Wednesday 1st May 2024
Komashisha familyAdvertisementContact । Time: ভোর ৫:৪২
Home / প্রবন্ধ-নিবন্ধ / শান্তির নগরীতে লাশের মিছিল, দায় নিবে কে?

শান্তির নগরীতে লাশের মিছিল, দায় নিবে কে?

লেখক

তাজ উদ্দীন হানাফী ::
যদি রক্ষা করতে পারনা
কাবার সম্মান, তাহলে ফিরিয়ে দাও,
মুসলিম বিশ্বের লালিল সপ্ন, আটকে আর রেখনা,
ফিরে যাও তোমরা,
তোমাদের সেই জাহিলিয়াতে,
মক্কা , মদিনা, বায়তুল মাকদাস । দুটি দেশের ৩টি পবীত্র স্থান । এ পবিত্র জায়গাগুলো শুধু মাত্র ওই দেশ দুটির সম্পদ নয় । বিশ্বের ১৫০ কোটি মুসলমানের হৃদয়ের স্পন্দন । অনুভুতির, ভক্তির, ভালবাসার সর্বোচ্চ মাকাম।

সাম্প্রতিক সৌদি আরবের বিভিন্ন মসজিদে আত্মঘাতী বোমা এবং বোমার আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন নামাজ রত মানুষের দেহ । সৌদি আরবে এগুলো কল্পনাতেও ছিলনা কিছু দিন আগেও ।কিন্তু এখন ঘটছে হরহামেসাই । কিন্তু কেন? মুসলিম বিশ্বে সৌদির অবস্থান, তাদের রাজতন্ত্র,মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্বে তাদের খবরদারি, ভুলনীতি, অতি মাত্রায় পশ্চিমা প্রিতি, সৌদিতে আমেরিকান সেনাদের অবস্থান, নিজ দেশে বিরোধী মত দমন আরো নানা কারণ আজকের অবস্থানের জন্য দায়ী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ।

আমরা আরো একটু পেছনে যাই । আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে আরবে মার্কিন সেনারা ঘাটি করে । সেৌদি রাজারা দাওয়াত দিয়েই বলা যায় পবীত্র ভুমিতে নিয়ে আসে তাদের রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য । মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে বিশ্বের কোন মুসলমানরাই ভাল চোখে দিখেনি কোন কালেও । ভাল চোখে দেখার মত মুসলিম বিশ্বের সাতে কোন নজীরও স্থাপন করেছে বলে ও  জানা নাই । এক সময়ের মার্কিনীদের হাতে তৈরি আল-কায়েদা যার প্রধান বিন লাদেন সৌদির সন্তান, তারা হামলা শুরু করে
মক্কায় আমিরিকান স্থাপনায় । তার পর কেটে গেছে অনেক বছর । সৌদির রাজতন্ত্র ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও মুসলিম বিশ্বে সৌদি সরকারের অবদান অনেক । বিশেষ করে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলো তাদের কাছে অনেক ঋণি ।

মসজিদে বোমা:
হজ্জের মাস দুয়েক আগে সৌদির বিভিন্ন মসজিদে সিরিজ বোমা হামলা হল । বিশেষ করে শিয়া মসজিদে । দায় শিকার  করলো আইএস । এরপর সুন্নি মসজিদে বোমা তার ও দায় নিল আইএস । কারা এই আইএস । সেটা অনেক বড় আলোচনা তবে এতটুকু জানুন যারা ফিলিস্তিন দখল নিতে চায়, সিরিয়াতে এক এলাকায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে অন্য এলাকায় তার পক্ষ হয়ে কাজ করে, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার দামি অস্ত্রোত্রাস  সৃষ্টি করে ইহুদীদের নীলনকশা বাস্তবায়ন করে , যৌন দাসীর লোভে আইএসএ যোগ দেয় আবার না পেয়ে ত্যাগ করে দেশে ফিরে যায়, তাদের মুখোশ চিনতে এত দেরি করার কথা নয় ।

ক্রেন দুর্ঘটনা
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫, জুমাবার শতাধিক হাজী শহিদ । একটা প্রশ্ন সবার চোখ এড়িয়ে সেটা হল ক্রেন দূর্ঘটনার আগে একটি পিলারের গোড়াতে আগুন লাগে কে বা কারা এই আগুণ লাগালো তাদের আজো খুজে বের করা যায়নি, হোটেলে অগ্নিকাণ্ড (১৭ সেপ্টেম্বর) এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বেশ কয়েকটি হোটেলে আগুন লাগলো । সেখানেও হতাহত হল অনেক । উল্লেখ্য বিভিন্ন দেশের হাজীরা এসব হোটেলে উঠে থাকেন । সন্দেহের চোখ কাদের দিকে দিবে মুসলিম বিশ্ব।

মিনা ট্র্যাজেডি
২৪ সেপ্টেম্বর ২০‌‌১৫, ঈদুল আযহা। হজ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা এটা । অনেক গুলো কারনের কথা বলা হয়েছে এখানে । আমাদের দেশের হাজীরাও কিছু অভিযোগ করেছেন । অনেকে বলেছেন আফ্রিকান হাজীদের কারনে এটা হয়েছে আরো
নানান কারন । কেউ বলেছেন ইরানি হাজীরা ওই সময় বেশি ছিল সেখানে । উপরের বিষয় গুলো ছাড়াও আরো অনেক কিছু ঘটছে সৌদিতে । আপনাদের কারো কাছে কি কৌতুহলী কোন প্রশ্ন উকি মারেনি যে, কেন সব কিছু এ বছরই ঘটছে এত কিছু ?

১৯৮৭ সালের ৩১ জুলাই সেদিনও ছিল জুমার দিন হজ্জের সময় । হঠাৎ লক্ষাধিক হাজী স্লোগান দিয়ে উঠেন কাবা শরীফের বাহিরে। এরা খুবই সংগঠিত বুঝাগেল তাদের মুভমেন্টে । এরা কেউই ওই দেশের নয় সবাই ইরানি! হুলস্থুল কান্ড চার পাশে । (কোন অনুমতি না নিয়েই… উল্লেখ্য সৌদিতে সকল প্রকার রাজনীতি নিষিদ্ধ) হ্জ্জ ওমরা করার ভিসা নিয়ে কাবা ঘরের একটু বাহিয়ে লক্ষাধিক মানুষ একত্রে,  কত বড় পূর্ব পরিক্লপনা করে এটা সম্ভব ছিল একটু চিন্তা করুন । এটা সেটা যে ওই দেশের শিয়া সরকারের রাষ্ট্রিয় মদদ ছাড়া সম্ভব না সেটা সহযেই অনুমেয় ।

১৯৭৯ তে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হয় খোমেনির হাত ধরে । ঠিক তার ৮ বছর পর সৌদিতে তারা এ কান্ড ঘটালো । সাধারণত ধরা হয় হজ্বে  ২০ লাখ হাজী হয়েছে এ বছর । তা হলে আজ থেকে ২৮ বছর আগে এ সংখ্যাটা ছিল অনেক কম ধরি সেটা ১০বা ১২ লাখ হাজী তখন হজ্জ করতে আসতো আর তাদের মধ্যে ১ লাখের ও বেশি ছিল ইরানি । তার মানে প্রতি দশ জনে ১ জন ইরানি! । শত মাইল পারিদিয়ে ভিন্ন একটা দেশে লক্ষাধিক মানুষ নিয়ে হজ্জ বা ওমরার ভিসায় তারা এ ন্যাক্কার জনক কাজটা করেছিল সৌদি সরকারকে বিব্রত করতে । তারা (ইরানিরা) যে নিজ দেশ ছাড়াও ভিন্ন দেশে গিয়েও যে বিসৃংখলা করতে পারে তার ছোট্র একটা উদারন মাত্র ।

ইরানের সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ দেই, শতকরা ৭০% সুন্নি অধ্যুশিত সিরিয়ায় বহু বছর থেকে রাজত্য করছে বাসার আল আসাদ যিনি একজন শিয়া । বিশাল সংখ্যক এই সুন্নি জনগণকে দমিয়ে সেনা সহায়তায় টিকে আছে আসাদ সরকার । বছর চারেক আগে থেকে সেখানে সেনা এবং সু্ন্নি জনগণ বিদ্রোহ করে । হাতে অস্র তুলে নেয় । বিশাল এই জনশক্তিকে দমানের জন্য অবৈধ আসাদ
সরকারকে শুধু মাত্র শিয়া হওয়ায় ইরান শুরু থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে । এর মধ্যে অবাক করা বিষয় হল সিরিয়ার একটা এলাকাতে স্বাধিনতাকামী আন নুসরা ফ্রন্টের হতে ধরা পড়ে শতাধীক লোক যাদের পরিচয় হল তারা ইরান সামরিক বাহীনির সাবেক মেজর,কর্নেল সেনা! তারা যুদ্ধ করতে এসেছে আসাদ সরকারের হয়ে । ইরান তার সেনা অস্র গোলাবারুদ দিয়ে শুধু সিরিয়াকে না । আরব ও আরবের আসে পাশে যেখানে কিছু শিয়া আছে সেখানেই সব কিছু দিয়ে অরাজকতা করছে । সেটা লেবানন, ইরাক, তুরষ্ক, ইয়েমন আরো অনেক ।

বাংলাদেশে ইরানের ভয়ংকর থাবা :
ভয়ংকর তথ্য হল তারা বাংলাদেশেও গরীব ও মেধাবী ছাত্রদের নিজস্ব আবাসিক এলাকায় রেখে পড়ালেখা করিয়ে শিয়া বানাচ্ছে । তারা খিৃষ্টান মিশনারির মত কাজ করছে গরীব বাঙ্গালীদের মধ্যে । কিছু আলেম কিনছে টাকার বিনিময়ে, যে আলেমরা সমাজে বিসৃংখলা তৈরি করচে বিভিন্ন মাসয়ালা দিয়ে।

ইয়েমেনে ইরানি আগ্রাসন :
ইয়েমেন সৌদির সিমান্ত ঘেষা এই দেশ ।  এখানের বড় একটা অংশ সুন্নি জনগণ । ইরানের সাথে সৌদির বিরোধ বিভিন্ন কারনে প্রথমত ইরান শিয়া এরপর ইরান চায় সৌদির মুসলিম বিশ্বের প্রভাব কমিয়ে ইরান দখল করুক । সব মুসলমান শিয়া হয়ে যাক । আরো নানা কারন । সৌদির প্রভাব কমাতে সৌদির ভিতরে না পেরে ইরান দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয় টার্গেট করে ইয়েমেনকে । সেখানে শিয়াদের সবরকম অর্থ সহায়তা দেয় যারা ইয়েমেনে “হুতি” নামে পরিচিত । এই হুতিরা নির্দিস্ট এলাকাতে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে আস্তে আস্তে তারা আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে । ইরানের সহায়তায় মরুভুমিতে অস্র যোগান দেয়। মাঝে মাঝেই ইয়েমেনের বিভিন্ন এলাকাতে বোমা হামলা করে । বছর খানেক আগে ইয়েমেন সরকারের রাজপ্রসাদের দখল নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করে । শুরু হয় বিদ্রোহ শান্ত একটা দেশ মুহুর্তেই অশান্ত হয়ে যায় । সৌদি তার পাশের দেশে সন্ত্রসি হুতি বিদ্রোহীদের দমাতে সেখানে সেনা পাঠায় । ইরানের আতে ঘা লাগে । ইরান উঠে পরে লাগে সৌদি ও তার সরকারকে কিভাবে নাস্তানাবুদ করা যায় ।

যে ইরান আজ থেকে ২৮ বছর আগে লক্ষাধিক লোক নিয়ে কাবার পাশে মিছিল করতে পারে, তারা মিনায় দুর্ঘনায় যে পূর্ব পরিক্ল্পনায় করতে পারে না তার নিশ্চয়তা কোথায় । উল্লেখ্য ওই দিন মিনার ঘটনাস্থলে সব চেয়ে বিশি লোক ছিল ইরানিরাই । তারা সেটাকে নানাভাবে সহানুভুতি নিতে চেয়েছে । তাদের রেডিও তেহরান খুললে খুব ভালভাবে বুঝা যায় ইয়েমেনে নিয়ে কিভাবে বানিয়ে বানিয়ে সন্ত্রাসি“হুতি”দের সাপোর্টে নিউজ করা হয় । ইরান চায় তাদের আগের “পারস্য” সাম্রাজ্য ফিরে পেতে সারা বিশ্বে আবার তারা “রোম-পারস্য”।

আমার মনে পড়ছে রসুলাল্লাহর সেই কথা, একজন মো’মেনের সম্মান কাবার ঊর্ধ্বে। সেই মো’মেন দাবিদারদের যখন এই করুণ মৃত্যু দেখে যে কষ্ট হৃদয়ে অনুভব করছি তা ভাগাভাগি করার জন্য আবার ও লিখার সিদ্ধান্ত নিলাম। শুধু কষ্ট থেকে নয়, আল্লাহর রসুলের একজন গোনাহগার, অধম উম্মত হিসাবে এই ব্যর্থতার দায় ও গ্লানি আমি নিজের আত্মায় অনুভব করছি।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের গোটা জাতির এ পরিস্থিতি কেন হবে? আমরা লাখে লাখে মারা যাচ্ছি বোমার আঘাতে, মরে যাচ্ছি সাগরে ডুবে। এক মুসলিম আরেক মুসলিমকে দেশ থেকে উচ্ছেদ করছে, অন্য মুসলিমরা তাদেরকে ঠাঁই দিচ্ছে না। আমরা লাখে লাখে উদ্বাস্তু হয়ে ইউরোপে আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে করুণাভিক্ষা করছি। এমন কি আমরা হজ্ব করতে গেলাম, সেখানেও পায়ের নিচে চাপা পড়ে মরে যাচ্ছি। রসুল পাক (দ.)-এর জীবনেতো আমরা দেখি না যে উম্মতে মোহাম্মদী একজনের পায়ের নিচে চাপা পড়ে আরেকজন মরে গেছে বা পানিতে ডুবে হাজারে হাজারে মরেছে। তারা জীবন দিতে যুদ্ধক্ষেত্রে কখনো শত্রুর ঘোড়া বা হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে। কিন্তু আজ তাদের এমন দুর্ভাগ্য কেন ঘিরে ধরল? এটা নিয়ে আজকে ভাবতে হবে।

বিষয়গুলো স্পর্শকাতর বলে এ পর্যন্ত এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, কিন্তু ক্ষতস্থান স্পর্শকাতরই হয়। তাই বলে কি ক্ষত না সারিয়ে রেখে দেওয়া যায়? যায় না। কারণ তাতে সেই ক্ষত এক সময় মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়ায়। স্পর্শকাতর বলে কি আমরা চিরটাকাল এভাবেই মৃতের মতো কাটিয়ে যাবো, সংশোধনের চেষ্টা করব না? না, তা আর হতে পারে না। বিশ্ববাসী হাসবে আমাদের এই বিশৃঙ্খলা দেখে, আমাদের এই লক্ষ্যহীনতা দেখে, আমাদের অব্যবস্থাপনা ও কাজকর্ম দেখে। আমরা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মাহ বলে দাবি করি অথচ দুনিয়াতে আমাদের ন্যূনতম সম্মান নেই, গৌরব নেই।

আমরা যুগোপযোগী হওয়ার জন্য, আধুনিক জীবন যাপনের প্রতিটি উপাদানের জন্য, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা, জীবনব্যবস্থা, সংস্কৃতি সবকিছুর জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী। মুসলিম উম্মাহর বাৎসরিক সম্মেলনের জন্য আল্লাহ ব্যবস্থা দিয়েছেন পবিত্র হজ্বের। সেই হজ্বে আমরা বিশ্ববাসীর জন্য ঐক্য, শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্বের অনন্য নজির স্থাপন করতে পারতাম। যে বিষয়টি আঞ্চলিকভাবে সমাধান করা যায় না, সেটি জাতীয়ভাবে বসে যেন সমাধান করা যায় সেজন্যই আল্লাহ হজ্বের ব্যবস্থা রেখেছেন। হজ্ব নিছক আধ্যাত্মিক কোনো তীর্থযাত্রা নয়, তীর্থযাত্রার হজ্ব তো রসুলাল্লাহর আগমনের আগেই ছিল। মহানবী (দ.) সেই হজ্বকে আধ্যাত্মিক প্রেরণার পাশাপাশি জাতির সামষ্টিক কল্যাণার্থে কাজের লাগানোর লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছেন। হজ্ব ছিল কোরাইশদের ব্যবসার মাধ্যম, সেখান থেকে আল্লাহর রসুল একে নিঃস্বার্থ ও কল্যাণমুখী সম্মেলনের রূপ দিলেন এবং জাহেলিয়াতের চিহ্নমুক্ত করে শালীন
করলেন।

আল্লাহ এই জাতিকে এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল হওয়ার জন্য রসুলাল্লাহর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করেছেন যার উপমা আল্লাহ দিয়েছেন গলিত সীসার তৈরি প্রাচীরের সঙ্গে (সুরা সফ ৪)। হজ্বের সেই উদ্দেশ্য আমাদেরকে বুঝতে হবে। যেমন জামাতে নামাযের উদ্দেশ্য হলো মুসলিম পাঁচবার তাদের স্থানীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র মসজিদে একত্র হবে, তাদের স্থানীয় সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা পরামর্শ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে, তারপর স্থানীয় ইমামের নেতৃত্বে তার সমাধান করবে।

তারপর সপ্তাহে একদিন বৃহত্তর এলাকায় জামে মসজিদে জুমা’র নামাযে একত্র হয়ে ঐ একই কাজ করবে। তারপর বছরে একবার আরাফাতের মাঠে পৃথিবীর সাদা-কালো, তামাটে-বাদামি এক কথায় সমস্ত মুসলিমদের নেতৃস্থানীয়রা একত্র হয়ে জাতির সর্বরকম সমস্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ইত্যাদি সর্বরকম সমস্যা, বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে, পরামর্শ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে। অর্থাৎ স্থানীয় পর্যায় থেকে ক্রমশ বৃহত্তর পর্যায়ে বিকাশ করতে করতে জাতি পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু মক্কায় একত্রিত হবে। একটি মহাজাতিকে ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখার কী সুন্দর প্রক্রিয়া। কী অপূর্ব সিস্টেম।

আজ এ জাতির মধ্যে জামাতে পাচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমার নামাজ ও হজ্বের এই উদ্দেশ্য কতটুকু স্মরণে আছে? হজ্বের সময় চলছে জাতিসংঘে সম্মেলন। জানি না পশ্চিমারা ইচ্ছা করে এ সময়ে অধিবেশন ডেকেছে কিনা।

গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্য মোতাবেক প্রায় সকল মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও তাদের গুরুত্বপূর্ণ সফরসঙ্গীরা জাতিসংঘ দফতরে অবস্থান করছেন। তারা ভুলে গেছেন যে তাদের কেবলা নিউ ইয়র্ক নয়, ইংল্যান্ড বা মস্কোও নয়, তাদের কেবলা ক্বাবা শরীফ যেখানে হজ্ব করতে গিয়ে অব্যবস্থার দরুণ পদপিষ্ঠ হয়ে মারা গেছেন হাজার হাজার হাজী যাদের মতো ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ভোটেই নেতৃত্ব উপভোগ করছেন আমাদের নেতারা।

এ দুর্ঘটনার দায় তাই কেবল আরব সরকারের নয়, সকল মুসলিম নেতৃবৃন্দের। কেননা হজ্ব নিয়ে চরম অব্যবস্থা, স্বার্থপরতার বাণিজ্য ও হাজীদের ভোগান্তি তো প্রতিটি পর্যায়ে রয়েছে। যাই হোক, ঘোর সংকটময় সময় পার করছে জাতি। সেই আফ্রিকা থেকে চীন সীমান্ত পর্যন্ত বসবাসকারী সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী ভয়াবহ সমস্যায় আক্রান্ত। এই হজ্বের সময় সমগ্র উম্মাহর নেতৃবৃন্দ যদি একত্র হয়ে এই জাতীয় সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে বসতেন তবে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো দিক বেরিয়ে আসতো।

কিন্তু তারা চলে গেছেন নিউইয়র্কে। আর এই সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষগুলো লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে যেয়ে সেখানে নিদারুণ অব্যবস্থাপনার মধ্যে আরব ধনকুবের শেখ আর যুবরাজদের প্রটোকল রক্ষার্থে পদদলিত হয়ে জীবন দিচ্ছে। এদের মৃত্যুর দায় কে নেবে?

ইরান দায়ী করছে সৌদি সরকারকে, অন্যদিকে আফ্রিকা থেকে আগত কিছু হাজীদের বিশৃঙ্খলাকেও দায়ী করছে সৌদি রাজ কর্তৃপক্ষ। উল্টোপক্ষে সৌদি গণমাধ্যমগুলো ইরানের হাজীদেরকেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির জন্য দায়ী করছে। কেউ কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছে, কেউ হাজীদেরকে দায়ী করছে– এমন পাল্টাপাল্টি দোষারোপের মধ্যে বোঝা মুশকিল যে আসলে কে দায়ী, নাকি সবাই নির্দোষ? আরবের গ্র্যান্ড মুফতি যথারীতি তার চাকরির স্বার্থে এ দায় যুবরাজের কাঁধ থেকে সরিয়ে নিয়তির কাঁধে চাপানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, “এ ঘটনা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। কেননা ভাগ্য ও নিয়তি মানুষের অবধারিত বিষয়”।

বিবিসির ভাষ্যমতে এই মন্তব্য মুসলিম বিশ্বের সাধারণ মানুষকে আরো বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। আমরাও বিশ্বাস করি, এটা মুসলমানদের নিয়তি হতে পারে না। এটা আমাদের বিশৃঙ্খলার পরিণতি তথা কর্মফল মাত্র।

কারণ বিদায় হজ্বের ভাষণে আল্লাহর রসুল বলেছিলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ উদ্দেশ্যে অন্য কোন মুসলিমকে ধাক্কা দেওয়া কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। আমি কি বলব মুসলিম কে? মুসলিম ঐ ব্যাক্তি, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলিমরা নিরাপদ; মো’মেন ঐ ব্যাক্তি, প্রাণ ও সম্পত্তির নিরাপত্তার ব্যাপারে যার উপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে। (সিরাত বিশ্বকোষ: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।

তাহলে সৌদি যুবরাজের নিরাপত্তা রক্ষীরা কীভাবে যুবরাজের চলার পথ করে দেওয়ার জন্য অন্য হাজীদেরকে পিটিয়ে জায়গা করতে পারেন? প্রকৃত ইসলামের সময় কি এমন জাহেলিয়াত কল্পনা করা যেত? অবশ্যই না। রসুলাল্লাহ (দ.) শক্তভাবে বলেছেন, “অনারবের উপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।” অথচ আজকের আরবরা বিশ্বের অন্য দেশের মুসলিমদেরকে মিসকিন মনে করে।
সংবাদে প্রকাশ, সেখানে ধনী দেশের হাজীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকে আর গরীব দেশের হাজীদের জন্য অব্যবস্থা থাকে। ইসলামের অভিভাবক সেজে এত বড় অবিচার যারা করতে পারে তাদের কাছে ইসলাম কতটা মূল্য আর বাণিজ্যের কতটুকু মূল্য তা সহজেই অনুমেয়।

যারা মুসলিম তাদেরকে এই পরিস্থিতি পাল্টানোর ব্যাপারে অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে, কারণ আল্লাহর ঘর ক্বাবা তওয়াফ করার অভিলাস সব মুসলিমই পোষণ করেন। আল্লাহ এই গৃহকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির ঐক্যসূত্র হিসাবে স্থাপন করেছেন কেননা এই গৃহের সঙ্গে আদি পিতা আদমের (আ.) স্মৃতি জড়িত, নূহ (আ.), এব্রাহীম (আ.), ইসমাইল (আ.), শেষ নবী মোহাম্মদ (দ.) এর পবিত্র স্মৃতিও জড়িত।

আমরা ক্বাবার অভিমুখে সেজদাহ করি, তাই কাবা প্রাঙ্গণের পবিত্রতা রক্ষা, হজ্ব ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা, কাবা ও হজ্বের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এই সমস্যা আমাদের সবার সঙ্গে সম্পর্কিত। মুসলিম উম্মাহর প্রাণকেন্দ্র ক্বাবা এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় রসুল পাক (দ.) এর রওজা মোবারক যথাক্রমে মক্কা ও মদীনায় অবস্থিত।

কিন্তু এই পবিত্র স্থানগুলো আরবের নয়, কেননা রসুলাল্লাহ পুরো মানবজাতির রসুল। আল্লাহ বলেন, কুল, ইয়া আইয়্যুহান নাস, ইন্নি রাসুল্লিাহি ইলাইকুম জামিয়া অর্থাৎ “বলে দাও, হে মানব মণ্ডলী। তোমাদের সবার প্রতি আমি আল্লাহ প্রেরিত রসুল। (সুরা আরাফ ১৫৮)। তাঁকে মানবজাতির জন্য রহমতস্বরূপ (রহমাতাল্লিল আলামীন) প্রেরণ করা হয়েছে।

 কবি নজরুল যে মদীনার ধুলিমাখা পথ হওয়ার জন্য আফসোস করেছেন, কারণ সেই পথে আল্লাহর রসুল হেঁটে গেছেন। সেই পবিত্র মক্কা-মদীনার ইজারাদার সেজে আরব রাজতন্ত্র ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিল করছে।

আমরা যদি এভাবে চিন্তা করি যে, আমরা সত্য কথা বলব না, সত্য বললে অমুক নাখোশ হবে, অমুকে আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া দেবে তাহলে এভাবেই জীবন যাবে আমাদের, এভাবেই আমরা মহানবীর ভবিষ্যদ্বাণীর ভেসে যাওয়া আবর্জনার মত হয়ে যাব।

উম্মাহর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বলতে যেয়ে রসুলাল্লাহ (দ:) একদিন বললেন- “শীঘ্রই এমন দিন আসছে যে অন্যান্য জাতিসমূহ এই উম্মাহর বিরুদ্ধে একে অপরকে ডাকবে যেমন করে (খানা পরিবেশন করার পর) একে অন্য সবাইকে খেতে ডাকে।”

তাঁকে প্রশ্ন করা হলো “আমরা কি তখন সংখ্যায় এত নগণ্য থাকবো?” তিনি বোললেন, “না, তখন তোমরা সংখ্যায় অগণিত হবে, কিন্তু হবে স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মত। আল্লাহ তোমাদের শত্র“র মন থেকে তোমাদের সম্পর্কে ভয়-ভীতি উঠিয়ে নেবেন এবং তোমাদের হৃদয়ের মধ্যে দুর্বলতা নিক্ষেপ করবেন।”

কেউ প্রশ্ন করলেন, “ইয়া রসুলাল্লাহ! এই দুর্বলতার কারণ কী হবে?” তিনি জবাব দিলেন, “দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা ও মৃত্যুর প্রতি অনীহা [হাদীস- সাওবান (রা:) থেকে আবু দাউদ মেশকাত]।

এখন আমাদের, সত্যনিষ্ঠ মো’মেনদের, যারা সত্যিকারভাবে আল্লাহকে পেতে চায়, রসুলকে ভালোবাসে, দীনকে ভালোবাসে, আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনকে উৎসর্গ করতে চায় তাদেরকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।

এতগুলো মানুষের মৃত্যু দেখে কষ্ট পেয়ে দু’দিন পর ভুলে গেলে হবে না, এর সমাধানের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে মুসলিম উম্মাহর সমস্যা মুসলিম উম্মাহকেই সমাধান করতে হবে। এই উম্মাহ যতদিন না তাদের মূল পরিচয়ে ফিরে যাবে, যতদিন না ঐক্যবদ্ধ হবে, তবে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

আসুন আমরা সবাই মিলে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করি, তিনি যেন আমাদের ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বোঝার জ্ঞান দেন, সত্যের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর হিম্মত দেন। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক

Check Also

12208476_1654632461479932_2783812938008046695_n

একজন মানব সেবকের বেনজির দাস্তান !

 Azizul Haque:: দা’ঈ ইলাল্লাহ এমনই তো হওয়া চাই: ড. আব্দুর রহমান আস্ সুমাইত একজন দা’ঈ ...