২। প্রথম থেকেই দারুল উলুম দেওবন্দের নিয়ম ছিলো পবিত্র কোরআন সমাপ্ত করার পর আরবি পড়া শুরুর আগে ছাত্রদের জন্য পাঁচ বছরের একটি কোর্স ছিলো। এর নাম ছিলো। নার্সারী ও ফার্সী কোর্স। এস্তরে উর্দু, ফার্সী, ধর্ম শিক্ষা, তাজবীদ, অঙ্ক, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে একজন আলেমের জন্য যতটুক মৌলিক ধারণা প্রয়োজন ততটুক শিক্ষা দেয়া হতো। তা ছাড়া কোনো কারণ বশতঃ যদি কেউ এখানেই শিক্ষা সমাপ্ত করতে বাধ্য হয়, তবে ইহকাল ও পরকালের প্রয়োজনীয় এতটুকু মৌলিক জ্ঞান অর্জিত হয়ে যেতো যে, সে একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে সুন্দর জীবন যাপন করতে তাকে কোনো বেগ পেতে হতো না। এ কোর্স আরবি ও ইসলামি জ্ঞানের জন্য সুদৃঢ় ফাউন্ডেশনের মতো বিশেষ উপকারী ছিলো। এ কোর্স সমাপ্ত করে ছাত্ররা যখন আরবি ও ইসলামি শিক্ষাস্তরে পৌঁছত তখন তাদের উর্দু ফার্সিতে লেখা ও প্রবন্ধ নির্মাণের যথেষ্ট যোগ্যতা হতো,, যা তাদের আরবি ও ইসলামি জ্ঞান অর্জনে প্রচুর সহযোগিতা করতো। এ কোর্স মাদরাসাগুলোতে দীর্ঘদিন যাবত হয়তো সম্পূর্ণ বন্ধ বা হ্রাস পেতে পেতে একবছরের শিশু শ্রেণীতে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। যার ফলে ছাত্ররা যখন আরবি ও ইসলামি শিক্ষা স্তরে পদার্পণ করে তখন সাধারণতঃ তার লেখা অসুন্দর, বা বানানে ভুল, রচনায় অযোগ্যতা , মৌলিক বিষয়ে দুর্বলতা থেকে যায়। আর এত অল্প সময়ে ব্যাকরণ, সাহিত্য, ফেকাহ প্রভৃতি বিষয়ে পরিপূর্ণ বোঝার এবং তা আয়ত্ত করার যোগ্যতাও হয় না। এসব বিষয় তার কাছে প্রচণ্ড কঠিন মনে হয়। ভিত্তি মূলেই যখন দুর্বলতা ও অপরিক্কতা দিয়ে সূচনা হয় পরবর্তী স্তরগুলোতে তা বিরাট প্রভাব ফেলে। এজন্য আমাদের দৃষ্টিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলো, দারুল উলুম দেওবন্দের উল্লিখিত নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিক শ্রেণীর মেয়াদকাল আরো বৃদ্ধি করা হোক। এবং উর্দূ, [বাংলা] ধর্ম শিক্ষা, নবীজীবনী, তাজবিদ, অঙ্ক, জ্যামিতি ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে এতটুকু শিক্ষা দেওয়া হোক, যা পরবর্তী বিষয়াবলী বুঝতে সহায়ক হবে।
৩। নেজামী শিক্ষা পদ্ধতিতে (দরসে নেজামীতে ) ইতিহাসকে যথারীতি একটি বিষয় হিসাবে সিলেবাসে এই জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি যে, ছাত্রদের অধ্যয়ন করার যোগ্যতা ও স্পৃহা সৃষ্টি হলে ব্যক্তিগত অধ্যয়নের দ্বারাও তা সহজে আয়ত্ত করা সম্ভব। কিন্তু এখন বাস্তব অভিজ্ঞতা হল এই যে, ছাত্রদের ব্যক্তিগত অধ্যয়নের অভিরুচি দিন দিন বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। এই জন্য আরবি শ্রেণীগুলোর পাঠ্যসূচীতে ইতিহাস ও সিরাতকে একটি বিষয় হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করা সঙ্গত হবে বলে মনে হয়।
৪। অনুরূপ ‘তাছাউফ’ বা আধ্যাত্মিক বিদ্যা এজন্য সিলেবাস বহির্ভূত ছিল যে, মাদরাসার পুরো পরিবেশই আত্ম ও চরিত্র শুদ্ধির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। আর অবসশিষ্টাংশ নিজেস্ব অধ্যয়ন এবং কোন আধাত্মিক পথ নির্দেশকের সাথে সম্পর্কের দ্বারা পূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু এখন এসম্পর্কৃত কিতাবগুলোও সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে মনে হয়। যেমনঃ- ইমাম গাজ্বালির ‘হেদায়েতুল হেদায়া’ “আরবাঈন” এহয়াউল উলূমের নির্বাচিত কিছু অংশ ইমাম সাহরাওয়ার্দীর ‘আওয়ারেফূল মাআরেফ’ হাকীমূল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ)-এর ‘তাকাশশুফ’ এবং তাশাররুফ বিভিন্ন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
৫। একজন আলেমের জন্য উচিত ইসলামের সাথে যেসব ধর্মমতের সরাসরি সংঘাত দীর্ঘ দিন হতে চলে আসছে এবং স্থানে স্থানে তাদের প্রচার সংস্থাগুলো পূর্ণোদ্যমে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে এবং মুসলমানদের মধ্যে যেসব উপদল বিশেষ দর্শন ও মতাদর্শ নিয়ে নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করে, এসবের মূল চিন্তাধারা ও আকীদা বিশ্বাস সম্পর্কে মোটামোটি ধারণ অর্জন করা। যেন প্রয়োজনের মুহূর্তে তাদের মোকাবেলা করতে পারে। এজন্য সিলিবাসে “ধর্ম ও দর্শন” নামে পৃথক একটি বিষয়ের সংযোজন করা উচিত। এ বিষয়ে সেসব ধর্ম ও গোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, তাদের মৌলিক চেতনা বিশ্বাস এবং সেসবের অসারতা প্রমাণে মূল দলিল পড়ানো হবে যাদের সাথে উপমহাদেশের মুসলমানদের মুখোমুখি হতে হয়। যেন তাদের সম্পর্কে প্রত্যেক ছাত্রের প্রয়োজনীয় সংক্ষিপ্ত ধারণা অর্জন হয়ে যায়। এবং যারা পরবর্তী কোন সময় এসব ধর্ম ও মতের কোন একটির উপর বিশেষ গবেষণাধর্মী কাজ করতে চায় এ সংক্ষিপ্ত ধারণা যেন তাদের জন্য ভিত্তি প্রস্তরের মত কাজ দেয়।
মূল : আল্লামা তকি উসমানি
ভাষান্তর : কাজী মোহাম্মদ হানিফ
শাইখুল হাদিস, জামিয়া আরাবিয়া মারকাজুল উলুম, কাঁচপুর, নারায়ণগঞ্জ