বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই মুসলিম। আর মুসলিমদের জন্য প্রার্থনার এক বিশেষ স্থান হল মসজিদ। মসজিদে মুসলিমরা দলবদ্ধভাবে নামায পড়ে থাকেন। মুসলিমদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র হল মসজিদ। পৃথিবীতে মোট ২৫ লাখের মত মসজিদ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মসজিদ রয়েছে আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতে। সেখানে প্রায় ৩ লাখের মত মসজিদ রয়েছে। সাম্প্রতিক এক জরিপ থেকে এই তথ্যটি জানা যায়।
বাংলাদেশেও প্রচুর পরিমাণে মসজিদ রয়েছে। বাংলাদেশে মসজিদের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখের মত। দেশের আয়তনের কথা চিন্তা করলে বাংলাদেশেই মসজিদের ঘনত্ব গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর শহরের হিসেবে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে পৃথিবীর যেকোন শহরের তুলনায় বেশি মসজিদ রয়েছে। ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তি একটি জেলা হল মুন্সীগঞ্জ। এই মুন্সীগঞ্জেই অবস্থিত বাবা আদম শাহ মসজিদটি। মসজিদটি অত্যন্ত প্রাচীন একটি মসজিদ। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের দিক থেকে শীর্ষস্থানীয় এক মসজিদ এইটি। আজ আমরা এই মসজিদটিরই বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে জানবো।
অবস্থান এবং সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বাবা আদম শাহ মসজিদ মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার দরগাবাড়ি গ্রামে অবস্থিত। এটি একটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন মসজিদ। এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৪৮৩ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর আগে। এ মসজিদে এখনও নিয়মিত জামায়াতের সহিত নামায আদায় করা হয়। এ মসজিদের চত্বরেই রইয়েছে বাবা আদম (রহঃ) এর মাজার। ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এ মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে।
বাবা আদম (রহঃ)
১০৯৯ সালে বাবা আদম (রহঃ) সৌদি আরবের মক্কা নগর থেকে কিছুটা দূরের শহর তায়েফে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কিশোর বয়স থেকেই আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ লক্ষ্যে তিনি বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর কাছে দীক্ষা নিতে বর্তমান ইরাকের বাগদাদে চলে আসেন। এরপর তিনি আরব থেকে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে উপমহাদেশে আসেন।
তখন বাংলায় সেন শাসন আমল চলছিল। সেরকম সময়ে ১১৭৮ সালে বর্তমান বাংলাদেশের ধলেশ্বরীর তীরে মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিমে আসেন আধ্যাত্মিক সাধক বাবা আদম। তখন এ এলাকাটি ছিল বল্লাল সেনের অধীনে।
জনশ্রুতি আছে যে, বল্লাল সেন ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারি এক শাসক। তিনি তার এলাকায় মসজিদে আযান দেয়া এবং গরু জবাই করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু বাবা আদম এসে সেই এলাকায় আবার গরু-মহিষ জবাই দিতে শুরু করলেন এবং মসজিদে আযান দিয়ে নামায পড়া শুরু করলেন। ফলে বল্লাল সেন আর বাবা আদমের মাঝে যুদ্ধ অবধারিত হয়ে দেখা দিল। সেই যুদ্ধে বল্লাল সেনের হাতে শহীদ হন বাবা আদম। যুদ্ধে পরাজিত হলেও ভাগ্যক্রমে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায় যার কারণে এলাকাটিতে মুসলিমদের কর্তৃত্ত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এই জনশ্রুতিগুলোর অধিকাংশই ঐতিহাসিকভাবেই মিথ্যা প্রমাণিত। কারণ বল্লাল সেনের পরও তার কয়েক প্রজন্মের হাতে সেই এলাকার শাসনভার অর্পিত ছিল যা ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য।
বাবা আদমের বিভিন্ন অবদানের জন্য তার মৃত্যুর প্রায় ৩০০ বছর পরে তার কবরের পাশে হিজরী ৮৮৮ বা, ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয় বাবা আদম মসজিদ। এ মসজিদটি নির্মাণ করতে প্রায় ৪ বছর সময় লেগেছিল। সুলতান ফতেহ শাহর শাসন আমলে মালিক কাফুর এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। যদিও বাবা আদম নামে সত্যিই কেউ ছিলেন কিনা তা নিয়ে অনেক ঐতিহাসিকই সন্দেহ প্রকাশ করেন। এর কারণ মসজিদটির শিলালিপিগুলোতে সেই আমলের অনেকের নাম থাকলেও বাবা আদমের নাম নেই। এমনকি কোন মাজারেরও উল্লেখ নেই সেইসব শিলালিপিতে। সেখানে মসজিদটির নাম লেখা রয়েছে ‘জামি মসজিদ’ হিসেবে।
মসজিদের বিবরণ
মসজিদটির ছাদে একই আকৃতির অনতিউচ্চ ৬ টি গম্বুজ রয়েছে। এর ভিত্তি এলাকার দৈর্ঘ্য ৪৩ ফুট এবং প্রস্থ ৩৬ ফুট। এর দেয়াল পুরটাই ইট এবং সুরকি দ্বারা নির্মিত। দেয়ালগুলো ৪ ফুট প্রশস্থ। ইটের আকার ৫ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত। ইটগুলো লাল পোড়ামাটির তৈরি। এর সম্মুখে তিনটি খিলানের মত প্রবেশ করার পথ আছে। খিলানগুলোর শীর্ষদেশে মনোরম কারুকাজ আছে। এখানে ঝুলন্ত শিকল ও ঘন্টার অলংকরণ দেখা যায়। এ তিনটি পথের মাঝের পথটি এখন ব্যবহৃত হয়। মসজিদটিতে কোন বারান্দা নেই। মসজিদটিতে মোট ছয়টি কাতারের ব্যবস্থা আছে। মসজিদটিতে নিয়মিত জামায়াতে নামায হয়ে থাকে বলে স্থান সঙ্কুলান হয় না। তাই সামনের প্রাঙ্গনে কংক্রিট ঢালাই করে আরো সাতটি কাতারের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান তৈরি করা হয়েছে।
মসজিদের দু’পাশে জানালা নেই। ফলে রৌদ্রজ্জ্বল দিনেও বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে মসজিদটি। মসজিদটি দেখতে অনেকটাই সুরক্ষিত দুর্গের মত। এর কারণ সম্ভবত যাতে ইবাদতে মশগুল থাকা অবস্থায় মুসলমাররা যাতে কারো হামলা বা, আক্রমণের শিকার না হন। মসজিদটি থেকে কয়েক গজ পূর্বেই বাবা আদমের মাজার। মাজারটি পঁচিশ ফুট বাহুবিশিষ্ট বর্গাকার আয়তনের। মাজারটির মঞ্ছ ইটের তৈরি।
মসজিদটির ভেতরের পশ্চিম দেয়ালের দিকে তিনটি অর্ধবৃত্তাকার অবতল মেহরাব আছে। মসজিদের চার কোণায় চারটি মিনার আছে। এ মিনারগুলোতে অলঙ্করণের কাজ আছে। পূর্ব দেয়ালে আরবি লিপির একটি শিলাফলকও চোখে পড়ে। এছাড়াও মসজিদটির দেয়ালে লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা, ঝুলন্ত প্রদীপ, শিকল, গোলাপ ফুল ইত্যাদির অত্যন্ত সুন্দর পোড়ামাটির নকশা আছে।
মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ
ভারতবর্ষের প্রত্নতত্ত্ব জরিপ বিভাগ ১৯০৯ সালে একবার মসজিদটি সংস্কার করে রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু পরবর্তিতে তা সেই কাজ আর তেমন আগায়নি। ১৯৪৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এ মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটিতে লোহার তৈরি সীমানা বেড়া দেয়। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ থেকে এই বাবা আদম মসজিদের ছবি সংবলিত একটি ডাকটিকেট প্রকাশ করেছিল। সংগৃহীত
তথ্যসূত্রঃ
২। http://www.munshiganj.gov.bd/
৪। http://www.somewhereinblog.net/