শ্রীমঙ্গলী হুজুর : ভিন্নমাত্রিক আয়নায়
লিখেছেন: মুসা আল হাফিজ
২০০৫ সাল কী গভীর চিত্তদোলা নিয়ে আমাকে মাতিয়েছিলো ছন্দের বৃষ্টিধারায়। এমন সৃষ্টিচঞ্চল মত্ততা, এমন শিল্পমুগ্ধ নিবিড়তা, এমন উচ্ছল প্রাণাবেগ, এমন বর্ণিল প্রাণপ্রাচূর্য আজ আর আমার আকাশে রংধনু রচনা করে না। ছন্দের শিহরণ যে স্বাদ দিয়ে কবিকে নিদ্রাছাড়া করে, পাঠমগ্নতা যে মাদকতা দিয়ে কবিকে নিমজ্জিত করে, তত্ত- তথ্য মন্থন যে তীব্রতায় কবিকে ডুবিয়ে দেয় গভীর অন্বেষায়, শিল্পের অলিগলি যে মোহন মায়াবীতায় কবিকে করে ফেলে ঘরছাড়া, নির্মাণের যে আঁকুতি কবির দিনরাত্রিকে করে তুলে সাধনামুখর, তার বেগ ও আবেগ আমার ২০০৫ কে নাঁচিয়ে তুলেছিলো, মাতিয়ে রেখেছিলো। মনে পড়ে সে সময় বাংলা ছন্দের জলসায় চেয়েছিলাম নিয়ে আসতে আরবী মুতাকারিব ছন্দকে। সে জন্য শুরু করেছিলাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তার কিছু চিহ্ন-রেশ ধারণ করছে সেই সময়ে রচিত আমার- সৃজনে রক্ত চাই- ছড়াগ্রন্থটি। কাজী নজরুল ইসলাম এ ছন্দকে প্রথমে ব্যবহার করেছিলেন আপন বিক্রমে। তারপর দীর্ঘ নীরবতা। আমি যখন লিখলাম-
বিশ্বাসে নুন
নিঃশ্বাসে তূণ
খুন চাই খুন
নিভাতে আগুন
ঈগলের চোখ
দুলদুল রোখ
হৃদ উন্মুখ
চাই ফররুখ
বজ্রের মুখ
জিন্দা দারাজ
তেগ যার তাজ
ছুটে সাজ সাজ
সেই শাহবাজ
খুঁজি তাকে আজ
অনেক দীর্ঘ ছিল সেই ছন্দধারা। বেশ কয়েকটি ছড়ায় তা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলো। গ্রন্থটি প্রকাশে উচ্ছসিত অভিব্যক্তি পেশ করেছিলেন কবি আল মাহমুদ। বলেছিলেন- ছন্দের খরায় নিপতিত তরুণ কবিরা এ গ্রন্থ থেকে মিল ব্যবহারের উদ্দামতা অর্জন করতে পারবে।আমা হেন কিশোরকে তিনি অভিহিত করেছিলেন- সতর্ক কবি বলে। আল মুজাহিদী লিখেছিলেন- ছড়া সম্পর্কে এ গ্রন্থটিতে অভিনব ধারণা মূর্ত হয়েছে। কবিতার বিবর্তিত কাঠামো হিসেবে ছড়া বিকশিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান, কিছু ছন্দপাগলের প্রয়াসে, অনুষ্ঠিত হলো সিলেট সিটি কর্পোরেশন মিলনায়তনে। তারুণ্যের উচ্ছাসে উপচে পড়া ভালবাসা সে দিন কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছিলো হলটিকে। মনে পড়ছে, অনুষ্ঠানে দুধসাদা আগ্রহে উপস্থিত ছিলেন আমার শ্রীমঙ্গলী হুজুর।কিছু তরুণ কবি সে দিন মুতাকারিব ছন্দ বুঝতে না পেরে বইটির কিছু ছড়াকে অভিহিত করেছিলো ছন্দ ছাড়া হিসেবে। প্রবীণ আলোচকরা তাদেরকে বলেছিলেন- জ্ঞাত ছন্দ ছাড়া আর কোনো ছন্দ কোথাও নেই, এমনটি মনে করা অন্যায়। এ বইটির অন্যতম কৃতীত্ব হলো মুতাকারিব ছন্দের সম্পন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। শ্রীমঙ্গলী হুজুর ও বক্তব্য রাখলেন, তিনি বললেন- আমাদেরকে বানানো হয়েছে ইমামতি করার জন্য। কিন্তু অনেকেই সাহিত্যে মুক্তাদি হিসেবে আমাদের জায়গা দিতে চান না। আজ আমরা প্রমাণ করলাম যেখানে অন্যরা গিয়ে থেমে যান, সেখানে আমাদের কলম সক্রিয়। আপনারা তো অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্তের কথা বললেন, কিন্তু নতুন বৃত্ত সৃষ্টি করার জন্য আমরা এসেছি। দয়া করে কেউ রাগ করবেন না। পারলে আমাদের মতো নতুন কিছু সৃষ্টি করুন। আমি হতবাক হলাম হুজুরের বক্তব্যে। এমন সাহস, এমন প্রজ্ঞা, এমন প্রত্যয় তিনি সে দিন সূর্যরেণুর মতো ছড়ালেন, যা আমার হৃদয়কে জাগ্রত করে তুললো নতুন শক্তি ও সিদ্ধান্তে। দারসে হাদীসের এ মহান শিল্পবাগীশ বিতর্কের ময়দানে ছিলেন বিজয়ী বীর। তার অসামান্য বাকসিদ্ধি কী মোহনীয় পরাক্রমে বিজয় অর্জন করে, তার একটি নজির রচিত হলো আমার চোখের সম্মুখে। তারপর থেকে আমি হুজুরকে নতুন তাৎপর্যে অবলোকন করতে লাগলাম। যতবার যতভাবেই পরখ করেছি দেখেছি ইলমে- হিলমে, আকলে-হেকমতে, আখলাকে-এহসানে, উদারতায়-বলিষ্টতায়, সূক্ষ্মদর্শিতায়- বাকপটুতায় হযরত যেনো এক সাফল্যের উপমা। জীবনপথে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন এই সব অনবদ্য গুণাবলীর সতত ঝিলিক। সমকাল তা দেখেছে। আগামীর যাত্রীদের দায়িত্ব হলো সে আলোকমালাকে মহাকালের খাতায় গ্রথিত করে রাখা। তাহলে মননের দারিদ্রে পীড়িত প্রজন্ম পেতে পারে সমৃদ্ধির সবক। আর আধাঁর রাতের মুসাফিররা দেখতে পাবে একটি কুতুবতারা অন্ধকারের বুক ভেদ করে কীভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে সামনে চলার পথ।