“কবে পুনঃ বীর রসে,

জগৎ ভরিবে যশে,

ভারত ভাস্বর হবে পুনঃ?”

হেমচন্দ্র সঙ্কোচ ও বিহবলতার মধ্যে দিয়ে সাজাত্যবোধের মর্মবাণী বহন করতে চেয়েছেন। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার কথা স্মরণ ক’রে আত্মশ্লাঘা আছে, শক্তিমত্ততার বন্দনা আছে। ইংরাজ-অধিকারের স্বীকৃতি আছে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পরাধীনতাজনিত উদ্যমহীনতার জন্ম, হতাশা ও আক্ষেপ আছে। হেমচন্দ্র অধিকারী ইংরাজের কাছেই কল্যাণ যাচ্‌ঞা ক’রেছেন, অধুনা দুর্বল ও সন্ত্রস্ত ভারতীয়দের জন্যকৃপাভিক্ষা ক’রেছেন। হিন্দু ধর্মাদর্শের পুনর্প্রভাব কামনা ক’রেছেন প্রাচীন আর্য-সাধনার সঙ্গে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মিশ্রণ যাচ্‌ঞা ক’রে। রাষ্ট্রীয় অধিকারবোধের আভাষ পর্যন্ত নেই কিন্তু সাজাতিকতা এবং হিন্দু ভারতের একীকরণের কথা আছে।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে। সর্বপ্রথম বলিষ্ঠভাবে এবং যথেষ্ঠ স্বচ্ছতার সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবোধের কথা এখানেই বলা হয়। দেশমাতৃকার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা এবং অর্চনার মধ্যে, অনেকটা ধর্মীয় রূপকেরর সাহায্যেই, হিন্দুর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনের জন্য তিনি যে জাতীয় ঐক্যতত্ত্বের সংবাদ আনলেন বাংলা দেশে, তার প্রভাব হ’ল অভূতপূর্ব। জাতি হিসেবে হিন্দুদের প্রতিষ্ঠা এবং সস্তিলাভের পক্ষে মুসলমানকেই বঙ্কিমচন্দ্র এমমাত্র প্রতিবন্ধক ভেবেছেন। অধিকারী ইংরেজের বিরুদ্ধে কোথাও অভিযোগ নেই। অনুদারতা এবং অসদ্ভাবের এই যে ভিত্তিভূমি রচনা করে হ’ল, আজ পর্যন্তও তা স্থির ও সুদৃঢ় রয়েছ।

উর্দূ কবি হালীর ‘মসদ্দস’ প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হয়। হালী ভারতীয় মুসলমানদের কল্যাণের জন্য কুসংস্কার-রহিত যে বিশ্ব মুসলিম ঐক্যবোধের কথা বল্‌লেন, তা’তে মুসলমনদের তৎকালীন বিপর্যয় এবং অশেষ হতাশার জন্যরোনাজারি আছে কিন্তু কোথাও হিন্দুর অকল্যাণ-কামনা নেই। স্যার সৈয়দের সংস্কার ও শিক্ষা আন্দোলনের পশ্চাতে হালীর অনুভূতি সক্রিয় ছিল। নির্জিত-প্রাণ মুসলমানদের জন্য পূর্ব-গৌরবের রুদ্ধ-কবাট প্রথম উন্মোচন করলেন হালী। এ-গৌরবের পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন ইউরোপের সে-জ্ঞানভাণ্ডার যা আজ বিশ্ব কর্তৃক স্বীকৃত, নিরলস কর্মপথে আচারের জীবনকে বর্জন এবং বুদ্ধির আলোকদীপ্ত জীবনপথের সন্ধান।

বাংলা দেশের মুসলমানদের কাছে মুসলিম সভ্যতার পুনরুত্থানের কথা অ্রজ্ঞাত ছিলো না। রাজনৈতিক তরঙ্গবিক্ষোভে বাঙ্গালী মুসলমানদের নির্যাতিত মনও কম্পমান হ’লো। বিহবল মুসলমানদের জাগরণের কথা বল্‌লেন মীর মুশাররফ হোসেন, মুষাম্মেল হক, ইসমাইল হোসেন শিরাজী ও কায়কোবাদ। এঁদের রচনার পরাধীনতার জন্য তীব্র বেদনাবোধ ছিলো, এবং ইংরাজ তোষণের মতো হীনমন্যতার প্রশ্রয় ছিলো না। শব্দবোধ শ্লথ এবং দুর্বল, কোথাও কোথাও হেম-নবীনের অনুকৃতি মাত্র কিন্তু এর মধ্যেই কেমন একটি অকপট, নিষ্কলঙ্ক মনের পরিচয় আছে, যা’ আজ্‌কের দিনে আর পাওয়া যায় না।

ইক্‌বালের সঙ্গে আমাদের পরিচয় তারও অনেক পরে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর তুর্কীর খেলাফত যখন আর নেই, যখন বিশ্বমুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের স্বপ্ন অস্পষ্ট হ’য়েছে, তখন নজরুল ইস্‌লাম অতর্কিতে আমাদের প্রাণে উন্মাদনা আন্‌লেন উদ্ভব-যুগের ইস্‌লামের কাহিনী স্মরণ ক’রে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্থাবর শান্ত মনে প্রচণ্ড আঘাতে ক’রে। নজরুল ইস্‌লামকে পূরোভাগে রেখে বাঙ্গালী মুসলমান যখন আপন জীবনের ভিত্তিহীনতার জন্য অভিযোগ তুল্‌ছে, তখন ইক্‌বালের “শেকোয়া”র সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়।

নজরুলকে পথিকৃৎ মেনে আশরাফ আলী খান আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে অভিযোগ আন্‌লেন আমাদের জীবনের বিপর্যয় ও স্বস্তিহীনতার জন্য এবং সত্যাদর্শের অভাবের জন্যও। “শেকোয়া”য় তিনি আপন মনের অনুরণন শুন্‌লেন। কাব্য হিসেবে “শেকোয়া”র মূল্য যতই লঘু হোক্‌ না কেন, এর অভিযোগ আমাদের অনুভূতিতে শিহরণ তুলেছিলো। নজরুলকে ভাল লেগেছিলো, ই্‌কবালকে আরো ভালো লাগ্‌লো। নজরুলের দীপ্তি অসাধারণ কিন্তু সে দীপ্তির দাহন আছে- স্নিগ্ধতা নেই; ইক্‌বালের কাব্য জ্বালা আছে কিন্তু ধর্মের স্থির-সত্যের সঙ্গে তার অসদ্ভাব নেই, তাই তা’ মূলতঃ প্রশান্ত এবং জীবনানুভূতিতে অতুলনীয়।

এর পর যখন তিনি স্পষ্ট ভাষায় হিন্দু থেকে বিশ্লিষ্ট হ’ইয়ে ভারতীয় মুসলমানকে অন্য এক জাতীয় ঐক্যতত্ত্বের সন্ধান  করতে বল্‌লেন, তখন তাঁকে আমরা নেতৃপদ দিলাম। ১৯৩০ সালের এলাহাবাদ মুসলিম লীগ অধিবেশনের সভাপতির ভাষণে ইক্‌বাল ভারতের দ্বিজাতিতত্ত্বের যে-তথ্য প্রকাশ ক’রলেন, পরবর্তীকালে তাই হ’য়ে দাঁড়ালো পাকিস্তান পরিকল্পনার অঙ্কুর। অভিভাষণে ইক্‌বাল বল্‌লেন যে, রেন বলেন, মানুষ তার গোত্র বা ধর্মের দাসত্বে আবদ্ধ থাকে না। ভৌগলিক সীমারেখাও তা’কে বন্ধনদশায় রাখ্‌তে পারে না। উদারহৃদয়, বিদগ্ধমনা মানুষের সমষ্টি একটি বিশেষ আদর্শ ও বোধের সৃষ্টি ক’রে থাকে যা’কে আমরা জাতি ব’লে আখ্যাত করি। এহেন জাতির সৃষ্টি একেবারে যে অসম্ভব, তা’ নয়, যদিও এর সম্ভাব্যতার জন্য মানুষের মনকে নতুন ক’রে সংগঠন ক’রবার একটি বিলম্বিত প্রক্রিয়ার প্রয়োজন করে। এমন অবস্থা সত্য হ’তে পারতো, যদি কবীরের শিক্ষা এবং আকবরের বিশ্বাস জনসাধারণের মনকে স্পর্শ ক’রতো।

কিন্তু অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয় যে, একটি বৃহত্তর পরিবেশে সম্মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষা ভারতের কোন ধর্মাবলম্বীই আপন বিশ্বাস ও আদর্শকে অস্বীকার ক’রতে প্রস্তুত নয়। সম্মিলিত অস্তিত্বের জন্য কারোই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় না এবং সেজন্য যে মূল্য দিতে হবে, তা’ও কেউ দিতে চায় না। ভারতীয় ঐক্যবোধের জন্য প্রয়োজন অনেক আদর্শ এবং জাতির অনস্তিত্বের নয় কিন্তু সে সবার মধ্যে পারস্পরিক বুঝাপড়ার। একমাত্র যুক্তিসঙ্গত এবং বাস্তব পন্থা হচ্ছে, যা’ নেই তা’ মেনে নেওয়া নয় কিন্তু প্রচলিত অবস্থাকে স্বীকার করা।

পাকিস্তান পরিকল্পনার উন্মেষ হ’লো এভাবেই। রাষ্ট্রনৈতিক পরিকল্পনা নয় কিন্তু আদর্শের স্বীকার। সাহিত্যে আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা শুনা যেতে লাগলো আরো পরে ১৯৪০ খৃষ্টাব্দে মুস্‌লিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের পর। বলা হ’লো প্রকাশ্যেই যে, আমাদের সাহিত্য হবে আলাদা, কেন না আমাদের জীবনবোধ হিন্দুদের সঙ্গে সংসক্ত নয়। কবিতার ক্ষেত্রেই এ-আদর্শের অনুসৃতি হ’লো সার্থক। পাকিস্তান তখনও পর্যন্ত আবেগ, উল্লাস ও কল্পনার এবং কবিতাই হ’ল এ-আবেগ প্রকাশের একমাত্র পরিসর। এ-বক্তব্যের সঙ্গে রূপকল্পের সমন্বয় সাধনের পর কখনও কখনও কারো কবিতা শ্রোত্ররসায়নও হ’য়েছে। কিছুটা অগভীরভাবে হ’লেও কাব্যক্ষেত্রে তিনটি ধারার চিহ্ন দেখা গেলো- ইস্‌লামী ঐতিহ্যের কাহিনী ও সৌন্দর্যের ধারা; ইস্‌লামের সত্য, বিশ্বাস এবং উপলব্ধিগত আদর্শ জীবনবোধ এবং সর্বশেষে পুঁথিসাহিত্য ও পল্লীগীতির রূপ এবং কল্পনার জীবন।

ইক্‌বালের প্রভাব কার্যকরী হ’ইয়েছিলো প্রথম দু’টি ক্ষেত্রে। ইক্‌বালের প্রভাবে এ-দুটি ধারা বলিষ্ঠ এবং নতুন রূপ নিয়েছিলো- ক্ষীণ প্রাণধারা স্রোতাবেগ পেয়েছিলো। ষোল শতকের কবি সৈয়দ সুলতান “জ্ঞান-চৌতিশা”র ইস্‌লামের ধর্ম-তত্ত্ব সম্পর্কে আলোকপাত ক’রেছেন। সতের শতকের কবি আলাওল সুফী-তত্ত্বজ্ঞ ছিলেন যা’র পরিচয় তাঁর অনুবাদ-গ্রন্থ “তোহফা”য় বিশেষভাবে পাওয়া যায়। আঠারো শতকের কবি আলী রাজা “জ্ঞানসাগরে” নিগূঢ় আধ্যাত্মিকতার পরিচয় দিয়েছেন। অর্থাৎ বাংলার কাব্যে ইস্‌লামী আধ্যাত্মিকতার স্ফুরণ এবং বিকাশ বহু আগেই হ’য়েছে। কিন্তু এহেন বিকাশের মধ্যে কেমন যেন স্থূলত্ব ছিলো। ধর্মকে সেখানে নির্মমভাবে জীবনের নিয়ামক করা হ’য়েছে, কিন্তু জীবনের আবেগ ও অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কিত রাখা হয়নি।

অবশ্য উনিশ শতকের পূর্বের বাংলার কাব্যে আত্মবিশ্লেষণ নেই, হৃদয়াবেগের সঞ্চারণ নেই- তা’র মূল্য কাহিনী-মাহাত্ম্যে, কখনও বস্তু-প্রকৃতি, দেব-বিগ্রহ বা ভগবানের কাছে নিবেদিত চিত্ততায়। যাই হোক্‌, ঊনিশ শতকের মুসলমান সাহিত্যিক মীর মুশার্‌রফ হোসেনের রচনায় এবং পরবর্তীকালে মুযাম্মেল হক্‌, কায়কোবাদ, ইস্‌মাইল হোসেন শিরাজীর কাব্যে ইস্‌লামের ইতিহাসের অপরিমিত প্রয়োগ দেখি উপাদান হিসেবে এঁদের রচনায় ইতিহাসের সংবাদ আছে অর্থাৎ ইতিহাসমিশ্রিত জ্ঞানের পরিচয় আছে। যে বস্তুত অভাব মনে হয়, তা হচ্ছে ইতিহাসের অভিজ্ঞতা এবং ঐতিহ্যবোধ। অনেক পরে নজরুল ইস্‌লামের কাব্যে ইস্‌লামের ইতিহাস নিছক পটভূমি বা উপাদান নয় কিন্তু অনুভূতির লালনভূমি, সৌন্দর্যের প্রাণকেন্দ্র এবং জীবনের স্বপ্ন ও সম্ভাবনায় পরিণত হয়। নজরুল ইস্‌লামের কাব্যে অভাব ছিলো তওহীদ বা নিঃসংশয় একত্ববাদের, এবং কোরানের ইস্‌লামের সৌন্দর্য ও উপলব্ধির চিত্রের। বিপর্যয়ের জন্য বেদনা এবং বিদ্রোহের অগ্নিবর্ষণ আছে কিন্তু আত্মবিশ্লেষণের অভাবের জন্য গ্লানি ও হতচেতনার সত্যিকারের প্রতিষেধক নির্ণিত হয়নি।

ইক্‌বাল মুসলমানের নিশ্চেষ্টতা ও হতোদ্যমের যথাযথ চিত্র অঙ্কন করেছেন এবং এই পতন ও সর্বনাশের জন্য তাঁর ক্ষোভ নিদারুণ। “জওয়াব-ই-শেকোয়া”য় যে পথ-নির্দেশ আছে, তা’তে ইস্‌লামের চিরশক্তিমত্ততায় বিশ্বাসী ইক্‌বালের নিবিড় উপলব্ধির পরিচয় মেলে। তিনি প্রত্যেক মুসলমানকে অবলম্বন ক’রতে ব’লেছেন, ইসলামের প্রবাহমান সত্য এবং কোরানের অমোঘ সঞ্জীবনী বাণীকে। এক জায়গায় তিনি বলেছেন, “In times of crises in their history it is not Muslims that saved Islam, on the contrary, it is Islam that saved Muslims.”- ইতিহাসের সঙ্কট-মুহূর্তে মুসলমান ইস্‌লামের ত্রাণকর্তা হননি, অন্যপক্ষে ইস্‌লামই রক্ষা ক’রেছে মুসলমানকে। অবশ্য মনে রাখ্‌তে হবে যে, ইস্‌লামের অর্থ ইক্‌বালের কাছে স্তিমিত-প্রাণ ব্যক্তির আত্মসমর্পণ নয়; ইসলামের অর্থ শক্তিমত্তা, ন্যায়নুসরণ ও সাধনা একই সঙ্গে।

ইক্‌বালের এই বলিষ্ট আবেগ তরুণ মুসলমানের মনকে নাড়া দিয়েছিলো প্রচণ্ডভাবে। সাহিত্যক্ষেত্রে এ-আলোড়নের সংবাদ পাই ১৯৪২-৪৩ সাল থেকে। যাদের অনেকটা পরিহাস ক’রে কাজী আবদুল অদুদ “আত্মনিয়ন্ত্রণী দল” ব’লেছেন, তাদের উদ্ভব এ-সময়ের দু’টি সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। পূর্ব-পাকিস্তান রেঁনেসা সোসাইটি এবং পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য-সংসদ মুস্‌লিম সাহিত্য-সাধনার পথ-নির্দেশ দিতে চাইল। আবুল কালাম শামসুদ্দীনের আগ্রহ ও ঐকান্তিকতাই ছিলো এ-আন্দোলনের সজীবতার উৎস। কাব্যক্ষেত্রে নেমে এলাম ফর্‌রুখ আহমদ ও আমি। ইক্‌বালের আদর্শের অনুবর্তী হ’তে চেষ্টা ক’রলেন ফর্‌রুখ আহমদ। তাঁর কাছে পরম মূল্যবান হ’লো উন্মেষ-যুগের ইস্‌লাম। আজ হয় তো বিপর্যয় এবং পরিবেশের সঙ্গে অসদ্ভাব আছে কিন্তু বিশ্বাস ও উপলব্ধির পথে প্রথম যাত্রার উৎসাহ ছিলো অদম্য এবং স্বস্তিও ছিলো প্রগাঢ়। তাই হেরার রাজতোরণই তাঁর লক্ষ্য, যে লক্ষ্যে অগ্রসর হ’তে হ’লে বিশ্ব-মুসলিম ঐক্যবোধ, ইস্‌লামী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা এবং সর্বোপরি খিলাফতের প্রয়োজন। মুজীবুর রহমান অবতীর্ণ হ’লেন স্বতন্ত্র তমদ্দুনের তুর্যবাদক হিসেবে।

ইক্‌বাল বাংলাতে অনূদিত হ’ইয়েছেন দু’টি কারণে। প্রথমতঃ, আমাদের হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে যোগসূত্র নির্ণয়ের জন্য; দ্বিতীয়তঃ ধর্মবোধের পোষকতা ও তত্ত্বজিজ্ঞাসার মীমাংসার জন্য। বাংলাতে তাঁর প্রথম অনূদিত গ্রন্থ “শেকোয়া”। যে সময় বাঙালী মুসলমান নজরুল ইস্‌লামকে পূরোভাগে রেখে আপন দুঃখদুর্দশার নিবৃত্তি খুঁজ্‌ছে, স্বস্তিহীন মুহূর্তে সে আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধেও অভিযোগ এনেছে, তখন ইক্‌বালের “শেকোয়া”য় সে আপন মনের অনুরণন শুনেছিলো। চরম দারিদ্র্যে নিষ্পিষ্ট, দুঃখ জর্জরিত এবং তৎহেতু আত্মঘাতী কবি আশরাফ আলী খান “শেকোয়া”র প্রথম তর্জমা ক’রেছিলেন। আশ্চর্য আবেগ এবং গতির মধ্যে আশরাফ আলী “শেকোয়া’য় আপন মনের প্রতিফলন দেখেছিলেন, তাই তাঁর অনুবাদ আক্ষরিক না হ’লেও আন্তরিকতায় উজ্জ্বল এং কাব্য-সৌন্দর্যে নবোদিত সূর্যের বর্ণবৈচিত্র্যের মতো। এর পর “শেকোয়া”র তর্জমা অনেক হয়েছে – মুহম্মদ সুল্‌তান, মীজানুর রহ্‌মান, ডক্টর শহীদুল্লাহ্‌ এ-তিনজনের নামই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মীজানুর রহমান ও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ মূলকে যথাযথভাবে অনুসরণ ক’রেছেন; তাই তাঁদের রূপায়ণে ইক্‌বালের বক্তব্যের বিকৃতি ঘটেনি, কিন্তু কাব্যিক মাধুর্য ক্ষুণ্ন হ’য়েছে। একে তাঁরা দোষের মনে করেননি, কেননা তাঁদের উদ্দেশ্য বাংলার পরিবেশে ইক্‌বালকে যথাযথভাবে পরিদৃশ্যমান করা, সুদৃশ্যভাবে নয়।

আমাদের ধর্মবোধের পোষকতা এবং তত্ত্বজিজ্ঞাসার জন্য অনূদিত হয়েছে ইক্‌বালের ‘আস্‌রারে খুদী’ ও ‘রমুজে বেখুদী’। উভয় গ্রন্থই নিগূঢ় দার্শনিক তত্ত্বসমন্বিত, নিশ্চিন্তে বোধগম্য নয়। ‘আস্‌রারে খুদী’র প্রথম বাংলা তর্জমা করেন সৈয়দ আবদুল মান্নান। অনুবাদটি জনপ্রিয়ও হয়েছে। আবদুল মান্নান গদ্যে তর্জমা ক’রেছেন। এর পর আমি সপ্তম অধ্যায় পর্যন্ত কাব্যানুবাদ করেছিলাম। আমি মূলকে যথাযথভাবে অনুসরণ করিনি, শুধু মূলীভূত তত্ত্ব এবং আদর্শকে অক্ষুণ্ন চেয়েছি। ফর্‌রুখ আহমদও কাব্যে অংশবিশেষ অনুবাদ করেছেন।

এ ভাবে বিচিত্রভাবে বাংলা কবিতার আসরে আমরা ইক্‌বালকে পেয়েছি। বাংলার হাওয়ায় তাঁর গান ভেসেছে, বাংলার জলকল্লোলে তাঁর কণ্ঠ শুনেছি, তাঁর হৃদয়ের বিপুলতা দেখেছি বাংলার আকাশে। যেমন নবোদিত সূর্য সমুদ্রের দিগন্তে কাল্পনিক তটরেখা সৃষ্টি করে, যেমন মেঘের কৃষ্ণছায়া আকাশকে স্পর্শ ক’রেছে ব’লে মনে হয়, তেমনি আমরাও মনে করছি যে, ইক্‌বালকে বোধের আয়ত্তে এনেছি; কিন্তু সমুদ্রের কল্লোলের যেমন পরিমাপ হয় না অথচ তা দেখে বিহবল ও আনন্দিত হওয়া যায়, তেমনি ইক্‌বালের গভীরতা, ব্যাপকতা ও বিপুলতা আয়ত্তাতীত কিন্তু আমাদের জন্য সংবেদনশীল ও আনন্দদীপ্ত।

সূত্রঃ প্যারাডাইজ লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত, সৈয়দ আলী আহসান সম্পাদিত “ইকবালের কবিতা” গ্রন্থ