বাউলকে বাউলই বলতে হবে! উঁহুঁ, হবে না। লালন নিজেকে ফকির বললেও নয়, মূলে সংস্কৃত বাউল বলেই লালনকে ডাকতে হবে। ফকির একটি আরবি শব্দ — এটা চলবে না। ফরহাদ মজহার এই সংস্কৃত মূল থেকে আসা ‘বাউল’ শব্দের জায়গায় ‘ফকির’ বসাতে চাইছেন। এখানে ‘ষড়যন্ত্র’ আছে। আরবিকরণ আছে, মুসলমানি আছে। ষড়যন্ত্র তাহলে ফকির লালন শাহই শুরু করেছেন। নিজেকে তাঁর বাউল বলে ঘোষণা দেওয়া দরকার ছিল। আরবি নয়, বাংলার সংস্কৃতির মূলে আছে সংস্কৃত। এই ভাবেই আমার লেখার একটি সমালোচনা পড়লাম ও উপভোগ করলাম।
লেখাটিতে বলেছিলাম, লালন নিজেকে ঘূণাক্ষরেও ‘বাউল’ বলেন নি। লালনকে বাউল বানাবার ‘রাজনীতি’টুকু বোঝা দরকার। গুরুগম্ভীর ভাষায় আগাপাছ বাদ দিয়ে দেখলাম ফেসবুকে মন্তব্যকারী লিখেছেন, আমার এই ‘তত্ত্ব’ নাকি ‘ইন্টারেস্টিং’ – তিনি আমার তত্ত্বের মধ্যে কন্সপিরেসি থিওরি জন্মের লক্ষণ খুঁজে পেয়েছেন। যিনি এই মন্তব্য করেছেন তথ্য আর তত্ত্বের ফারাক বুঝবার জ্ঞানটুকু তার নাই। লালন নিজেকে ফকির বলেছেন, বাউল বলেন নি, এটা তথ্য – এটা ফরহাদ মজহারের ‘তত্ত্ব’ নয়। (দেখুন ‘নদিয়ার ভাব ও লালন শাহ’)
তাঁর আপত্তি আমি ‘সংস্কৃত মূলের ‘বাউল’ শব্দের জায়গায় ‘আরবি’ ফকির ধারণা নিয়ে আসতে চাইছি’। বাউল শব্দটি আদৌ মূলে সংস্কৃত কিনা সেই ভুল বা আন্দাজি অনুমান তো আছেই, তবে বুঝতে পারলাম বাউল মূলে সংস্কৃত বলে ফকিররা নিজেদের ফকির বললেও তাদের সংস্কৃত মূল থেকে তৈয়ারি নামেই ডাকতে হবেঃ ‘বাউল’। তাই নদিয়ার তিন পাগলকে কেন আমি ফকির বলে ‘আরবিকরণ’ করলাম এতেও তিনি গোস্বা করেছেন। সুলতানী আমলে সমাজে ক্ষমতার যে রূপান্তর ঘটেছিল সেখানে ইসলামের প্রভাবের কথা আমি আনলাম কেন তার জন্য তিনি আমাকে আসামি করেছেন। বাংলা শব্দ ও শব্দের পেছনে ধারণাসমূহের আরবিকরণ বা মুসলমানিকরণের এই খারাপ চেষ্টা নতুন কিছু নয়। আমি সেই ‘কোশেশ’ করছি। আর এখানেই তার আসল আক্রমণের জায়গা। সেটা হোল ‘আমিই সেই বুদ্ধিজীবী, যিনি শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণী সংগ্রামকে ‘জিহাদ’ হিসেবে ‘বয়ান’ করি। বেশ। মন্তব্যকারী যে গর্তে থাকেন তারা আবাস চিনলাম। (দেখুন, এখানে)
জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইকে জেহাদ বলার দোষ কি আমি আজও তা বুঝে উঠতে পারলাম না। হোক তা আক্ষরিক বা প্রতীকী। তর্কের খাতিরে মানি, তার অপব্যবহার আছে, সেই ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থ নয়, ধারণাগত মর্মের পর্যালোচনা হতেই পারে।। জিহাদ কথাটার আক্ষরিক অর্থ প্রচেষ্টা। এখন বুঝতে পারলাম আরবি শব্দ ব্যবহারেই আপত্তি। আমাদের সংস্কৃতে থাকতে হবে আরবিকরণ চলবে না। তাই শ্রেণি সংগ্রামকে জিহাদ বলা যাবে না। তাছাড়া জিহাদ ইসলামি জঙ্গীরা ব্যবহার করে সহিংসতা আর রক্তপাতের জন্য। জঙ্গ মানে যুদ্ধ। যদি ইসলাম পন্থিরা একে ‘যুদ্ধ’ বলে তাহলে? কিন্তু শ্রেণি সংগ্রামী কমিউনিস্টদের হাতও কি শ্রেণি যুদ্ধে রক্তরঞ্জিত নয়। সেটাও কি জঙ্গী ছিল না? ইতিহাস কি সেই সাক্ষ্য দেয় না? আমার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের তথাকথিত ইসলাম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক সেকুলারদের এই প্রধান অভিযোগ নিয়ে কিছু বলবারও রুচি আমার নাই। তারা যেখানেই ইসলামের নামচিহ্ন আছে তার সংস্কৃতায়ন করতে চায়। এখন ভাল জিনিস শিখেছি। ফকিরকে বাউলই বলতে হবে, কারন তা মূলে সংস্কৃত। দারুন! এইসব ইসলাম বিদ্বেষীদের উর্বর মস্তিষ্কের তারিফ করছি, আর ছেঁউড়িয়া থেকে ফিরে এসে ক্লান্ত শরীরে বেশ আমোদ উপভোগ করছি। এই ধরণের বিদ্বেষমূলক মন্তব্য নতুন কিছু নয়, তবে নদিয়ার ভাবচর্চা ও তার রাজনীতির আলোকে কিছু কথা না হয় আবারও বলে রাখি।
রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরকে ‘বাউল’ বলেছেন – অতএব আমাদেরকে ঠাকুরের কথা মান্য করতে হবে, এই যুক্তি যারা দিতে চান তাঁদের সঙ্গে আমি একমত নই। ঠাকুর যদি বাউল আর ফকির একই করে ফেলে থাকেন, সেটা সেসময়ে তিনি যতোটুকু জানতেন তার ভিত্তিতে করেছেন। সেসময় ক্ষিতিমোহন সেনের গবেষণার ওপর তিনি ভর করেছিলেন, কিন্তু সেনবাবু ছিলেন রীতিমতো বিপর্যয়। তাঁর জীবিতাবস্থাতেই তার সংগৃহীত বাউল গান সম্পর্কে ভদ্র ভাশায় ‘সন্দেহ’ তৈরি হয়েছিল। আর সোজা ভাষায় তিনি নিজেই লিখে সেটা নিজেই নানান বাঊলের নাম নিয়ে ছেপে দিয়েছিলেন। যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হোল কোথায় এইসব বাউল? তিনি চেপে গেলেন।
এখন অনেক গবেষণা হয়েছে। অন্যদিকে পৌষ মেলায় ফকির আর বাউলদের রবীন্দ্রনাথ আলাদা করে রাখবার ব্যবস্থাও রেখেছিলেন। এই বিভাজনকে আমরা সাম্প্রদায়িকতা বলতে পারি। আবার এই ক্ষেত্রে তাকে তার জানা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা ও অসম্পূর্ণতাও বলতে পারে। নির্ভর করছে আমরা কিভাবে তা দেখছি। রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক ছিলেন এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য কষ্টকর।
আমার মন্তব্যে ‘ষড়যন্ত্র’ যারা পাচ্ছেন, বুঝতে পারি তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চিন্তিত। ঠিক, আমি রবীন্দ্রনাথকে নদিয়ার ভাব বুঝবার ক্ষেত্রে প্রামাণ্য মনে করি না। তিনি বড় কবি, সুলতানি আমলে গড়ে ওঠা নদিয়ার ভাব সম্পর্কে তাঁর কোন পড়াশোনা, গবেষণা কিম্বা সম্যক জ্ঞান ছিল না। তিনি কবি – ফকিরদের কাব্যগুণান্বিত গানে আকৃষ্ট হয়েছেন, সেটা খুবই ভাল কথা। বাউলদের শাস্ত্র বিরোধিতা কিম্বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিরোধিতা তার ভালো লেগেছে; পাশ্চাত্যে তিনি সেটাই প্রচার করেছেন। কিন্তু তার ভাবগত বা দার্শনিক ভিত্তি সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট অবহিত ছিলেন না। এটা তাঁর ক্ষেত্রও ছিল না। বাইরে থেকে বাউলদের দেখে তার যা ভাল লেগেছে বলেছেন। ফকির বা বাউলদের জীবন নিয়ে তার কাব্যিক নুরীক্ষণ ছিল, কিন্তু তাদের তত্ত্ব নিয়ে তাঁর কোন কাজ ছিল না।
‘রাজনীতি’ কথাটা কী অর্থে ব্যবহার করেছি, সেটা আমার বাক্যটির ঠিক ওপরেই ব্যাখ্যা রয়েছে। জিহাদকে কেন শ্রেণি সংগ্রাম বলি সেই অজুহাত তুলে যিনি আমাকে সমালোচনা করছেন তিনি সেইদিকে গেলেনই না। সেখানে তত্ত্ব ছিল, অবশ্যই। অথচ কমেন্টকারী তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন, এমনকি আমার ‘নদিয়ার ভাব ও লালন শাহ’ লেখাটির পুরোটাই ‘রাজনীতি”টা আসলে কী, তার ব্যাখ্যা – আফসোস, কিছুই সংস্কৃতপন্ন আরবি ও ইসলাম বিদ্বেষী বুদ্ধিতে প্রবেশ করলো না।
কথাটা যেখানে ছিল তার ওপরেই বলা হচ্ছে, “দীর্ঘদিন ধরে ছেঁউড়িয়ায় অনুষ্ঠান হচ্ছে লালন সাঁইজীর তিরোধান দিবসে কিম্বা দোলে – কিন্তু এই দুটি দিনের মর্যাদা বিন্দুমাত্র রক্ষা হয় না। দেখি, কিভাবে নদিয়ার ভাবের সর্বোচ্চ প্রকাশ লালনের ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে, গাঁজায়, কল্কি, সিদ্ধি এবং নানান গুহ্য সাধনার ইতিবৃত্তে। এটা করা হচ্ছে লালনকে ‘বাউল’ আখ্যা দিয়ে। ‘বাউল সম্রাট’ আখ্যা দিয়ে লালনকে যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করা যায়”। ভেঙ্গে বলিঃ
১. লালনকে ‘বাউল’ বললে গাঁজা, কল্কি, সিদ্ধি সহ নেশাদ্রব্য গ্রহণ ও নানান ‘গুহ্য সাধনা’ বা যৌনবৃত্তি তাঁর নামে ন্যায্য প্রমাণ করা যায়। এই সবের বিরুদ্ধে কোন নৈতিক ছুঁচমার্গ আমার নাই, তবে শরীর স্বাস্থ্যের দিক থেকে যে কোন প্রকার ধূমপান সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা আছে। নদিয়ার ফকির লবান শাহ বলতেন তুমি গাঁজা খেতে পার, কারণ স্বয়ং দেবের দেব মহাদেব গাঁজা খেতেন। কিন্তু তিনি আগে সৃষ্টিকে রক্ষার জন্য বিষ খেয়ে সেই বিষ কন্ঠে ধারণ করে ‘নীলকন্ঠ’ হয়েছেন। তিনি মহাদেব। তিনি গাঁজা খেয়ে সমাজের এমন কি উপকার করচ যাতে জীবের বা ব্রহ্মাণ্ডের এক রতি উপকার হয়। লালনপন্থীরা সামাজিক, সমাজেই তাদের তাদের বাস, নিজেদের জীবঞ্চর্চাকে উদাহরণ তৈরী করেই তাঁরা সমাজকে অনুপ্রাণিত করেন। যা তাদেরকে বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেটা তাঁরা করে করেন না। তাঁরা কোন অসামাজিক, মিস্টিক, ভবঘরে উদাসীন কেউ নন।
ফকিরদের সেবা, সেবার প্রকরণ বা খাদ্য ব্যবস্থার চর্চা নিয়ে গবেষণা কমই হয়েছে, যতোটা না বাউলদের উদাসী ও উচ্ছৃংখল জীবন ও তাদের গুহ্য সাধনা পদ্ধতি নিয়ে। এতে বোঝা যায় শিক্ষিত মধ্যবত্তের গুপ্ত আগ্রহ কোথায় এবং কীসে? সকালে গোষ্ঠ গান ও সন্ধ্যাবাতি ও গুরুভক্তির পর দৈন্য গানের তাৎপর্য কিম্বা বাস্তব ও বৈষয়িক জগতের সঙ্গে খাদ্যব্যবস্থার চর্চা কিভাবে জীবের সঙ্গে পরমের সম্পর্ক রচনার চর্চা হয়ে ওঠে সে সবের কোন খবরই আমরা নিতে চাই না। আমাদের আগ্রহ গাঁজা, কল্কি, সিদ্ধি ও গুহ্য বিদ্যায়। এতে নদিয়ার ভাবচর্চার কী বিশাল ক্ষতি হয়েছে ও হচ্ছে তার কোন সীমা পরিসীমা নাই। ফকির লালন শাহের জীবদ্দশায় নবপ্রাণ আখড়াবাড়ির সেবার সময় নেওয়া কিছু স্থির চিত্র।
২. ঔপনিবেশিক আমলে গড়ে ওঠা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ‘বাবু বা ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি নিম্ন বর্ণ ও শোষিত মানুষের রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রাম ও ভাবচর্চার ধারাকে হেয় প্রতিপন্ন করবার জন্য নদিয়ার ফকির ও ভাবচর্চাকে স্রেফ নেশাদ্রব্য গ্রহণ ও গুহ্য চর্চার ধারা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে আসছে। এরা ডার্টি, নোংরা থাকে। এমনকি ঠাকুর রামকৃষ্ণের মতো মহৎ মানুষও মনে করতেন এরা সদর দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে চায় না, মেথর যে দ্বার দিয়ে আবর্জনা সরায় সেই দরজা দিয়ে গৃহে প্রবেশ করতে চায়। বাঊলদের সম্পর্কে এই গড়পড়তা সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গীর নিন্দা করা উচিত। এই বদ্ধমূল অনুমান ও প্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে নদিয়ার ফকিরদের বাউল বলার নগদ লাভ হচ্ছে ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথকে ফকিরদের বিওপরীতে দাঁড় করানো। যারা রবীন্দ্রনাথের বরাতে লালনকে বাউল বলতে চান এটা তাদের নগদ রাজনীতি। এর সঙ্গে ও শাক্ত ঠাকুর রামকৃষ্ণকেও নদিয়ার ভাবচর্চার বিপরীতে দাঁড় করানো যায়। যদিও শ্রেণি ও চিন্তাধারার দিক থেকে ভিন্ন কিন্তু এই দুই মহতের বিরুদ্ধে নদিয়ার কোন প্রকাশ্য কোন বিরুদ্ধতা নাই। তাঁদের অবদান নদিয়া অকুন্ঠ চিত্তেই স্মরণ করে। কিন্তু ব্রাহ্ম বা শাক্ত নদিয়ার ভাব নয়। আসলে ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির রাজনীতির জন্য নিম্ন বর্গের মানুষের ভাবান্দোলন বিপজ্জনক। তাই নদিয়ার ভাবচর্চার সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্টকে অস্বীকার করে তাকে ‘বাউল’ নামক সাধারণীকরণে পর্যবসিত করবার সস্তা রাজনীতি ঔপবেশিক আমল থেকেই চলে আসছে। এখনও তার ধারাবাহিকতা চলছে। গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’- এ মনে হয় লালন একজন ব্যাভিচারী জঙ্গলে বাস করা নাচলেকুঁদনে ওয়ালা কাল্ট ফিগার। কলকাতার এই চেষ্টা কুৎসিত এবং এর যথেষ্ট প্রতিবাদ করার দরকার ছিল। আমরা করতে পারি নি।এখন ‘কসমিক সেক্স’ নামে আরেক জিনিস বানানো হয়েছে। আমি দেখিনি ভয়ে, জানিনা দেখলে মূর্ছা যাব কিনা। নদিয়া দেহবাদী সন্দেহ নাই, কিন্তু তান্ত্রিক বা যোগাচারী দেহবাদ থেকে আলাদা – আমার লেখায় আমি তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।
৩. দ্বিতীয়ত যদি ভাবচর্চার ইতিহাসে না নামি – খালি কে নেশা করল আর কে করল না নিয়ে ব্যস্ত থাকি – তাহলে তন্ত্র থেকে চৈতন্যের রসতত্ত্ব এবং রসতত্ত্ব থেকে ফকির লালন শাহের ‘ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে’ কিভাবে ‘রাঙাচরণ’ পাওয়া যায় — চিন্তার এই পরিভ্রমণ — তার নানান ভাঙাচোরা পথ ও বাঁকের ইতিহাসের কোন হদিসই আমরা পাবো না। ভাবব নদিয়া বুঝি যোগাচার, তন্ত্র ও নানান গুহ্য সাধনার কায়কারবার। আমি দীর্ঘদিন ধরেই এর বিরোধিতা করছি ও করে যাব। কারণ বাংলাদেশের তরুন ভাবুকদের এই গর্বটুকু দিয়ে যেতে চাই যে নদিয়ায় রাজনৈতিক ও দার্শনিক অর্থে একটি বড় বিপ্লব ঘটেছে এবং তারা তার গর্বিত উত্তরাধিকারী। ঔপ্নিবেশিক কলকাতার বদ্ধমূল ভদ্রলোকী চিন্তা ও ভদ্রলোকী সংস্কৃতির পক্ষে শ্রেণিগত কারণেই একে বোঝা ও গ্রহণ কঠিন ছিল। এখন দেখি তারা একে বড়জোর এক ধরণের সেকুলার মানবতাবাদী ব্যাপারে পর্যবসিত করে।
৪. নদিয়ার এই লড়াই একই সঙ্গে আধুনিক পাশ্চাত্যের অনুমান ও জ্ঞানকাণ্ড পর্যালোচনার প্রাথমিক বহু উপাদান আমাদের দিতে পারে। অতএব কলোনিয়াল শাসনের আগে চৈতন্যের সময় থেকে এর আবির্ভাব ঘটলেও ফকির লালন শাহ অবধি এই ভাবচর্চাএ যে বিস্তৃতি ও বিকশিত পরিমণ্ডল তা পাশ্চাত্য অনুমান, জ্ঞা্নকাণ্ড ও তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাজনীতির বিরুদ্ধে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। এই বিপ্লব ঘটেছে সমাজের সবচেয়ে নীচের মানুষগুলোর দিক থেকে, তার রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটেছে নদিয়ার ‘ভক্তি’ আন্দোলনে – যার সঙ্গে এই উপমহাদেশের অপরাপর ভক্তির ধারার সঙ্গে মিল ও পার্থক্য দুটোই রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ তরুণদের নেবার জন্য আমি আমার লেখায় অনুপ্রাণিত করি। আমামদের হাতে ও সামনে অনেক কাজ।
৫. তৃতীয়ত নদিয়া সম্ভব হয়েছে সুলতানী আমলে ইসলামের প্রত্যক্ষ প্রভাবে। নইলে উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ ও বর্ণাশ্রম প্রথা বিরোধী আন্দোলন নদিয়ায় গড়ে উঠত না। – অর্থাৎ শাস্ত্র বিরোধী, জাতপাত বিরোধী ধারা মোটেও বঙ্গে গড়ে উঠত কিনা। অতএব ইসলাম নদিয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রসং, যা ফকির লালন শাহ থেকে শুরু করে নদিয়ার ফকিরদের ঘরে ঘরে হাজির। নদিয়ার ভাবের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে সুলাতানী আমলের ইতিহাস সরাসরি আরও নজরে আনাও আমার উদ্দেশ্য। বলা বাহুল্য, জাতপাত বিরোধিতা নদিয়া যে ভাষায় তাদের গানে ও জীবনযাপন চর্চায় করে থাকে তা এক অনন্য সামাজিক আন্দোলন। তার সীমা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্ত আমি এই রাজনীতি ধারণ করি এবং তার পর্যালোচনারসম্ভাব্য বিকাশের পথ অনুসন্ধানের চেষ্টা করি।
৫. নদিয়ার ভাবের ফসলের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এ কালের তরুণদের ‘ফকিরী’ করতে হবে এটা কখনই আমার প্রস্তাব নয়। সেটা যার যার নিজের বিবেচনা। তবে নিজের মনের বাসনা কি এবং ব্যাক্তিগত জীবন শুধু নয়, সমাজে তারা কী অবদান রাখতে চায় সেটা গভীর ভাবে পর্যালোচনা জরুরী। বড় কাজ হচ্ছে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিসরে এর বিকাশ দ্রুত ও ত্বরান্বিত করবার প্রকরণ আন্তরিক ভাবে সন্ধান করা। এ বিষয়ে আমার চিন্তা ভাবনা আমি অন্যত্র কিছু কিছু লিখেছি, আরও লিখব।
লেখক : কবি, বুদ্ধিজীবি