শরীফ মুহাম্মদ ::
বিষয় : মসজিদে জুমার বয়ান কিংবা দুআর বক্তব্য-ভাষা। এ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিরক্তি প্রকাশ ও সমালোচনা করার জন্য বহু ধরনের লোকজনকে মুখিয়ে উঠতে দেখা যায়। পত্রপত্রিকায় ও টকশোতে তারা কথা বলেন। তাদের অনেকেই ঠিকমতো মসজিদে যায় না। অনেকে আবার ইসলাম ধর্মের প্রতি ঈমানও রাখে না। কিন্তু বয়ান ও দুআয় যেন ‘সংস্কার’ সাধন করা হয়- এ নিয়ে আলোচনায় তারা বেশ অস্থির।
তাদের এ অভিযোগ শুধু মসজিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এমনকি তাদের এ-জাতীয় অভিযোগ নতুন নয় এবং নির্দিষ্টও নয়। তারা ওয়ায-মাহফিলের বক্তব্য-ভাষা নিয়েও একই রকম অভিযোগ ব্যক্ত করেন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, কওমী মাদরাসার পাঠ্য সিলেবাস নিয়েও তারা অহরহ একই সুরে বলে থাকেন, সেখানে পরধর্ম ও জাতির প্রতি হিংসার শিক্ষা দেওয়া হয়। এসব দেখে-শুনে তাদের প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষার শেষ মনযিল যে কী- এটা বলা মুশকিল। কিন্তু বয়ান-মাহফিল ও দুআর বক্তব্য ও শব্দ নিয়ে তাদের সাধারণ ও আপাতত টার্গেট হিসেবে যে বিষয়টি ফুটে ওঠে সেটি হচ্ছে, তারা চান- দুনিয়ার কোথাও কোনো নির্যাতিত মুসলমান কিংবা মুসলমান গোষ্ঠীর প্রতি প্রকাশ্য সহানুভূতি জানানো যাবে না। কোথাও মুসলমানদের প্রতি জাতিগত কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো বর্বরতা ও হত্যাকা- ঘটলেও কারো বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, দুআও করা যাবে না। মুসলমানদের জীবন এবং ইসলামী অনুশাসনের কোনো কিছুর প্রতি কোনো নিয়ন্ত্রণ কিংবা দমন নেমে আসলে সেটার প্রতিবাদে টু শব্দটিও উচ্চারণ করা যাবে না। সব দুআয়, বয়ানে ও মাহফিলে কেবল এমন কিছু যিকির-আযকার ও ‘নির্বিরোধ’ শব্দ-বাক্য উচ্চারণ করতে হবে যাতে দুনিয়ার কোনো উৎপীড়ক, জালেম ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীকে বিব্রত বোধ না করতে হয়।
এই অভিযোগ ও প্রত্যাশা কতটা সমীচীন- আজ সে বিষয়েই কিছু কথকতা হতে পারে। দেখুন, ইসলামের ইবাদত ও আলোচনার ধরন ও বিষয় তো ইসলামের মূল দলিল এবং শিক্ষা থেকেই নিতে হবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের কথা, ভ্রাতৃত্বের ডাকে সাড়া দেওয়ার কথা, সহানুভূতি প্রকাশ ও কষ্ট না দেওয়ার কথা বারবার এসেছে। আক্রমণকারী শত্রুদের পতনকামনা ও শান্তির পক্ষের মানুষদের বিজয়-প্রত্যাশার কথা তো মাসনুন দুআর শব্দে শব্দে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিদায়-হজ্বের ভাষণসহ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের বিভিন্ন খুতবা এবং ভাষণ ও বক্তব্যে মুসলমানদের ঐক্য, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করা, একে অপরকে কষ্ট না দেওয়ার বহু বর্ণনা তাকীদ-মমতার সঙ্গে উল্লেখ হয়েছে। এখন কি তবে ইসলামের এসব শিক্ষা একপাশে সরিয়ে রেখে ‘এক পাক্ষিক’, ‘নৈর্ব্যক্তিক’ এমন কিছু বক্তব্যের অনুশীলন আমাদের ইমাম-আলেমদের করতে হবে যেখানে আক্রান্ত মুসলমানদের প্রতি কোনো মমতা থাকবে না? ইসলামী ইবাদত ও আলোচনার অবয়ব ও ধরন নিয়ে তবে কি বিভিন্ন দেশের সেকুলার ও ইসলামবিদ্বেষীদের ‘দায়সারা’ ও মমতাহীন নির্দেশনাই অনুসরণ করতে হবে? এটা কি সম্ভব? এটা কি হওয়া উচিত? যদি অন্য সব ইবাদতের ক্ষেত্রে এটা সঙ্গত না হয়- তাহলে বয়ান, দুআ ও মাহফিলেও সম্ভব করার কথা বিভিন্ন ফোরাম থেকে যারা বলেন, তাদের কথায় কান দেয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করা যায় না। কারণ এটাও ইবাদতের বিষয়। অনুসরণের বিষয়। চাপিয়ে দেওয়া কিংবা নতুন আরোপিত ও উদ্ভাবিত কোনো বক্তব্য ধার্য করার বিষয়ই নয়।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে হোক, কিংবা হোক সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে- বিপন্ন, আক্রান্ত ও বিপর্যস্ত মুসলমানদের জন্য কথা বলা, সহানুভূতি প্রকাশ করা, দুআ করা, সম্ভাব্য সাহায্য করা অপর মুসলমানদের দায়িত্ব। দায়িত্বটা কেবল নৈতিক নয় কিংবা যৌক্তিক পরিধিতে সীমাবদ্ধও নয়- বরং এটা ধর্মীয় দায়িত্ব। দ্বীনী কারণেই বিপন্ন ও আক্রান্ত মুসলমানের প্রতি সহানুভূতি জানাতে অপর মুসলমান আদিষ্ট এবং বাধ্য। বিষয়টিকে আমরা দেশীয়-দলীয় রাজনীতির ভেদবুদ্ধির বৃত্তে আটকে না ফেলি। এটা আসলেই এইদল-সেইদলের বিরুদ্ধতার সুযোগের বিষয় নয়। এমন কি সরকারি-বিরোধী কোনো দলেরই এ বিষয়টিকে পক্ষ বা বিপক্ষ হিসেবে নেয়া বা টার্গেট বানানোও অপ্রয়োজনীয়। তাই আজ দুনিয়ার যেসব দেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কিংবা প্রভাবশালী কোনো গোষ্ঠীর নেতৃত্বে মুসলিম নির্যাতন ও নিগ্রহ চলছে, যতদিন তার নিবৃত্তি না হবে- সেসব মুসলমানদের জন্য দুআ করা, কথা বলা এবং সম্ভাব্য ও নিয়মতান্ত্রিক সাহায্য করার পদক্ষেপ গ্রহণ অন্য মুসলমানরা বন্ধ করতে পারেন না। এবং এই পদক্ষেপ গ্রহণ মূলত মুসলিম সরকারগুলোরই প্রধান দায়িত্ব। এজন্য ইবাদতের সময়, বয়ানের সময়, মসজিদে ও মাহফিলে এই বেদনার প্রকাশ ও কান্না বন্ধ করার দাবি যৌক্তিক হতে পারে না। যদি আমরা ধর্মীয় অঙ্গনের বাইরে আমাদের যতগুলো অঙ্গন রয়েছে; আমাদের সাধারণ অনুষ্ঠান, আমাদের সব বিদ্যালয়ের ছাত্র সম্মিলনি, আমাদের সব জাতীয় উপলক্ষ ও দিবস এবং এরকম আরো যত সমাগম ও বলা ও শোনার ক্ষেত্র- সেখানে এইসব ইস্যু নিয়ে সোচ্চার হয়ে যেতাম। দেশে দেশে মুসলিম হত্যা ও নির্যাতনের বেদনা নিয়ে বিশ্লেষণ করতাম, প্রতিবাদ করতাম, দুআ করতাম- তাহলে মসজিদ-মাহফিলে এবং বয়ান-দুআয় এই ইস্যু না উঠানোর দাবি কেউ হয়তো করতে পারতো। কিন্তু আমরা তো জীবনের সাধারণ আঙিনায় এসব হৃদয়বিদারক দ্বীনী বিষয়কে মোটেও স্পর্শ করছি না- তাই ন্যুনতম ধর্মীয় দায়িত্বের অংশ হিসেবে ধর্মীয় অঙ্গনে আমাদের মুখ ও দিলের আমল আমাদের করে যেতেই হবে। এছাড়া তো উপায় নেই। যে কোনো কারণেই হোক, দুনিয়ার নানা প্রান্তে আজ মুসলমানরা শক্তিধর শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। বোমা বর্ষণে, গুলিতে ও ড্রোন হামলায় মুসলমান নারী-শিশু বৃদ্ধরা মারা পড়ছেন। এসবের বিরুদ্ধে দুনিয়ার মুসলমানরা (রাষ্ট্রীয় কিংবা অন্য কোনো উদ্যোগে) কিছুই করতে পারছেন না। তারা কি তবে দেশে-বিদেশে আক্রান্ত লাখ লাখ ভাই-বোন ও সন্তানদের জন্য কাঁদতেও পারবেন না? দেশে দেশে তাদের ভাইদের মারা হবে, কোনো রাষ্ট্র থেকে কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হবে না; তবে কি বয়ান ও দুআতে তাদের জন্য অন্য কোনো দেশের মুসলমানরা চোখের পানিও ফেলতে পারবে না? প্রতিরোধ তো দূরের জিনিস, চোখে জমা হওয়া পানির ফোঁটা মুছতেও পারবে না? সেরকম কিছু করলেও সেটা হিংসা হয়ে যাবে? সেটা উসকানি ও উগ্রতা হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? এক পক্ষের বর্বরতা, মারধর, আক্রমণ, হত্যা, নিগ্রহ ও অত্যাচারকে হিংসাত্মক কোনো কর্ম হিসেবে দেখাই হচ্ছে না, অথচ মারাখাওয়া নির্যাতিত মানুষগুলোর জন্য শব্দ করে কান্না করাও ‘হিংসা’ হিসেবে সাব্যস্ত করা হচ্ছে! এটা কি সমীচীন ও সমতাপূর্ণ কোনো বিবেচনা?
দ্বিতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে, এটা তো স্বতঃসিদ্ধ ও সব মহলের কাছেই স্বীকৃত একটি বিষয় যে, কোনো নির্যাতিত গোষ্ঠীর প্রতি নির্বিরোধ ও মৌখিক কিংবা আত্মিক সহানুভূতি একটি নির্দোষ বিষয়। আক্রমণকারী শক্তিও এ ধরনের সহানুভূতিকে আইন ও নীতির চোখে বৈধ ও অনুমোদিত বলে মনে করে থাকে। বিভিন্ন বয়ানে, দুআয়, মাহফিলে পৃথিবীর দেশে দেশে নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য সহানুভূতিপূর্ণ যে দু-চার শব্দের বক্তব্য ও প্রার্থনার চর্চা হয় সেটা তো বাস্তব ময়দানের কোনো প্রতিরোধ নয়। সেটা তো হাতে-কলমে কোনো যুদ্ধ-পাল্টাযুদ্ধ নয়। সেটা তো কেবলই মৌখিক ও আত্মিক সহানুভূতি কিংবা নৈতিক সমর্থন। এরচেয়ে বেশি তো কিছু কোনো বয়ানে কিংবা দুআয় মানুষের পক্ষে করা সম্ভবও নয়। সুতরাং এ নিয়ে সাধারণ যুক্তিতেও আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। তারপরও যারা মসজিদের বয়ান, দুআ ও মাহফিলের বক্তব্যে সব সময় ‘অহিংস’ অবস্থানের জন্য চাপাচাপি করেন, অভিযোগের আঙ্গুল তাক করেন-তারা আসলে ভ্রাতৃত্ববোধ-শূন্য, মমতাহীন একটি নির্বিকার মুসলিম সমাজের খোলস কায়েম করার পথ তৈরি করতে চান। তারা চান, মুসলমান এমন হোক, একজন আরেকজনের দিকে দুঃসময়ে তাকাবে না। একজন আরেকজনের ব্যাথায় ব্যথিত হবে না। সবাই একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে কথায়, ব্যাথায়, চিন্তায় এবং বিপর্যয়ে। সবাই ভিন্ন ভিন্ন হয়ে মার খেতে থাকবে, ভিন্ন ভিন্ন হয়েই চিৎকার করতে থাকবে। কেউ কারো পাশে দাঁড়াবে না। এদের কাউকে কারো পাশে দাঁড়াতে দেওয়া উচিত-ও হবে না। তাদের মনোবাসনার ধরনটা এমনই। কিন্তু তাদের এই প্রত্যশা যেমন ইসলামসম্মত নয়, তেমনি তা নয় মানবিক বিবেচনাসিদ্ধ ও যুক্তিসঙ্গত। আমরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের একটি হাদীস এ পর্যায়ে স্মরণ করতে পারি। তিনি ইরশাদ করেছেন-
الْمُسْلِمُونَ كَرَجُلٍ وَاحِدٍ، إِنِ اشْتَكَى عَيْنُهُ، اشْتَكَى كُلُّهُ، وَإِنِ اشْتَكَى، رَأْسُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ.
[সব মুসলমান একটি ব্যক্তির মতো। ওই ব্যক্তির চোখে জখম হলে তার গোটা দেহ ব্যথিত হয়। ওই ব্যক্তির মাথা জখম হলে তার গোটা দেহ জখম হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০০০]
এ মর্ম ও বক্তব্যের বাহক হাদীস শরীফ বহু বহু। সুতরাং সহানুভূতির কোনো বয়ান ও দুআর বিরুদ্ধে কারো কোনো অভিযোগের কোনো মূল্য নেই মুসলমানদের কাছে। বরং সেই অভিযোগ ও নিন্দাকে মুসলমানরা তাদের আক্রান্ত ভাইদের জন্য তাদের কান্নার অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র রূপেই গণ্য করবে। সন্দেহ নেই, যারা মুসলমানের প্রতি এক মুসলমানের সহানুভূতি ও দুআ-দরদকে ‘হিংসা’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়- তারা মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের চোখের পানি ছিনিয়ে নিতে চায়। আমরা তো সব দিয়েছি। এখন কি চোখের এই পানি, মমতা ও ভ্রাতৃত্বের এই শেষ অশ্রুবিন্দুও ছিনিয়ে নিতে দেব!
তৃতীয় আরেকটি ব্যাপার আমরা দেখতে পারি। আমরা যদি ভিন্ন দেশে আমাদের নির্যাতিত-নিপীড়িত মুসলমান ভাইবোনদের জন্য কান্না বন্ধও করে দিই, এতে অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা কি নিজেদের মধ্যে কান্না ও দরদের লেনদেন বন্ধ করে দেবে? একটি উদাহরণ দেখুন, ভারত ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়েও এই সেদিন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে যেসব হিন্দু তাদের দেশে আশ্রয় নেবে-তাদেরকে ভারতের নাগরিকত্ব ও নানাবিধ শিক্ষা ও চাকুরির সুবিধা দেয়া হবে। কিন্তু একইরকম সমস্যায় পড়ে কোনো মুসলমান ওই দেশে গেলে তাকে নাগরিকত্ব ও কোনো সুবিধা দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে তারা পরিষ্কার। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতে তারা মোটেও দ্বিধান্বিত নয়। তারা যা করছে ঘোষণা দিয়েই করছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমরাই কেবল রাখঢাক করছি। আমরাই কেবল ভ্রাতৃঘাতী নির্মমতার অনুশীলনে যেতে চাচ্ছি। তাই সবদিক থেকেই আমাদের ভেবে দেখতে হবে- এটা কীভাবে সঠিক আচরণ ও কর্মপন্থা হতে পারে!