Friday 22nd November 2024
Komashisha familyAdvertisementContact । Time: সকাল ৬:০৩
Home / এশিয়া / চিনে মুসলিম আবাস, উইঘুর মুসলমানরা আজ বাস্তুহারা

চিনে মুসলিম আবাস, উইঘুর মুসলমানরা আজ বাস্তুহারা

wegur muslimচলতি বছর চীন তার গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ৬৬ বছর, বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর এবং শিনচিয়াংয়ের মুসলিমদের জন্য বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ৬০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করছে। প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান গত ৩১ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর চীনের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ শিনচিয়াং ও রাজধানী বেইজিং সফর করেন। চীনের, বিশেষ করে শিনচিয়াংয়ে ধর্মীয় ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা নিয়ে তাঁর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হলো আজ।

চীনের পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত স্বর্ণ, তেল ও গ্যাসসম্পদে সমৃদ্ধ শিনচিয়াং প্রদেশটি আয়তনে ১০টি বাংলাদেশের সমান, আটটি দেশের সঙ্গে তার সীমান্ত আছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও চীন সরকারের মতে প্রদেশটি অনগ্রসর। কিন্তু সেখানকার পশুপালনকারী রাখাল ছেলেটিরও মাসিক গড় আয় প্রায় ৯০ হাজার টাকা। এই প্রদেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সোয়া দুই কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটিই দেখতে মধ্য এশীয়দের মতো—উইঘুর সুন্নি মুসলমান। তারা চীনা নয়, উইঘুর ভাষায় কথা বলে, যা তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। বিচ্ছিন্নতাবাদ ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদের হিংসাত্মক তৎপরতায় জেরবার এই প্রদেশ। উইঘুর জঙ্গিদের প্রধান সংগঠন ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টকে (ইআইটিএম) যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে তারা শিনচিয়াংয়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও উইঘুরদের ওপর নিপীড়ন নিয়ে উচ্চকিত। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক চীনের সমালোচনায় উচ্চকিত। কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ দেশ শিনচিয়াংয়ের পরিস্থিতিকে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে।
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) চেয়ারম্যান মুন্সি ফয়েজ প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চিমা জগৎ শিনচিয়াং নিয়ে যা বলে, তাতে অতিরঞ্জন আছে। আবার এও ঠিক যে তিব্বত ও শিনচিয়াং নিয়ে চীন সত্যিই সংকটে আছে। তবে বাংলাদেশ কখনো এ বিষয়ে বক্তব্য রাখেনি।
‘ভারত শিনচিয়াংয়ের পরিস্থিতিকে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে’, মুঠোফোনে প্রথম আলোকে মন্তব্য করেছেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিদেশনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট সি. রাজামোহন। গত ১৭ আগস্ট থাইল্যান্ডের হিন্দু মন্দিরে সন্দেহভাজন উইঘুর উগ্রপন্থীদের বোমা হামলার বিষয়ে তিনি অবশ্য কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ এবং সিল্করুট-সংক্রান্ত জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফগানিস্তান ও পাকিস্তান টাস্কফোর্সের বিশেষজ্ঞ গ্রুপের সদস্য সিগফ্রিড ও. উলফ প্রথম আলোকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে শিনচিয়াংয়ের উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান, যিনি বর্তমানে ওয়াশিংটন সফর করছেন, তিনিও একই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।
বিশ্বের ১৩টি দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্প্রতি শিনচিয়াং সফরে গিয়ে বারবার প্রশ্ন জেগেছে, এখানকার মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে কি বাংলাদেশের একশ্রেণির জিহাদিদের কোনো ধরনের যোগাযোগ ঘটে থাকতে পারে?
২ সেপ্টেম্বর শিনচিয়াং কলেজ অব এথনোলজি অ্যান্ড সোসিওলজির অধ্যাপক দিলমুরাত ওমর এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘না, এখন পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশের কোনো উগ্র গোষ্ঠীর সঙ্গে শিনচিয়াংয়ের উগ্র গোষ্ঠীর যোগসাজশের হদিস পাইনি।’
আট দিন বাদে ১০ সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অবতরণ করেই পত্রপত্রিকায় শিরোনাম দেখলাম, ১৭ আগস্ট থাইল্যান্ডের একটি হিন্দু মন্দিরে বোমা হামলার প্রধান সন্দেহভাজন আইজান ঢাকায় এসেছিলেন। অবশ্য এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাও হতে পারে। ওই বোমা হামলায় ২০ জন প্রাণ হারিয়েছে। থাইল্যান্ডের পুলিশ বলেছে, ইতিমধ্যে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে এই হামলার পেছনে একটি আন্তরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের সক্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরেক সন্দেহভাজন ব্যক্তি বিস্ফোরণের ঠিক আগে পাকিস্তানে প্রবেশ করে বলে পাকিস্তান সরকার স্বীকার করেছে। মালয়েশীয় সরকার দুই মালয়েশীয় ও একজন পাকিস্তানিকে গ্রেপ্তার করেছে। থাই পুলিশ বলেছে, তারা তাদের দেশের দক্ষিণ সীমান্তে রোহিঙ্গা পাচারের ওপর সাম্প্রতিক ক্র্যাকডাউনের আলোকেও বোমা হামলার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। মিয়ানমারে গ্রেপ্তার হওয়া এক বাংলাদেশির ব্যাপারেও সতর্ক রয়েছেন থাইরা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উইঘুর মুসলিমরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ জায়গা করে নিচ্ছে। ধারণা করা হয়, গত জুলাইয়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া ১০৯টি উইঘুর পরিবারকে জবরদস্তি করে চীনের কাছে হস্তান্তর করার কারণে থাইল্যান্ডে প্রতিশোধমূলক হামলার ঘটনা ঘটে। ২২ সেপ্টেম্বর থাই পুলিশপ্রধান জেনারেল সোমিয়ত বলেন, ‘গত মে মাসে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের গণকবর আবিষ্কারের সময় অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে চীনা উইঘুররাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা আন্তর্দেশীয় আদম পাচারের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলাম। এটা তারই প্রতিশোধ।’
ঢাকার চীনা দূতাবাসের একজন মুখপাত্র প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বিষয়টি মিডিয়ায় দেখেছেন। এখন তদন্ত করে দেখছেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো চীনা উগ্রপন্থীর বাংলাদেশে অবস্থান প্রকাশ পেল। এটা দুঃখজনক যে পুলিশ প্রথমে এটা স্বীকার করতে চায়নি। পরে থাই সরকারের চাপের মুখে তারা স্বীকার করেছে। তাদের উচিত হবে এ বিষয়ে একটি সর্বাত্মক তদন্ত চালানো; বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কালে নাশকতাকারীদের একটি আঞ্চলিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। গত ১৫ আগস্টকে ঘিরে ভারতে সম্ভাব্য হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে হায়দরাবাদে সম্প্রতি বাংলাদেশি হুজির দুজন সদস্য ধরা পড়েছে।’
উল্লেখ্য, উইঘুর উগ্রপন্থীরা সিরিয়া, আইএস, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে ছড়িয়ে পড়েছে। শিনচিয়াং পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জেনারেল মনিরুজ্জামান বলেন, ‘অন্তত এটা অনুমেয় যে ওই চীনা সন্দেহভাজন আইজানের পক্ষে একটি সমর্থক নেটওয়ার্ক ঢাকায় থাকলেও থাকতে পারে। বাংলাদেশে নিরাপদে তাঁর দুই সপ্তাহ অবস্থানও ইঙ্গিত দেয় যে এ দেশে তাঁর পূর্বযোগাযোগ থাকতে পারে। এটাও লক্ষণীয় যে থাইল্যান্ডের নাশকতার পরিকল্পনা করে তিনি ঠিক বিস্ফোরণের দিনটিতে বাংলাদেশে থাকাই তাঁর পরিকল্পনার জন্য অনুকূল ও নিজের জন্য বেশি নিরাপদ মনে করেছেন। তাই আমি বলব, বাংলাদেশ একটি নতুন নিরাপত্তাগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।’
অবশ্য সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ, যিনি চীনা ভাষা রপ্ত করেছেন এবং একাধিকবার শিনচিয়াং সফর করেছেন, তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টিকে অবশ্যই সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত। চীনের পশ্চিমাঞ্চল বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে। সুতরাং, সেখানকার উগ্রপন্থীদের বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ফায়দা লাভ করা দুরূহ।
মুন্সি ফয়েজের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে জার্মান বিশেষজ্ঞ সিগফ্রিড বলেন, ‘একে একটি ইঙ্গিত হিসেবে দেখতে হবে যে উইঘুর সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য ও কৌশলগত পরিধি বিস্তৃত করছে। তাদের লক্ষ্য কেবল শিনচিয়াংয়ের স্বায়ত্তশাসন কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য লড়াই চালানো নয় বরং আন্তর্জাতিকভাবে “মূলধারার জিহাদের” সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা। এটা মনে রেখেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশ একটি অসাধারণ ভূরাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে।’ ভবিষ্যতে হতে পারে, তবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে উইঘুুরদের ব্যবহার জুতসই নয়, মন্তব্য করেছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। উল্লেখ্য, ১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ইন্টারপোল তুরস্কে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী যোদ্ধা’ বিষয়ে প্রায় ৫০টি দেশের গোয়েন্দাদের নিয়ে বৈঠক করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। এতে নিবন্ধকারদের অনেকেই চীনাসহ বিদেশি জঙ্গিদের মধ্যে আন্তর্দেশীয় যোগাযোগ জোরালো হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। মনিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কেউ কেউ মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন।
এদিকে পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকে নিরাপদে আইজানের ঢাকায় অবস্থান এবং প্রস্থানের ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মো. নজরুল ইসলাম ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, ‘থাই সরকার আমাদের ১০ সেপ্টেম্বরে আইজানের উপস্থিতির কথা জানিয়েছিল। এর ১০ দিন আগেই তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি কোথায়, কীভাবে ছিলেন, তা এখন গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছে।’ তবে গতকাল সোমবার ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৬ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ বিমানে চেপে ঢাকায় পৌঁছানোর আগে ঢাকা বুকিংডটকমের মাধ্যমে বনানীর একটি মধ্যম মানের হোটেলে রিজার্ভেশনের চেষ্টা করেন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায় তিন সপ্তাহ অবস্থানকালে ওই হোটেলে তিনি ওঠেননি। চলতি বছরে ঢাকায় এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় সফর।’ ইন্টারপোল আইজানের বিষয়ে বাংলাদেশের কাছে তথ্য চেয়েছে।
চীনের মোট ভূখণ্ডের ছয় ভাগের এক ভাগজুড়ে থাকা প্রদেশটিতে দীর্ঘকাল ধরে চাপা রাজনৈতিক উত্তেজনা ও ধরপাকড় চলছে। ১ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিনচিয়াং ও বেইজিংয়ে বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশের ২৩ জন জ্যেষ্ঠ মিডিয়া প্রতিনিধির সঙ্গে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও সরকারি কর্মকর্তারা সিল্করুট বাস্তবায়ন, ধর্মীয় উগ্রতা ও সন্ত্রাস দমন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। তাঁরা বলেছেন, শিনচিয়াং পরিস্থিতি চীন সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং সেখানে ব্যাপকভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস শিনচিয়াংয়ের উন্নয়নের প্রতি একটি হুমকি হয়ে আছে। উইঘুুর সন্ত্রাসীরা বিদেশের মাটিতে ‘কামানের গোলা’ হিসেবে বিক্রিও হচ্ছে।

আগামীকাল: ধর্মীয় স্বাধীনতা মানে বিধিনিষেধ না থাকা নয়

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

সুত্র: প্রথম আলো

Check Also

11952737_10203492839121119_6689770968709660701_o

কুরআন-হাদিস নাগালে আছে, আলেমদের কথা শুনবো কেন?

ফাহিম বদরুল হাসান :: কুরআন-হাদিস নাগালে আছে, আলেমদের কথা শুনবো কেন? এরকম কথা রাসূলের শানে ...