শেকড়চ্যুত প্রজন্মের যন্ত্রণা: সে বললো- সাহিত্য তো সাহিত্যই, তাতে আবার ইসলামী অনৈসলামী কেনো? সে আমার স্নেহভাজন, তরুণ, মাওলানা এবং প্রগতিশীল লেখক হবার চেষ্টায় নিবেদিত। তার প্রশ্ন শুনে অবাক হইনি মোটেও। কারণ ইসলামী জীবনাদর্শের গভীরে চিত্তের নিমজ্জন না ঘটালে এবং জীবনদর্শন হিসেবে ইসলামের পূর্ণতায় আপন অবগাহন ঘটাতে না পারলে ইসলাম সম্পর্কে বিকলাঙ্গ ভাবধারা সৃষ্টি হওয়া অনিবার্য। বিকলাঙ্গ ভাবধারা থেকে যে যুক্তি উৎপন্ন হবে, তা হবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, যে বক্তব্য আসবে তা হবে খোঁড়া ও অবসাদগ্রস্ত। আর এর সাথে যদি আত্মপরিচয় সংক্রান্ত হীনমন্যতা যুক্ত হয়, তাহলে অথর্ব হয়ে পড়বে স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি ও বিবেচনাবোধ। কিছু ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে এ অসুখ ধর্মহীন ধারায় শিক্ষিতদের মধ্যে রাজত্ব করছে প্রবলভাবে। এ অসুখের দৌরাত্ম্য আমাদের জাতীয় জীবনকে ভয়াবহ রুগ্ণদশায় বিপন্ন করে তোলেছে। এখন দেখছি বানের পানির মতো তার বিস্তার ধর্মীয় ধারার দরোজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করতে উদ্যত। এ পরিস্থিতিতে সচেতন মহল যে উৎকণ্ঠায় কেঁপে ওঠেন, তার কিছু আভাস চেহারায় রেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম-ইসলামী জীবনদর্শনে বিশ্বাস করো? বললো-হ্যাঁ, করি। প্রশ্ন করলাম কেনো? দর্শন তো দর্শনই। সে অখ- ও অবিভাজিত জীবনের রহস্য উদঘাটন করে। সেখানে ‘ইসলামী জীবনের দর্শন’ সেটা আবার কী? জবাব দিলো-ইসলামী জীবনদর্শন মানতে হয়। যেহেতু তার একটা প্রতিষ্ঠিত রূপ আছে ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস আছে। যেহেতু ইসলামকে মূলভিত্তি করে তা স্বতন্ত্র ভূগোল রচনা করেছে।’ এবার বললাম- ইসলামকে মূলভিত্তি করে স্বতন্ত্র ভূগোল রচনা করলে দর্শনকে যদি ইসলামী বলতে হয়, তাহলে সেই জীবনদর্শন ও বিশ্বাসের নির্দেশে ইসলামী জীবনের স্বতন্ত্র ভূগোল রচনা করবে যে সাহিত্য, তাকে ইসলামী সাহিত্য বলতে আপত্তি কেনো? এবার সে তার চেহারার সবটুকু পর্দা সরিয়ে আসল কথাটি বলে ফেললো-‘না’ সাহিত্যের ব্যাপারটি আলাদা। আদর্শের প্রচারক হলে সেটা সাহিত্য থাকে না। এমনটি করে সীমিত সাফল্য অর্জন হলেও চূড়াস্পর্শী সাফল্য কেউ দেখাতে পারেননি। বুঝতে পারলাম, তার নাকের দড়ি সেই খুঁটির সঙ্গে বাঁধা যার নিয়ন্ত্রণ জাফর ইকবালদের হাতে। ওরা সাহিত্যকে কেবলই শিল্পের দোহাই দিয়ে নৈতিক আদর্শিক প্রাণশক্তি থেকে বিচ্যুত করতে চায়। এর মাধ্যমে ওরা চায় মূলত ইসলামী শিক্ষা ও চেতনার শিল্পময় বিকাশের দ্বার রুদ্ধ করতে। ফলে আধুনিক বেশ ও কেশধারী বখাটে তরুণ যেভাবে সমাজের জন্য আপদ হয়ে ওঠে তেমনি সাহিত্য ও মানুষকে মানুষ বানাবার নৈতিক কর্তব্যকে অবজ্ঞা করে প্রগতিশীল প্রক্রিয়ায় মানবতার বিপদকেই প্রশস্ত করে। এমন সাহিত্য পূজাভবনে ঝুলন্ত মৃত্যুর ফাঁদ ছাড়া আর কী হতে পারে? পৃথিবীর সমস্ত সৎ ও মহৎ সাহিত্য কোনো না কোনো আদর্শের শিল্পভাষ্য। আদর্শের রক্তজল ছাড়া কোন কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের শরীর সজীব হতে পারে না। জীবনবোধের সুবাতাস ছাড়া কোন সাহিত্যই লাভ করেনি জীবনীশক্তি। আদর্শহীন জীবন যেভাবে পাশবিক আকাক্সক্ষার অরণ্যে পশুর পিপাসা নিয়ে গোঙাতে থাকে, এই সাহিত্যও তেমনিভাবে আলেয়ার পিছনে ছুটতে থাকে রতির অস্থিরতায়। এসব কেবলই মানুষের কর্তব্যকে আবিলতার কুয়াশায় ঢেকে ফেলার কাজ আঞ্জাম দিতে পেরেছে সাফল্যজনকভাবে। এসব সাহিত্যের পেছনে অন্ধের মতো যে তরুণ ছুটতে চায়, তাকে আমি ঠিক বিপরীত পথের মাথায় সুউচ্চ এক বহুবর্ণিল মিনারের ঔজ্জ্বল্য কীভাবে দেখাবো? অথচ সেই ঔজ্জ্বল্য কুহকগ্রস্ত এই তরুণটির জন্য শুধু নয় বরং অসুখে বিপন্ন কুয়াশাচ্ছন্ন গোটা সভ্যতার জন্য একান্তই অপরিহার্য। সেই ঔজ্জ্বল্য যেমন স্নিগ্ধ, তেমনি দীপ্ত। যেমন সুস্পষ্ট তেমনি বর্ণাঢ্য। যেমন প্রসারিত তেমনি সুগভীর। সেই দীপ্তি কালজ থেকে কালোত্তর, ব্যক্তিক-নৈর্ব্যক্তিক। হার্দিক আবার কর্মমুখী। সেই দীপ্তিতে আত্মা ও দেহের বিকাশ নিশ্চিত। সৃষ্টি ও স্রষ্টার সম্পর্ক বিভাসিত। মানুষ ও মানুষের সম্পর্কের ভারসাম্য বিবৃত। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্কের ইতিবাচক নির্দেশনা বিধৃত। সেখানে ইহজগৎ পরজগৎ সমান আলোর যৌথতায় সমুজ্জ্বল। এই সমতল যৌথতার জীবনে দৃষ্টি না খুললে সে অন্ধই থেকে যাবে। সে পথভ্রান্ত হয়ে দিগি¦দিক ছুটতে থাকবে আলেয়ার গলিতে। এ জন্যে অন্ধত্ব থেকে জীবনকে দৃষ্টিবান করে যে সাহিত্য, তার চেয়ে বড় প্রয়োজন মানবতার জন্য আর কী হতে পারে? সেই প্রয়োজন পূরণে হাজার বছরের ইতিহাসে অগ্রসর ও সফল কীর্তিগাথা যারা রচনা করেছেন তাদের অগ্রগণ্য হলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ.। হিজরী ১১ শতকের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ইতিহাসে শাহওয়ালীউল্লাহ যে সূর্যতুল্য অবস্থানে আসীন, তা শুধু মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে নয়, বরং বিশ্বসভ্যতার বৃহৎ ক্যানভাসে। তার বিকাশের সময় পাশ্চাত্য পূনর্জাগরণের তরঙ্গে কম্পমান। চিন্তা ও জ্ঞানের ইতিহাসে একটি নতুন জন্মের ও পুনর্জীবনের প্রাণাবেগে আন্দোলিত ইউরোপ। হাজার বছরের ঘুম ঝেড়ে ইসলামের যে দূরবর্তী আকর্ষণ তাদেরকে আলোর দিকে সচকিত করে তুলে, সেই আলোকে তখন প্রাচ্যে নবতর উৎকর্ষে পরিচর্চা করছেন শাহওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী। তিনি জানতেন ইউরোপের পরিবর্তন ও জাগরণের প্রেক্ষাপট। জানতেন প্রাচ্য তথা মুসলিম বিশ্বে সেই পরিবর্তন প্লাবনের মতো এসে হানা দেবে। এবং প্রাচ্য সেই প্লাবনকে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না। ফলে রাজনৈতিক অধীনতা, সাংস্কৃতিক দাস্যবৃত্তি ও চিন্তানৈতিক আত্মসমর্পণ প্রাচ্যের জন্যে অবধারিত হয়ে উঠবে। তিনি তাই অগ্রসর হয়ে প্রাচ্যের মনন ও সৃজনের গোটা উদ্যানে মালির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন আপন কাঁধে। সেনাপতিত্ব গ্রহণ করলেন চিন্তায়, প্রজ্ঞায়, সাহিত্যে। ধর্মতত্ত্বে দর্শনে। ফলত গোটা সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের জ্ঞান-মনীষা ও সাহিত্যের ইসলামী বয়ান উপস্থাপনে শাহ ওয়ালীউল্লাহ হয়ে ওঠেন এক বিস্ময়কর স্বতন্ত্র মহাদেশ, সেই মহাদেশের নাগরিক মুসলিম জনগোষ্ঠী তৎকালে হয়ে উঠতে পারেনি বলেই পাশ্চাত্য নিজের হাতে পরবর্তী পৃথিবীর ইতিহাস রচনা করে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. ইতিহাসের লাগাম মুসলিমদের হাতে তোলে দেয়ার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন আপন কলম ও কর্মে। সেই সম্পন্ন আয়োজনের সাথে আজকের প্রজন্ম পরিচিত না হলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব কমবে না। মনস্তাত্বিক পঙ্গুত্ব এবং সাহিত্যিক নিশ্চলতারও অবসান হবে না। এ ক্ষেত্রে শাহ ওয়ালীউল্লাহ পরবর্তী অন্যান্য মুসলিম বুদ্ধিজীবি ও দার্শনিকদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরে যারাই এই উদ্যানে বৃক্ষরোপন করেছেন, সকলেই তার চিন্তানৈতিক উত্তরাধিকারকে ধারণ করেছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। আমি আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলতে চাই তার পরবর্তী মানবতাবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ বিশ্বপ্লাবী দার্শনিক প্রয়াসসমূহ নিজেদের সীমাবদ্ধতা নিয়েও শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. থেকে আলো গ্রহণ করেছে যথেচ্ছ। এ ক্ষেত্রে যে নামটি অনিবার্যভাবে আসবে, তা হলো সমাজবাদী চিন্তা ও কার্লমার্কস এর দর্শন। আগাগোড়া মার্কসবাদ কীভাবে শাহ ওয়ালীউল্লাহর দার্শনিক বয়ানের লক্ষচ্যুত ও দূরবর্তী অনুবাদ, তা বানান করে বুঝিয়ে দিয়েছেন আল্লামা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি রাহ.। নয়ীম সিদ্দিকী দেখিয়েছেন কীভাবে মীর দর্দ, মীর তকী মীর, টি এস এলিয়েট, ম্যাক্সিম গোর্কি বরিস পাস্তেরনাক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের ঔজ্জ্বল্য নির্মিত হয়েছে শাহ ওয়ালীউল্লাহর নাক্ষত্রিক কক্ষপথ মাড়িয়ে। মিকাইলোভিস দস্তয়েভস্কির কালজয়ী উপন্যাস “ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট” আগাগোড়া কুটিল ষড়ষন্ত্র, অন্যায় অনিয়মের বঞ্চনা ও ব্যর্থতাকে ব্যক্ত করে। যে কোন অপরাধের অবধারিত পরিণতি যে পানিশমেন্ট, এই সত্যটি দস্তয়েভস্কির নিখুঁত কলমে অঙ্কিত হয়ে জীবন্ত দলীল হয়ে ওঠেছে। কিন্তু এই সত্য শাহওয়ালীউল্লাহর গ্রন্থ ‘আল বুদূরুল বাযিগাহ’ এর বিভিন্ন অধ্যায়ে যেভাবে দার্শনিক উদ্ভাসে ব্যক্ত হয়েছে, তার নজির আর কোথায়? বিশ্ব বরেণ্য সাহিত্যিক গি দ্যঁ মোপাশার গোটা সাহিত্যকর্মে যে চিরন্তন বাণী বিদ্যমান, সেখানে সত্যের সাথে মিথ্যার সুন্দরের সাথে অসুন্দরের বোঝাপড়া নিখুঁতভাবে অঙ্কিত। কিন্তু তা কি শাহ সাহেবের ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার’ পঞ্চম অধ্যায়ের ছায়া মাত্র নয়? ম্যাক্সিম গোর্কির “মা” উপন্যাসে সংগ্রামে প্রেরণাদায়ী এক মহীয়সী জননীর আপত্য স্নেহের দলীল আমরা পড়েছি, কিন্তু শাহ ওয়ালিউল্লাহর “বাওয়ারিকুল ওলায়াহ” এবং “শাওয়ারিকুর মা’রিফাহ” গ্রন্থে যে মনীষাদীপ্ত পিতা ও চাচার বাস্তব জীবনের চিত্র, তার সাথে কি পরিচিত হয়েছে এই প্রজন্ম? পার্ল এস বাক এর “গুড আর্থ” পড়েনি, এমন সাহিত্যিক খুবই কম। কিন্তু আমরা কয়জনে জানি যে এর বীজ লুকিয়ে আছে শাহ ওয়ালীউল্লাহর বিভিন্ন কবিতায়? আধুনিক অনেক সাহিত্যিকের আত্মজীবনী আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়ি। কিন্তু ভুলে যাই “আল জুযউল লতীফ” নামে শাহ ওয়ালীউল্লাহ আত্মজীবনী লেখার চমকপ্রদ শিল্প ও ঐতিহ্য আমাদের জন্য রেখে গেছেন। প্রশংসাকাব্যে তার সুপ্রসিদ্ধ “আতয়াবুল গনমের” নজির কোথায়? তাঁর “দিওয়ানুশ শায়ীরে” যে সব হৃদয়ভেদ্য কবিতা রয়েছে, তা কি কবিতার আকাশে চাঁদের মতো স্নিগ্ধতা ছড়ায় না? তার ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ইযলাতুল খাফা, ফুয়ুজুল হারামাইন’ থেকে শুরু করে ধর্মতত্ত্বের ‘হুসনুল আকিদা’ পর্যন্ত যে বিশাল সাম্রাজ্য, সেখানে বিচরণ করে স্তম্ভিত হয়ে লিখতে হলো শাহ ওয়ালীউল্লাহর বিচক্ষণতার সামনে ইমাম গাযালী, রাযী, ইবনে রুশদ প্রমুখের কৃতিত্ব ম্লান হয়ে যায়। এই যখন বাস্তবতা, তখন শাহ ওয়ালিউল্লাহর সাথে তুলনা করবো এমন দার্শনিক আধুনিক পৃথিবীতে কে? কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আমাদের আলোচ্য তরুণটি ওইসব সাহিত্যক দাশনিককে অপরিহার্য ও বাধ্যতামূলকভাবে শিরোধার্য হিসেবে মানে, কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ.-কে অবশ্যপাঠ্য বলে মানতে নারাজ। বস্তুত সে বহুভাষায় বহু সাহিত্যিকের হাজার হাজার পৃষ্ঠা হজম করেছে, কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ তার কাছে সাহিত্যের কোন সৃজনশীল গন্তব্য নয়। তার আবেদন নিছক ইলমী বিভিন্ন অধ্যায়ের গভীর ও প্রশস্ত বিশ্লেষণ ও সূক্ষ্ম অন্তদৃর্ষ্টির অনন্যতাতেই সীমিত। রবীন্দ্রকাব্যের ভেতর দিন-রাত অতিবাহনে যার স্বাচ্ছন্দ্য সে যখন ভাবে প্রবলভাবে ইসলাম উপস্থিত হলে দর্শন সাহিত্য পীড়িত হয়, এবং এ কারণে অস্তিত্বের রক্তজল প্রবাহিত হচ্ছে যে উৎসকেন্দ্র থেকে, সেখানেই অবজ্ঞার ধূলো নিক্ষেপ করে তখন অবাক না হয়ে পারি না যে, আমাদের প্রজন্ম শেকড়চ্যুত হয়ে ভেসে ছুটছে প্রলয়ের কোন প্লাবনে। সে কেনো ভুলে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ স্বীয় সাহিত্যে তার ধর্ম ও বিশ্বাসের বক্তব্যকেই উচ্চারণ করেছেন। তার কাছে কি আদর্শের চেয়েও তথাকথিত আধুনিক সাহিত্যিক বিভিন্ন মতবাদ বড় হয়ে উঠলো? দ্বীনী আদর্শের সুদৃঢ় ভিত্তি থেকে বিচ্যুত হয়ে এসব মতবাদের কুহকে আক্রান্ত হলে কী পরিণতি হয়, তা বড় তিক্ততার সাথে আমরা টের পাচ্ছি। অতীতে দেখেছি মাদরাসা পড়ুয়া আহমদ শরীফ কীভাবে নাস্তিক হয়ে গেছেন। কীভাবে মাদরাসার ছাত্র শওকত ওসমান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বদরুদ্দীন ওমর বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে ইসলামী চেতনাকে ধ্বংসের ক্রুসেড চালিয়ে যাচ্ছেন। এরা এক সময় মাদরাসায় পড়তেন এ কথা অনেকটা বিস্ময়কর মনে হয়। কিন্তু আজ আমাদের মধ্য থেকে শেকড়চ্যুত যে প্রজন্ম উঠে আসছে, তাদর মধ্য থেকে কেউ কেউ ভবিষ্যতে আরো বেশি বিস্ময়ের জন্ম দেবেনা-তা বলতে পারছি না। তাদেরই একজন বলছে শাহ ওয়ালীউল্লাহ আলিম লেখক হিসেবে বরেণ্য। কিন্তু মৌলিক সাহিত্যের কেউ নন তিনি। সে হয়তো জানে না শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ.-এর একক বিশিষ্টতা শুধু এজন্য নয় যে, তিনি বিশ্ববরেণ্য এক আলিম ছিলেন। কিংবা এজন্য নয় যে, ইতিহাসখ্যাত দার্শনিক। তিনি যে সাহিত্যভা-ার রেখে গেছেন, তার বিপুলতার কারণেও নয়। বরং শাহ ওয়ালীউল্লাহের অনন্যতা গোটা মানবগোষ্ঠীর জীবনীশক্তিকে আত্মস্থ করার জন্য। এবং ইতিহাসের রক্তসঞ্চালনে একাত্ম হয়ে সময়ের ঘোড়ার লাগাম হাতে নেয়ার জন্য। এই কৃতিত্ব তাকে আধুনিক পৃথিবীর সূচনা ও মধ্যযুগের সমাপ্তিলগ্নের এমন সেতুতে পরিণত করেছে, যে সেতু অতিক্রম না করলে মানবতার জ্ঞান ও অগ্রযাত্রা মাহরুম থেকে যায়। ঐশ্বর্য ও সামর্থের এক মহাপৃথিবী থেকে। এর একদিকে একটি সভ্যতার বিপর্যয়কর প্রেক্ষাপট অবলোকন, তার কার্যকারণ পর্যবেক্ষণ ও পতনের উপসর্গসমূহ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা জ্বলন্ত। সেই অভিজ্ঞতার মালমসলা সভ্যতার পতন ও পচনশীল যে কোন পেক্ষাপটকে মোকাবেলার দীপ্রখর অবলম্বন। তিনি একে একে এই মোকাবেলায় পথ ও পাথেয় নির্দেশ করেছেন অসামান্য বৈদগ্ধের সাথে। আবার আরেকটি সভ্যতার নবতর উত্থান ও তার দার্শনিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাতসমূহকে প্রতিরোধের মন্ত্র ও কর্মপদ্ধতি তার বক্তব্যে সুস্পষ্ট। মূলত শাহ ওয়ালীউল্লাহ কোন একটি যুগকে শুধু ধারণ করেননি, কোন একটি জাতিগোষ্ঠীর উত্থান ও পতনকে শুধু বাঙ্ময় করেননি, বরং মহাকালের পর্যটক হয়ে উঠেছেন তিনি। এবং বিশ্বজনীন মানবতার উত্থানের আলোকশিখা দীপ্ত করেছেন। সভ্যতার অবক্ষয়ের বিপরীতে জীবনীশক্তির কালোত্তীর্ণ নহর হয়ে উঠেছেন। ফলে তিনি শুধু কয়েক শতাব্দী আগের এক মনীষী ও দার্শনিক নন, বরং তিনি দার্শনিক এ যুগের, তিনি চিকিৎসক আজকের অসুখেরও। মানবতার অসুখের পথ্য যে রচনা, তা মৌলিক সাহিত্য যদি না হয়, তাহলে কী আর হবে? কিন্তু তাঁর জীবন ও সাহিত্য আজকের অসুখের পথ্য, এই প্রশ্ন সামনে না রেখে শাহ ওয়ালীউল্লাহকে কেউ বিশ্লেষণ করতে চাইলে তা হবে অন্ধ বিচার ও খর্ব মীমাংসা। এই অন্ধত্ব ও খর্বতা নিয়ে তাঁর জীবনের কৃত্রিম আলোচনা, ভক্তিসোচ্চার স্তবকতা কিংবা তার চিন্তাধারার নামে পর্যালোচনার কাগজ যত হাজার পৃষ্ঠাই হোক তা সত্যিকার কোন সুফল আমাদের হাতে তুলে দেবে না। তা উম্মাহের কালো রজনীতে ভোরের কোন সাড়াও জাগাতে পারবে না। যারা শাহ ওয়ালীউল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তারা তো মরীচিকার পিছনে ছুটছে। কিন্তু যারা তাকে অবলম্বন করতে চাইছি, তারা এই মৌলিক জায়গাটায় আজকের সভ্যতা, সমাজ ও মুসলিম মিল্লাতকে স্থাপন করে ওয়ালীউল্লাহী উপসংহারকে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। কারণ আমরা তাকে সামগ্রিকভাবে সমসাময়িক বহুমাত্রিকতায় ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। এই ব্যাখ্যার জ্ঞানতাত্ত্বিক দিকটি খোলাসা করার জন্যে আমরা শাহ ওয়ালীউল্লাহের সমকালটিকে একটু অবলোকন করবো। সেই সময় মুসলিম জাহানের চিন্তা ও মননের মৌসুমটি কেমন ছিল? এই জায়গাটিতে রয়েছে বিভ্রান্তির বিস্তর ধুলোবালি। একদল হীনমন্য বুদ্ধিজীবি এ সময়টিকে সৃজনহীন ও উৎপাদনহীন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পঙ্গুত্বের মৌসুম হিসেবে দেখাতে প্রয়াসী। তাদেরই এক প্রতিনিধি বামপন্থী তাত্ত্বিক ও সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক লিখেছেন “মধ্যযুগের শেষ দিকে প্রাচ্য তো জ্ঞানের মরুভূমি। মুসলিম দুনিয়া অসুস্থ ব্যক্তি। উপমহাদেশে জ্ঞানবান কোন উঁচু মাথা নেই। তাই অন্ধের যষ্টি শাহ ওয়ালীউল্লাহ।” ওয়াহিদুল হক এ বক্তব্য দ্বারা তার বিকারগ্রস্ত মানসের জানান দিলেও ইতিহাস কিন্তু আমাদের জানায় যে, হিজরী ১১ শতক মুসলিম জাহানের জ্ঞানগত আবহাওয়া যথেষ্ট প্রশান্তিদায়ক। মিসর, সিরিয়া, হলব, আলেপ্পা, ইসফাহান, ইরাক, হেজাজ, ইয়ামান, ফিলিস্তিন, মরক্কো, তুরস্ক ও ভারতবর্ষে জ্ঞানের চর্চা ও আবেগের নদী সবেগে প্রবাহিত। বিশ্বসেরা জামিয়াসমূহ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তুরস্ক থেকে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন শহরে-নগরে। উলূমে ইসলামীর সুগভীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে নিমগ্ন জ্ঞানসাধকদের তৎপরতাও আলো ছড়াচ্ছে দিগি¦দিক। হেরেম শরীফে হাদীসের দারস দিচ্ছেন আল্লামা আবুল হাসান সিন্দি (আল কাবীর রাহ.) তিনি কলম হাতে নিয়ে কাঁপিয়ে তুললেন উলূমে ইসলামীর ইতিহাস। সিহাহ সিত্তার উপর রচনা করলেন বিশ্ববিখ্যাত টীকা ‘আল হাওয়ামিশুস সিহাহ’। সিরিয়ায় আলো ছড়াচ্ছেন শায়খ ইসমাইল আজলুনি ওরফে আল জারাহীর মতো মুহাদ্দিস। যিনি রচনা করেন দুর্বল ও জাল হাদিস বিষয়ক সবচেয়ে বৃহৎ ও পূর্ণাঙ্গ কিতাব “কাশফুল খাফা ওয়া মাযয়িলুল আলবাস”। ইয়ামানে সূর্যের মতো চমকাচ্ছেন সুলাইমান ইবনে ইয়াহইয়া আল আহদল , মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইসফারাইনী, যিনি রচনা করেন “আর-রাদ্দুল মাওসূয়াতি ফিল আহাদীসি আল-মাওযূয়াত” এর মতো কালজয়ী গ্রন্থ। সেখানে ছিলেন মুহাম্মদ ইসমাইল আল হাসানী আস সানআনী, এই সময় জ্ঞানের রাজ্যে জ্বলজ্বল করে জ্বলছিলেন আল্লামা মুহাম্মদ সাঈদ সুম্বুল রাহ.। যাকে প-িত্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় আসীন হিসেবে অভিহিত করা হতো। তার রচিত “আওয়ায়েলে কুতুবে হাদীস” এর প্রমাণ। মিসরের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সুবাতাস ছড়াচ্ছেন আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে আবুল বাকী যুরকানী। শায়খ আব্দুল গণী আন নাবলুসী। যার গ্রন্থসংখ্যা দুইশত তেইশ। এ যুগেরই আলিম হলেন আল্লামা ইসমাইল হাফী। বিশ্ববিশ্রুত “তাফসীরে রুহুল বয়ান” তারই রচনা। বাগদাদ আলোকিত করে আছেন আব্দুল্লাহ ইবনে হুসাইন আস সুদ্দী। আফগানিস্তানে মীর যাহেদ ওরফে কারী মুহাম্মদ যাহেদ এর মতো দার্শনিক ও বিদগ্ধ তাত্ত্বিক জ্ঞান রাজ্যের উচ্চাসনে আসীন। তাহলে দেখা যাচ্ছে ইলমী গবেষণা, প্রজ্ঞার চাষাবাদ ও দ্বীনের বিভিন্ন শাস্ত্রগত, ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনার মৌসুমটি সরগরম ছিলো তখন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন সব মহান আলীম ও প্রজ্ঞাবৃক্ষের ছায়া প্রশস্ত ছিলো, যাদের সমতুল্য মনীষী দীর্ঘদিন পর্যন্ত দুর্লভ ছিলেন। উলূমে ইসলামীর রতœভা-ারে যাদের প্রদত্ত মণি মুক্তোর পরিমাণ অত্যন্ত বিপুল। কিন্তু এই বিপুল ঐশ্বর্যম-িত অবদানের মাঝে শাহ ওয়ালীউল্লাহর অবদান কীভাবে এককবিশিষ্টতা অর্জন করলো? কীভাবে অফুরান মহিমায় ম-িত হলো তার সৃষ্টিরাজ্য? এতোসব মহাত্মার ভীড়ে কীভাবে শাহ ওয়ালীউল্লাহ অর্জন করলেন অনন্যতার শিরোপা? কেন তার রচনাবলী সমস্ত রচনাবলীকে প্রদীপ বানিয়ে নিজে আত্মপ্রকাশ করলো সূর্যের মহিমায়। এর একক কোন কারণ চিত্রিত করা দুঃসাধ্য। তার শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি ছিলো না বিশেষ কোনো খাতে। বরং তা প্রফুল্ল গতিতে গন্তব্য স্পর্শ করেছে সামগ্রিক স্বাচ্ছন্দ্যে। প্লাবিত করেছে সংস্কার দিয়ে জীবনের সকল অলিগলি। সেই সংস্কারের প্রয়োজনে যেখানে যতটা গুরুত্ব আবশ্যক, ততটা দিয়েছেন। ফলত তাকে সবচেয়ে বেশি অবলম্বন, প্রচার ও বিশ্লেষণ করতে হয়েছে কোরআন এবং তারপর হাদীসে রাসূল সা.। সবকিছু করেছেন শিল্প ও প্রেমের মধ্য দিয়ে। তার প্রেম বিচরণ করতো আধ্যাত্মের সেই ঊর্ধ্বমার্গে, যেখানে প্রত্যক্ষণের মধ্য দিয়ে সত্যকে অবলম্বন করা যায়। জীবন্ত সেই রূহানী সামর্থ্য ইসলামী সংস্কারকের জন্যে আবশ্যকীয়। শাহ ওয়ালিউল্লাহের মধ্যে সেই সামর্থ প্রস্ফুটিত হয়েছিলো সামগ্রিক সৌরভে। এই সৌরভেরই এক ঝিলিক হচ্ছে নবুওতী উৎসের সাথে তার লেখনীর সংযোগ। তিনি এর বিবরণ দিয়ে বলেন-আমি অন্তরে এমন এক আলোকবর্তিকা পেলাম, যা কেবলই বেড়ে চলছিলো। মক্কা শরীফে যখন ছিলাম, তখন এক রাতে ইমাম হাসান ও ইমান হুসাইন রা.-কে স্বপ্নে দেখলাম। তারা আমাকে কলম দিয়ে বললেন- এটা আমাদের নানা রাসূল সা.-এর কলম। এই কলমটি তিনি পেলেন বলেই গোটা জীবনের উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠেছিলো তার রচনাবলী এবং এই বিশিষ্টতাকে ধারণ করার মতো কোন প্রতিভা দীপ্ত হয়ে ওঠেনি তৎকালীন পৃথিবীতে। যদি তা না হতো, তাহলে জ্ঞান ও সাধনামার্গে গগনস্পর্শী প্রতিভা তৎকালে খোদ ভারতেই কম ছিলো না। তারা যেভাবে অধ্যাপনায় ছিলেন বিদগ্ধ, তেমনি লেখনিদক্ষতায় ছিলেন শিখরস্পর্শী। তাদের মধ্যে আহমদ ইবনে আবু সাইদ ওরফে মুল্লা জীবন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ইতিহাসে আজও বিশ্ববিশ্রুত। যিনি লিখেছেন “নূরুল আনওয়ার” ও “তাফসীরে আহমদীর” মতো ইতিহাস কাঁপানো গ্রন্থ। শরহে সুল্লাম রচয়িতা হামিদুল্লাহ, সুল্লাম রচয়িতা মুল্লা হাসান, মাওলানা রুস্তম আলী কনৌজী, শায়খ সিফাতুল্লাহ খায়রাবাদী, শায়খ আলী আসগর কনৌজী, শায়খ গোলাম আলী আযাদ বিলগ্রামী, শায়খ গোলাম নকশবন্দী লাখনৌবী, সুল্লামুল উলূম ও মুসাল্লামুস সুবুত রচয়িতা ন্যায়শাস্ত্রের মহারাজ কারী মুহিব্বুল্লাহ বিহারী, শরহে সুল্লাম রচয়িতা কাজী মোবারক গোপামভী, কাশশাফে ইস্তেলাহাতে ফুনূন রচয়িতা মাওলানা মুহাম্মদ আ’লা থানভী রহ. এবং দরসে নেজামীর প্রবর্তক মোল্লা নিজামউদ্দীন লাখনৌভী রহ. অন্যতম। এরা প্রত্যেকের কলম রচনা করেছে জ্ঞান বিজ্ঞানের তুঙ্গস্পর্শী নানান ভাষ্য। কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ রহ. এতো সব নক্ষত্রের রাজকীয় সভায় একক ও অনন্য। তার আলো সকল আলোকে ধারণ করেছে এবং তার রচনা সমুদ্র সমান ব্যাপকতা নিয়ে জাগ্রত। অন্য সকল রচনা সেখানে একেকটি সুন্দর ও অভিনব দ্বীপ হয়ে জীবনের পাটাতন হয়ে উঠেছে। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন একক উঁচু মাথা। এদের জ্ঞান প্রজ্ঞা ও সাধনার সমতুল্য নজির শতাব্দীতে দু’একটি পাওয়া যায়। তেমন একজন মনীষী দিয়েই একটি যুগ গৌরবানি^ত হয়ে ওঠে। একটি জনপদ জ্ঞানের মরুভূমির আপদ ঘুচাতে পারে। কিন্তু আমরা দেখছি, এগারো শতকে এমন মনীষী শুধু ভারত উপমহাদেশে অনেকেই ছিলেন। ফলে শাহ ওয়ালীউল্লাহকে অন্ধের যষ্টি হিসেবে কেউ দেখতে চাইলে তিনি ইতিহাসের বিপক্ষে দাঁড়াবেন। হয়তো না জানা অথবা হীনমন্যতাই এমন বক্তব্যের উৎস হতে পারে। প্রকৃত পক্ষে ওয়ালীউল্লাহ সেই রাজসভার মধ্যমণি ছিলেন, যার প্রত্যেক সদস্য শুধু মুসলিম মিল্লাত নন, বরং গোটা মানববিশ্বের জ্ঞানের উত্তারাধিকার বহন করছিলেন বিভিন্নভাবে। শাহ ওয়ালীউল্লাহর সমকালের আধ্যাত্মিক অবস্থার বিচার করুন। সেখানে এমনসব সূর্যসম আলোকধারা বহমান ছিলো যার নজির সাধারণত দুষ্কর। এক দিল্লীর কথাই ধরুন। সেখানে হযরত মীর্জা মাজহার জানে জানা রহ.-এর মতো ব্যক্তিত্ব বিদ্যমান ছিলেন। যার সম্পর্কে জালাল উদ্দীন রুমী রহ. ভবিষ্যদ্বাণী করে ছিলেন ‘জানে জানা যে দিন জন্মগ্রহণ করবেন সে দিন আল্লাহ তাআলা নিজের মাহাত্ম্যকে প্রকাশ করবেন। যার জন্মই এতো মহিমাময়, সেই মনীষীর কর্মময় জীবন তখন সুপরিণতি রচনা করছে। সিলসিলায়ে নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দেদিয়ার সুউচ্চ পতাকা উড়িয়ে তিনি আকাশ স্পর্শ করেছেন। কাদেরিয়া সিলসিলার বসন্তবায়ু ছড়িয়ে দিচ্ছেন দারসে নেজামীর রূপকার মোল্লা নিযামুদ্দীনের মুর্শিদ হযরত সাইয়িদ আব্দুর রাজ্জাক বাসবী রহ. এবং চিশতিয়া সিলসিলার মহান ইমাম শাহ কালিমুল্লাহ জাহানাবাদী রহ. এবং শাহ ফখরুদ্দীন ওরফে শাহ ফখরে দিল্লী তখন দিল্লীতে বর্তমান। আছেন নকশবন্দিয়া সিলসিলার শায়খ মুহাম্মদ আবিদ সাম্মামী, খাজা মুহাম্মদ নাসির আন্দালিব, শাহ মনীবুল্লাহ বালাপুরী এবং হযরত শাহ নূর মুহাম্মদ বাদায়ূনী রাহ. এ মতো আধ্যাত্মিক সম্রাট ও নির্ভরযোগ্য ইমামগণ। এদের যে কেউ একটি দেশ ও জনপদের গৌরব ও আলোর কেন্দ্র হবার য্যোগতা রাখেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ এদের উপস্থিতিতেই এদের স্বীকৃতি নিয়েই বিকশিত হন। তাঁর বিকাশ স্বকীয় যোগ্যতায় ও আপন মাহাত্ম্যের স্ফুরণের মধ্য দিয়ে। এমন সব উচ্চতর বটবৃক্ষের ভিড়ে, যাদের তুল্য একটি বৃক্ষও আজকের পৃথিবীতে নেই।
ওয়াহিদুল হক লিখেছেন- ‘সংস্কারক হিসেবে তার একটি প্রসিদ্ধি ছিলো। কিন্তু তার সাহিত্য ও চিন্তা সে তো মধ্যযুগীয় কূপের কাহিনী। জীবনের বিস্তৃত বিকাশ বা ব্যাপক আকাশ সেখানে উন্মোচিত হয়নি। তবুও জ্ঞানগত দারিদ্রের দীর্ঘ অন্ধকারে তিনি মোঘল ইতিহাসের পতনবেলার আলো’। শাহ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য জীবনের কোন গভীরতাকে মূর্ত করে? সাহিত্যের ইতিহাসে সেটা কোন বিশিষ্টতাকে প্রতিষ্ঠিত করে? সেই বিশিষ্টতায় শিল্পগত সৌহার্দ কোন মাত্রা স্পর্শ করেছে? প্রশ্নগুলোর কিঞ্চিৎ জবাব দিয়েছি ওয়াহিদুল হকের ভ্রান্তির মুখোমুখী হবার আগে। আমরা তো দেখি শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.-এর সাহিত্য জীবনের সেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, যা মানবিক স্বাতন্ত্র্যের ও বৈশিষ্ট্যগুলোর ধারাভাষ্য হয়ে ওঠেছে। তাঁর সৃষ্টিরাজি বিশেষ এক পরিবেশের মধ্য দিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন-ধর্ম, মতবাদ, প্রকৃতি, অভিজ্ঞতা, ইতিহাস অন্যান্য উপকরণ নিয়ে স্রোতোধারার মতো প্রবাহিত হয়েছে। তার সাহিত্য রাব্বানী ধ্যান-ধারণার পূর্ণগঠনে মানবতার সেই সম্পদ, যা মানুষের স্বভাবকে প্রকৃত মাহাত্ম্যে বিভূষিত করার ফলপ্রসূ ও কার্যকর উপকরণ। এ উপকরণ নিজস্ব কক্ষপথে এতোটা আলোকিত, যতটা আলোকিত এরিস্টটল তার দর্শন, প্লেটো তার চিন্তাধারায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শাহ ওয়ালীউল্লাহর বিশেষত্ব হলো তার চিন্তাধারা মানুষের শক্তিহীনতাকে বিশ্বাসের দ্বারা মোকাবেলা করেছে, প্রবৃত্তিকে পবিত্রতা ও ভক্তির দ্বারা শোধিত করেছে। জীবনকে সামনে অগ্রসর করে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে তা কখনো ব্যক্তির ভূমিকায় অসত্যতার প্রবক্তা নয়। তার দর্শন মানুষের জীবন ও চেতনাবোধের শূন্যস্থানগুলো এমন এক মানবিক উদ্দেশ্য দ্বারা পূরণ করে, যা জীবনকে সামনের দিকে উন্নতির জন্য নিয়ে যায়। এ উন্নতি ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ জগতে যেমন ঘটে, তেমনি ঘটে কর্মময় বহিরাঙ্গনে। শাহ ওয়ালিউল্লাহর সাহিত্য এতোটা নিবিড়, এতোটা নিপুণ, এতোটা স্পন্দনশীল যে, তা পাঠের মাধ্যমেই সমাপ্ত হয় না, আনন্দ ও নিছক শিক্ষার সামগ্রী হয়েই বসে থাকে না, বরং জীবনের উপর বিস্তার করতে থাকে আপন প্রভাব আর মানুষের সমগ্র চিন্তাশক্তি, কর্মশক্তি ও অনুপ্রেরণাকে নিজের অনুগত করে নেয়। চেতনার ভেতর এমন কোন শূন্যস্থান পড়ে থাকে না, যেখানে বিভ্রান্তির পতাকা উড়াবে। এমন কোন কোঠরি থাকে না, যেখানে অন্ধকার বসতি গাড়বে। এমন কোন অনাবাদী স্থান থাকে না যেখানে আগাছা আপন রাজত্ব কায়েম করবে। এই সাহিত্যের গভীর থেকে এমন এক ঝড় প্রবাহিত হয়, যা ইনসানিয়াতকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার জন্য সবগুলো দরজা-জানালায় সবেগে আছড়ে পড়ে। শতাব্দীর ঘুমের পাড়ায় হুলস্থুল পড়ে যায়, তারপর সংগ্রাম ও সংশোধনের মধ্য দিয়ে জীবন ও শিল্পকলার যে জাগরণ ঘটে, তা মহত্বের বিজয়কে অনিবার্য না করে ছাড়ে না। জীবনের সুসভ্য সুশান্ত আকাশকে উন্মোচিত না করে ছাড়ে না। সেই আকাশে চন্দ্রের মতো স্নিগ্ধতা ছড়ায় বিশ্বাস। সূর্যের মতো দীপ্তি ছড়ায় আদর্শ। তাহলে ওয়াহিদুল হক কোন যুক্তিতে বললেন- শাহ ওয়ালিউল্লাহর সাহিত্য জীবনের কোন আকাশকে উন্মোচিত করেনি? কোন যুক্তিতে তিনি বললেন সেই সাহিত্য মধ্যযুগীর কূপের কাহিনী? আমরা তো দেখি, তাঁর সাহিত্য স্বয়ং এক বিকল্প আকাশ হয়ে ওয়াহিদুল হকের মতো অন্ধদের আহ্বান করছে দৃষ্টিবান পৃথিবীর দিকে। তাঁর সাহিত্য স্বয়ং রুদ্রতার বাধ ভেঙে পৃথিবীকে পথ দেখাচ্ছে বর্বরতার কূপ থেকে উত্তরণের দিকে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ যে আদর্শের ব্যাখ্যাকার, সেই আদর্শের ঝলকানি পেয়েই তো পশ্চিমা জগৎ তাদের বর্বরতার মধ্যযুগ থেকে মুক্তির দিশা পেয়ে আধুনিক পৃথিবীর সীমানায় প্রবেশ করলো। ওয়াহিদুল হকরা আমার কথা বিশ্বাস করতে না চাইলে তাদেরই শ্রদ্ধাভাজন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক রবার্ট ব্রীফল্টের কথা বিশ্বাস করবেন আশা করি। তিনি লিখেছেন- ‘আধুনিক জীবনধারার এমন কোন পর্যায় নেই, যার ইসলামী উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করা যায়। চিন্তা-দর্শন ও বিজ্ঞানের যে স্রোত মুসলিম বিশ্ব থেকে প্রবাহিত হয়েছে তারই রূপান্তরিত ও বিবর্তিত ধারাটির নাম আধুনিক সভ্যতা। বস্তুত ইসলামে ব্যাপক ও মৌলিক অনুদান ছাড়া আধুনিক সভ্যতার কথা চিন্তাই করা যায় না।’ ইতিহাসের বয়ান যে আদর্শকে আধুনিক পৃথিবীর রূপকার সাব্যস্ত করলো, শাহ ওয়ালিউল্লাহ সেই আদর্শের বাতিঘর। তার মানে পৃথিবীর অগ্রগতির বীজ নিহীত আছে তার আলোয়। সেই আলো থেকে পৃথিবী পেয়েছে বহুমাত্রিক প্রতিভাস। এখন যারা আধুনিকতার উপাসনা করছেন, তাদেরকে তাদের দেবতার অস্তিত্বের ঋণ পরিশোধে শাহ ওয়ালিউল্লাহদের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতে হবে। ঋণ স্বীকার করতে হবে। তার কক্ষপথ ধরে হাঁটুন, ইতিহাস কিন্তু সেই পথে পা চালিয়েই আজকের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। অবাক হবো না। যদি বিশ্ববিবেক আপন পরিশুদ্ধির আকাক্সক্ষার কক্ষপথের আলোয় আপন গোসল সেরে নেয়। যদি এমনটি ঘটে, তাহলে পৃথিবীর জন্য এটা হবে সুবিশাল এক সুসংবাদ।
লেখক: কবি ও গ্রন্থকার ও গবেষক