মাওলানা আতীকুল্লাহ :
খুনরাঙা জনপদ!
(এক)
একজন মা। নিরন্ন। বিপন্ন। অন্নবস্ত্র-বাসস্থানহীন। কোলে একটা শিশুকে ডানহাতে আগলে রেখেছেন। আরেক হাতে চটের বস্তা। পেছনের শিশুটা অনবরত কাঁদছে। পেটের ক্ষুধায়। মায়ের শুকনো মুখ আর খাদে পড়া চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ছেলের মুখে কিছু দেয়ার মতো সঙ্গতি নেই।
কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অতি সরু গলি দিয়ে আমরা হাঁটছিলাম। দু’তিনবার মুখোমুখি হলাম সেই অসহায় মা ও শিশুদ্বয়ের। অন্যরা আমাদের পিছু নিয়ে সাহায্য চাইলেও, এই মহিলাকে দেখলাম দুর্লভ ব্যতিক্রম। তিনি একবারও আমাদেরকে দেখে থামেন নি। নিজের মতো করে কী যেন খুঁজছেন। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেলাম। মহিলা জানালেন:
-গতরাতে এসেছি। সকাল থেকেই হেঁটে যাচ্ছি। বাচ্চাগুলোর বাবার কোনও খোঁজ নেই। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। বর্মিজরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে। আর ফিরে আসেনি। খোঁজও পাইনি। কেইবা খোঁজ দেবে? সবার অবস্থাই আমার মতো। কারো বাবা নেই। কারো মা নেই। কারো বোন নেই। কারো ভাই নেই।
বাঙলাদেশে আমার পরিচিত কেউ নেই। অনেকের আত্মীয়-স্বজন আছে। তারা স্বজনদের কাছে এসে উঠেছে। আমি কোথাও যাওয়ার জায়গা পাচ্ছি না। বসার জায়গাও না। সবার ঘরেই কেউ না কেউ নতুন এসে উঠেছে। আমার কাছে টাকাও নেই। প্লাস্টিকও নেই, কোথায় ছাউনি গাড়বো। রাত থেকেই উপোস! আল্লাহ জানেন আমি কী করবো! দু’টো বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব! থাকা-খাওয়ার কী হবে?
(দুই)
আমাদের তিনদিকে ভারত। একদিকেই শুধু ভারতকে এড়ানোর রাস্তা আছে: মিয়ানমার। আমাদের একটা এস্কেপ রুট দরকার। সেটা মায়ানমার ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। ভারতের সেভেন সিস্টার্স কবে স্বাধীনতা অর্জন করবে, সেটা অনিশ্চিত। এভাবে বড় একটা রাষ্ট্রের হাতে সীমান্তবেষ্টিত হয়ে দমবন্ধ হয়ে মরার কোনও মানে হয় না। এছাড়াও চীনের সাথে একটা সরাসরি রুট দরকার। এজন্য সহজ উপায় হলো:
= রোহিঙ্গাদেরকে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে যোগ্য করে গড়ে তোলা। তাদেরকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা দেয়া। এতে করে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো ব্যাপার হবে। পাশাপাশি আগ্রহী ‘ব্যক্তিদের’ও বিশেষ মেহনতের একটা ক্ষেত্র তৈরী হবে।
(তিন)
একটানা দু’দিন-দু’রাত মাযলুম ভাইদের সাথে থেকে, কয়েকটা বিষয় মনে হয়েছে:
১: রোহিঙ্গারা জাতিগতভাবে ভীতু ও কাপুরুষ। প্রকৃত দ্বীনী শিক্ষা তাদের মধ্যে নেই। যদিও আরাকানে বিরাট বিরাট মাদরাসা আছে। তার মধ্যে অনেকগুলো দাওরা হাদীসঅলাও আছে।
২: আরাকানী মহিলাদের মধ্যে পর্দা-পুশিদা খুব বেশি নেই। অল্পকিছু পরিবারেই বোধহয় পর্দার দিকটাতে গুরুত্ব দেয়া হয়।
৩: সাধারন মানুষের মধ্যে বেদাতী কার্যকলাপ খুব একটা নেই। প্রায় সব রোহিঙ্গাই দেওবন্দী-তাবলীগি ঘরানার মানুষ। তৃণমূল পর্যায়ে তাবলীগি কাজই কিছুটা হয়ে থাকে। এজন্য তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রতিরোধের ইচ্ছাও অবশিষ্ট নেই। তাবলীগের মেহনতের কারনে একটা ভুল ধারনা অনেকের মধ্যেই চারিয়ে যায়: এ-কাজের মাধ্যমে দ্বীনের তাকাযা পুরো হয়ে যাচ্ছে। এই পথ ধরে থাকলেই আমাদের অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হবে। ব্যতিক্রমী চিন্তাও যে নেই তা বলা যাবে না। তবে মযলুম জনপদগুলিতে, গণতন্ত্র ও তাবলীগি বা শান্তি পদ্ধতির মেহনত একবার চালূ হয়ে গেলে, আর উপরে ওঠা যায় না। দিনদিন অবস্থা আরো নমনীয় হতে থাকে।
৪: তাদের অনেককেই দেখেছি: নিজের স্বার্থটা ভালো করে বুঝে নিতে। অন্যকে ডিঙিয়ে হলেও। কিছু ভাল মানুষেরও দেখা পেয়েছি। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম।
৫: সাধারনত দেখা যায়, একটা জাতি দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হলে, তাদের মধ্যে একসময় এক ধরনের ‘ইউনিটি’ বা ঐক্য তৈরী হয়। এক ধরনের প্রতিরোধমূলক চেতনা জেগে ওঠে! কিন্তু রোহিঙ্গা ভাইরা অদ্ভুত রকমের ব্যতিক্রম। তাদের মধ্যে কোনও পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। স্বপ্ন আছে বলেও মনে হয়নি। তারা বাঙলাদেশে একটু ঠাঁই পেলেই বর্তে যাবে, এমন মানসিকতা পোষণকারী। তাদের মধ্যে বেশির চেয়ে বেশি দুঃসাহস হলো: বাঙলাদেশী একটা জাতীয় পরিচয়পত্র হাসিল করে, মধ্যপ্রাচ্যের কোনও এক দেশে ‘সেটেল’ হওয়া।
৬: রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো বর্তমানে নানা এনজিওর আনাগোনার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। তবে আমার মনে হয়েছে, রোহিঙ্গারা আর যাই হোক, ইসলামত্যাগ করবে না। তাদেরকে টাকাপয়সা দিয়ে ধর্মত্যাগী বানানো কঠিন। বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে, সেটা ধর্তব্য নয়। এটা একটা বিরল গুণ। বাঙালীদের মধ্যে এই গুণ খুব একটা শক্তভাবে নেই। বাঙালীরা রোহিঙ্গাদের মতো বিপদে পড়লে, এতদিনে সবকিছু বিকিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করতো কি না, সন্দেহ আছে!
৭: কারো কারো মনে হতে পারে, রোহিঙ্গারা শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই নির্যাতিত হচ্ছে! এই চিন্তা বোধহয় শতভাগ সঠিক নয়। অর্ধেক সঠিক। বর্মিজরা অনেক আগে থেকেই বাঙালীদের পছন্দ করে না। দেখতে পারে না। রাখাইনরা জাতিগত কারনে মগদেরও পছন্দ করে না।
৮: রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষার প্রতিও খুব বেশি আগ্রহ নেই। তারা কোনও রকমে মাওলানা হতে পারলে, বা প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে কাজে নেমে পড়তে পারাকেই জীবনের পরম সার্থকতা বলে মনে করে। বিদেশ যেতে পারা হলো তাদের কাছে চরম মোক্ষ লাভ। অল্পসংখ্যক আলিম শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেন।
৯: আরাকান থেকে আসা মানুষগুলোর মধ্যে দু’ধরনের মানুষ আছে:
ক: তাদের চেহারাসূরত বাঙালীদের মতো। জাতিগতভাবেও তারা বাঙালী।
খ: তাদের চেহারাসুরত রাখাইন বা মগদের মতো। এরাই বোধ হয় সত্যিকার রোহিঙ্গা। বাকিরা এদিক থেকে যাওয়া চেহারা ও সুরতে ভিন্নতা থাকলেও, স্বভাব-চরিত্র এক।
১০: অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়ে যায়। নতুনদের ডিঙিয়ে অনেক পুরাতনও ত্রাণসামগ্রী হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ তাদের থাকা ও খাওয়ার মোটামুটি বন্দোবস্ত আছে।
(১১) রোহিঙ্গাদের মৌখিক ভাষা হলো চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষারই আরেকটু দুর্বোধ্য রূপ। কিন্তু তাদের লিখিত কোনও সুনির্দিষ্ট ভাষা নেই। শিক্ষিতরা উর্দুতে লিখতে পড়তে স্বচ্ছন্নবোধ করেন। আবার কেউ কেউ বর্মীজ ভাষাতেই। এটা একটা দৈন্য বলা যায়। তাদের বলা ও লেখার শক্ত একটা ভিত থাকা দরকার ছিল।
(চার)
আমরা ঢাকা থেকে সরাসরি টেকনাফ যাইনি। প্রথমে কক্সবাজারে থেমেছি। মাওলানা রজীবুল হক সাহেবের যুক্তি হলো:
-ওখানে হুট করে যাওয়া ঠিক হবে না। এখানে সাময়িক অবস্থান করে, অবস্থা ও পরিস্থিতি বুঝে সামনে এগুতে হবে।
(পাঁচ)
দু’দিনে সরেজমীনে ময়দানে থেকে ও আগে মেহনত করে যাওয়া ভাইদের সাথে কথা বরে যতটুকু বুঝতে পেরেছি:
১: শুধুই টাকা-পয়সা নিয়ে যাওয়া। অন্য কোনও খাদ্যদ্রব্য বা জিনিসপাতি না নিয়ে যাওয়া। মাযলুম ভাইদের এখন নগদ অর্থের প্রয়োজন। টাকা হাতে পেলে সে তার চাহিদামতো কিনে নিতে পারবে।
২: কক্সবাজারের পর বিডিআর চেকপয়েন্ট আছে। সেখানে গাড়ি থামিয়ে তারা চেক করেন। ত্রাণসামগ্রী নিতে দেখলে বাধা দেন। ফেরত পাঠান বা নামিয়ে রেখে দেন। মানুষ যেতে বাধা দেন না। তবে জিজ্ঞেস করলে বলা উচিত: ঘুরতে যাচ্ছি। মিথ্যে নয়, সত্যি কথাই বলা। ঘুরতেই তো যাওয়া হচ্ছে।
৩: দলবেঁধে না যাওয়া। সবার পক্ষ থেকে দুইজন বা তিনজন যাওয়া। তবে সরাসরি দেখতে পারলে, আবেগ ও ভালবাসার গভীরতাটা বৃদ্ধি পায়। এটা অস্বীকার করার জো নেই।
৪: ইয়ানত নিয়ে যাওয়ার আগে, স্থানীয় কারো সাথে যোগাযোগ করে যাওয়া। অথবা আগে গিয়েছেন, এমন কারো সাথে পরামর্শ করে যাওয়া।
৫: কোনও মাদরাসায় উঠলে, সেখানে থাকা-খাওয়া বাবদ খরচ দিয়ে দেয়া। তাছাড়া আমার থাকার কারণে তাদের উপর কোনও প্রাশাসনিক চাপ আসে কি না, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা।
(৬) যদি সম্ভব হয়, লম্বা সময় নিয়ে যাওয়া। মাযলুম ভাইদের সাথে থেকে, তাদের কষ্টটা বুঝে আসার চেষ্টা করা। হিম্মত করে গেলে, থাকার জায়গার অভাব হবে না।
(৭) আরাকান থেকে আসা ভাইদেরকে কোথায় পাওয়া যাবে? প্রধানত দুইটা আশ্রয় শিবিরে মূলত রোহিঙ্গা ভাইরা থাকেন।
ক: টেকনাফের আগে নীলার ‘লেদা ক্যাম্পে’। নতুন আসা ভাইয়েরা পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে এখানে এসে উঠেন।
খ: কুতুপালংয়ের ক্যাম্পে। এখানেও অনেক ভাই উঠেন। ল্যাদা ক্যাম্প থেকে কুতুপালং ক্যাম্পের অবস্থা বেশি শোচনীয় ও করুন। আয়তনেও বড়। আশ্রয়গ্রহণকারীর সংখ্যাও এখানে বেশি।
গ: টেকনাফে কিছু বিচ্ছিন্ন পরিবার থাকেন। ল্যাদা ও কুতুপালং ক্যাম্পের বাইরেও, আশেপাশে বিভিন্ন স্থানে ভাইয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। তাদের খোঁজ পেতে হলে, স্থানীয় মসজিদ ও মাদরাসায় যোগাযোগ করতে হবে।
(৮) টাকা-পয়সা দেয়ার ব্যাপারে, মাধ্যম ব্যবহার না করাই ভাল। মাধ্যম কোনও হুজুরের লেবাসধারী হলেও না। মানুষ চেনা বড়ই মুশকিল।
(৯) কোথাও গিয়েই টাকা বিলি করা শুরু না করা। টাকা দিতে গেছি, এটাই কাউকে বুঝতে না দেয়া। যতটো লুকোছাপা করা সম্ভব, কৌশল অবলম্বন করা।
(১০) সময় থাকলে, দুয়েকদিন থেকে, আশপাশটা ভালভাবে রেকি করা। মনে মনে তালিকা তৈরী করা। জিজ্ঞাসা করলেই বলে: আমি এবার এসেছি। এই তো তিনদিন আগে এসেছি। এই তো দশদিন আগে এসেছি। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যায়, উনি আজ দু’বছর বা আট বছর যাবত এখানে আছেন। এবং সরকারী রেশন ভোগ করছেন। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
(১১) যারা ইদানীং ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের প্রায় সকলেই ‘নতুন’ মানুষ খোঁজেন। মনে রাখতে হবে, পুরাতনদের মধ্যেও অনেক প্রকৃত মুহতাজ আছেন।
(১২) শুধু টেকনাফে নয়, আমাদের চেষ্টা করা উচিত, আরাকানের অভ্যন্তরে ত্রাণ পৌঁছানো যায় কি না, সেটা নিয়ে ভাবা। এটা সম্ভব। আলাপ করে জানা গেছে। সূত্র আছে। তবে সেটা বিশ্বস্ত কি না, আল্লাহ মালুম।
(ছয়)
এক বাসায় আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো। রাতের আঁধারে। নানা গলিপথ পার হয়ে। বেশ ভয় পাইয়ে দেয়া পথচলা। রাহবর আমাদের সাথে চলছিলেন না। তিনি বেশ দূরত্ব বজায় রেখে চলছিলেন। তার ভয় পাওয়া দেখে, দ্রুত কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, আপনি কাকে ভয় পাচ্ছেন?
-বলা যাবে না। এখানে অনেক মানুষ আছে। তারা জানতে পারলে, আমাদেরকে তাড়িয়ে দিবে। টাকারও ভাগ চাইবে।
-আচ্ছা।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর গন্তব্যে পৌঁছলাম। পনেরজনের মতো নানাবয়েসী মানুষ বসে আছেন। অপুষ্টি ও অনিশ্চয়তার ছায়া তাদের প্রত্যেকের চেহারায় পরিস্ফুট। একটু পর নিয়ে আসা হলো মেয়েদের একটা দলকে। প্রায় তের-চৌদ্দজন। মেয়েদের অবস্থা আরও শোচনীয়। শরীরে গোশত বলে কিছু নেই। চোখগুলো কোটরাগত। সবার গালভাঙা। তোবড়ানো। অথচ বয়েস তেমন বেশি নয়। পরিধেয় শতচ্ছিন্ন! কয়েকজন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। অভুক্ত আছে আজ সারাদিন। আশেপাশের মানুষ আর কতো সাহায্য করবে। এসব দৃশ্য সরাসরি দেখা যায় না। নিজেকে স্থির রাখা যায় না।
(সাত)
তারপর দ্বিতীয় দফায় আমরা গেলাম আরেক জায়গায়। একটা বাসায় গাদাগাদি করে আছেন মানুষ। পাঁচ পরিবারের মানুষ। বেশভূষা ও চেহারা দেখে মনে হলো ,তারা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ। একজন হুজুর আছেন তাদের মধ্যে: তিনি বাইশ বছর ধরে এক কওমী মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন। মাদরাসা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কোনও রকমে মেয়েকে নিয়ে এপারে আসতে পেরেছেন। কপর্দকশূন্য অবস্থায়।
এ-বাসায় দেখলাম চারজন বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে। মুখ ঢেকে কামরার এক কোনে জড়সড় হয়ে বসে আছেন। অপেক্ষা করছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের। এই বোনেরা ওপারে যেমন নিরাপত্তাহীন ছিল, এপারেও নিরাপদ নয়। বাঙালি ভাইয়ের সব জায়গায় ঠিক রক্ষকের ভূমিকা যথাযথ পালন করতে পারছেন না। কেউ কেউ ভক্ষকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হচ্ছেন। অত্যন্ত কষ্ট লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়।
(আট)
অতি ভোরে আমরা গেলাম লেদা ক্যাম্পে। আমাদের ঢাকা শহরের বস্তিগুলোও হার মানবে, এতটাই গিঞ্জি। মানবেতর জীবন যাপন করছে এখানকার মানুষগুলো। শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা অপ্রতুল। স্কুলগুলোতে যাওবা বিদেশী সাহায্যের কারণে, কিছুটা চলনসই। কিন্তু মাদরাসাগুলোর কথা না বলাই ভাল। নুরানী মাদরাসায় প্রায় দেড়শ শিশু পড়ে। ভাঙা বেড়া। উপরে শনের ছাউনি। নিচে বসার মাদুর নেই। ধুলিমলিন ছেঁড়া পাটির বিছিয়ে পড়াশোনা চলছে। প্রায় সবাই আদুল গা। গায়ে দেয়ার মতো জামা নেই। হুজুর যিনি পড়াচ্ছেন তিনিও ছেঁড়াতালিযুক্ত জামা গায়ে দিয়ে এসেছেন। পড়ার কুরআন শরীফ নেই। কায়দা-আমপারা নেই। কুরআন শরীফ রাখার রেহাল নেই।
(নয়)
আমরা ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি কয়েকটা বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছি:
ক: বাবা-মা নেই এমন শিশু কয়জন আছে। অথবা বাবা মা মা নেই এমন শিশু কয়জন আছে। কারো কাছে এই তালিকা নেই। দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ইনশাআল্লাহ তালিকা হয়ে যাবে।
খ: বিধবা হয়ে গেছেন। বিয়ের বয়েস আছে। এমন কয়জন নারী আছে। বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে কয়জন আছে। তার একটা তালিকা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
গ: বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। দেখাশোনার কেউ নেই। এমন মানুষগুলোর একটা তালিকা করা।
ঘ: আর্থিক সংকটের কারণে লেখাপড়া করতে পারছে না, এমন ছাত্রদের একটা তালিকা করা।
(দশ)
একটা বাসায় গেলাম। মক্তবের হুযুর সরাসরি অনেক ভেতরের এক ঝুপড়িতে নিয়ে গেলেন। খালাতো বোনের কাছে আশ্রয় নিয়েছে দুই শিশু ও এক কিশোরী। বাবা-মা দুইজনই নেই। বড় কোনও ভাইবোনও নেই। মেয়েটা অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। ভাই দুটো এখনো বিপদের ধরন বুঝে উঠতে পারে নি।
(এগার)
কুতুপালং ক্যাম্পের অবস্থা দেখলে, চোখের পানি ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। এভাবেও মানুষ থাকে? সামান্য একটা রেক্সিন লাঠির দিয়ে ছাউনি বানিয়ে শুয়ে আছে। স্বামী আর স্ত্রী। ইজ্জত-আব্রু রক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই।
(বারো)
রাতে গেলাম একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে। পথিমধ্যে দুই সাথীকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা পাকড়াও করলো। কঠিন জেরার মুখে রাহবর দৌড়ে পালিয়ে গেলো। তার পিছু পিছু নেতাও দৌড় দিল। প্রাণভয়ে ছোটা অসহায় রাহবর ভাইটা মারাত্মকভাবে আহত হলো। এতরাতে ডাক্তার পাওয়া মুশকিল। তবুও কোনওরকমে ব্যান্ডেজের ব্যবস্থা হলো। রাজনৈতিক নেতা থেকে বহুকষ্টে ছাড় পাওয়া গেলো।
(তেরো)
সাহায্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক স্থানে। পথেই গাড়ি অবরোধ করা হলো। সাহায্য করার আগে,তাদেরকেও কিছু দিয়ে যেতে হবে। নইলে পুলিশে খবর দিবে তারা। বখেরা খাওয়ার জন্যে প্রতি পদে পদে ওঁত পেতে থাকে কিছু স্বার্থান্বেষী। এদের ভূমিকা জালেমের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।
(চৌদ্দ)
এক অসহায় আলিমকে বললাম:
-আপনি নিজ দায়িত্বে, আমাদেরকে কিছু বিয়ের উপযুক্ত মেয়ের তালিকা দিন। যারা মোটামুটি লেখাপড়া জানে। দ্বীন জানে। কুরআন কারীম পড়তে পারে।
হুযুর কথাটা শোনা মাত্রই, ব্যাকুলভাবে হাত ধরে বললেন:
-হুযুর! আমার একটা মেয়ে আছে! বিয়ের উপযুক্ত!
চোখের পানি ধরে রাখা মুশকিল! একজন আলিম পিতা কতোটা অসহায় হলে, এভাবে নিজের মেয়ের কথা বলতে পারে!
(পনের)
সারাদেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা দেখে কিছু কথা মনে এলো:
ক: দেশের সাধারণ মুসলমানের মনে ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ এখনো বিদ্যমান। তারা মযলুম ভাইদের জন্যে কিছু করতে চান। সুযোগ দেয়া হলে, তারা আরও অনেক কিছু করতে আগ্রহী।
খ: কেউ কেউ অবশ্য, সামান্য আর্থিক সাহায্য করাকেই চূড়ান্ত দায়িত্ব পালন ভেবে নিজেকে তৃপ্ত ভাবছে! এটা চিন্তাগত ভ্রান্তি।
গ: কেউ কেউ আর্থিক সাহায্য ছাড়া আরও বেশি কিছু করতেও আগ্রহী। সুযোগের অপেক্ষায় আছে। ডাক পাওয়ার অপেক্ষায় আছে।
(ষোল)
কিছু ভিডিও দেখা যাচ্ছে, সেখানে বলা হচ্ছে, তারা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছে। ব্যাপারটা কতোটা সঠিক, সেটা তলিয়ে দেখা জরুরী। কারণ আরাকানীদের অতীতের ইতিহাস বড় একটা সুখকর নয়। তাদের গাদ্দারীর ইতিহাস আজো মুছে যায় নি।
(সতের)
যারা সাহায্য নিয়ে যেতে চান, তারা আরো কিছুদিন পরে গেলে ভাল হয়। কারন এখন সবাই যাচ্ছে। সব ক্ষেত্রে যা হয় আর কি, কিছুদিন পর আমাদের আবেগ থিতিয়ে আসবে। তখন যাওয়া হলেই ভাল।
(আঠার)
আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, যারা রোহিঙ্গা বোন বিয়ে করতে আগ্রহী, তাদের সাথে কিছু ভাবনা তুলে ধরা যেতে পারে:
১: বউ হিশেবে রোহিঙ্গা বোন কেমন?
= খুউব ভালো।
কারো যদি বেশি সন্তান লাভের ইচ্ছা থাকে, তাদের উচিত একজন রোহিঙ্গা বোনকে বিয়ে করা। এবার ওখানে গিয়ে দেখেছি, আগের অভিজ্ঞতাও ছিল, রোহিঙ্গা বোনেরা সন্তান জন্মদান ও লালনপালনে বেশ দক্ষ। গড়পড়তা বাঙালী মেয়েরা যেখানে একসন্তান বা দুই সন্তান হওয়ার পরই কঁকাতে শুরু করে, সেখানে একেকজন রোহিঙ্গা বোনের ছয়জরন আটজন সন্তান। দিব্যি তারা সুস্থ-সবল আছেন। শরীর ভেঙে পড়েনি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, অনেক হুযুর পরিবারের মেয়েও, দুই বা তিন সন্তানের বেশি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয়। তাদের কারো মনেও কুলোয় না। কারো শরীরে কুলোয় না। এদিক দিয়ে রোহিঙ্গা বোনেরা অনন্য।
২: রোহিঙ্গা মেয়েরা স্বামী-সোহাগীনি হয়। তুলনামূলক কারা বেশি স্বামীর অনুগত হয়, সেটা বলা মুশকিল। তবে এটুকু বলা যায়, একজন বাঙালি মেয়ে বিয়ে করার চেয়ে, একজন রোহিঙ্গা বোনকে বিয়ে করলে দ্বীন ও দুনিয়ার উপকার বেশি হবে।
দ্বীনি উপকার: তাকে ইচ্ছেমতো গড়ে নেয়া যাবে। তার মধ্যে দুনিয়াবি চাহিদা একদম থাকবে না বললেই চলে। তবে হাঁ, তার মধ্যে হয়তো পর্দা-পুশিদা কম থাকবে। কিন্তু সেটা সমাধান করা অতি সহজ। তিনমাসের একটা নুরানী কোর্সে ভর্তি করিয়ে দিলে এবং বিয়ের পর মাস্তুরাত জামাতে গেলে, সব ঠিক হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।
দুনিয়াবি উপকার: অল্প মোহরানায় বিয়ে করা যাবে। তার মধ্যে প্রযুক্তিগত খারাপ দিকগুলো কম থাকবে। যেহেতু তার পিছুটান কম থাকবে, তাই তার সমস্ত মনোযোগ স্বামীর প্রতিই থাকবে। তার মধ্যে আরো ছাই, আরো ভালোটা চাই-মার্কা বিরক্তিকর চাহিদা থাকবে। স্বল্পআয়েই বউবাচ্চা নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করা যাবে।
৩: একজন রোহিঙ্গা বোন বিয়ে করা মানে? একজন মাযলুমকে সাহায্য করা। মদীনার সেই অবিস্মরণীয় ঘটনা, আনসার-মুহাজিরের সুন্নাত যিন্দা করার দুর্লভ সওয়াব পাওয়া যাবে।
৪: আমাদের সাথে সফরে যাওয়া, এক ভাইয়ের স্ত্রী সানন্দে ও স্বেচ্ছায় সম্মতি দিয়েছেন: তিনি একজন রোহিঙ্গা বোনকে ‘সতীনবোন’ হিশেবে গ্রহণ করবেন। অন্য বোনেরাও বিষয়টা ভেবে দেখতে পারেন। যাদের সামথ্য আছে, থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে, তারা এগিয়ে এলে, কিছু বোনের সুন্দর সংস্থান হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।
(৫) আমাদের সাথে সফরে যাওয়া, এস সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার ভাই, তিনজন মেয়ের দায়িত্ব নিবেন বলেছেন। একজনকে তিনি নিজেই স্ত্রী হিশেবে গ্রহণ করবেন। বাকীদের জন্যেও তার ভাই ও বন্ধু সম্মত হয়েছেন। আরও আনন্দের বিষয় হলো, ও ভাইয়ের আ্ম্মুও ফোনে সানন্দে একজন রোহিঙ্গা বোনকে পুত্রবধূ হিশেবে গ্রহণ করতে বেজায় আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এবং সুদূর খুলনা থেকে বউ দেখতে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আল্লাহু আকবার।
৫: রোহিঙ্গা বোনকে বিয়ে করলে কিছু সমস্যাও দেখা দিতে পারে:
(ক) দু’জনের ভাষাগত সমস্যা দেখা দিবে। এটা কেটে যেতে বেশিদিন লাগবে না।
(খ) দু’জনের সংস্কৃতিগত পার্থক্য দেখা দিবে। ভাবী এতদিন যে রান্না খেয়ে অভ্যস্ত ছিলেন, আপনি আরেক রকম খাওয়ায় অভ্যস্ত ছিলেন। তার রান্না-বান্না আপনার ভাল নাও লাগতে পারে। এটাও তেমন ধর্তব্য নয়। বড়জোর একমাসের মধ্যে কেটে যাবে।
গ: প্রথম দিকে ভাবী কিছুটা মনমরা হয়ে থাকতে পারেন। এটা কিছু নয়। আপনার আদর-যত্ন তার মনের কষ্ট ভুলিয়ে দেবে।
ঘ: সবার আগে ভাবীকে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে গ্রহণ করতে হবে। প্রথম দিকে। পরে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে শিখবে।
শেষকথা:
(এক) হাটহাজারীতে যারা বিরানী খাইয়েছেন, তাদের প্রতি রইল গভীর কৃতজ্ঞতা। বলবো না, জীবনের সেরা বিরানী খেয়েছি, তবে এমেচার রাঁধুনী হিশেবে রান্নাটা বেশ ভালো হয়েছে এটা স্বীকার করতেই হবে। আর সংক্ষিপ্ত নোটিশে মাদরাসার সীমাবদ্ধ পরিসরে, ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজনের জন্যে গোছানো ইন্তেজাম করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। যাউয়াজাকুমুল্লাহ।
(দু্ই) মাওলানা রজীবুল হক সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন: সবার আবেগ যখন কমে আসবে, তারপর থেকে নিয়মিতই মাযলুম ভাইদের জন্যে নিয়মিত কিছু করার মেহনত চালু রাখবেন। প্রতিমাসেই কিছু করার চেষ্টা থাকবে। এবারই শেষবার নয়। প্রথমবার। ইনশাআল্লাহ নিয়মিত মাযলুম ভাইদের কাছে যাওয়া হবে।