বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সন্ধ্যা ৭:০৩
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদ করে শহীদ হয়েছেন যে মাওলানা

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদ করে শহীদ হয়েছেন যে মাওলানা

বঙ্গবন্ধুর অন্য জীবন- পর্ব ৭

Bangobandhu7সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ : ’৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে ক’জন সাহসী সন্তান প্রাণ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে একাত্তরের গেরিলা কমাণ্ডার মাওলানা সৈয়দ আহমদ অন্যতম। বঙ্গবন্ধুপ্রেমি এই সাহসী বীরই হলেন ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যার’ প্রথম প্রতিবাদকারী । তিনিই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারীদের মাঝে প্রথম শহীদ।

তিনি ১৯৬৫সালে চট্টগ্রামের পুঁইছড়ি ইসলামিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে আলেম হন। এর ভিতরে তিনি স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় পাশ করে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হন। (বর্তমান সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) সেই সময় ছাত্রলীগের ঘাটি হিসেবে পরিচিত ছিল কলেজটি। সিটি কলেজ থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। ১৯৬৮ ও ৬৯ এর গণআন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহনের মাধ্যমে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সম্মুখ সমরের জন্য গড়ে তুলেন নিজেস্ব গেরিলা বাহিনী। চট্টলার আঞ্চলিক ভাষায় মানুষের কাছে এই বীর মৌলভী সৈয়দ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। চট্টগ্রামের রাজনীতির ইতিহাসের এক আলোকবর্তিকা। বাংলাদেশের বিরত্বের ইতিহাসে সৈয়দ একটি অনুপ্রেরণার সাহসী আদর্শ।

লালদিঘীর মাঠে জয় বাংলা বাহিনীর মার্চপাস্ট অনুষ্ঠিত হল। পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো হল। শহীদ মাও সৈয়দ আহমদ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। সৈয়দ আহমাদ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম গেরিলা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন। তিনি ছিলেন তুখোর বক্তা। তার বক্তৃতা শুনে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্ভেলিত হতো সাধারন মানুষ। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন দুর্ধর্ষ একটি গোপন স্কোয়াড। তার দল সৈয়দ বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। এই মহান বীরের নেতৃত্বে অন্তত অর্ধশত বড় বড় সফল অপারেশন সংঘটিত হয়েছে। ৭১ -এর মার্চ মাসে সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় বেসামরিক বাহিনী “জয় বাংলা বাহিনী”। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই ধারাটি সংযোজিত হওয়া প্রযোজন যাতে আগামীর প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারে।

প্রয়াত জননেতা জহুর আহম্মেদ চৌধুরীর কাছে রাজনৈতিক দীক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য লাভ করেন তারা। বঙ্গবন্ধুর বিশস্থ ও আস্থাভাজন কয়েকজন নেতার মধ্যে অন্যতম। তিনি সৈয়দ আহমকে পুত্রসম স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু তাকে “আমার মৌলভী সাব” বলে ডাকতেন। চট্টগাম সফরে গেলে সৈয়দকে সাথে রাখতেন সব সময়। মাঝে মধ্যে ঢাকাতে খবর দিয়ে আনতেন। তার বীরত্ব ও সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।

৭১ রণাঙ্গনের সাহসী এই বীরযোদ্ধা গেরিলা যুদ্ধের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।৭৫ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের স্ব- পরিবারের নিহত হওয়ার ঘটনাকে তাই স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর এই সহচর। আওয়ামীলীগের বাঘা বাঘা নেতারা যখন ভয়ে চুপসে গিয়েছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে মৌলভী সৈয়দ সশ্রস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। শুরু করেছিলেন গোপন মিশন। সফল ভাবে কয়েকটি সফল অপারেশনও পরিচালনা করেছিলেন। ঘাতকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। ৭৫ এর ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদ মোশারফের পক্ষে ঢাকার সমাবেশের অন্যতম উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন এই বীর আলেম।

৭ নভেম্বর পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে যখন খালেদ মোশারফ নিহত হন তখন মৌলভী সৈয়দ, এ.বি.এম মহিউদ্দীন চৌধুরী সহ পুরো দলটি ভারতে আশ্রয় নেন। ১৯৭৬ সালের ৭ নভেম্বর দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মৌলভী সৈয়দ কে ১ নং ও এ.বি.এম মহিউদ্দীন চৌধুরীকে ২ নং আসামী করে মোট ১৬ জন বিপ্লবী নেতা কর্মীকে মামলা-১, মামলা-২,মামলা-৩ নামে পরিচিত ৩ টি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে ভারতে জাতীয় নির্বাচনে ইন্ধারী গান্ধির দল পরাজিত হলে মৌলভী সৈয়দ ও সহকর্মীদের ভারতীয় পুলিশ বাহিনী আটক করে ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে পুশব্যাক করে। বাংলাদেশের সীমানার প্রবেশের সাথে সাথে সেদিন মৌলভী সৈয়দ সহ তার অনেক সহকর্মী বাংলাদেশের পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে তাদের ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের জায়েন্ট ইন্টারগেশন সেলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়।ঐ বছরের ১১ আগষ্ট বিনা বিচারে মৌলভী সৈয়দকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।

পরবর্তীতে সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে তার লাশ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করে দীর্ঘ ১ মাস পুলিশ দিয়ে কবর পাহাড়া দেয় সামরিক সরকার।যাতে করে জনগণ এই হত্যার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে না পারে। শহীদ মৌলভী সৈয়দ বীরের পূর্ন্যভূমি চট্টলার বীর পুরুষ ছিলেন। অসামান্য দেশপ্রেমের অধিকারী এই বীর পুরুষটির ব্যাক্তিগত জীবন উৎসর্গ
করেছিলেন দেশ সেবায়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভালবাসা ছিল নজিরবিহীন। চট্টগ্রামের বাশখালিতে চির নিদ্রায় কবরে শুয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু প্রেমি শহীদ মৌলভী সৈয়দ।

লেখক : চিকিৎসক, ঔপন্যাসিক ও গবেষক

তথ্যসূত্র:
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একাত্তরের
ডাইরী।
মুক্তিযোদ্ধা রবিউল হোসেন সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ
আমার সাধনার দেশ’।
ড: এ, আর, মল্লিকের মুক্তিযুদ্ধের সৃত্মিকথা।
ক্যাপ্টেন শমসের মুবিন চৌধুরীর একাত্তরের
ডাইরী।
‘রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক’, সাখাওয়াত হোসনে মজনু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, ৯ম
খন্ড।
আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, শাকের হোসাইন শিবলী পৃষ্টা২৩৩।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

আদালতের ওপর বিশ্বাস ভেঙে গেছে: সায়্যিদ মাহমুদ মাদানী

নাজমুল মনযূর: আদালতের ওপর বিশ্বাস ভেঙেছে ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা সেই মুসলমানদের। এমন কথাই ...