দফা-৪ আধুনিক আরবি ভাষাশিক্ষা ব্যবস্থা চালু করুন; বাংলা ইংরেজির গুরুত্ব দিন।
বর্তমান আরবি এবং পূর্বেকার কিতাবের আরবির মধ্যে বিস্তর তফাৎ। আমরা বাংলা ভাষার দিকে থাকালে যেমন তারতম্য অনুভব করি, তেমনি আরবি ভাষার ব্যবহারিক শব্দ ও বাক্যে প্রভুত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নিত্যনতুন শব্দ যেমন যোগ হয়েছে, তেমনি ঘটেছে বিভিন্ন পরিভাষার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন। এই পরিবর্তন-পরিবর্ধন ভাষার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ামাত্র।
এককালে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বাংলাভাষায় কথা বলাকে পাপবোধ করতো। জবন, শ্লেচ্ছ, কুলি, চামারের ভাষা নাকি ছিলো বাংলা। শাস্ত্রীয় হিন্দুরা সংস্কৃতকে পকেটে পুরে রাখতো। সময় বয়ে চলেছে; জল অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। এখন আবার তারা বাংলা ভাষাকে ঘিলে খেতে চায়। বাংলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা হিসেবে প্রচারে কোনো ধরণের ত্রুটি রাখছে না!
নজরুল, ফররুখ কায়কোবাদ, জসিম উদ্দিন, গোলাম মোস্তাফা, আল মাহমুদগণ বাংলায় প্রাণ সঞ্চারিত করেছেন। কিন্তু উর্দু-ফার্সির মারপ্যাচে উলামায়ে কেরামগণ বাংলা ভাষার দিকে ততটুকু অগ্রসর হতে পারেন নি যতটুকু দরকার ছিলো। এখন অবশ্য আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে বা অনেকে অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছেন; কিন্তু তা রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত।
বর্তমান আধুনিক বিশ্বে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির গুরুত্বও অনস্বীকার্য। যুগ চাহিদায় ইংরেজি ভাষার প্রতিও আমাদের যথাযথ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। কারণ, বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশে অন্য কোনো ভাষা জানা না থাকলেও ইংরেজি জানা থাকলে সহজে অনেক কিছু করা যায়। তাই ইংরেজি এখন আর অবহেলা নয়; আবশ্যকীয় করা উচিত।
ধর্মীয় ভাষা হিসেবে মুসলমানদের জন্য আরবির বিকল্প নেই। কুরআন-হাদিসের শ্বাশত সৌন্দর্যের বাণী আরবি। নামায, ইবাদাত, দোয়া-দুরুদ আরবি। আরবি ইসলামের ভাষা। দুনিয়া-আখেরাতের ভাষাও বলা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন ‘আমি আরবিকে তিন কারণে ভালবাসি- আমি নিজে আরবি, কুরআনের ভাষা আরবি, জান্নাতের ভাষাও হবে আরব ‘। তাই মুসলমানদের জীবনের অনুষঙ্গই হলো আরবি জবান বা ভাষা।
১ম স্তর হলো- নামায, রোজা ও ফরজ ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুরা-কিরাআত মুখস্থ থাকা। এ পর্যায়ে আরবি ভাষা জানা ও বুঝার কোনো ব্যাপার থাকে না।
২য় স্তর হলো- কুরআন-হাদিসের জ্ঞান অর্জন। ইসলামি জ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জন। আর তা আরবি ভাষা শেখার উপর নির্ভর করে। যাদেরকে আমরা আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকিহ, ইমাম, মুজতাহিদ বলে জানি; তারা আরবি ভাষাজ্ঞানে জ্ঞানী ছিলেন। তাদের জানা ও গবেষণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্য দ্বীনইসলামের ওপর চলা সহজ হয়েছে। তাদের কারণেই আরবি ভাষাজ্ঞান জানা না থাকা সত্ত্বেও মানুষ ইসলামের মৌলিক শিক্ষা জানতে ও বুঝতে পারছে।
৩য় স্তর হলো- যাদের ভাষা আরবি, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয় আরবি ভাষায়, তাদের জন্য তাদের মাতৃভাষা শিক্ষা করা, জানা এবং বুঝা আবশ্যকীয়। কিন্তু অন্য ভাষার কেউ আরবসমাজে গিয়ে কাজকর্ম করতে চাইলে বা বসবাস করলে তাকেও আরবি ভাষা শিখতে হয়।
আমাদের আলোচ্য বিষয় কিন্তু ২য় স্তর নিয়ে। দ্বীনী জ্ঞানে পারদর্শী হতে হলে অবশ্যই আরবি ভাষায় পাাণ্ডিত্য অর্জন করতে হবে। কারণ, দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ কিতাব আরবিতে। কুরআন ও হাদিসের নিগুঢ় তত্ত্ব উদঘাটন করতে হলে পূর্ব থেকে অনেক আরবি কিতাব অধ্যয়ন করে আসতে হয়। নিজের ভাষা ছাড়া অন্য একটি ভাষা শিখতে কি কি সরঞ্জামের দরকার তা ভাষাবিদগণ বহু আগেই রচনা করে গেছেন।
একটি ভাষা শিখতে প্রাথমিকভাবে একজন শিক্ষার্থীকে কি করা উচিত? তার শুরুটা কেমন হওয়া চাই? এখানে আগে একটি কথা বলে রাখি, দুনিয়াতে ভাষার জন্ম আগে, ব্যাকরণ-গ্রামার-নাহু ইত্যাদি পরে। কিন্তু আমাদের কওমি অঙ্গনে আরবি শিক্ষাপদ্ধতির দিকে থাকালে মনে হতে পারে ব্যাকরণ দিয়েই বুঝি ভাষার উৎপত্তি। কওমির বর্তমান আকাবিরগণ কোথা থেকে যে এই পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন আল্লাহই ভাল জানেন। মক্তব আউয়াল থেকে ৫ম পর্যন্ত পড়ানো হয় উর্দু ১ম, উর্দু দুছরি, উর্দূ তিছরি; ৪টা ও। তার পরের ক্লাস থেকে শুরু হয় সারফ-নাহু-বালাগত। এমন আশ্চর্য তরিকা যা কেবল তুঘলকি কান্ডের সাথে তুলানা করা যায় !
মায়ের ভাষা বাংলা ছেড়ে তা‘লিমুল ইসলাম উর্দুতে। শিখানো হয় উর্দু আর পাণ্ডিত্য অর্জন করাতে চান আরবির। হায় সেলুকাস! ক’বছর আগেতো ফার্সির ধকলও ছাত্রদের সইতে হতো। এখনও অবশ্য কোথাও কোথাও সেই নীরব নির্যাতন চালু আছে।
এবার আসুন সামনের দিকে অগ্রসর হই। বাংলা, ইংরেজি কওমি মাদরাসার জন্য কোন ফ্যাক্টর নয়। কারণ ১০ম পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় শিক্ষা অনুসরণ করলে তার সমাধান হচ্ছে। অবশ্য প্রয়োজনে বাংলা ভাষায় ইসলামি ভাবধারার বই সংযোজন করা কল্যাণকর। অতিরিক্ত ভাষাজ্ঞানের জন্য উর্দু ভাষাকে আমরা সানুভিয়্যাহ থেকে শুরু করতে পারি। কিন্তু আরবি শুরু হতে হবে প্লে গ্রুপ বা মক্তব আউয়াল থেকে। ব্যাকরণ নয়, ভাষা বা শব্দভাণ্ডার শিখার মাধ্যমে। শব্দ, বাক্য, কালিমাত, মুকালামাত, ছোট ছোট গল্প-কবিতা, ঘটনা-কাহিনী দিয়েই আমাদের শুরু করতে হবে।
মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দা.বা. সাহেব অনুসৃত ‘এসো আরবি শিখি’ কার্যকর কিতাব হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। হযরত সুলতান যওক নদভী চট্টগ্রামি দা.বা.ও ছোটদের জন্য আরবি তদরিবাত লিখেছেন। নিজের মায়ের ভাষার মতো প্রয়োগিক পদ্ধতি অনুসরণ না করলে আরবি শিখা হবে না। শিক্ষককেও শিক্ষাদান পদ্ধতির শিক্ষা অর্জন করা জরুরী। বর্তমানে বিভিন্ন টার্মে আরবি ভাষার কোর্স হয় বিভিন্ন শহরে। শিক্ষককে সে সমস্ত কোর্সে অংশগ্রহণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করা অপরিহার্য। নতুবা তিনি যে সেকেলে ধারায় পড়াশোনা করেছেন ছাত্রদেরও সেই দশা হবে। আর বর্তমানে হচ্ছেও তাই।
ইবতেদাইয়্যাহ বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বা মোটামুটি কথোপকথন আরবি ভাষায় হওয়া উচিত। মুতাওয়াসসিতা থেকে আরবি ব্যাকরণের ধারণা দেয়া আর ছানুভিয়াত থেকে তাকে যেনো আর পিছনে ফিরে তাকাতে না হয়। মানে আরবিতে (বলা এবং লেখায়) পুরোপুরি পারদর্শী করে তুলতে হবে।
আজকাল মাদরাসাগুলোতে চলছে আরবির আকাল। ভালো উসতাদ নেই; তো ভালো ছাত্র কীভাবে তৈরি হবে? অনেকে আরবি সাহিত্য পড়ান; কিন্তু একটা প্রবন্ধ লিখার কথা বললে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হয়ে যান পেরেশান! হাদিস-তাফসিরের অনেক উসতাদকে জানি যারা আরবিতে দু’কথা বলার সাহস রাখেন না।
মাদারিসে কওমিয়ায় বর্তমানে যে আরবি সাহিত্য চালু আছে তা কম হলেও দু-তিনশো বছর পুরনো। মুকামাতে হারিরী এবং সাবআয়ে মুয়াল্লাকার কথা বললেতো হাজার থেকে ২হাজার বছর পিছনের দিকে যেতে হবে আমাকে। কারণ, এসব পুস্তক এখন আরব দেশগুলোতে গবেষণা-ইতিহাসের জ্ঞানার্জনের জন্য যাদুঘরের সেলফে শোভা পাচ্ছে।
অতএব কওমি মাদরাসায় আরবি ভাষাসাহিত্য ও কর্মকে জরুরীভিতিতে পুণর্মূল্যায়নের সিরিয়েলে রাখা একান্তভাবে জরুরী।