Tuesday 21st May 2024
Komashisha familyAdvertisementContact । Time: সকাল ৯:৫২
Home / Contemporary / হিজরী সন : ইসলামী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ

হিজরী সন : ইসলামী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ

Shah-Nazrul-Islamশাহ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম ::

(১ম পর্ব) সারাংশ : হিজরী সন মুসলিম উম্মাহ’র আপন সন। হজ্জ যাকাত রোযা শবেকদর শবেবরাত শবেমে’রাজ আশুরা ইতিকাফ তারাবীহ দুই ঈদ সাদকাতুল ফিতর কুরবানী শাওয়ালের ৬ রোযা ইত্যাদি ইবাদত হিজরী সনের সাথে সম্পৃক্ত। মহান আল্লাহ মানুষকে ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। ঈমানের পর ইবাদাত হচ্ছে মানুষের মূল আরাধনা। হিজরী সনের মাসসমূহ এই উপাসনার সাথে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। সুতরাং মুসলমানদের জন্য হিজরী সন গণণা আবশ্যক। হিজরী সন হচ্ছে চান্দ্র সন। এ সনের প্রথম মাস হচ্ছে মুহররাম। যিলহাজ্জার গত ২৯ তারিখে বিদায় হলো ১৪৩৬ হিজরী । এবার নানা মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো হজ্জ। আল্লাহর ঘরের মেহমান হাজী সাহেবানদের আপন ঘরে ফেরার মধ্যেই শুভাগমন হলো ১৪৩৭ হিজরীর। ইবাদত-বন্দেগীর নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ও মুসলমানদের দুর্গতির অবসানের প্রত্যাশায় আল্লাহর বান্দাদের কাছে নতুন বছরের গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিম হিসেবে হিজরী নববর্ষ উদযাপন কিংবা মুসলমানদের গৌরবের এ দিনটি পালনের ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকতা লাভ করেনি। অনেকে আমরা জানিও না যে, হিজরী নববর্ষ কোন মাসে আসে আর কোন মাসে যায়? আমরা হিজরীবর্ষ গণনার সঠিক ইতিহাস জানার গরজও অনুভব করি না। অথচ মুসলিম হিসেবে এটি আমাদের সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ হওয়া উচিৎ ছিল। আলোচ্য প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গেই যৎকিঞ্চিৎ আলোচনার প্রয়াস পাব।
কুরআন মাজীদে চন্দ্র সূর্য এবং সন ও মাস প্রসঙ্গ
মহান আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য বুঝা বড়ই কঠিন। তারপরও মানুষের সসীম শক্তি অসীমের সন্ধানে সর্বাদাই তৎপর রয়েছে। যমীন-আকাশ, চাঁদ সুরুজ, নক্ষত্র-তারা, গ্রহ-উপগ্রহ, নীহারিকা-ছায়াপত, সবুজ বনানী, সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত প্রবৃত্তির সৃষ্টি  রহস্য মানুষ জানতে চায়। মানুষের অনুসন্ধিৎসার শেষ নেই। মহান আল্লাহ তৎপ্রতি প্রণোদনা দিয়ে কুরআন মাজীদে ঘোষণা করেছেন-

إنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنْفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ مَاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ

‘নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে, মানুষের উপকারের জন্য সমুদ্রে জাহাজ ভাসার মধ্যে আকাশ থেকে আল্লাহর পানি বর্ষণে, মৃত পৃথিবীর পুনরুজ্জীবন পাওয়ার মধ্যে, বায়ু প্রবাহে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে মেঘমালার চলাচলে জ্ঞানবান লোকের জন্য নিদর্শনসমূহ নিহিত রয়েছে।’ (সূরা বাকারা-২/১৬৪)
সৃষ্টির শুরু থেকেই মাসের সংখ্যা ছিল বারো, এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ ঘোষণা –

اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ

‘নিশ্চয়ই আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনার মাস বারোটি, এর মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ সম্মানিত মাসসমূহে তোমরা নিজেদের উপর যুলুম করো না।’ (সূরা তাওবা : ৯/৩৬)

هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُورًا وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ مَا خَلَقَ اللَّهُ ذَلِكَ إِلَّا بِالْحَقِّ يُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ (৫) إِنَّ فِي اخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَمَا خَلَقَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَّقُونَ (৬)

‘তিনি সূর্যকে উজ্জ্বল ও চন্দ্রকে জ্যোৎস্নাময় করেছেন ও তাদের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন-যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেন নি। যাতে জ্ঞানী লোকেরা তাঁর নিদর্শন পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে।’ (সূরা ইউনুস ১০/৫)
মানুষের দৃষ্টি যতদূর যায়, দূরবীক্ষণে রকেটে দূর হতে দূরান্তরে ফাঁকা জায়গা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। এই অসীম ফাঁকা স্থানের মাঝে আছে অগণিত লক্ষ কোটি তারার রাজ্যÑআছে সূর্য, চন্দ্র গ্রহ, উপগ্রহ, পৃথিবী। এসব মিলে এ রাজ্যের নাম আসমান-নীল আকাশ। মহান আল্লাহ বলেন,

اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ مُسَمًّى يُدَبِّرُ الْأَمْرَ يُفَصِّلُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ بِلِقَاءِ رَبِّكُمْ تُوقِنُونَ (২)

‘আল্লাই ঊর্ধ্বদেশে আকাশম-লী কোনরূপ স্তম্ভ ছাড়াই স্থাপন করেছেন, তোমরা তো দেখতে পাও, অতপর তিনি আরশে সমাসিন হলেন, এবং সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মাধীন করলেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রন করেন এবং নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাত সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার।’ (সূরা রা‘দ ১৩/২)

وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ

‘তিনিই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত, দিন, সূর্য ও চাঁদকে; আর তারকারাজিও অধীন রয়েছে তাঁরই নির্দেশে। অবশ্যই এতে বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিশ্চিত নিদর্শন। (সূরা নাহাল-১৬/১২)

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ

‘লোকেরা তোমাকে নতুন চাঁদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করে। বল,‘উহা মানুষ ও হজ্জের জন্য সময় নির্দেশক।’ (সূরা বাকারা ২/১৮৯)
সুতরাং চাঁদ ইসলামের প্রায় সকল ইবাদতের সাথে জড়িয়ে আছে। আমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখি, চাঁদ দেখে ঈদ করি, চাঁদের দর্শনে হজ্জ ও কুরবানী বারে বারে আসে, শবেকদর, শবেবরাত, শবেমে‘রাজ বিশ্ব মুসলিম সমাজে এক আনন্দের হিল্লোল বয়ে নিয়ে আসে। তাই চাঁদ মুসলমানদের ধর্র্মীয় জীবন সাথী।
হিজরী সন ও হিজরতের প্রেক্ষাপট
নতুন চাঁদখুব সংক্ষেপে বলতে গেলে হিজরী সনের প্রেক্ষাপট হচ্ছে হযরত উমর রা.-এর খিলাফত আমলে পত্রাবলীতে সন তারিখ না থাকায় প্রশাসনিক জটিলতা। অন্যদিকে কাফিরদের চরম নির্যাতন-নিপীড়নে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে মহানবী সা. ও তাঁর অনুসারীদের স্বদেশ ভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনা চলে যাওয়াই হচ্ছে হিজরতের মূল প্রেক্ষাপট।
নবী-রাসূলদের বিরোধীতা করা, তাদেরকে অপবাদ দেয়া, গালমন্দ করা এমনকি হত্যা করা পৃথিবীর ইতিহাসের নতুন কোন ঘটনা নয়। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিরুদ্ধেও মক্কায় একট্টা হয়েছিল শত্রুরা। হিজরত আমাদের মনে করিয়ে দেয় কিভাবে অবিশ্বাসীরা রাসূল সা. কে পৃথিবী হতে সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। হিজরতকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে রাসূলুল্লাহ সা.-এর ত্যাগের ঐতিহাসিক স্মারক হিজরী সন। বছর ঘুরে এই দিনটি এসে আমাদেরকে নবীজী ও তাঁর সহচরবৃন্দের হৃদয়বিদারক কষ্ট বেদনার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রিয়জন বাড়ি-ঘর, পরিবার, এলাকা, নিজ শহর, ব্যবসায় বানিজ্য ছেড়ে সুদূর মদীনার পথে অনিশ্চিৎ ভবিষ্যতের দিকে রওয়ানা হয়ে সে সময় কী অসাধারণ ত্যাগের পরিচয় দিয়েছিলেন তারা! মহান আল্লাহ এর বিনিময়ে ইসলামের বিজয় দান করেছিলেন। সুতরাং হিজরত মুসলমানদের বিজয়ের পূর্বাভাস।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে মুসলিম নির্যাতন, গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, মুসলমানদের দেশান্তরিত হওয়া, অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট নিশ্চয়ই মুসলমানদের জন্য নতুন কোন বিজয়ের বার্তা বহন করছে। কারণ যুলুম চিরস্থায়ী হয় না। মালিক এক পর্যায়ে যালিমদের ঠুটি চেপে ধরেন। সে ধরা তাদের মর্মান্তিক পতন ঘটায়। নমরূদ ফেরাউন আদ ও ছামুদ জাতির নির্মম পতন এর জ্বলন্ত প্রমাণ বহন করে চলেছে। মহান আল্লাহ বলেন-

وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ

‘আর তারা চক্রান্ত করেছিল আল্লাহও কৌশল করেছিলেন; আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ।’
(সূরা আলে ইমরান ৩/৫৪)

লেখক পরিচিতি : গবেষক, আলেম ও বহুগ্রন্থ প্রণেতা।

আরও পড়ুন-

হিজরী সন : ইসলামী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ : ১ম পর্ব

হিজরী সন : ইসলামী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ : ২য় পর্ব

হিজরী সন : ইসলামী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ (শেষ পর্ব)

Check Also

11377093_768919959891693_8552450127626177621_n

Can anyone become a Muslim?

Yes anyone can. There are two declarations, which are necessary: 1- To bear witness that ...