ড. আহমদ আবদুল কাদের বাচ্চু
তুরস্কে ১৫ জুলাইয়ের সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা, প্রেসিডেন্ট এরদোগানের আহ্বানে জনগণ কর্তৃক অভ্যুত্থান প্রতিরোধ ও তাকে ব্যর্থ করে দেয়া ইত্যাদি বিষয় বিশ্ব মিডিয়ায় খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিগত ৫৬ বছরে সামরিক বাহিনী কয়েকবার সরাসরি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, কয়েকবার চাপ সৃষ্টি করে নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটিয়েছে। তুরস্কেও সেনাবাহিনী মূলত কামাল পাশার নেতৃত্বে মিত্রশক্তির মোকাবেলায় তুরস্কের স্বাধীনতা রক্ষার অবদানের সুবাদে অটোমান সুলতানকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিল। তিনি ক্ষমতায় বসেই খেলাফত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে তুরস্কের ৬০০ বছরের ইসলামি ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে সেখানে কট্টর এক ধর্মহীন রাষ্ট্র কায়েম করেন। এসব করতে গিয়ে তিনি মানবাধিকারের কোনো তোয়াক্কা করেননি। নামে ‘প্রজাতন্ত্র’ হলেও সেখানে কায়েম করেন একদলীয় স্বৈরাচারী ব্যবস্থা। কামাল পাশার মৃত্যুর আট বছর পর ১৯৪৬ সালে তুরস্কে বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু কামাল সেনাবাহিনীকে এমনভাবে গড়ে তোলেন যে, সেনাবাহিনী মূলত উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্মহীনতার অভিভাবক ও পাহারাদারে পরিণত হয়। কামালবাদী নীতি যতই গণবিরোধী হোক, তা পরিবর্তনের উদ্যোগ তো দূরের কথা, এজাতীয় ইচ্ছা প্রকাশকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। সমাজের সর্বত্র পাশ্চাত্যপন্থী গণবিরোধী এলিট সৃষ্টি হয়, যারা জনগণের ওপর তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পশ্চিমাপন্থী নীতি চাপিয়ে দেন। এমনকি, যেসব বিষয় পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থায় কাক্সিক্ষত না হলেও অধিকার হিসেবে স্বীকৃত, সেসব বিষয়ও তুরস্কে নিষিদ্ধ করা হয়। বস্তুত সেনাবাহিনী তুরস্কের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। সেনাবাহিনী ‘প্রয়োজন’ মনে করলে একটি নির্বাচিত সরকারকে সহজেই উৎখাত করতে পারত।
১৯৫০ সালে তুরস্কের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বহু দলভিত্তিক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনে জেলাল বেয়ার ও মেন্দারিস আদনানের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ৪৮৭ আসনের মধ্যে ৪০৭টি আসন পেয়ে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। পরপর তিনবার দলটি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। তৃতীয় মেয়াদের সময় ১৯৬০ সালের ২৭ মে সেনাবাহিনীর অপেক্ষাকৃত তরুণ অফিসারেরা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে একটি নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটায়। শেষ পর্যন্ত জেনারেল জামাল গোরসেলের নেতৃত্বে সামরিক সরকার গঠিত হয়। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয় সেকুলার রীতির কিছু ব্যত্যয় ঘটার অভিযোগে এবং কামালবাদী নীতি রক্ষার কথা বলে।
সামরিক জান্তা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জনসমর্থিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দারেস এবং তার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে ফাঁসিতে ঝুলায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেলখানায় আত্মহত্যা করেন। অশীতিপর প্রেসিডেন্ট জেলাল বেয়ারকে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। পরে পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। তা ছাড়া সামরিক জান্তা ২৩৫ জন জেনারেল এবং তিন হাজার কমিশন্ড অফিসারকে পদত্যাগে বাধ্য করে। ৫০০-র বেশি বিচারপতি এবং ১৪০০ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে। কামাল পাশার এককালের সহকর্মী জেনারেল ইসমত ইনোনুর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয় জান্তার নিয়ন্ত্রণে।
১৯৬৫ সালে সাধারণ নির্বাচনে সুলেমান ডেমিরেলের জাস্টিস পার্টি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ১৯৬৯ সালের নির্বাচনেও তার দল বিজয়ী হয়। ১৯৬০ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। প্রধানত বামপন্থীরা সর্বত্র বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। সন্ত্রাস, সহিংসতা ও অরাজকতা দিন দিন বেড়েই চলে। প্রতিক্রিয়ায় কট্টর জাতীয়বাদীরাও পাল্টা সন্ত্রাস শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ১২ মে সামরিক বাহিনী প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি পেশ করে- যেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দাবি জানানো হয়, অন্যথায় সামরিক বাহিনী তার ‘সাংবিধানিক কর্তব্য’ পালনে বাধ্য হবে বলে হুঁশিয়ারি দেয়। প্রধানমন্ত্রী ডেমিরেল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পদত্যাগ করেন। সামরিক বাহিনী নেপথ্যে থেকে বেসামরিক লোকদের দিয়ে একটি সরকার গঠন করে। এটি এমন এক সরকার, যা নির্বাচিত ছিল না আবার সরাসরি সামরিক সরকারও নয়। ছিল মূলত সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার। কার্যত সেনাবাহিনীই সব কিছু পরিচালনা করত।
১৯৭১-এর সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার পরিস্থিতি উত্তরণে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সুলেমান ডেমিরেল আবার কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। তবে সরকার পরিস্থিতি উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। দেশে ডান-বাম সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ বেড়েই চলে। গুম, খুন ইত্যাদি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এ পরিস্থিতিতে ১৯৮০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জেনারেল কেনান এভরানের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। সামরিক জান্তা পার্লামেন্ট, সংবিধান সবই বাতিল করে। নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও রেফারেন্ডামের মাধ্যমে তা অনুমোদন করা হয়। এ সামরিক অভ্যুত্থানের সময় সাড়ে ছয় লাখ লোক গ্রেফতার হয়, দুই লাখ ৩০ হাজার লোকের ‘বিচার’ করা হয়, সাত হাজার লোকের মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ করা হয়; ৫১৭ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এর মধ্যে ৫০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তা ছাড়া প্রায় তিন লাখ লোককে পাসপোর্ট পাওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, ৩০ হাজার লোককে চাকরি থেকে পদচ্যুত করা হয়, আরো প্রায় ৩০ হাজার বিদেশে পালিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এক কথায়, সামরিক জান্তা শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে গণহারে মানুষের ওপর ব্যাপক জুলুম চালায়। ১৯৮৩ সালে নতুন সংবিধানের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে মাদার পার্টির তুরগুত ওজাল বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রফেসর নাজমুদ্দিন আরবাকানের রেফা পার্টি প্রধান দল হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ট্রুপাথ পার্টির সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। আরবাকান প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু নির্বাচিত হলেও একজন ইসলামপন্থী প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব সেনাবাহিনী মানতে প্রস্তুত ছিল না। ১৯৯৭ সালে তার কাছে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মেমোরেন্ডাম দেয়া হয়। তদুপরি পদত্যাগের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। প্রবীণ নেতা আরবাকান শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে সাংবিধানিক আদালতে তার দল নিষিদ্ধ হয় এবং বয়োবৃদ্ধ আরবাকান নিজে রাজনীতিতে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলেন।
একেপির সরকার গঠন
২০০২ সালের সাধারণ নির্বাচনে রজব তাইয়েব এরদোগান ও আবদুল্লাহ গুলের নতুন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা একেপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এরদোগান ধর্মীয়ভাবাপন্ন এক কবিতা পড়ার কথিত অপরাধে তাকে ছয় মাসের জন্য জেলে যেতে হয়। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একেপি সরকার আবদুল্লাহ গুলকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করলে জেনারেলরা বেঁকে বসেন। কারণ গুলের স্ত্রী হিজাব পরেন। একেপিকে নিষিদ্ধ করা যায় কি না এ নিয়ে সাংবিধানিক আদালতে মামলা করা হয়। সামান্য ব্যবধানে একেপি নিষিদ্ধ হওয়া থেকে বেঁচে যায়। একেপি তখন গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের প্রধান প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনীকে কী করে বেসামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং তাদের ক্ষমতাকে কী করে খর্ব করা যায়, সেসব বিষয়ে কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। দশ বছরের চেষ্টায় একেপি সরকার সেনাবাহিনীতে ব্যাপক সংস্কার করতে সক্ষম হয়েছে।
আগে সামরিক বাহিনী তাদের নিজস্ব ব্যাপারে পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত ছিলÑ পার্লামেন্টের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। একেপির শাসনামলে সামরিক ব্যয় অংশত সরকারি হিসাব ও অডিট বিভাগের তত্ত্বাবধানে আনা হয়। সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা শিল্পকারখানার তহবিলের ব্যাপারে অধিকতর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (MGK) এমন কতগুলো নিয়মকানুন ছিল, যা বেসামরিক সরকারের কাছে গোপন থাকত। সেসব অপ্রকাশিত নিয়মকানুন বিলুপ্ত এবং এর নির্বাহী ক্ষমতা খর্ব করা হয়। ২০০৪ সালে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মহাসচিব পদে প্রথমবারের মতো বেসামরিক ব্যক্তি নিয়োগ করা হয়। এর আগে এটি সামরিক বাহিনীর লোকের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তথাকথিত EMASYA প্রটোকল যার আওতায় ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। এটি অনুভূত হলে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ তথা ক্ষমতা দখল করতে পারবে’- এ প্রটোকল বাতিল করা হয়। ২০১১ সালে সুপ্রিম মিলিটারি কাউন্সিলের (YAS) সভায় প্রথমবারের মতো টেবিলের শীর্ষপ্রান্তে একাই বসে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী এরদোগান। এর আগে প্রধানমন্ত্রী সামরিক বাহিনীর প্রধানের পাশে বসতেন। তার এ পদক্ষেপ ছিল কার্যত সামরিক বাহিনীর অবাঞ্ছিত মোড়লিপনার ইতি টানা।
স্মরণাতীতকালের সর্বাধিক ভোট পেয়ে ২০১১ সালে একটানা তৃতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়ে একেপি সরকার গঠনের পরপরই আর্মি চিফ অব স্টাফ পদত্যাগ করেন। একই দিনে সেনাবাহিনী প্রধান, নৌপ্রধান ও বিমানবাহিনী প্রধানও অবসরে যাওয়ার আবেদন জানান। বিশ শতকের সেনাবাহিনীর একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসান ঘটে একুশ শতকের প্রথম এক যুগের একেপি শাসনের মাধ্যমে। তবে এবার ১৫ জুলাই সেনাবাহিনীর একটি অংশ শেষ কামড় দেয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরদোগানের আহ্বানে প্রতিরোধে নেমে আসে জনতা, ব্যর্থ হয়ে যায় সামরিক অভ্যুত্থানের শেষ চেষ্টা। বিজয় ঘটে গণতন্ত্রকামী জনতার। প্রমাণ হলো এরদোগানের নেতৃত্বে দেশের জনগণ এমন এক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অধিকারী হয়েছে, দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনী দেশের নেতৃত্ব দখলের চেষ্টা করবে এটা কোনোক্রমেই তারা আর মানতে রাজি নয়।
এভাবেই দশ বছরে এরদোগান সরকার তুরস্কের চরম শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি দেশের জনগণকেও এ কাজে সম্পৃক্ত করেন, যারা নিজের জীবন দিয়ে হলেও সেনা-অভ্যুত্থান প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করেছে। তুরস্কের সেনাবাহিনী ন্যাটো জোটের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম (যুক্তরাষ্ট্রের পর) এবং সারা বিশ্বের অষ্টম শক্তিশালী বাহিনী। সে বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করা সহজ ছিল না। তদুপরি তুরস্কের স্বাধীনতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর কৃতিত্বপূর্ণ অবদান এবং প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর থেকে বিশ শতকের পুরো আট দশক একচেটিয়া ক্ষমতা ও সুবিধাভোগী একটি বিশাল বাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে আনা মোটেও সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। এরদোগানের নেতৃত্বাধীন একেপি সরকার এ অসাধ্য কাজই সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। জনগণের সত্যিকার সমর্থনপুষ্ট সরকারের পক্ষেই এমন কঠিন ভূমিকা পালন করা সম্ভব।
অবশ্য এখনো সেনাবাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কাজটি পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। আশা করা যায়, ১৫ জুলাইয়ের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে বাকি কাজটিও সম্পন্ন হবে।