Wednesday 1st May 2024
Komashisha familyAdvertisementContact । Time: সকাল ৮:৪৮
Home / আকাবির-আসলাফ / মুফতি আমিনী (রহ.) জীবন্ত ইতিহাস

মুফতি আমিনী (রহ.) জীবন্ত ইতিহাস

মুফতি ফয়জুল্লাহ

mufty aminiতিনি চলে গেলেন। গেছেন না ফেরার দেশে। তিনি হাসতে হাসতে গেলেন। কাঁদলেন জগদ্বাসী। অঝোর ধারায় কেঁদে উঠল আকাশ। সেদিন আকাশ এভাবে কেঁদে উঠবে, এর পূর্বাভাস ছিল না। কিন্তু কাঁদল, কাঁদল একই সঙ্গে বাংলাদেশের উপরে ছাদ হয়ে থাকা পুরো আকাশ। কাঁদল অজস্র মানুষ। কারও গাল বেয়ে পড়ছে অশ্রু। কারও বুকফাটা আর্তনাদ। কেউ ডুকরে কেঁদে উঠছে। কেউ কেঁদে চলেছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। সারা দেশ যেন শোকে কাতর। আপনহারা শোকের বেদনায় যেন সারা দেশের মানুষ অন্যরকম এক কাতরতায় মুহ্যমান। একটি রুহের তিরোধানে অকস্মাত্ শূন্য হয়ে গেল অনেকগুলো আসন। কারণ, তিনি ছিলেন একাধারে একজন খ্যাতিমান হাক্কানি আলেম, ছিলেন শায়খুল হাদিস। ছিলেন দেশবিখ্যাত মুফতি। ছিলেন একজন আপাদমস্তক আবেদ। ছিলেন মুত্তাকি। ছিলেন নির্লোভ। ছিলেন মুস্তাজাবুদ দাওয়াত। ছিলেন রুহবানুল লাইল-ফুরসানুন নাহার। ছিলেন লেখক। ছিলেন সময়ের শ্রেষ্ঠ বক্তা। ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিচক্ষণ রাজনীতিক। ছিলেন ঐতিহাসিক। ছিলেন কিতাবের পোকা। ইলমের অথৈ সমুদ্রে সদা সন্তরণরত বিমগ্ন সাধক। ছিলেন অভিভাবক। ছিলেন তাত্ক্ষণিক সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। ছিলেন সত্সাহসী। ছিলেন প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন। ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভা ও ধী-শক্তির অধিকারী। অসাধারণ বাগ্মিতায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। তিনি অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। ছিলেন তিনি অনন্য অসাধারণ বহুগুণে গুণান্বিত শত বছরের ব্যবধানে নজিরবিহীন একজন মনীষী। চলে গেলেন রফিকে আ’লার সান্নিধ্যে, ছিলেন মজলুমের কণ্ঠস্বর। জালিম ও তাগুতের চির দুশমন। জালিম সরকারের শিকল থেকে তিনি চিরমুক্তি লাভ করেছেন। কিন্তু জাতিকে রেখে গেলেন অথৈ সাগরে ভাসমান। উহ… যখন তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন তিনি চলে গেলেন। জগদ্বাসী আর শুনবে না বাঘের গর্জন। তাগুত ও আল্লাহর দুশমনদের জন্য ভিত কাঁপানো হুঙ্কার আর শুনবে না আল্লাহতে বিশ্বাসী মানুষ। তাঁর সাহসী সিদ্ধান্ত মুসলমানরা আর জানতে পারবে না। বুক ফুলিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো সাহসী সঠিক সুপুরুষ মানুষ আর দেখবে না।
তাগুতের বিরুদ্ধে তার উচ্চারণ ছিল তরবারির চেয়েও ধারালো। যিনি উদ্বুদ্ধ করতেন দেশ ও জাতিকে। বলতেন হকের কথা। তিনি ছিলেন বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। ভালোবাসা ও স্নেহের সুর ছিলেন, বিদ্রোহের মিনার ছিলেন, কখনও তিনি শুধুই ফুল ছিলেন, কখনও তিনি ছিলেন ধাউ ধাউ করে জ্বলে ওঠা দাবানল, তিনি দরিদ্রকে বলতেন—এই দিন পরিবর্তন হবে। তিনি অত্যাচারী স্বেচ্ছাচারী শাসকদের বলতেন, তোমাদের মাথায় ক্ষমতার যে মুকুট আছে, কদর না করলে সেটি পদদলিত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। তিনি আল্লাহদ্রোহীদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকে বলতেন—‘আমি তোমাদের থামাতে পারি। তিনি দুঃখ-কষ্ট, বেদনা আর কারাগারকে বলতেন—আমি তোমাদের ভাঙতে পারি। তিনি আরাম, শান্তি, আনন্দ আর নিদ্রাকে বলতেন—আমি তোমাদের ছাড়তে পারি। তিনি নিজের জীবনকে বলতেন, ‘আমি তোমাকে আল্লাহর রঙে রঙিন করতে পারি (যা তিনি করেছেনও)। তিনি মানুষকে বলতেন মানুষকে ভালোবাস। নিজেও ভালোবাসতেন। তিনি নেই আজ এই ধরায়।
তিনি চলে গেছেন। যিনি সব সুখ ত্যাগ করে ‘জীবন্ত হায়াত’ শহীদী মৃত্যু লাভ করেছেন। পুলিশ বেষ্টনীতেই হলো তার আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়া। তার দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন। তিনি বলতেন, জীবন্ত হায়াতের স্বাদ কত? তা দেখতে চাইলে নিজের কলিজাটা ফাটিয়ে দেখ। তিনি বলতেন, আল্লাহর জন্য পাগল দেখ সুন্দর ও সৌন্দর্য কাকে বলে। বাস্তবিক পক্ষে তিনি সেই সুন্দর ও সৌন্দর্যকে অবলোকন করেছিলেন। তিনি বলতেন, গরদানে আঘাত খেয়ে দেখ তবে তুমি গোলাপ হয়ে সুবাস ছড়াবে। তিনি আঘাত পেয়েছেন। আজ সুবাস ছড়াচ্ছেন। তিনি কথায় নয় কর্মে মুজাহিদ ছিলেন। তিনি তাগুত প্রতিরোধের প্রধান বীর ছিলেন। তিনি সত্য, দীন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষে হিমালয় পর্বতের মতো ছিলেন। তিনিই ছিলেন যিনি ধসে দিতেন মিথ্যার ভিত। তুলে ধরতেন সত্যের পতাকা। তিনি পাহাড়সম বিপদ-আপদ ও সংঘাতে আপসহীন থাকতেন। এগিয়ে যেতেন ওমর (রা.), আলী (রা.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে। তিনি এগিয়ে যেতেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে।
তিনি চলে গেছেন। সাড়া দিলেন মাওলার ডাকে। কিন্তু কীভাবে? ২০০৭ সালে ব্রেইন স্ট্রোক করেছিলেন। তারপর থেকে তাকে নিয়মিত ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকতে হতো। কিন্তু বিগত ২১ মাস। এই ২১ মাস তিনি গৃহবন্দী ছিলেন। তাকে বাইরের কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হতো না। শুধু তাই নয়, তাকে পূর্বনির্ধারিত তারিখে ডাক্তারের কাছেও যেতে দেয়া হতো না। যেতে চাইলে বলা হতো, আজ নয় কাল। কাল এলে বলা হতো পরশু। এভাবে তাকে চিকিত্সা গ্রহণে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করা হতো। ইন্তেকালের ৫ দিন আগেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হলো। তাকে পূর্বনির্ধারিত সময়ে ও দিনে ডাক্তারের কাছে যেতে দেয়া হয়নি। এখন এই প্রশ্ন ওঠা কি অস্বাভাবিক যে, তাকে পরিকল্পিতভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তাকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে? মুমূর্ষু অবস্থায়ও তাকে সরকারি বিভিন্ন বাহিনী কেন অনুসরণ করবে? তিনি যখন পরপারের যাত্রী তখনও কেন গেটে সশস্ত্র পুলিশ পাহারা? কেন পুলিশ বেষ্টনী তার চারপাশে? এ কেমন নির্মমতা? এ কেমন নির্যাতন? এ কেমন অমানবিকতা? নিষ্ঠুরতা? এর বিচার কি হবে না? এর জবাব কে দেবে?
১১-১২-১২ ইং তিনি রুটিন অনুযায়ী লালবাগ জামেয়ায় আগমন করলেন। ইসলামী আইন বিভাগ (ইফতা বিভাগের) ছাত্রদের ক্লাস করলেন। বাদ আসর সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বললেন। নির্দেশনা দিলেন। বাদ মাগরিব তিনি বুখারি শরীফের দরস দিলেন। বাদ এশা একজনের জানাজায় ইমামতি করলেন। ওই ব্যক্তির অসিয়ত ছিল মুফতি আমিনী সাহেব যেন তার জানাজা পড়ান। তার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করলেন।
সামনে-পেছনে পুলিশ বেষ্টনী। স্বয়ং তার গাড়িতে একজন পুলিশ। বাসায় গেলেন। খাওয়া-দাওয়া করলেন। ফ্রেশ হলেন। বললেন, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। মনে হয় গ্যাস জমেছে পেটে। পরিবারের পক্ষ থেকে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। মেডিসিন নিলেন। উত্তর দিকে মাথা পশ্চিম দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লেন। বললেন, আমার নিঃশ্বাসটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে। বুকে হাত দিলেন। উচ্চারণ করলেন সর্বশেষ শব্দ ‘আল্লাহ’। আস্তে করে চোখ বন্ধ করলেন। ১২-১২-১২ রাত ১২টা ২০ মিনিটে ডাক্তারের পক্ষ থেকে ঘোষিত হলো—মুফতি আমিনী আর নেই। তিনি অন্তরীণ অবস্থায় পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে শহীদী মৃত্যু লাভ করলেন। যে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করেছেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম মালেক (রহ.), ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.), ইবনে তাইমিয়াহসহ অনেকে। তিনি মৃত নন, তিনি চিরঞ্জীব।
তিনি চলে গেলেন। রেখে গেলেন নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। তিনি এত দিন, এতটা মাস, দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ সয়েছেন বিভীষিকাময় কঠোর জুলুম। যার সামান্য আমাদের ওপর হলে ভেঙে যেত আমাদের শিরদাঁড়া। কিন্তু তিনি দাঁতে দাঁত চেপে সব অত্যাচার, সব চাপ ও কঠোরতা সয়েছেন। তিনি নিষ্পাপ ফুল। তাকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছে। আমরা কিছুই করতে পারিনি। তিনি সিরাতুল মুস্তাকিম বেছে নিয়েছেন। বেনিয়াদের দালাল ও ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়া কভারেজ দেয়নি। কিন্তু তার জানাজায় লাখ লাখ মানুষের নজিরবিহীন উপস্থিতি তাগুতের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। দাপাদাপি আরম্ভ হয়েছে। জানি না আরও ৪-৫ ঘণ্টা বিলম্বে জানাজা হলে ঢাকা শহর বাংলাদেশ হয়ে যেত কিনা? অর্থাত্ সারা বাংলাদেশ ঢাকামুখী হয়ে যেত কিনা?
আমরা জানি ঝড়টা আসবেই। ঝড় আসবে তাগুত ও বাতিলের বিষ দাঁত ভেঙে দিতে। তার জানাজা এরই পূর্বাভাস মাত্র। মুফতি আমিনী একজন চলে গেছেন। তিনি নেই। কিন্তু আজ একজন মুফতি আমিনী একজন দু’জন বা ক’জন মুফতি আমিনী নয়। গোটা বাংলাদেশ আজ মুফতি আমিনী হয়ে উঠছে। তারা মিশে আছে মানুষের ভিড়ে, মাটির সঙ্গে, আলো আর বাতাসের সঙ্গে। সেই আমিনীরা অসহ্য যন্ত্রণা বুকে নিয়ে, কোমরে পাথর বেঁধে, বন্ধুর-কঠিন এই পথটা পাড়ি দেবেই। চূড়ান্ত সীমা দূরে হলেও খুব বেশি দূরে নয়। মুফতি আমিনীর দেখানো পথে এগিয়ে যেতে হবে আমাকে/আমাদেরকে। আল্লাহ যেন আমাদের কবুল করেন। মুফতি আমিনী (রহ.) হোক আসীন জান্নাতুল ফেরদাউসের উঁচু স্থানে। আমিন!
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক11947586_518824031617627_1761419230833925805_n

Check Also

সুলতান মাহমুদ

মহাবীর সুলতান মাহমুদ গজনভী রাহ.

আবু সাঈদ মুহাম্মাদ উমর:: পূর্ণ নাম: ইয়মিনউদ্দৌলা আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে সবুক্তগীন। জন্ম: ২ নভেম্বর ৯৭১ ...