মানসিক ও শারীরিক টর্চারমুক্ত সৌহার্দপূর্ণ পাঠদান ব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ইসলামী তাহযিব-তামাদ্দুনে আগ্রহী করে গড়ে তুলুন।
আনুষ্টানিকভাবে পাঠশালার সূচনা কখন থেকে হয়েছে, তার সঠিক ইতিহাস হয়তো বলতে পারবো না। তবে পাঠদান শুরুর ইতিহাস অবশ্যই হযরত আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুরু হওয়ার ইঙ্গিত আমরা পাই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আদম আ. কে সকল বিষয়ের নাম শিখিয়ে ফেরেস্তাদের সামনে পেশ করে বললেন, এবার বলো দেখি?
তাহলে পড়া বা শিখার ইতিহাস মানব জীবনের সূচনা থেকেই বলা যায়। পড়ার পাশাপাশি লেখালেখি জ্ঞানের কথাও আমরা জেনেছি। এ তো মহান আল্লাহপাকের বিশেষ দান। আগেকার যুগে গুহার প্রবেশদ্বার, মাটি বা পাথরের ওয়াল, পশুর চামড়া, গাছের ছাল, লোহা, তামা, পুড়ামাটিতে মানুষ লিখত। আঁকাআঁকি করত। দেখা যেত কেউ একজন লেখা শুরু করেছে এবং লিখতে লিখতে গুহার প্রবেশদ্বার বা ওয়াল ভরে দিয়েছে। অত:পর কালক্রমে আসলো কাগজের যুগ। এখন তাও শেষ হতে চলেছে ইন্টারনেটের পাতায়। কাগজের গায়ে লেখালেখিও একসময় অচল হয়ে যাবে।
যাক, এবার আসি মূল কথায়। আল্লাহপাক এরশাদ করেন ‘আপনি বলে দিন, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা উভয়ে কি সমান?’ না তা কখনো নয়। কারণ, না জানা অন্ধকার সদৃশ আর জানা হল আলো সদৃশ। এজন্য দরকার নিজে আলোকিত হওয়া এবং অন্যকে আলোকিত করা। রাসুল সা.’র জামানায়ও মসজিদে নববীতে আসহাবে সুফ্ফা নামে মাদরাসা ছিলো । ওহীর জ্ঞানের জন্য সাহাবা রা.দের অন্তর ছিলো চাতক পাখির মতো পাগল পারা। রাসুলে আরাবী সা.’র সহচর্যে এসে আঁধারাচ্ছন্ন একটি জাতি হয়ে গেল জগত সেরা। শুধু জগতের সেরা নয়, সাহাবাদের ন্যায় এমন জাতি এই পৃথিবী কেবল ঐ একবারই দেখেছে। আর কখনো দেখবে না।
রাসুলে আকরাম সা. ছিলেন উস্তায আর সাহাবাগণ ছাত্র। সেই উস্তাযের অবস্থা হলো এই যে, ‘আল্লাহর রাসুল সা. জীবনে কাউকে আঘাত করেন নি; শুধু আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ ছাড়া। ‘প্রিয় রাসুল সা. কর্তৃক স্ত্রী-সন্তান, সহপাঠি, শিক্ষার্থী কাউকে আঘাত করার ইতিহাস নেই। হাদিসে এসেছে- ‘তোমরা ৭ বছর বয়সে সন্তানদের নামাযের শিক্ষা দাও। ১০ বছর হলে শাসন করো।’ এখন দেখুন উম্মতের মহান শিক্ষক প্রিয় নবী সা.’র কথা- ‘১০ বছর হলে শাসন করো।’ এই কথার মর্ম কি, শাসনটা কেমন ছিলো, বর্তমানে কেমন হচ্ছে আর নবী কথার তাৎপর্যে শাসনটা কেমন হওয়া উচিৎ; তা অবশ্যই আমাদের জানা দরকার।
একবার এক ছেলের পিতা মাতা নবী দরবারে এসে অভিযোগ দায়ের করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ সা.! আমাদের সন্তানটা ঘরে রাখা সকল মিষ্টি খেয়ে ফেলে। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে? এদিকে মিষ্টি জাতীয় জিনিস আল্লাহর রাসুল সা.’রও খুব প্রিয় ছিলো। আরজ করলেন যে, তোমরা আগামি সপ্তাহে এসো। তারা পরের সপ্তাহে এলে প্রিয় রাসুল সা. ছেলেকে ডেকে স্নেহমাখা কথায় বুঝাতে লাগলেন যে, বৎস! এভাবে ঘরের মিষ্টান্ন ভাণ্ডর উজাড় করে খেতে নেই। সে মাথা নাড়লো। ছেলেটির পিতা-মাতা একটু অবাকই হলেন বটে। তারা মনে মনে ভাবলেন, একথাটা তো আগেই বলে দিতে পারতেন। এক সপ্তাহ পর আসার কি দরকার ছিলো? তারা নবীজি সা.কে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে প্রিয় নবী সা. উত্তরে বললেন- দেখো, আমি নিজে কিন্তু মিষ্টি পছন্দ করি। এখন যাকে উপদেশ দেবো, তার আগে তো আমার নিজের উপর আমল করা উচিৎ। তোমাদেরকে এক সপ্তাহ পরে আসার কথা এ কারণেই বলেছি যে, এই এক সপ্তাহে মিষ্টির ব্যাপারে নিজেকে কন্ট্রোল করবো, তারপর কাউকে উপদেশ দিব। তাই তো গত এক সপ্তাহ আমি কোন মিষ্টি খাই নি। নিজের উপর আমল আছে বলে উপদেশ দিলাম। এখন কথা ও কাজে মিল থাকবে। এই ছিলো অবিস্মরণীয় আখলাক্ব। যুগশ্রেষ্ট শিক্ষকের অনুপম উপমা।
একজন শিক্ষকের জন্য এই ঘটনাটি মৌলিক দিকনির্দেশনা হিসাবে বিবেচিত হবে সন্দেহ নেই। আমাদের অবস্থা এমন যেন না হয় যে, ‘তোমরা লোকদেরকে পুণ্যের দিকে ডাকছো অথচ ভুলে গেছো নিজেদের কথা।’ একজন শিক্ষকের জন্য অপরিহার্য বিষয় হল, তিনি যা বলবেন, যা শিখাবেন বা দিক নির্দেশনা দিবেন তার বাস্তব নমুনা যেন তিনি নিজে থাকেন।
‘জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরজ।’ দুনিয়ার ইতিহাসে এমন গুরুত্বপুর্ণ কোনো বাণী ইতোপুর্বে ধরণী দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে। ‘যে জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কোথাও সফর করলো, আল্লাহপাক তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দিবেন।’ (সুবহানাল্লাহ)
উল্লেখিত বাণী দুটির আলোকে এখন বলতে হবে- মুসলমান মানে কেউ অশিক্ষিত হতে পারে না। মুসলমান হয়ে কেউ মুর্খ থাকতে পারে না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, চারপাশ তাকালেই আমরা দেখতে পাই অজ্ঞতা, অন্ধত্ব, মূর্খতা, জেহালত এই মুসলমানদের মাঝেই বেশি। যে সমাজকে জ্ঞানার্জনের জন্য ফরজ বিধান রাখা হয়েছে, সে জাতি আজ মূর্খতা, অন্ধত্ব আর জেহালতের চাদরে আচ্ছাদিত। আল্লামা ইকবাল যথার্থই বলেছেন- ‘ওরা জামানায় সম্মানিত হয়েছিলো মুসলমান হয়ে, আর তোমরা বিনাশ হতে চলেছো কুরআন সাধনা ছেড়ে।’
আল্লাহর রাসুল সা. এরশাদ করেন, “যখন কোন মানবসন্তান জন্মগ্রহণ করে, তখন তার পিতা-মাতার উপর কয়েকটি দায়িত্ব বর্তায়। যেমন- সুন্দর অর্থবহ একটি নাম রাখা। চুল মুণ্ডন করা ও চুল পরিমাণ কোনো কিছু সদকা করা এবং আক্বীক্বা আদায় করা। তাকে দুধপান করানো। উত্তমভাবে লালন-পালন করা। যখন সে কথা শিখবে, তখন প্রথম আল্লাহর নাম শিখানো। [এসম্পর্কে বিস্তারিত তারবিয়্যাতুল আতফাল বলে পুরো একটি পরিচ্ছদ হাদিস ও ফিক্বাহের বিভিন্ন কিতাবে আছে।]
আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে মেয়ে সন্তান হলে জীবন্ত মাটি চাপা দেয়া হত। কন্যা সন্তানকে তারা অপমানের কারণ মনে করত। সে যুগে নারী জাতির কোনো মূল্য ছিলো না। ইসলাম এসে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। অন্ধকার যুগের কু-সংস্কার সমূহ চিরতরে বিদূরিত করেছ্। কন্যা সন্তান পালনে উদ্ভুদ্ধ করা হয়েছে। যেমন- একজন, দুজন বা তিনজন মেয়ে হলে জান্নাতের ওয়াদার কথা কে না জানি। মানুষ হিসেবে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্য সমান; বরং মেয়েদের ক্ষেত্রে অধিক সর্তক ও যত্নবান এবং বেশি করে সাপোর্ট দেয়ার কথা আছে। মায়ের অধিকারের কথা তিন তিনবার বলা হয়েছে। চতুর্থবার বলা হয়েছে পিতার কথা। বলা হয়েছে- জান্নাত মায়ের পায়ের নীচে। মাতা পিতার চেহারার দিকে নেক নজর মকবুল হজ্জের সমান সওয়াব বলে ঘোষিত হয়েছে।
আলো ঝলমল সেই দ্বীনের অনুসারীরা দেউলিয়া হয় কিভাবে? মুর্খ হয় কি করে? মুসলমানরা আজ ইলমের চেয়ে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তাই দুনিয়া তাদের থেকে অনেক দূরে। জ্ঞানীর কদমে কদমে দুনিয়ার অবস্থান। আজ গোটা ইউরোপ আমেরিকা সামাজিক মানদণ্ডে কত উপরে! তাদের প্রতিটি অলি গলিতে আছে লাইব্রেরি। দুনিয়াবি দৃষ্টিভঙ্গিতে সেখানকার সমাজে কেউ মুর্খ থাকবে; তা কল্পনাও করা যায় না। যে জাতির ওহীর সূচনা ‘পড়’ এবং ‘লেখ’ দিয়ে, তারা আজ নিজে নিজে মারো এবং মরো এই আত্মকলহে লিপ্ত। যদিও আদর্শিক আধ্যাত্মিকতার মানদণ্ডে ইউরোপে শুন্যতা বিরাজমান। কিন্তু জাগতিক ও মানবিক ক্ষেত্রে তারা একটি মডেল ও অনুকরণীয় অবকাঠামো গড়ে তুলেছে এবং তা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
শিশু অধিকার, নারী অধিকার, মানবাধিকার এসব হল তাদের শ্লোগান। তাদের এসব শ্লোগানে চতুরতা, নিষ্পেষণ এবং অপরাধ প্রবণতা আছে, কিন্তু বাহ্যিকভাবে তো তারা বিশ্বকে কিছু একটা দেখাতে পারছে বলেই গোটা বিশ্ব ইউরোপ পাড়ি জমাতে মরিয়া।
উন্নত বিশ্বের শিশুরা এতো তাড়াতাড়ি ব্রিলিয়ান্ট হয় কেমনে? কী করে?
আসলে ইউরোপের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দেখার মত, বুঝার মত, অনুধাবন করার মত এবং শিখার মত অনেক কিছু আছে। প্লে গ্রুপ থেকে প্রাইমারী বিভাগ। নিম্নমাধ্যমিক থেকে হাইস্কুল বিভাগ। প্রতিটি স্কুল যেন একেকটি পরিবার। একটি সংসার। একটি ছোট্ট রাষ্ট্রের সাথেই তুলনা করা যায়। মা-বাবার ভালবাসা, ভাই-বোনের সোহাগ ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলমুখি করে রাখে। স্কুল ছাড়া সেখানকার শিশুদের দিন অলস হয়ে ওঠে। আমার কিশোরী মেয়ের একশত ডিগ্রি জ্বর নিয়ে স্কুলে যাওয়া দেখে আমি হতবাক না হয়ে পারি নি। এই শিশুরা কোনো কারণে স্কুলে না যেতে পারলে সারাদিন কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে ওঠে! পিত-মাতাও কেমন যেন অস্বস্থিবোধ করেন। তাদের জন্য যখন আরবির জন্য গৃহ শিক্ষক রাখা হয়, তখন তারা কেঁদে কুটে বুক ভাসায়। কিংবা শনি রবির বন্ধে সাবাহী মক্তবে যেতে যেন আসমান ভেঙ্গে মাতায় পড়ে। আমি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, সমাধানের পথও বের করলাম।
আমি যখন সমাধানে গেলাম, তখন বাংলাদেশিমেইড কোন শিক্ষককে দু:খজনকভাবে আন-নূর ইসলামিক স্কুলে খেদমতে রাখার সুযোগ আর থাকলো না। আমরা তো এমন এক পরিবেশে বড় হলাম আর শিখলাম, যেখানে জালিবেতের বাড়ি, রুলার, বাঁশের কঞ্চি, লাঠি, কানমলা এবং আরো কতো কিছু! ‘হুজুরের মাইর যে জায়গায় লাগে, সে জায়গা বেহেস্তে যায়’ ইত্যাদি। নানান কিসিমের শাস্তি আর তাযির তো আছেই! সাউটিং বা জোরে জোরে শব্দ করে শাসানো যে অন্যায়, তা একসময় জানা ছিলো না। এমনও শিশু দেখেছি, সামান্য সাউটিং এর কারণে অসুস্থ হয়ে ডাক্তারে নিয়ে যেতে হয়েছে। তাই শিশু নির্যাতন হয় কিভাবে, তা আমরা অনেকেই জানি না।
শিশুদের সাথে কথা বলা, উপস্থাপনা ভঙ্গি, চাহনি, বডির ভাষা, ইশারা-ইঙ্গিত সবকিছুর একটি সীমা আছে। নীতিমালা আছে। আমাদের সমাজে ট্রেনিং ছাড়াই শিক্ষক নিয়োগ হয়। অযোগ্যের প্রোডাকশন হয়। যারা নীচের ক্লাসে পড়ান, তাদের কোয়ালিটি ভিন্ন থাকা জরুরি বলে মনে করা হয় না। অথচ ইউরোপে নিচের ক্লাসের শিক্ষকদের দ্বায় বড়। বেতন বেশি। ট্রেনিং বেশি। সচেতনতা অধিক।
শিশুদের মন-মেজাজ শারিরিক-মানসিক বিষয় সম্পর্কে একজন শিক্ষককে ভালোভাবে অবহিত থাকা জরুরি। প্রতিদিন কত সময় পড়ানো যায়, কতটুকু একটা ক্লাস এক সাথে চলতে পারে? মুখস্থ করানোর কলা-কৌশল, সবক দানের উত্তম পন্থা অবশ্যই জানা আবশ্যক। আমাদের দেশের স্কুলের কথা নাই বা বললাম; কিন্তু মাদরাসা নিয়ে যেহেতু ভাবি, ভাবায় আমাকে; সেদিকের কথা মনে রেখেই আজকের অবতারণা। এখানে পড়ানো ও শিখানোর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করার অবকাশ নেই। শুধু বলবো, আমরা যা করছি, তা নিয়ে যেন একটু ভাবি। সামান্য হলেও গবেষণা করি। যাচাই বাছাই করি। জগতে আর কোথায় কি হচ্ছে, তা জানার এবং বোঝার চেষ্টা করি। দরজা বন্ধ করে গেইটে তালা মেরে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে হাত-পায়ে আঘাত কোনটিই কাজে আসবে না; যদি না আপনি তার মনের ভাষা বুঝতে পারেন। ২৪ঘণ্টর মাঝে ১৬ঘণ্ট পড়িয়ে আট ঘণ্টার ছুটি দিয়ে কেল্লাহ ফতেহ হবে, তা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।
কোন বয়সের ছাত্র কার সাথে বসবে, কোন প্রকারের পরিবেশে বসছে, প্রচণ্ড গরম না ঠাণ্ডা, তা জানা দরকার। পাঠ্য পুস্তকের বেলায়ও বিবেক-বিবেচনা করে নির্বাচন করুন। শিক্ষক নিয়োগের আগে জানা উচিৎ তিনি এই বয়সের সাথে কতটুকু মানানসই।
আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইউরোপিয়রা সেরা! কেনো সেরা ? তারা কি জোর করে সেরা হয়েছে? কে আপনাকে বাঁধা দিয়েছে সেরা না হতে? অলস অকর্মন্য জাতির কেবল বাহানা আর বাহানা। আমার কাছে সবচেয়ে খারাপ একটি দিক হলো যে, কওমি মাদরাসা যে জাগায় শুরু হয় বা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে, সেখানের কর্মকর্তাবৃন্দ মোটেই জানেন না যে, এখানে কতটুকু কি করবেন!? রুমের পর রুম বাড়িয়ে ক্লাস বৃদ্ধি একটি সহজাত নীতি-পদ্ধতি বা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ জানা উচিৎ ছিলো যে, এখানে কতজন ছাত্রের সঙ্কুলান হবে? তাদের ক্লাসরুম, নামাযের জায়গা, লাইব্রেরী, কমনরুম টয়লেট, বিশ্রামাগার, খাবার ঘর, খেলধুলা ও অভিভাবকদের বসার জন্য পর্যাপ্ত স্থান আছে কিনা- এসব ভেবে ক্লাস বৃদ্ধির চিন্তা করা।
কোন এক টাইটেল মাদরাসার প্রাইমারী বিভাগের প্রধান শিক্ষক ছাত্র ও অভিভাবকদের নিয়ে প্রগ্রেস মিটিং করলেন। কিছু অভিভাবক মায়েরাও এসেছিলেন। পর্দা সহকারে বসার ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু পরবর্তিতে উর্ধতন কর্তৃপক্ষ তাকে ভালমন্দ বকাঝকা দিলেন যে, মাদরাসার ভিতর মহিলা কেন আসবে? আমি শোনে বললাম, আচ্ছা যদি তাদের পিতা না থাকে, তখন কি ঐ নারী একজন পুরুষ অভিভাবক হায়ার করে নিয়ে আসতে হবে? আমাদের ঘরে কি মা বোন নেই? আমাদের এই মাদরাসা বাউন্ডারির ভিতরে যদি পর্দানশীন মা বোনেরা এসে নিরাপদে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আমরা বিপদেই আছি।
অবশ্যই এখানে নারীরা প্রদর্শনির জন্য আসবে না। দ্বীনের প্রয়োজনে আসবে। দ্বীনী মাহাওলে দ্বীনদারী বজায় রাখার পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের আহবান করতে হবে।
২য় বিষয় হলো: ইসলামী তাহযিব-তামাদ্দুনে প্রত্যক্ষভাবে আগ্রহী করে গড়ে তুলা।
দেখা গেছে ২৪ঘণ্টা দ্বীনদারীর পরিবেশে থেকেও ছাত্ররা জামাতে নামায পড়ে না। ফজরে উঠে না। দাড়ি কাটে। মিথ্যা কথা বলে। বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হয়। শিশুরা সারাদিন মাদরাসায় পড়ে। ঘরে ফিরে টিভি সিরিয়ালে নাটক-সিনেমা দেখে অনৈসলামিক কার্যকলাপের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ঠিক বিপরীত দিক উন্নত বিশ্বে। যখন আমরা দেখি আমাদের সন্তানরা স্টেইট স্কুলে যায়। ঘরে বাহিরে রাস্তায় সবখানে যা চোখে পড়ে, তা হয়তো বাংলাদেশের কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। সেখানে তো অধিকাংশ মুসলমানের সন্তানরা ভালো থাকে। খারাপ হচ্ছে না এমনও না, কিন্তু যেখানে পুরোটাই খারাপ হওয়ার কথা, সেখানে ঘটছে উল্টো। আর যেখানে পুরোটাই ভালো থাকার কথা, সেখানে হচ্ছে বিপরীত। তাই চিন্তার বিষয়- এখানে রহস্য কি? প্রথমতঃ বলবো ইউরোপের মুসলমানরা বুঝে শোনে মুসলমান। যাদের পিতা-মাতা সচেতন তাদের সন্তানরাও সচেতন। আর যারা অসচেতন তারা উভয় কূলই হারান। অপরদিকে বাংলাদেশের কথাই বলি যেন আমরা গরু খাওয়া মুসলমান। ইসলাম যে একটি শিখার বিষয় ট্রেনিংএর বিষয় জানা বোঝা এবং মানার বিষয়, তা কেউ গুরুত্ব দেয় না। বাবা মুসলমান, মা মুসলমান ব্যস্! তার নামও মুসলমান! আর কি লাগে? তাই দ্বীনী শিক্ষার সাথে প্রত্যক্ষভাবে তাদের হৃদয়ঙ্গম করানো উচিৎ। আমরা ভাবি ইসলাম যেন বোবা সংস্কৃতি। যেখানে হাসি নেই, খেলাধুলা নেই, আনন্দ ফুর্তি বলতে কিছুই নেই, আছে কেবল কান্না আর কান্না।
যখন প্যারিস সফরে ছিলাম, তখন এক ভদ্রলোক; যিনি এক মসজিদের ভাইস চ্যায়ারম্যানও বটে, আমার কাছে জানতে চাইলেন যে, হুজুর! আমার ছেলে তো মসজিদে আসতে চায় না। কারণ, একদিন ওয়াজে এসে শোনলো এক হুজুর বলছেন যে, ‘আমরা কুকুরের চা্ইতে আরো নিকৃষ্ট!’ তো আমরা মানুষ হয়ে আবার কুকুরের চাইতে খারাপ কেমনে হলাম? বললাম আপনার ছেলেটা ভুল মাহফিলে বসেছিলো হয়তো। কারণ স্বামী-স্ত্রীর ওয়াজ যদি দশ বারো বছরের শিশুকে শোনানো হয়, তখন কেমন লাগবে? সত্তর বয়সী ওয়াজ তো সাত বছরে মানায় না।
বললেন যে, মসজিদে আসলে তাকে কেউ হাগ করে মায়া দেয়, কেউ বুকে জড়িয়ে ধরে, তো কারো শরীরে দুর্গন্ধ; সে তা খারাপ পায়? বললাম, এই ছোট্ট বয়সে সবাই তাকে কেন হাগ করবে, বুকে জড়িয়ে ধরবে? কিস দেয়ার কোন অধিকার তো কারো নেই! ঈদের কোলাকুলি তার সমবয়সীদের সাথে করবে। মাতা-পিতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, ভাই-বোন হয়তো কিস দিতে পারে, বাহিরের লোক কিস দেয়ার কোন অধিকার যে নেই। আর মুয়ানাক্বা-মুসাফাহাতো ইসলামের বিধান। আপনার বাচ্চাকে ইসলামি তাহযিব-তামাদ্দুন, আদর্শ-আচরণ-আখলাক্ব সম্পর্কে আগে শিক্ষা দিন, পরিচয় করিয়ে দিন। দুর্ঘন্ধ তো ব্যক্তি বিশেষের দোষ, ইসলামের দোষনা। পিয়াঁজ রসুন খেয়ে মসজিদে না আসতে বারণ করা হয়েছে। দুর্ঘন্ধের কারণে যেখানে রহমতের ফেরেস্তা আসেন না। যে নবীর উম্মতের নামাজ মিসওয়াক ছাড়া সওয়াবের ক্ষেত্রে অসম্পুর্ণ, সেই নবীর উম্মত থেকে তো খুশবো আর খুশবো আসা উচিৎ। প্রিয় রাসুলের ঘামের সাথে মিশকে আম্বর ঝরতো। তাই দোষ ইসলামের নয় আমাদের উপস্থাপনার বিচক্ষণতায়।
অতএব, ইসলামী তাহযিব-তামাদ্দুন, আদর্শ-আখলাক্ব-সম্পর্কে নিজে সচেতন হই, পরিবারে সচেতনতা সৃষ্টি করি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান যেন আক্ষরিক অর্থে উত্তম আদর্শের উপমা হয়, সেভাবে গড়ে তুলি।
লেখক : খতিব ও চিন্তক
আরও পড়ুন :
১ম দফা : একক কওমি শিক্ষাবোর্ড বাস্তবায়ন করুন।
২য় দফা : আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় সাধিত সিলেবাস প্রণয়ন করুন।
৪র্থ দফা : আধুনিক আরবি ভাষাশিক্ষা ব্যবস্থা চালু করুন; বাংলা ইংরেজির গুরুত্ব দিন।