ড. আবদুস সালাম আজাদী :
আমার বাসায় কিছু উচ্চ শিক্ষিত এবং জ্ঞানী ভাইদের একবার দাওয়াত দেই। সেখানে একজন ছিলেন ইসলাম সম্পর্কে খুব অধ্যয়ন করা প্রাজ্ঞ মানুষ। খাওয়ার পর আড্ডাতে বাঁধে এক গণ্ডগোল। ইসলাম সম্পর্কে অধ্যয়নকারী প্রাজ্ঞ ভাইটি উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দীকা ও আবূ হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা নিয়ে মারাত্মক কটূক্তি শুরু করলেন। তিনি সাহাবীগণের বেশকিছু ব্যক্তিত্বকে ইসলাম বিরোধী সাব্যস্ত করতে নানা গাল-গল্পের অবতারণা করতে লাগলেন। এবং তাদের ব্যক্তিগত বিষয়াদি নিয়ে এমনভাবে কথা বলা শুরু করলেন যে, আমি আমার সহ্যের বাঁধটাকে বালু দিয়ে বানায়ে রাগের বন্যায় নিমেষেই ভেঙ্গে দিলাম। আর কোন যুক্তি ও গাল-গল্পের তোয়াক্কা না করে ওখানেই আলোচনার দরোজা ধুড়ুম করে বন্ধ করে দিলাম।
এখান থেকে শুরু হয় আমার শিয়াদের নিয়ে গভীর অধ্যয়ন। মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে শিয়াদের মৌলিক আক্বীদা-বিশ্বাস ও তাদের দর্শনের মূল ভিত্তি নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা আমরা পড়েছি। কিন্তু ইসলামী সমাজে তাদের এই বিস্ফোরণ নিয়ে আমি কিছুই জানতাম না। এই প্রাজ্ঞ ভাইয়ের পদস্খলন আমাকে সেই জানার দরোজায় প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
শিয়ারা সায়্যিদুনা আলী (রা) এর অনুসারী হলেও রাজনৈতিক মঞ্চে এদের অধিষ্ঠান হয় মূলতঃ মেইন স্টীম মুসলিমের বিপরীতে। উমাইয়া বংশের পতন ঘটিয়ে আব্বাসীয়দের ক্ষমতায় আনার পথ রচনা করতে ইসলামী যে সব শ্লোগান তাদের আমদানী করতে হয় তা ছিলো- আহলে বায়তের প্রাধান্য দেয়া। ইসলামি দুনিয়া জুলুম ও ইসলাম বিরোধিতায় ছেয়ে গেছে, একে আবার ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসা। ফিৎনার যে ভয়াবহতা তাতে ইমাম মাহদীর আগমন অবস্যম্ভাবী হয়ে গেছে বলে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তোলা। ফলে তার আগমনে স্বাগত বাহিনীর ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
এই শ্লোগানগুলো সবটাই ছিলো তৎকালিন ইসলামী সাম্রাজ্যের শাসকদের বিরোধিতার মূলমন্ত্র। সত্যি বলতে কি এই শ্লোগানগুলোই মুসলিম সাম্রাজ্যের পদমূলে আঘাত করে এবং আবু মুসলিম খোরাসানীর মত লোকদের সহযোগিতায়, আহলে বায়তগণের চেষ্টায় ও বনী আব্বাসীদের নেতৃত্বে উমাইয়্যাহ শাসন শেষ হয়।
আব্বাসীয়রা ভালোভাবেই বুঝতেন ইসলামের সর্বনাশ কোন সব দর্শনে সাধিত হতে পারে। ফলে তারা আবূ মুসলিমদের যেমন শেষ করে দেন, আহলে বায়তদের কেও সামনে আসতে বাঁধা দেন, এবং শিয়া চিন্তার বীজমন্ত্র ‘মাহদীবাদ’কে অংকুরেই শেষ করার চেষ্টা করেন, অথবা শেষ করে দেন পারস্য দর্শনের তল্পীবাহক বারমাকীদের। কিন্তু ৩৫০ হিজরীর পরে মিশরে ফাতেমীদের সাথে তারা কুলিয়ে উঠতে পারিনি। ফলে শিয়া চিন্তা হয়ে ওঠে এক অনুপনীয় কালিমা যা ইসলামের ললাটে আজ জ্বলজ্বল করে জলছে এবং উম্মাতের বিভেদের এক মারাত্মক হেমিলিয়নী বাঁশি বেজেই চলছে।
শিয়ারা ইসলামী সমাজ ও সভ্যতায় বেশ কিছু ভয়াবহ চিন্তার বিষ ছড়িয়ে গেছে, যা আজো অনেকের মুখেও তার প্রতিধ্বনি শুনি আর কেঁপে কেঁপে উঠি। তারা বলেছে এবং বিশ্বাস করিয়ে নিয়েছে যে, প্রথম জেনারেশানের সাহাবীগণ আহলে বায়তের উপর জুলুম করেছে। তাদের সম্পত্তি ও শক্তি জবরদখলে নিয়েছে সাহাবাগণের অধিকাংশ। তারা আবূবকর উমার, উসমানসহ বড় বড় সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুমদের শধু ইসলামের বিরোধী বলেই শেষ করেনি; তাঁদেরকে কাফিরদের চেয়েও মারাত্মক বলে অভিহিত করেছে এবং করে যাচ্ছে।
চিন্তার জগতে আয়েশা সিদ্দীক্বা, আবু হুরায়রা এর মত যে সব সাহাবী (রা) বড় বড় ভূমিকা পালন করেছেন তাদের কে শুধু বিতর্কিত করেই তারা ক্ষান্ত হয়না, এদের ব্যক্তিগত জীবনে জঘন্য ও ঘৃণিত হিসেবে তুলে ধরে। শিয়া গ্রন্থে মা আয়েশা সিদ্দীকা (রা)কে যা দেখানো হয়েছে, সালমান রুশদী তার ছিটেফোটাও আলোচনা করেনি। আবূ হুরায়রাকে একজন অজ্ঞাত কূলশীল বলেই তারা শেষ করেনি, একজন চোর-বাটপার বলেও তাঁকে চিত্রিত করেছে ওরা। আপনি এইসব সাহাবার (রা) হাদীসগুলো বাদ দিলে কুরআনের ব্যাখ্যা করার সময় আর কাওকে পাবেন না।
তারা মনে করে আহলে বায়তের অধীনে ইমামাতে উযমা বা রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়িম করা সবচেয়ে বড় ফরজ। এখান থেকেই এসেছে মুসলিম দেশেও মনমত ভালো লোকদের ক্ষমতায় আনতে ইসলামী দল গঠনের প্রক্রিয়া। এদেরই হাতে গড়ে ওঠে ইসলামী রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে আরেকটা রাষ্ট্র কাঠামো। স্টেইট উইথিন দা স্টেইটের ধারণা। যা আসলে ইসলামী সাম্রাজ্য বা মুসলিম দেশকে খুব দুর্বল করে দেয়। দেশ চলবে দেশের আইনে, আর ওদের দলীয় লোকেরা চলবে ওদের আমীর বা দলনেতাদের হাতে বাইয়াত করে। ইসলামি দেশে এটা ছিলো ইসলামী বাইয়াতের সম্পূর্ণ বিরোধী চেতনার। খাওয়ারেজরা রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা যেমন দুর্বল হয়েছে, এই ঘাপটি মারা তাককিয়্যার অনুসারীরাও শেষ করেছে ভেতরে থেকেই।
‘উলিল আমর’ বা শাসন ও সমাজনেতৃত্ব তৈরিতে ইসলাম সবসময় জ্ঞান, তাক্বওয়া, ইজতিহাদ ও ইহসানের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ যে কােউকে মেনে নিতে বলে। নাক কান কাটা হাবশী, কোন বড় লোকের কেনা গোলাম, কারো বারির কর্মচারি এখানে সমান মর্যদা পায়। এখানে ইবনে মাসঊদ, বেলাল, সালেম, সুহায়ব দাস হলেও উলুল আমর হিসেবে নবীর (সা.)-এর যুগ থেকেও স্বীকৃত হয়ে এসেছেন। কিন্তু শিয়ারাই হলো প্রথম দল, যারা নবীর (সা.)-এর বংশধরকেই কেবল ইসলামের ব্যাখ্যাতা বা ইসলামের শাসন ক্ষমতার উপযুক্ত বলে মনে করেছে। ফলে খেলাফত থেকে শুরু করে এরা আহলে বায়তের বাইরে কাওকে দেখতে চায় না, কারো কথা শুনতে চায় না। ইসলামের এই রক্তীয় ধারার সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে এখানে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শুধু নগন্য মনে করেই বসে থাকেনি ওরা; বরং সবকিছুতে এই আহলে বায়তের সীল নিয়ে ইসলামকে মারাত্মক খাদে ফেলে দিয়েছে।
প্রতিটি সুফী রাস্তাতে আহলে বায়তের সিলসিলা লাগিয়ে ঐ পথের বাইরে হক নেই বলে মনে করা হয়েছে। এজন্য দেখবেন যত সূফী তারীকা আছে তার প্রতিটিতে আলী (রা) পর্যন্ত নিতেই হবে। ওখানে আবু বকর উমার উসমান (রা) দের কোন স্থান নেই। সমাজ জীবনেও ব্রাম্মণ্যবাদের মত মুসলমানদের শ্রেণিবিভাজন করে আহলে বায়তকে কাজে লাগানো হয়েছে। সৈয়দ বংশ ও তাদের পাশের বংশরাই হত মুসলিম সমাজের কাণ্ডারী।
আহলে বায়তদের চিন্তা-দর্শনকে তারা এতটাই প্রাধান্য দিয়েছে যে কুরআন ও তাদের দৃষ্টিতে আহলে বায়তের হাতেরটাই আসল। তারা মনে করে বাকিগুলোর মৌলিকতা যাচাই করতে হবে আহলে বায়তের নিজস্ব ব্যাখ্যায়। এজন্য যেসব সহীহ হাদীস কুরআন এর ব্যাখ্যা করে, তা সবই তাদের মতে দূর্বল। আর তাদের সনদে যেহেতু আহলে বায়তের কেউ না কেউ আছে, কাজেই তা কুরআনের মতই অকাট্য। আর দুঃখের কথা হলো ঐসব তথাকথিত হাদীসগুলো হলো ইসলামের জন্য এখন বিপদ।
ইতিহাস, সঙ্গীত, বিজ্ঞান চর্চা ও দর্শন ইত্যাদিতে আহলে বায়তের লোকেরা পারদর্শিতা নিয়ে আসেন এবং শিয়ারা এতে এগিয়ে থাকতে শুরু করে তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরী শতকে। ফলে ইসলামের বেশ কিছু ব্যাখ্যা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বেশকিছু শাখা তারা এমনভাবে বিষময় করে দেয় যে, আজো এগুলো মুসলিম সভ্যতার ‘গার্বেজ’ হিসেবে পরিগণিত হয়। ইস্ফাহানীর আগানী বা ‘সঙ্গীতসমূহ’, শিয়া উলামাদের হাদীসগ্রন্থসমূহ, দার্শনিকদের গ্রন্থরাজি তা সে ‘রাসাইল ইখওয়ানুস সাফা’ হলেও ইসলামের মারাত্মক ক্ষতি করে। শিয়ারা খুব সন্তর্পনে তাদের দর্শনগুলো এখানে ঢুকিয়ে গেছে। আমি সায়্যিদুনা উসমান ও সায়্যিদুনা মুয়াওয়িয়া (রা) সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে ইমাম তাবারীর কিছু তথ্য দেখে তাজ্জব হয়ে গেছি। হিসেব করে মিলাতে পারতাম না। পরে গবেষণা করতে যেয়ে দেখতে পাই ইমাম তাবারীর রেফারেন্সে বেশ কিছু শিয়া বর্ণনাকারী আছেন। আহলুস সুন্নার এত বড় একজন ইমামের গ্রন্থেও ঐসব বিষ কীভাবে ঢুকেছে তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে বৈকি!!
প্রতিটি শিরক, বিদআত ও খুরাফাত তথা ইসলামের নামে চলা গাল গল্পের মূল হয়ে গেছে এই গোষ্ঠীই। ইসলামি অবতারবাদ, সর্বেশ্বরবাদ বা অধুনাকালের আহলুল কুরআন গোষ্ঠীর মূল চালিকাশক্তিই হলো এই দলের মারাত্মক কাজ। আহলুল কুরআন নামে যে মারাত্মক বিভ্রান্ত দল এখন সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের উৎস হলো এই শিয়ারা। আমি এই লেখার প্রথমে যে প্রাজ্ঞভাই এর উদাহরণ দিয়েছি তিনি মূলত আহলুল কুরআন। আমি তার সকল চিন্তা শিয়াদের সাথেই ১০০% মিল পেয়েছি।
লেখক : ইসলামি চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট