সৈয়দ শামছুল হুদা::
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এখন আর কোনো ব্যক্তি নন। একটি প্রতিষ্ঠান। এমন প্রতিষ্ঠান যার বিশালতা একটি জাতিগোষ্ঠির অগ্রসরমানতার প্রতীক। এ প্রতিষ্ঠানের এক একটি দিক এক একটি গ্রন্থ রচনার দাবি করে। এ হিসেবে খান সাহেবের জীবন এক সুবিশাল গ্রন্থাগার হয়ে উঠেছে। এ গ্রন্থাগার খুবই সমৃদ্ধ। খুবই গৌরবোজ্জল। যা একটি যুগের মহিমাময় শিরোনাম হতে পারে কিংবা হতে পারে ইতিহাসের উজ্জল কোনো লকেট। যার দিকে তাকিয়ে কালান্তরের
প্ররিব্রাজক সহসা বলে উঠবে- হ্যাঁ, ঐ তো খান সাহেবের যুগ, মাসিক মদীনার যুগ!
সেই যুগের ভ্রুণ তৈরী হয়েছে যে প্রেক্ষাপটে, তা উদঘাটন করতে হলে মুসলিম সভ্যতার বিপর্যয়কর শতাব্দীর ভেতর খনন কাজ করতে হবে। আমরা সে দিকে না গিয়েও এতটুকু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে খান সাহেবের বিকাশের সময়টায় উপমহাদেশের চরম সমস্যা সংকুল পরিস্থিতি। এদেশ শাসন করছে উপনিবেশবাদী ইংরেজরা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের দু:শাসনে এদেশে যে সর্বনাশ হয়ে গেছে, তার কূল-কিনারা করাটাও হয়ে উঠেছে দু:সাধ্য। এদেশের জনগণ হয়েছে দুর্বিষহ নির্মমতার শিকার। মুষ্ঠিমেয় হিন্দু মধ্যবিত্ত ছাড়া গোটা ভারত উপমহাদেশ উৎপীড়িত মানুষের দূর্গত নি:শ্বাসে কম্পমান। সবচে দূর্দশা ঘটে গেছে মুসলমানদের উপর। তাদের অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সমাজিক নিরাপত্তা ও স্বপ্ন- সম্ভাবনার মেরুদন্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। শিক্ষাহীনতার অভিশাপে জর্জরিত, দারিদ্রের চাবুকে ক্ষত-বিক্ষত, নির্যাতনের পাথর চাপায় নিপিষ্ট ও সংস্কৃতির রক্তশূন্যতায় বিপর্যস্ত জাতীয় মুসলিম জীবন। মুসলিম প্রজাসাধারণ তখন হিন্দু জমিদারদের কাছে হালের বলদের চেয়েও তুচ্ছতর। এবং সন্দেহ নেই সেই প্রজাদের মধ্যে খান সাহেবের ভাগ্যাহত বাপ-দাদারাও ছিলেন। সেই পরিস্থিতি থেকে একটি জাতির ঘুরে দাড়ানো বিশাল এক রেঁনেসা সংগঠিত হওয়া ছাড়া সম্ভব ছিলোনা মোটেও।
মুসলিম জীবনে সেই রেনেসার হাওয়া লাগলো। কিন্তু বড় বেশি গৌনভাবে। সামগ্রিক বিক্রমে নয়, পরিপূর্ণ শুস্থতায় নয় কিংবা নয় আমূল রূপান্তরের প্রক্রিয়ায়। জাগরণের ঢেউটা মূলত উঠলো রাজনীতিতেই। এবং তারই সফেন তরঙ্গরাশী আছড়ে পড়লো সংস্কৃতিতে, জীবনবোধে, সামগ্রিক চেতনাধারায়। সেই আছড়ে পড়া তরঙ্গ প্রাণশক্তির অভাবে ছিলো ম্রিয়মান, নেতৃত্বের লক্ষ্যহীনতায় ছিলো দুদুল্যমান, চিন্তার অস্থিরতায় ছিলো বীর্যহীন এবং আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারের দুর্বলতায় ছিলো ভঙ্গুর। কিন্তু তারপরও গণজাগরণের তীব্রতা প্রধানত রাজনীতিকে করলো উত্তাল, যার ধাক্কা সামলাতে না পেরে ব্রিটিশ ভাগলো দেশ ছেড়ে। স্বাধীন হলো ভারত-পাকিস্তান। মাওলানা মুহীউদ্দীন খান ছিলেন এই গোটা প্রক্রিয়ার বিশ্বস্ত দর্শক ও মর্মস্পর্শী স্বাক্ষী।
উল্লেখিত সব দুর্বলতা নিয়ে জাতী স্বাধীন হলো তো সত্য। কিন্তু নৈতিক ও মানসিক গোলামী থেকে স্বাধীন হতে পারলোনা। বিশেষ করে মুসলিম জাতীয় জীবনে- তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস- আদালত, হাট-বাজার, সভা-সমিতি, ঘর-বাড়ী এমনকি তাদের আপন দেহ পর্যন্ত স্বাক্ষ্য দিতে লাগলো- না আমরা স্বাধীন নই। আমাদের উপর পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতি ও হিন্দুয়ানী চিন্তাধারা ও শিল্পসাহিত্য
পুরোমাত্রায় কর্তৃত্বশীল। মুসলমানী মগজ দিয়ে এদেশের মানুষ চিন্তা করতে পারছেনা, মুসলমানী মুখ দিয়ে কথা বলতে পারছেনা, মুসলমানী চোখ দিয়ে দেখতে পারছেনা। বরং বিজাতীয় নির্দেশিত পথই অনুস্বরণ করছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আর ইসলাম নিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিকরা খেলছেন জোয়া। তারা স্বার্থের বেদিতে ইসলামকে বলি দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। অনাচার করছেন নিজেরা, আর এর পক্ষে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন ইসলামকে। এর মূল কারণ, তারা ইসলামের জীবনদর্শনকে আত্মস্ত করতে পারেন নি। এবং সাংস্কৃতিক ভাবে একীভূত হতে পারেন নি ইসলামের মর্মবাণীর সাথে। বরং তারাও ছিলেন বিজাতীয় সংস্কৃতির গোলাম। তাদের মগজের উপর চেপে বসেছিলো ভিন্নতর সংস্কৃতির দু:শাসন।
এই গোটা পরিস্থিতি মাওলানা মুহীউদ্দীন খানকে এ পয়গাম দিলো- জ্ঞান-সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে ইসলামের সত্যিকার প্রতিফলন না ঘটলে রেঁনেসার কোনো প্রচেষ্টাই এই জাতীর সত্যিকার স্বাধীনতা এনে দিতে পারবেনা। প্রথমত চিন্তাধারা ও শিল্পসাহিত্যের সংযোগ ঘটাতে হবে ইসলামের সাথে। এবং এর মাধ্যমে মস্তিস্ক থেকে দখলদার চিন্তাধারা কে বিতাড়িত করতে হবে। জীবনের মাঠে পরাজিত করতে হবে একে। ইসলামের সাথে বিশ্বাস ও আবেগের সংযোগকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিভূমিকে বলিষ্ট করে জাতীয় জীবনের আলোকায়ন যখন খান সাহেবের লক্ষ্যে, তখন তিনি ইসলামী সভ্যতার গোটা জ্ঞান ভান্ডারের দিকে হাত বাড়ালেন। এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী যে জ্ঞান ও হেকমতের চর্চা হয়েছে, তাকে যথাসম্ভব এদেশের মর্মমূলে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তিনি পালন করতে লাগলেন দূতের ভূমিকা। খোলে দিলেন নতুন চিন্তা ও সাহিত্যের অভিনব চ্যানেল। এক্ষেত্রে তিনি প্রাধান্য দিলেন শিক্ষামূলক সাহিত্যকে। যেহেতু সেই সময় বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠির আত্মগত পাঠসামগ্রি ছিলো নিতান্তই অপ্রতুল, অতএব খান সাহেব ভাবলেন শিক্ষিত মুসলমানদের হাতে তুলে দিতে হবে পাঠসামগ্রি। যা মূলত সভ্যতার বারুদ ও জাতীয় জাগরণের দিশারী। যা না হলে তারা নিজেদের দ্বীনকে চিনবেনা, নিজেদের সংস্কৃতিকে চিনবেনা, নিজেদের জাতিসত্তাকে অনুভব করবেনা। সে প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন জাতির গোলাম থেকে যাবে। এবং নিজের আত্মপরিচয়কে পদদলিত করতে থাকবে নিজের আচরণে।
অতএব আলোটা জ্বালাতে হবে একেবারে তৃণমূলে, একেবারে ব্যক্তির সুগহীন সত্তায়। খান সাহেব তাই আরবী-ফার্সী- উর্দূ থেকে দ্বীনী গ্রন্থাবলী অনুবাদ করতে লাগলেন। কেবলই তা জাতির অনুভবে আলো ফেলার জন্যে। কেবলই জাতিকে দৈনন্দিন কর্মসূচীর প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য। ফলত একেবারে সহজ-সরল অনাড়ম্বর এক ভাষারীতি তাকে আবিস্কার করতে হয়েছে। যাতে উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয় এবং শিক্ষামূলক ধর্মীয় রচনাবলী গণসাহিত্য হয়ে উঠে। কারো জন্যই তা দুর্বোধ্য না ঠেকে। খান সাহেবের এ প্রয়াস ব্যর্থ হলে লক্ষ্যের দিকে তিনি এগুতে পারতেন না। প্রকৃত কৃতীত্ব তার অর্জিত হতোনা। হয়তো উন্নত সাহিত্য তৈরীর কৃতীত্ব তাকে কেউ কেউ দিতো, কিন্তু গণসাহিত্যের পথ ধরে জাতীয় রেনেসার সুবাতাস প্রবাহে তার অনস্বীকার্য অবদান ও গৌরবময় অর্জনের মহাকাব্য রচিত হতোনা। সবচে প্রয়োজনীয় এবং নিত্যকার প্রয়োজনীয় প্রতিটি প্রেক্ষাপটে খান সাহেব ইসলামের পথনির্দেশ সম্বলিত গ্রন্থরাজি নিয়ে হাজির হলেন চরম দারিদ্রময় সময়ে। জাতি তার কাছে পেলো জ্ঞানের যে কিতাব, তার গভীর সৌন্দর্য ও স্বত:স্ফূর্ত সাবলীলতা তাদেরকে আকৃষ্ট না করে পারলোনা। খান সাহেবের যৌবনের অনুবাদগুলো সেই সাবলীলতার ঢেউয়ে ঢেউয়ে নৃত্যপর। সেখানে আছে প্রকাশের বেগময়তা, অনুভবের বলিষ্টতা, ও জীবনচিন্তার বেচিত্রময়তা। আদর্শিক সূর্যের আলোয় তার সাহিত্য বিধৌত হয়ে পরিণত হলো অফুরন্ত সত্যের কলনাদে। যার স্পর্শে পাঠকের অন্তর্চক্ষুর উজ্জলতা বাড়তে লাগলো এবং জীবনের কাছে সাহিত্যের মূল্য হয়ে উঠলো অনেক বেশি অর্থবহ।
কিন্তু এতটুকু কৃতীত্ব দিয়ে জাতীয় জীবনের জমাট অন্ধকারের মোকাবেলা সম্ভব ছিলোনা। এজন্য প্রয়োজন ছিলো সমন্বিত সংগ্রাম ও সুপরিকল্পিত ঐকতানের। এ লক্ষ্যে খান সাহেব প্রকাশ করলেন চিন্তা ও সাহিত্যের সুষমায় মন্ডিত মননশীলতার বিশ্বাসী মুখাপত্র- আজ। সেটা নিছক কোনো সাময়িকী ছিলোনা বরং তা ছিলো বিশ্বাসী চেতনার শিল্পময় এক সম্মিলীত মার্চপাস্ট। কবি শাহাদাত হোসেন, ফররুখ আহমদ, তালিম হোসেন, বেনজির আহমদ, রওশন ইয়াজদানী, আব্দুল খালেক, নজির আহমদ, আব্দুল আজিজ আল আমান, মোফাখখারুল ইসলাম, আশকার ইবনে শাইখ- বাঙালী মুসলমানের এইসব নক্ষত্র খচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন ‘আজ’ এর মার্চপাস্টে অংশীদার। যারা সেকালে এবং পরবর্তীতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্বাসী সাহিত্যের পরিস্ফুটনে, স্বকীয় ঐতিহ্যের রাজপূরী নির্মাণে। ‘আজ’ এর মাধ্যমে এর যে স্বপ্নময় আবহ ও চেতনার হিন্দোল তৈরী হয়েছিলো, পরবর্তিতে আর কোনো সাহিত্যগোষ্ঠির মাধ্যমে এমনটি হয়ে ওঠেনি।
স্বপ্নের এই মহাযাত্রা মাওলানা খানকে ‘মদীনার’ অভিলাষী করে তুলে। মাসিক মদীনার শুরু হয় দীর্ঘ স্বপ্ন ও প্রেমের প্রতিফলন হিসেবে। মদীনার পবিত্র আলোকে এদেশের পলি, নদী ও নিসর্গের আত্মায় প্রোথিত করার সংগ্রাম শুরু করে পত্রিকাটি। হয়ে ওঠে সত্য প্রকাশের বীণা। অবস্থান করে নেয় মানুষের হৃদয়ের একান্ত সান্নিধ্যে। সেই বৈরী হাওয়ার যুগে, যখন বাঙালী মুসলমান শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, দর্শনে-সাহিত্যে, সর্বক্ষেত্রে নির্জীবতা আর দীনতার অভিশাপে ছিলো রুদ্ধশ্বাস, তখনই মদীনার মাধ্যমে মিল্লাতের আত্মপরিচয় ও আত্মনির্মাণের প্রত্যয় মুক্তভোরের বিহঙ্গের মতো বাংলার পল্লীতে-শহরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সীতা-সতি আর সরস্বতির প্রভূত্বে ম্রিয়মান বাংলা সাহিত্য সহজ-সরল ভাষা ও শিল্পের সৌহার্দে ঈমানের জলধারায় অবগাহনের দ্বারা সিক্ত হতে থাকে। মাসিক পত্রিকার পটভূমিতে মাসিক মদীনা লাভ করে প্রবাধসম খ্যাতি। মুসলমান মধ্যবিত্তকে স্পর্শ করার শক্তিমত্তা ছিলো পত্রিকাটির। এবং সে তা গৌনভাবে হলেও করেছে। এর প্রমাণ পাই, স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা ছিলেন এই পত্রিকার গর্বিত পাঠক। দুয়েক সংখ্যা না পেয়ে তিনি শেখ মুজিবকে পাঠিয়ে দেন মাওলানা খানের কাছে। হাতে তার একখানা চিঠি আর পত্রিকার বার্ষিক গ্রাহক ফিস।
এ নয় কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এ হলো সামগ্রিক পরিধির একটি দিক। একদিকে ভবিষ্যত রাষ্ট্রনায়ক পত্রিকাটির জন্য আসছেন সম্পাদকের কাছে অপরদিকে জাপান প্রবাসী এক হিন্দু জানাচ্ছেন পত্রিকাটি না পেয়ে তিনি অস্থির।
এই হলো মাসিক মদীনার সার্বজনীনতা। এই হলো তার সুবিশাল আকাশের বিস্তৃতি। মাসিক মদীনার পর আর কোনো ইসলামী পত্রিকা এই সার্বজনীন চরিত্র অর্জনে সক্ষম হয়নি। সক্ষম হয়নি তার মান ও চারিত্রগত কৌলিন্যকে স্পর্শ করতেও।
আসলে মাসিক মদীনা কোনো একটি পত্রিকা হয়ে রয়নি। সেটা বরং একটা যুগের জন্ম দিয়েছে। এই যুগের ভেতরে লক্ষ লক্ষ পাঠকের সচেতন আত্মার ডানা মেলে উড়াল প্রকম্পিত করেছে নিস্তরঙ্গতার ভূগোলকে। বিপুল সংখ্যক লেখক- চিন্তাবীদের চিন্তাস্রোত সময়ের সেতারে তুলেছে সভ্যতার ঝংকার। সেই ঝংকার সাতটি নিরবচ্ছিন্ন দশক ধরে ক্রমে ক্রমে মিশছে জাতির মননে, মগজে-রক্তধারায়। এবং এরই মধ্য দিয়ে জাতির অগ্রযাত্রা তথা ইসলামী সংস্কৃতির বিগত ৫০ বছরের পথপরিক্রমায় এ দেশে মাসিক মদীনার ভূমিকাকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে উপায় নেই। এ শ্রদ্ধা নিছক কথার কথা নয়, এ হচ্ছে অপরিহার্য বিষয় এবং ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশ। এ শ্রদ্ধা কেবল বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে নয় সীমাবদ্ধ। সীরাত চর্চার অব্যাহত ধারা, আধুনিক জীবনদৃষ্টিকে ইসলামের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে ব্যাখ্যা, যুগের চ্যালেঞ্জের বাস্তব জবাব দান, শেকড়স্পর্শী চিন্তা ও ঐতিহ্যসচেতনতার পৃষ্ঠপোষকতা… … প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার দানের হাত থেকেছে প্রসারিত এবং এখনো ক্রম প্রসারমান। এক মদীনা যত লেখক তৈরী করেছে, বৃহৎ বৃহৎ ইনস্টিটিউটের পক্ষেও তা সম্ভব হয়নি। মাসিক মদীনা তার পথ পরিক্রমায় সকল বিভ্রান্তির সাথে করেছে সংগ্রাম, সকল ক্ষুদ্রতার সাথে বাঁধিয়েছে সংঘাত, সকল অসুন্দরের সাথে করেছে যুদ্ধ। এবং এর সবটাই জাতির দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক পরাধীনতা এবং এখনো চলমান মানসিক গোলামীর উৎসাদনের জন্যে থেকেছে নিবেদিত।
এ লক্ষ্যে নিবেদিত মাওলানা খানের রাজনীতিও। কৈশোরে যে রাজনীতির উল্লাস্ফন তিনি দেখেছিলেন, এর মধ্যে অঙ্গীকার ও আদর্শের যে অনুপস্থিতি কিংবা আদর্শের সঙ্গে প্রগতিশীল কর্মসূচীর যে সমন্বয়হীনতা দেখেছিলেন, এর উত্তরণ না হলে এ জাতির মুক্তি হবেনা বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। অতএব প্রকৃত অর্থে আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রগতিশীল কর্মসূচীর সমন্বয় সাধনে তার রাজনৈতিক প্রয়াস সেও এক যুগান্তকারী কর্মধারা।
আসলে মাওলানা মুহীউদ্দীন খান নামক কালাতিক্রমী প্রতিষ্ঠান বাঙালী মুসলিমের মানসিক দারিদ্র, সাংস্কৃতিক রক্তশূণ্যতা এবং জাতিসত্তা ও আত্মপরিচয়গত হীনমন্যতার বিপরীতে গৌরব ও মহিমার এক বিজয় মিনার। সেখান থেকে প্রতিনিয়ত আশার আলো ছড়ায়, পথনির্দেশের ইশতেহার ঘোষিত হয় এবং প্রতিটি বিপর্যয়কর প্রেক্ষাপটে ধ্বণিত হয় শিল্পময় ঈমানের আযান। এ আযান মানেই তো আত্মার উত্থান। যে আত্মার কোনো ক্ষয় নেই, লয় নেই।