কমাশিসা ডেস্ক :: সিলেট ও খুলনায় আলোচিত দুই শিশু সামিউল আলম রাজন ও রাকিব হত্যার দায়ে ছয়জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। বহু আলোচিত এ দুটি হত্যাকাণ্ডের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে পৃথক দুটি মামলার বিচার শেষে আজ রোববার রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
সিলেটে শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন (১৪) হত্যার দায়ে প্রধান আসামি কামরুল ইসলামসহ চারজনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আকবর হোসেন মৃধা। আর খুলনায় শিশু রাকিব (১২) হত্যার দায়ে প্রধান আসামি মো. শরীফসহ দুজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক দিলরুবা সুলতানা।
যথাক্রমে ১৪ ও ১০ কার্যদিবসে শেষ হয়েছে দুটি মামলায় বিচার-প্রক্রিয়া।
সিলেট থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, রাজন হত্যা মামলায় কামরুল ইসলাম, চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়না, তাজউদ্দিন আহমদ ওরফে বাদল ও জাকির হোসেন ওরফে পাবেল ওরফে রাজুকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া মামলার আসামি নূর আহমদকে যাবজ্জীবন; শামীম আহমদ, মোহিত আলম ও আলী হায়দারকে সাত বছর করে কারাদণ্ড এবং দুলাল আহমদ ও আয়াজ আলীকে এক বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেকসুর খালাস পেয়েছেন তিন আসামি ফিরোজ উল্লাহ, আজমত উল্লাহ ও রুহুল আমীন।
চুরির অপবাদে চলতি বছরের ৮ জুলাই সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন শেখপাড়ায় নির্যাতন করে হত্যা করা হয় সিলেটের জালালাবাদ থানা এলাকার বাদেয়ালি গ্রামের সবজি বিক্রেতা রাজনকে। লাশ গুম করার সময় ধরা পড়েন একজন। পরে পুলিশ বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় মামলা করে। ফেসবুকে প্রচারের উদ্দেশে নির্যাতনের ভিডিও চিত্রও ধারণ করেন নির্যাতনকারীরা। ১২ জুলাই এই ভিডিও চিত্র নিয়ে প্রথম আলোয় ‘নির্মম পৈশাচিক!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়।
ঘটনার পরপরই পালিয়ে সৌদি আরব চলে যান মামলার প্রধান আসামি কামরুল ইসলাম। ইন্টারপোলের (আন্তর্জাতিক পুলিশ) মাধ্যমে গত ১৫ অক্টোবর তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়। তাঁর উপস্থিতিতে মামলার গুরুত্বপূর্ণ ১১ সাক্ষীর পুনরায় সাক্ষ্য গ্রহণের পর একটানা তিন দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত আজ রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।
আমাদের খুলনা অফিস ও প্রতিনিধি জানান, শিশু রাকিব হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামিরা হলেন শরীফ মোটরসের মালিক মো. শরীফ ও তাঁর সহযোগী মিন্টু। এ মামলায় অভিযুক্ত অপর আসামি শরীফের মা বিউটি বেগমকে খালাস দিয়েছেন আদালত।
চলতি বছরের ৩ আগস্ট বিকেলে খুলনার টুটপাড়ায় শরীফ মোটরস নামে এক মোটরসাইকেলের গ্যারেজে নির্যাতন করে রাকিবকে হত্যা করা হয়। পরের দিন রাকিবের বাবা মো. নুরুল আলম বাদী হয়ে শরীফ, শরীফের সহযোগী মিন্টু খান ও মা বিউটি বেগমের বিরুদ্ধে সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ১ নভেম্বর বিচারক আজ রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। বহু আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে মামলা হওয়ার ৯৬ দিন পর এই রায় ঘোষণা করা হলো।
রাকিব হত্যা মামলার রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তার বাবা, মা ও এলাকাবাসী। রায় শুনে রাকিবের বাবা নুরুল আলম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘মিন্টু ও শরীফের ফাঁসির রায় হয়েছে, এতে আমি সন্তুষ্ট।’ উচ্চ আদালতেও যেন এ রায় বহাল থাকে, সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি এ আহ্বান জানান তিনি।
রাকিবের মা লাকী বেগম বলেন, এতদিন অপেক্ষা করেছি আসামিদের ফাঁসির রায় শোনার জন্য। বিউটি বাদে অন্যদের ফাঁসির রায় হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ রায় আমি মানি না। আমি চেয়েছিলাম বিউটিরও যেন ফাঁসি হয়।’ বলতে বলতেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান। পরে তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হয়।
রাকিবের ছোট বোন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ভাইকে যারা মেরেছে তাঁদের ফাঁসি না হলে আমি সহ্য করতে পারব না।’
রাকিব হত্যার দায়ে বিউটি বেগমের ফাঁসি না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন এলাকাবাসী। সকাল ১০টা থেকেই তাঁরা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জড়ো হতে থাকেন। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে এলাকাবাসী জড়ো হয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালতের সামনের রাস্তায় রাকিব হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকেন। এর একটু পরে আসামিদের আদালতে নিয়ে যাওয়া হলে এলাকাবাসী আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেন। এ সময় রাকিবের মা স্লোগান দিতে দিতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
১২টা ৫০ মিনিটের দিকে বাইরে অপেক্ষামান জনতা দুই আসামির ফাঁসি এবং এক আসামির খালাসের খবর শুনে ‘এ রায় মানি না’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁরা এ সময় কয়েক দফায় আদালত প্রাঙ্গণের সামনের সড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন। বেলা ১টা ১০ মিনিটের দিকে আসামিদের আদালত থেকে বের করে প্রিজন ভ্যানে তোলার চেষ্টা করা হলে বিক্ষুব্ধ জনতা গাড়িতে হামলার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ গাড়ির সামনে সড়কের ওপর শুয়ে পড়েন। পরে পুলিশ তাঁদের সরিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বাদী পক্ষের আইনজীবী মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত সব জেনেশুনেই রায় দিয়েছেন। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।’ বিউটি বেগমের খালাসের ব্যাপারে রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আসামি পক্ষের আইনজীবী তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘প্রমাণের ভিত্তিতে এ রায় হয়নি। সাক্ষীরা সবাই শুনে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আবেগতাড়িত হয়ে এ রায় দেওয়া হয়েছে।’ এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে তিনি জানান।
সূত্র : প্রথম আলো