বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১০:৫২
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক, সুন্দরবনকে মারবেন না

বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক, সুন্দরবনকে মারবেন না

সোহরাব হাসান :

বন্ধু-সহকর্মী ইফতেখার মাহমুদ একাধিকবার বলেছেন, ‘আপনি সুন্দরবন নিয়ে কিছু লিখছেন না কেন?’ আমি বললাম, অনেকেই তো লিখেছেন। বিশেষজ্ঞরা লিখেছেন। পরিবেশ নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা লিখছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনকি ইউনেসকোও সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তিনি বললেন, কিন্তু সরকার তো শুনছে না।

এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে সরকার শুনবে? তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিতে যাঁরা আছেন, তাঁরা কেউ সরকারকে উৎখাত করতে চাইছেন বলে জানা নেই। বরং বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এই কমিটির অনেক আন্দোলনের সঙ্গে আজকের ক্ষমতাসীন সরকারের অনেকে সহমত প্রকাশ করতেন। এই জাতীয় কমিটির বাইরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি হয়েছে, যার নাম সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি। এসব কমিটির কেউ বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করেছেন, এমন দাবি দুর্মুখও করতে পারবেন না। বরং যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ সরকারের অনেক ভালো কাজকে তাঁরা স্বাগতও জানিয়েছেন।

দুই কমিটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে তেমন ফারাক আছে বলে মনে হয় না। তাদের সবার লক্ষ্য ওয়ার্ল্ড হেরিটেজখ্যাত সুন্দরবন রক্ষা করা। সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও বলছেন, সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হোক, তা তাঁরা চান না। আর জাতীয় কমিটি বা সুন্দরবন রক্ষা কমিটির কেউ এ কথা বলেননি যে ভারতের সহায়তায় বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না। তাঁরা বলেছেন, বিদ্যুৎ প্রকল্প করুন। কিন্তু সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে।

তাহলে সমস্যাটি কী? সমস্যাটি হলো সুন্দরবনের অদূরে বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন। এই প্রকল্প কারা করছে, কোন দেশের বিনিয়োগ আছে, সেসব নিয়ে বিতর্ক নেই। বাংলাদেশের উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন আছে। এবং বিদ্যুৎ খাতে সেই বিনিয়োগ যে আরও বেশি প্রয়োজন, সে কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। যাঁরা বিদ্যুৎ খাতে ভারতের বিনিয়োগের বিরোধিতা করেন, তাঁদের সঙ্গে আমরা একমত নই। যাঁরা বলেন, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনলে তারা যেকোনো সময়ে সুইচ অফ করে দিতে পারে, তাঁরাই একসময় বলতেন, ভারত পানি দিলেও সেই পানিতে ময়লা থাকবে। আজ অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হলেও সত্য যে ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিস চালু হওয়ার প্রতিবাদে তৎকালীন বিরোধী দল হরতালও ডেকেছিল।

তাই পরিষ্কার বলা প্রয়োজন যে অন্ধ ভারতবিরোধিতার সঙ্গে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এই আন্দোলনের একজন নেতা কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা যখন আন্দোলন শুরু করি, তখন তারা নিশ্চুপ ছিল। এখন আন্দোলনটি জনগণের সমর্থন পাওয়ায় তারা আন্দোলনকে “ছিনতাই” করার চেষ্টা করছে।’

এ কথাও মনে করার কারণ নেই যে সরকারের যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁরা সবাই দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে তৎপর। আর যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরাই একমাত্র দেশপ্রেমিক। আমরা যেমন উন্নয়ন চাই, তেমনি সুন্দরবন রক্ষাও করতে চাই। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলতে চাইছেন যে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলেও সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। তাঁরা বিদ্যুৎকেন্দ্রে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং নৌপথে কয়লা আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার কথা বলেছেন। যে দেশে রানা প্লাজা, তাজরীন বা টাম্পাকোর মতো মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ঘটে, সে দেশে সবকিছু আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সুরক্ষা করা সম্ভব নয়।

বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক। কিন্তু সেটি সুন্দরবনের কাছে হতে হবে কেন? পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি উপযুক্ত স্থান বেছে নেওয়া যেতে পারে। রামপালে এখনো অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। ফলে প্রকল্পের স্থান পরিবর্তন করাও কঠিন নয়। সরকারকে বুঝতে হবে, বিদ্যুৎ প্রকল্পের জায়গা পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু সুন্দরবন সরানো যায় না। তাই কেবল সরকারের সমর্থক পরিবেশবিদ নয়, দেশি-বিদেশি সব বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন। এই আন্দোলন সরকারের পক্ষেও নয়, বিপক্ষেও নয়। এটি সুন্দরবনের পক্ষে। সরকার প্রকল্পের পক্ষে নানা যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে। আন্দোলনকারীদেরও যুক্তি আছে। সেই যুক্তিগুলো শুনুন। সবার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিন। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনকে সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।

গত শনিবার শহীদ মিনারে জাতীয় কমিটি যে মহাসমাবেশ আহ্বান করেছে, তাতে সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতি দেখেছি। সেই সমাবেশ থেকে সরকার উৎখাতের ঘোষণা কেউ দেননি। বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না, সে কথা কখনো বলেননি। তাঁরা বলেছেন, ওখানে বিদ্যুৎ প্রকল্প করলে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুন্দরবনের ক্ষতি হলে বাংলাদেশও বিপন্ন হবে। বিগত আইলা ও সিডরের সময় সুন্দরবনই রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে, সেটিও ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল না হলে আগামী ২৬ জানুয়ারি হরতাল আহ্বান করা হয়েছে সমাবেশ থেকে। এটি হুমকি নয়, দাবি আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ হুঁশিয়ারি। আমরা আশা করব, সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে এবং জেদ থেকে সরে আসবে।

একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পার্থক্য হলো গণতান্ত্রিক সরকার ভুল করলে সেটি সংশোধনের চেষ্টা করে। আর স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ভুলকেই আঁকড়ে রেখে নতুন ভুলের পথ প্রশস্ত করে। শেখ হাসিনার সরকার আশা করি প্রথমটাই বেছে নেবে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র হোক। কিন্তু সুন্দরবনকে মেরে নয়, বাঁচিয়ে।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

ইতিহাসে আল্লামা আহমদ শফী

–ফরহাদ মজহার বাংলাদেশে দ্বীনি ইসলামের দেওবন্দী ধারার বর্ষীয়ান মুরুব্বি আল্লামা শাহ আহমদ শফী ইন্তেকাল করেছেন। ...