পরিক্রমায় ১৪৩৬ হিজরি বিদায় নিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে হিজরি নতুন বছর ১৪৩৭। মুসলিম জীবনে হিজরি সন ও তারিখের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। হিজরি সন এমন একটি সন, যার সাথে মুসলিম উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যের ভিত্তি সম্পৃক্ত। মুসলমানদের রোজা, হজ, ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর, শবেমিরাজসহ ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধান হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের অনুসারী। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, হিজরি সনের পহেলা মাস মহররম একের পর এক আমাদের দুয়ারে হাজির হয় ঠিক, কিন্তু হিজরি সনের নব আগমন উপলক্ষে হৈ-হুল্লোড় নেই, নেই কোনো প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়ার বিশেষ কোনো আয়োজন। যেমনভাবে বিশেষ আয়োজন পরিলক্ষিত হয় ঈসায়ী নববর্ষ কিংবা বাংলা নববর্ষেও আগমনে।
ঈসায়ী নববর্ষ কিংবা বাংলা নববর্ষ আগমনে আমাদের দেশের সংস্কৃতি প্রেমিকরা সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির চর্চায় মেতে ওঠে। এতে ইসলামী বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা করা হয় না। তথাকথিত সংস্কৃতিপ্রেমীদের সাথে সাথে আমাদের একশ্রেণির তারুণ-তরুণী নববর্ষ উদযাপনের নামে অশ্লীলতা ও বেলেল্লাপনায় গা ভাসিয়ে দেন। ঈসায়ী নববর্ষ কিংবা বাংলা নববর্ষকে যেভাবে গুরুত্ব তথা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে উদযাপন করা হয় এবং হিজরি নববর্ষেও প্রতি অবহেলা দেখে মনে হয় হিজরি নববর্ষের যেন আমাদের প্রয়োজনই নেই। অথচ হিজরি নববর্ষকে গুরুত্বসহকারে পালন করাই ছিল আমাদের মুসলিম অধ্যুষিত দেশে কাম্য। যেসব উপাদান মুসলিম উম্মাহকে উজ্জীবিত করে তন্মধ্যে হিজরি সন অন্যতম। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-কালচারে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরি সন গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্ময়রণীয় ঘটনাকে উপলক্ষ করে। রাসুল (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীবর্গের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আরবি মহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে তথা দ্বীনের স্বার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রাসুল (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামগণের হিজরতের বছর থেকেই হিজরি সনের সূচনা।
খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা.)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনে, প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) ইরাক এবং কুফার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একদা হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) খলিফা উমরের (রা.) খেদমতে এ মর্মে পত্র লিখেন যে, আপনার পক্ষ থেকে পরামর্শ কিংবা নির্দেশ সংবলিত যেসব চিঠি আমাদের নিকট পৌঁছে তাতে দিন, মাস, কাল, তারিখ ইত্যাদি না থাকায় কোনো চিঠি কোা দিনের তা নিরুপণ করা আমাদের জন্য সম্ভব হয় না। এতে করে আমাদের নির্দেশ কার্যকর করতে সমস্যা হয়। অনেক সময় আমরা বিব্রত বোধ করি চিঠির ধারাবাহিকতা না পেয়ে। হজরত আবু মুসা আশআরীর চিঠি পেয়ে হজরত উমর (রা.) এ মর্মে পরামর্শ সভার আহ্বান করেন যে, এখন থেকে একটি ইসলামি তারিখ প্রবর্তন করতে হবে। উক্ত পরামর্শ সভায় হজরত উসমান (রা.), হজরত আলী (রা.) সহ বিশিষ্ট অনেক সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সকলের পরামর্শ ও মতামতের ভিত্তিতে ওই সভায় ওমর (রা.) সিদ্ধান্ত দেন ইসলামি সন প্রবর্তনের। তবে কোন মাস থেকে বর্ষের সূচনা করা হবে তা নিয়ে পরপস্পরের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হয়। কেউ মত পোষণ করেন রাসুল (সা.)-এর জন্মের মাস রবিউল আওয়াল থেকে বর্ষ শুরু করার। আবার কেউ কেউ মত পোষণ করেন রাসুলের ওফাতের মাস থেকে বর্ষ শুরু করা হোক। অন্যান্যের মতে হুজুর (সা.)-এর হিজরতের মাস থেকে বর্ষ করা হোক। এভাবে বিভিন্ন মতামত আলোচিত হওয়ার পর হজরত উমর (রা.) বললেন, হুজুর (সা.)-এর জন্মের মাস থেকে হিজরি সনের গণনা শুরু করা যাবে না। কারণ খ্রিস্টান সম্প্রদায় হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের মাস থেকেই খ্রিস্টাব্দের গণনা শুরু করেছিল। তাই রাসলের জন্মের মাস থেকে সূচনা করা হলে বাহ্যত খ্রিস্টানদের অনুসরণ ও সাদৃশ্যতা হয়ে যায়, যা মুসলমানদের জন্য পরিত্যাজ্য। এ সম্পর্কে রাসুলের বাণী, ‘তোমরা ইয়াহুদি-খ্রিস্টানদের বিরোধিতা করো।’ (বুখারি ও আবু দাউদ শরিফ)
অপরদিকে হুজুর (সা.)-এর ওফাত দিবসের মাস থেকেও গণনা শুরু করা যাবে না, কারণ এতে হুজুর (সা.)-এর মৃত্যু ব্যথা আমাদের মাঝে বারবার উত্থিত হবে। পাশাপাশি অজ্ঞ যুগের মৃত্যুর শোক পালনের ইসলামবিরোধী একটি কুপ্রথারই পুনরুজ্জীবন ঘটবে। হজরত ওমর (রা.)-এর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যকে হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.) এক বাক্যে সহমত পোষণ করে বললেন, এরই পরিপ্রেক্ষিতে খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা.) হিজরতের বছর থেকেই ইসলামি দিনপঞ্জী গণনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ। মোদ্দা কথা, আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে হিজরি সনের গণনা সূচনা করেন। এটাই ছিল হিজরি সনের প্রেক্ষাপট। মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গণনা হিসেবের মাস হলো বারোটি।
হিজরী সনের প্রথম মাস হলো মহররম। মহররম একটি তাৎপর্যমন্ডিত ও বরকতময় মাস। মুসলিম ইতিহাসে এ মাসটি বিভিন্ন কারণে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কুরআন কারিমে এ মাসটিকে ‘শাহরুল্লাহ’ তথা আল্লাহর মাস বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন, ‘চারটি মাস রয়েছে যেগুলো সম্মানিত মাস। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো মহররম। (সূরা তাওবাহ : ৩৬)
আর এ মাসেই রয়েছে ফজিলতপূর্ণ ‘আশুরা’। মহররমের দশম তারিখে ঐতিহাসিক ‘কারবালা’ সংঘটিত হয়েছিল। এছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দিনে ঘটেছে এবং ভবিষ্যতেও এই দিনে আরও অনেক ঘটনা ঘটবে। মহররমের ফজিলতপূর্ণ অনেক আমল রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নফল রোজা।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রাসুল (সা.) কে এই দিন (আশুরার) এবং এই মাসে রমজানের রোজার চেয়ে অন্য কোনো রোজাকে এত গুরুত্ব দিতে দেখিনি। (মিশকাত শরিফ)
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমার বিশ্বাস যে, আশুরার রোজার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের গোনাহ মাফ করে দিবেন’। (তিরমিজি শরিফ)
শেষ কথা: হিজরি সনের সম্পর্ক চাঁদের সাথে থাকার কারণে এই সনের তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক। এই চাঁদের হিসাবে মুসলমানদের অনেক ইবাদত-বন্দেগী, আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে। কাজেই সর্বক্ষেত্রে হিজরি তারিখকে গুরুত্ব দেয়া জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক, ব্লগার, কলামিস্ট