(১) সৈয়দ শাসছুল হুদা:
আজ বেফাকের মানববন্ধন : কী ও কেন?
বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড সংক্ষেপে বেফাক। একটি শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসা সমূহকে একটি ছায়াতলে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বৃহত্তম সংগঠন। কওমী মাদ্রাসাসমূহকে একটি ছায়াতলে আশ্রয় দেওয়ার জন্য এরচেয়ে বড় দ্বিতীয় কোন ব্যানার আমার চোখে পড়ে না। আমি বেফাককে ভালোবাসি। বেফাক আমাকে ভালোবাসে। কারন কওমী অঙ্গনের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হলো এই বেফাক।
সেই বেফাক যখন হঠাৎ করে আজকের মানববন্ধন কর্মসূচী ঘোষণা করে, তখন আমার ক্ষুদ্র মনেও প্রশ্নের উদ্রেক হয়।
কেন? কী কারনে বেফাক মাদ্রাসার দরস-তাদরীস বন্ধ করে রাজপথে ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে মানববন্ধন করার কর্মসূচী গ্রহন করলো? এই বিষয়টি বুঝার জন্য এলাকার একজন শ্রদ্ধেয় আলেম, বিশেষ করে উনাকে আমি উনার বলিষ্ঠ, সাহসী উচ্চারণ ও ইলমি ইস্তি’দাদের জন্য শ্রদ্ধা করি, তার কাছে ছুটে গেলাম। যা বুঝলাম, তাতে আমার অন্তর মুরুব্বিদের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো।
আজকের কর্মসীচী কী?
কর্মসূচী হলো- ঢাকা এলাকার জন্য সদরঘাট থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যে রাস্তা রয়েছে সে রাস্তার দু’ ধারে কওমী মাদ্রাসার উলামা-তুলাবাগণ মানববন্ধন করবেন। নিরবে দাঁড়িয়ে থাকবেন। কোন বক্তৃতা হবে না। কোন মিছিল হবে না।
কেন এই কর্মসূচী : এটা বুঝতে হলে বুঝতে হবে বর্তমান পরিস্থিতির গুঢ় রহস্য। এই ব্যাপারে আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বুঝেছি তার সারসংক্ষেপ তুলে ধরলাম।
* প্রথম কথা হলো-যারা বসে এই কর্মসূচী গ্রহন করেছে, আমি কী তাদের চেয়ে বেশি বুঝি? নিশ্চয়ই না। সুতরাং প্রথম কাজ হলো- মুরুব্বিরা বসে যেই সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছেন, তাদের কর্মসূচীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন। কর্মসূচীতে অংশগ্রহন। যদি আমি কওমী প্রেমিক হই, কওমীর সন্তান হই।
* দ্বিতীয়ত: এই কর্মসূচি গ্রহনে নিশ্চয় বিশেষ কোন কারন আছে, এটা মানতেই হবে। মুরুব্বিদের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। অধিকাংশ মুরুব্বিগণ বসে যখন এই কর্মসুচী নিয়েছেন নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন কল্যাণ আছে, এটাও বিশ্বাস করতে হবে।
* তৃতীয়ত: বেফাককে কেউ কেউ খুব ক্ষুদ্র আকারে ভাবতে শূরু করেছিলেন, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে কেউ কেউ স্বপ্ন দেখছিলেন, সরকারের কাছে এই ম্যাসেজ দিতে চাচ্ছিলেন, বেফাক মানে মাওলানা আব্দুল জব্বার, উনি ঘাপটি মেরে বেফাক দখল করে রেখেছেন। আজকের কর্মসূচীর মাধ্যমে এটা প্রমাণ করা যে, বেফাক মানে বাংলাদেশ। বেফাক মানে কওমী জগত। বেফাক মানে কওমীর আত্মা। বেফাক মানে বে-ফাঁক, এখানে কোন বিভেদ নেই, ফাঁক নেই। স্বীকৃতি দিতে চাও, তাহলে বেফাকের কাছেই আসতে হবে। কোন খেলা খেলতে চাও, তাহলে বেফাকের সাথেই তোমাদের আগামী দিনের খেলা হবে।
*চতুর্থত: কোন কওমী মাদ্রাসার স্বীকৃতির ব্যাপারে কেউ কেউ অন্য কোন ব্যানারকে সামনে আনতে চায়। বেফাককে পাশে ঠেলে দিতে চায়। গত সরকারের আমলেও এই কাজটি হয়েছে। হঠাৎ করে গজিয়ে উঠলো সম্মিলিত কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড। এই সাইনবোর্ড দিয়ে বেফাককে কোণঠাসা করে ফেলেছিল। সুযোগ নিয়েছিল সুযোগ সন্ধানী মহল। এইবার উলামায়ে কেরাম এটা পুর্ব থেকেই আঁচ করতে পেরেছেন। ফলে আজকের কর্মসচী, এর সাথে দেশের সব বড় বড় উলামায়ে কেরাম কিন্তু একমত। বেফাকের কর্মসূচীর বিষয়টি অনেকে গভীরভাবে অনুভব না করায় হয়তো কেউ কেউ প্রাথমিক বিরোধিতা করেছেন। ভিন্নমত দিয়েছেন। এটা কিন্তু বিরোধ নয়, কওমী অঙ্গনে ভাঙ্গনও নয়। শুধূমাত্র বুঝার ভিন্নতা, শুন্যতার কারনে ভিন্নমত দেওয়া।
* পঞ্চতম: দেশে একটি নতুন পরিভাষা, আক্রমনের নতুন ধারণা শুরু হয়েছে। জঙ্গীবাদ। দেশে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, ভয় সৃষ্টিতে একদল অপরিণামধর্মী মানুষ সশস্ত্র সংঘাত সৃষ্টি করতে চাচ্ছে, দেশের ভাবমূুর্তি ক্ষুন্ন করতে চাচ্ছে এর সাথে কারা জড়িত? এরা আসলে কারা? এই বিষয়টি খুব পরিস্কার না হলেও ইতিমধ্যেও দেশবাসী জেনে গেছে এরা কারা? কিন্তু একটি চতুর, ধুরন্ধর গোষ্ঠী এর দায়ভার দেশের কওমী মাদ্রাসা সমূহের উপর চাপিয়ে দিতে নানা কল্পকাহিনী ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর একটি যুৎসই প্রতিবাদ করা কওমী মাদ্রাসা সমূহের উপর দায়িত্ব হয়ে পড়েছিল। তারা দেশের মানুষকে, দেশের সরকারকে, আন্তর্জাতিক শক্তিকে এটা দেখাতে চায়- চলমান ইস্যুর সাথে দেশের কওমী মাদ্রাসার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। আলেম-উলামাগণ কখনই এ জাতীয় সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয়নি। অতীতেও দেয়নি। আগামীতেও দিবে না। দিতে পারে না। উলামায়ে কেরাম যুগে যুগে বাতিলের বিরোদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছে, জুলুমের বিরোদ্ধে প্রতিবাদ করে এসেছে, ইনসাফ কায়েমের লড়াইয়ে ত্যাগ ও কোরবানী করে এসেছে। কিন্তু এই যে, হঠাৎ করে নিরীহ মানুষ মেরে ফেলা, জনবসতিতে আঘাত করে রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়া, এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এরা ইসলামের কোন প্রকার প্রতিনিধিত্ব করে না। এরা মিসগাইডেড।
সুতরাং আজকের কর্মসূচীতে সমর্থন দিন, অংশগ্রহন করুন।
(২) সাইমুদ সাদী:
বেফাক নিয়ে মন্তব্য করার সময় সতর্ক হওয়া উচিত।
এই বক্তব্যের সাথে আমিও একমত। তবে ফেসবুকের কোন মন্তব্যের কারণে বেফাকের ক্ষতি হয়ে যাবে এই ধরণের ধারণারও কোন কার্যকর ভিত্তি আছে বলে মনে করিনা। বেফাক এত ভংগুর কোন ঘর নয় বলেই জানি।
কিন্তু এটা তখনই দুর্বল ও নড়বড়ে হয়ে যায় যখন বেফাকের ভিতরেই মত দ্বৈধতা, মত বিরোধিতা, ব্যাক্তি ও গোষ্ঠীগত প্রভাব বিস্তারের মত নাজায়েজ কাজের চর্চা শুরু হয়ে যায়।
এই কাজগুলো মনে হয় শুরু হয়ে গেছে অনেক আগেই। কোন কোন আকাবির যখন ওপেন প্রোগ্রামে বেফাকের বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলেন তখন তা ই মনে হওয়া অন্যায় নয়।
কিন্তু এইসব কাজের ব্রেক টানা উচিত। কারো কোন বক্তব্য থাকলে তার কথা শোনার মত সৎ সাহস বেফাকের থাকা উচিত। বলা উচিত কারো কোন অভিযোগ থাকলে বলুন আমরা সংশোধন হতে ও করতে প্রস্তুত।
আমার খুব মনে পড়ে আজ থেকে কয়েক যুগ আগে বেফাকে বিভিন্ন মাদ্রাসাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য হজরত মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেবের পরিশ্রমের কথা। পল্টনের বেফাক অফিসে প্রায়ই যেতাম উনার কাছে। তিনি গল্প শোনাতেন তার কর্মের ও পরিশ্রমের। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার।
ছাত্র মজলিসের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে নিয়ে আসতাম হুজুরকে। শর্ত দিতেন একটাই, এসব প্রোগ্রামের নিউজে তার নাম যেন না যায়।
বর্তমান এই সময়ে বেফাক নিয়ে একটা ধুম্রজাল তৈরি করার চেষ্টা চলছে মনে হচ্ছে। এর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সবাই যার যার কব্জায় নেয়ার চেষ্টা করছেন। চলমান নেতৃত্বকে বিতর্কিত করার চেষ্টাও চলছে।
চলমান নেতৃত্ব কোন নিস্পাপ কেউ নন। ভুলত্রুটির উর্ধেও নন। কিন্তু এজন্য বেফাককে ভাগ করে ফেলার মত কিছুই হয়নি।
সবই তো ভাগ করে ফেলেছেন আপনারা। মাদ্রাসা ভাগ করেছেন, দল ভেংগে টুকরো টুকরো করেছেন এই একটা প্রতিষ্ঠান নাহয় নাই ভাঙলেন।
আমি মনে করি বেফাককে রাজনীতির বাইরে রাখা উচিতই নয় জরুরী।
রাজনীতিতে আপনার কি করছেন, তাগুত এবং বাতিলকে উল্টাইয়া ফালাইছেন নাকি নিজেরাই উল্টাইয়া গেছেন সেটা পর্যালোচনার বিষয়। কিন্তু লক্ষ কোটি মুসলমানদের আশা ভরসার এই লাইট হাউস বেফাককে দয়া করে রাজনীতির উর্ধে রাখুন।
(৩) ওলীউল্লাহ আরমান:
‘সন্ত্রাস জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে একটা শিক্ষাবোর্ড কেনো মানববন্ধন করবে?’
প্রশ্নটা যদি এমন উঠে, তবে আমারও কিছু বলার আছে৷ নিজের আবেগ, বিবেক এবং অনুভূতি থেকে স্পষ্ট ভাষায় কিছু বলতে চাই আমি৷ কিন্তু ‘অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’ দাবীদার আমাকেও মাঝে মাঝে জড়তা গ্রাস করে৷ ‘করিতে পারি না কাজ, সদা ভয় সদা লাজ, সংশয়ে সংকল্প সদা টলে, পাছে লোকে কিছু বলে’ টাইপের দ্বিধা মিশ্রিত ভাবনা আমাকেও বাকরুদ্ধ করে দেয়৷
শেষ পর্যন্ত বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া অন্তর্ভূক্ত একটি দাওরায়ে হাদীস মাদরাসার শিক্ষকহিসেবে আমিও ইনশাআল্লাহ আগামিকাল ১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০-১১টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য মানববন্ধন কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশ নিবো৷ শুধু অংশ নিবো বললে ভুল হবে৷ বরং চোঙ্গা ফোঁকানোর অতীত অভিজ্ঞতার কারণে মানববন্ধনে আমাদের জামিয়ার অংশগ্রহণের ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করবো৷
যদিও এই প্রোগ্রামে খিলগাঁও এলাকায় অবস্থিত ছোট্ট মাদরাসার নামোল্লেখ করা হলেও অজ্ঞাত কারণে নতুনবাগ মাদরাসার নাম আসেনি৷ যাইহোক, ‘এটা দ্বীনি ইস্যু, এটা নিয়ে রাজনীতি নয়’ আমরাও বড়দের এমন কথার সাথে একমত হয়ে নির্দিষ্ট স্পট তথা মালিবাগ রেলগেট থেকে রামপুরা ব্রীজের মধ্যবর্তী স্থানে থাকবো৷
ছোটবেলায় বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলের মুখে ‘পঞ্চম বাহিনী’ বলে কোনো এক স্বার্থান্বেষী মহলের নাম শুনতাম৷ মনে হচ্ছে এখন দ্বীনি এবং ইসলামী অঙ্গনেও ‘পঞ্চম বাহিনী’র উদ্ভব ঘটেছে৷