কালাম আজাদ: একটি গবেষণা গ্রন্থ। মুসা আল হাফিজের- যাকে আমি সুস্বর কবি বলি। বলি হীরকদ্যুতির গ্রান্থিক। কাব্যাঙ্গণ, গবেষণা এবং প্রবন্ধ সাহিত্যে উজ্জ্বল উপস্থিতি তাঁর। ইদানিং ইন্টারনেটেও তাঁর ব্যতিক্রমী বৈশিষ্টের উপস্থিতি। উচ্ছ্বাস, উল্লাসে দেশ কাঁপাতে পারতেন। কিন্তু আপনা মাংসে হরিণা বৈরী জাতীয় একটা কথা আছে যে! তাঁর কবিতা ঐতিহ্যের কথা, ভাববাদের কথা এবং জাগরণের কথা বলে। যা ইসলামী বিশ্বাসের অনুবর্তী। বিধায় কে নাচবে তাঁকে নিয়ে, কে ই বা গাইবে তাঁর গান। কবিতা লিখছেন, অনুবাদ করছেন, প্রবন্ধ সাহিত্যে ঐন্দ্রজালিক ভাষার প্রভা এবং প্রবাহ এনে সুধি পাঠককে বিমোহিত করছেন ঠিকই। কিন্তু সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না তাঁর এবং তাঁর কর্মের। কেন হচ্ছে না, তার কারণ জানা যাবে তাঁর সদ্য প্রকাশিত প্রাচ্যবিদদের দাঁতের দাগ গ্রন্থটিতে। সভ্যতার সংকট বিষয়টি আধুনিক কিছু নয়। গ্রীকো পার্সিয়ান যুদ্ধগুলিকে এর সূচনা পর্ব বিবেচনা করলে- এর দূরবর্তী কালে তিন শত বছরের ক্রুসেডগুলি সভ্যতার সংকটকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে দেয়। তারও পরবর্তীতে ইউরোপ বিশ্বজয়ী ঔপনিবেশিক শক্তিতে আবির্ভূত হলে বিজয়ী হয় তাদের ভাষা- বিজয়ী করতে চায় তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে। আর ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বিজয়ী করতে গিয়ে প্রাচ্যে তাদের একমাত্র প্রতিপক্ষ হয়ে যায় ইসলাম। অতএব ইসলামের ধ্বংস কামনায় প্রতীচ্যের যে বিশাল কর্মযজ্ঞ ও সাধনা- এরই প্রচ্ছন্ন নাম প্রাচ্যবাদ। বলা প্রয়োজন- ইউরোপে রিফর্মেশন, রেনেসাঁ, ম্যাগনাকার্টা, ফরাসী বিপ্লব, মানবতাবাদ সহ কত কিছুরই জন্ম হয়েছে- এর মধ্যে। কিন্তু প্রতীচ্যের প্রাচ্যবাদিতার মূল লক্ষ্য ইসলামের বিনাশ সাধন থেকে বিচ্যুত হয়নি এক মুহূর্ত ও। অপর পক্ষে বিজয়ীর ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাববলয়ে গড়ে উঠা পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণী যেহনী গোলামী বরণ করে নেয় অবলীলায়। তারা পন্ডিত হয়ে উঠে পাশ্চাত্য বিদ্যায় আর প্রাচ্যবিদদের বিষ আকণ্ঠ পান ও ধারন করে হয়ে যায় নীলকণ্ঠ। ঐ বিশাল প্রেক্ষাপটে মুসা আল হাফিজ একজন তাত্ত্বিক ও গবেষক হিসাবে প্রাচ্যবিদদের দাঁতের দাগ রচনা করেছেন। এটি এক বিশাল কাজ, সফল কাজ এবং সময়ের মহত্তম গ্রন্থনা। গোটা জাতির উপর যে কাজ সময়ের প্রেক্ষাপটে জরুরী হয়ে উঠে, সে কাজের যোগ্য লোক জন্মদান যে কোন জাতির জন্য গর্বের। মুসা আল হাফিজের গুরুত্ব সেই জায়গায়। প্রাচ্যবিদরা সতর্ক শত্রুতায় আল্লাহ, রাসুল, কিতাব, সীরাত হাদীস ফেকাহ তথা ইসলামের সকল জায়গায় বিষদাঁত ফুটিয়েছে পান্ডিত্যের কৌশলে। আর মুসা আল হাফিজ তাদের স্বরুপ নির্ধারণ করেছেন ঐতিহাসিকের স্বনিষ্ঠ প্রজ্ঞায় এবং বলে ও দিয়েছেন ‘এটা জবাবী গ্রন্থ নয়। ওদের বহুমাত্রিক অভিযোগের পর্যালোচনা করবে এ ধারার পরবর্তী গ্রন্থ- এই সব অন্ধকার!’ সেই গ্রন্থের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান থাকবেন তাঁর সকল পাঠক। এটি আমার বিশ্বাস। আমাদের মাতৃপিতৃকুল নাশা মুসলিম নামধারী পন্ডিতকুল, যারা প্রাচ্যবাদের গরল ধারন করে সংশয়বাদী বা তথাকথিত মুক্তমনা হয়েছেন, তাদের হাতে এ বই উঠবে কি না, আমি জানি না। তবে মনে প্রাণে কামনা করি এ গ্রন্থটি তারা পড়–ক। আর হ্যাঁ, এই গ্রন্থ দারুনভাবে এ মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক এজন্য যে, তসলিমা নাসরিন সহ আমাদের তথাকথিত মুক্তমনা তরুণ ব্লগারদের বেদ-বাইবেল যে এই প্রাচ্যবিদদের বিষভান্ডার,- তা ও জানান দিচ্ছে এই গ্রন্থ। এ গ্রন্থের ব্যাপারে বাকবিস্তার আমি করব না। কারণ এর হৃদয়গ্রাহী ভাষা ও বিষয় বস্তুর অমোঘ নির্দেশনা এতই মোহনীয় যে- এর যে কোন উপক্রমনিকা অপ্রয়োজনীয় তথা অক্ষম হতে বাধ্য। হ্যাঁ, মুদ্রনপ্রমাদ আছে বইটিতে। কিছু ল্যাটিন ও ইংরেজী শব্দে বিভ্রাট থাকলে ও এর তাত্ত্বিকতা ও ইতিহাসচারিতায় কোন ফাঁক নেই। বইটি পড়তে যেয়ে বার বার মনে হয়েছে এটা শুধু প্রাচ্যবিদদের দাঁতের দাগ নয়, আঁতের দাগ ও। এটি পাশ্চাত্যের বিষের, ছোবলের বিশ্বস্ত চিত্রায়ন। হতে পারে, আমজনতার মধ্যে এই বিষ দৃশ্যমান নয়। কিন্তু ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিতজনদের এক বিশাল অংশ এই বিষে আক্রান্ত এবং স্ব স্ব অবস্থানে বিষবৃক্ষ ও!! সুস্বর কবি, বহুমাত্রিক লেখক ও হীরকদ্যুতির গ্রান্থিক মুসা আল হাফিজকে প্রাণজ বাংলার আত্মিক শুভেচ্ছা। পুনশ্চ: ভাই মুসা আল হাফিজ! সালাম আপনাকে। আপনার বইয়ের আলোচনা করতে হলে- আপনার বই এবং ভাষা উদ্বৃত করতে হয়। মজার কথা হচ্ছে বইয়ের আংশিক উদ্বৃতি ও এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়, বিধায় গোটা বইটি হাতে লিখে দিতে হয়!! আমি এই পন্ডশ্রম করলাম না- কারণ এটি এতই পূর্ণ এবং সুসজ্জিত যে, এখানে দাঁতের দাগ বসানো সম্ভব নয়।
কালাম আজাদ : বিখ্যাত কবি,প্রিন্সিপাল সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজ সিলেট