াতে৷
প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ‘তুমি গোস্ত রান্না করলে ঝোলের জন্য এক গ্লাস জল বেশি দাও, যেনো তোমার গরিব প্রতিবেশীকেও খানিকটা দিতে পারো। আর যদি না দিতে চাও, তাহলে এমন সময় রান্না করো, যখন প্রতিবেশীর বাচ্চা ঘুমিয়ে থাকে৷ গোস্তের সুগন্ধ পেয়ে বাবা-মাকে গোস্ত খাওয়ার কথা না বলতে পারে৷ না হয় গরিব বাবা-মা গোস্ত কিনে খাওয়াতে পারবে না, তখন মনে অনেক কষ্ট পাবে হয়তো।’
এভাবেই ইসলাম আমাদেরকে মানবতার শিক্ষা দিয়েছে৷ নিজেদের বাস্তব জীবনেও আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমও আমাদেরকে শিখিয়েছেন৷ তারাই আমাদেরকে বলেছেন মানুষের মন না ভাঙতে, মানুষকে কষ্ট না দিতে।
কিন্তু আজ খোদ আমরাই ইসলাম ও মুসলমানের সুরে সুর মেলাই৷ দাবি করি খাঁটি মুসলমান৷ ইসলামের নামে গাই কতো শতো স্লোগান৷ কিন্তু কাজটা করি কোন সে কীসের? হায়, কবে যে বোধোদয় হবে আমাদের!
ইসলামই একমাত্র মানব-মানবতার শ্রেষ্ঠ কথা বলে৷ ইসলামই একমাত্র সত্য ও সাম্যের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দেয়৷ কিন্তু আমরা মুসলমান হয়েও কী সেই শিক্ষা ধারণ করতে পেরেছি! হায়, কবে যে পূর্ণভাবে লালিত হবো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শে! কবে যে আমরা হবো সাহাবায়ে কেরামের মতো উত্তম ও শ্রেষ্ঠ চরিত্র-গুণাবলির অধিকারী! তৌফিক প্রার্থনা করছি ঐশীদরবারে৷
মহামহিম হে, শুদ্ধ ও স্বচ্ছ দর্শন আমাদেরকে দান করো৷ তোমার অনিঃশেষ করুণায় নসিব করো শ্রেষ্ঠ বেহেশ্ত ‘জান্নাতুল ফেরদাউস’৷ আমিন৷