:
মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই বিস্ময়কর বিজয়ের মধ্য দিয়ে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে। ব্যাপারটা এই যে অনেক মার্কিন নাগরিক, বিশেষ করে সাদা বর্ণের পুরুষ নাগরিকেরা ভাবছেন, তাঁরা বাদ পড়ে গেছেন। এটা শুধু অনুভূতি নয়, বাস্তবেই অনেক মার্কিন নাগরিক বাদ পড়ে গেছেন। তাঁদের ক্রোধের মধ্য দিয়েই ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। আর যে কথাটি আমি বারবার বলে যাচ্ছি তা হলো, যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বেশির ভাগ মানুষের উপকার করতে পারে না, তা ব্যর্থ। তাহলে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন এ বিষয়ে কী করবেন?
৩৫ থেকে ৪০ বছর ধরে মার্কিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমনভাবে পুনর্লিখিত হয়েছে যে তাতে শুধু সমাজের উঁচু তলার মানুষেরাই উপকৃত হচ্ছে। এতে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে, সমাজের নিচু তলার ৮০ শতাংশ মানুষ এর জন৵ ভুগছে। ট্রাম্পের বিজয়ের পরিহাস হচ্ছে, তিনি যে রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই রিপাবলিকান পার্টিই বিশ্বায়নের চূড়ান্ত প্রবক্তা ছিল। কিন্তু ইতিহাস তো ফেলনা নয়। চীন ও ভারতও এই বৈশ্বিক অর্থনীতির অংশ হয়ে গেছে। এ ছাড়া পৃথিবীতে প্রযুক্তির এত বিকাশ হয়েছে যে উৎপাদনমূলক খাতে চাকরির সুযোগও কমে গেছে।
এ কথার মাজেজা হচ্ছে, ট্রাম্প ভালো বেতনের উৎপাদন খাতের চাকরি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাতে তিনি তেমন একটা সফল হবেন না। তিনি হয়তো কম বেতনের কিছু চাকরি ফিরিয়ে আনতে পারবেন, সেই ১৯৫০-এর দশকের বেশি বেতনের নয়। কথা হচ্ছে, ট্রাম্প যদি অসমতা কমানোর ব্যাপারে সত্যিই আন্তরিক হন, তাহলে তাঁকে নতুন করে নিয়ম লিখতে হবে, যাতে সবাই উপকৃত হয়। শুধু তাঁর মতো মানুষের উপকৃত হলেই চলবে না। তাঁর প্রথম কাজ হবে বিনিয়োগ বাড়ানো। এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি তেজি প্রবৃদ্ধির ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে, ট্রাম্পের উচিত হবে অবকাঠামো ও গবেষণা খাতে ব্যয় বাড়ানো। এ কথা শুনলে ধাক্কা খেতে হয়, যে দেশটির অর্থনৈতিক সফলতার ভিত্তি প্রাযুক্তিক উন্নয়ন, সেখানে আজ মৌলিক গবেষণা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তা ৫০ বছর আগের তুলনায় কম।
অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে বেসরকারি বিনিয়োগ থেকে বেশি ফল পাওয়া যাবে। বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় কম। ছোট ও মাঝারি খাতের উদ্যোগে টাকা দেওয়া হলে বেসরকারি বিনিয়োগ গতি পাবে। নারী উদ্যোক্তাদেরও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। কার্বন কর আরোপ করলেও ভালো হতে পারে। এতে যেমন পরিবেশ নির্মল থাকবে, তেমনি এই টাকা অবকাঠামো খাতে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতেও কাজে লাগানো যেতে পারে। কিন্তু ট্রাম্প যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারটাই মানেন না, সে জন্য মনে হয়, তিনি এর সুবিধা নেবেন না (এতে অন্য দেশগুলোও মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করতে পারে। কারণ, এগুলো বানাতে জলবায়ু পরিবর্তন–বিষয়ক নীতিমালা ভাঙা হয়েছে)।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আয় বণ্টনব্যবস্থাকে উন্নত করতে সমন্বিত মনোভঙ্গি দরকার, যেটা উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। ট্রাম্প ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি অন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে হাত দেবেন বলে মনে হয় না: শ্রমিকদের সিবিএ করার অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া, সিইওদের ক্ষতিপূরণ ও অর্থনীতির আর্থিক খাত-নির্ভরতা।
কথা হচ্ছে, বিধিগত সংস্কার যেন আর্থিক খাতের ক্ষতি সীমিতকরণের মধ্যে আটকে না থাকে। এই খাত যেন মানুষকে সেবা দিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এই গত এপ্রিল মাসে বারাক ওবামার কাউন্সিল অব ইকোনমিক অ্যাডভাইজার্স যে বিবৃতি দেয়, তাতে দেখা যায়, বাজার কিছু খাতের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। এর মানে হলো, প্রতিযোগিতা কমে দাম বেড়ে যাওয়া। এর প্রত্যক্ষ পরিণাম হিসেবে যেমন মজুরি কমে যাবে, তেমনি প্রকৃত আয়ও কমে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রকে এই কেন্দ্রীভবন মোকাবিলা করতে হবে, যার নবতম রূপ হচ্ছে শেয়ারিং ইকোনমি, যেখানে বাজার কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর-ব্যবস্থা পশ্চাদ্গামী। এটা ধনীকে আরও ধনী করে। এই ব্যবস্থার সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। এর দৃশ্যমান লক্ষ্য হওয়া উচিত, ক্যাপিটাল গেইন ও লভ্যাংশ তুলে দেওয়া। আরেক ব্যাপার হচ্ছে, কোম্পানিগুলো যাতে কর দেয়, তা নিশ্চিত করা। এর জন্য যে কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে কর দেয় ও বিনিয়োগ করে, তাদের করপোরেট করের হার কমানো যেতে পারে। আর যারা করে না, তাদেরটা কমানোর দরকার নেই। ট্রাম্প নিজেও এই ব্যবস্থার একজন বড় সুবিধাভোগী। ফলে তিনি আমজনতার উপকারের জন্য সংস্কার করবেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর রিপাবলিকানরা তো কর-ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে ধনীদের সুবিধার্থে।
ট্রাম্প সম্ভবত সুযোগের সমতা আনতে পারবেন না। কথা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি নব্য সামন্তীয় দেশ হতে না চায়—যেখানে সম্পদ এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের হাতে যায়—তাহলে সেখানে সরকারি বিদ্যালয়ে আরও বিনিয়োগ করতে হবে, সবার জন্য প্রাক্বিদ্যালয় শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু ট্রাম্প কার্যত এ ব্যাপারে নিশ্চুপ।
সবার জীবনে সমৃদ্ধি আনতে গেলে এমন নীতি করতে হবে, যাতে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও গৃহায়ণ নিশ্চিত করা যায়। একই সঙ্গে, সবার জন্য নিরাপদ অবসর নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও মর্যাদা থাকবে। সব শ্রেণি-পেশার মার্কিন নাগরিকের উচ্চবিদ্যালয়-উত্তর শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে তারা পছন্দ ও সামর্থ্য অনুসারে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে। কিন্তু আমি দিব্য চোখে দেখতে পারছি, রিয়েল এস্টেট মোগল ট্রাম্প গৃহায়ণে ব্যাপক জোর দেবেন (যার সিংহভাগ সুবিধা তাঁর মতো ব্যবসায়ীদের পকেটেই যাবে)। তিনি ওবামাকেয়ার সংশোধনের ঘোষণা দিয়েছেন। এতে লাখ লাখ মার্কিন নাগরিক স্বাস্থ্যবিমা থেকে বঞ্চিত হবে (যদিও নির্বাচনের পর তিনি এ ব্যাপারে সতর্ক পদক্ষেপ নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন)।
বিরূপ মানুষেরা যে সমস্যা সৃষ্টি করেছেন (দীর্ঘদিনের অবজ্ঞার কারণে), তা সহজে বা প্রচলিত উপায়ে সমাধান করা যাবে না। কার্যকর কৌশল প্রণয়নে অপ্রচলিত সমাধান বের করতে হবে। কিন্তু রিপাবলিকান করপোরেট স্বার্থের জন্য তা অনুকূল হবে না। ট্রাম্প যদি সত্যিই বাদ পড়াদের সাহায্য করতে চান, তাহলে তাঁকে অতীতের আদর্শিক লড়াই থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শুধু অর্থনৈতিক সংস্কার নয়, তাঁর কাজ হবে একটি গতিশীল, উন্মুক্ত ও ন্যায্য সমাজ লালন করা, যার মাধ্যমে মার্কিনদের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত মূল্যবোধের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এই দেশে নতুন যা হবে, তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন অর্থনীতিবিদ।