মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান -অবসর ::
(ক)
কৌমি মাদ্রাসায় একজন পাঁচ/ ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে হোস্টেলে রেখে একটি আইসোলেটেড পরিবেশে সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রীত পরিবেশে শিক্ষা দেয়া হয় । আমি কৌমি মাদ্রাসার শিক্ষা নিয়ে, শিক্ষার নিতীনৈতিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করছিনা। কৌমি মাদ্রাসায় কোরআন ও হাদিসের সমন্বয়ে সর্বোত্তম শিক্ষা দেওয়া হয় সেটাও ঠিক।
কিন্তু আমি প্রশ্ন তুলছি অন্য একটি বিষয়ে। সেটা হল একজন পাঁচ/ ছয় বছরের ছেলেকে তার পিতা মাতা গ্রামের/ মহল্লার বন্ধু বান্ধবদের নিকট থেকে আলাদা করে হোস্টেলে রেখে শিক্ষকদের চোখের সামনে একটি কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখে তার শিক্ষা জীবনের দীর্ঘ সময়ে তার মন ও মগজে তিনটি বিষয় প্রথিত করা হয়:
এক। আদব; বা ভদ্র ব্যাবহার । অর্থাৎ একজন কৌমি মাদ্রাসার ছাত্র তার শিক্ষা জীবনে আদব বা নম্রতা , ভদ্রতা ও সুন্দর ব্যবহারের উচ্চ মার্গের শিক্ষাই শুধু পায়না তা মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রীত পরিবেশে তার উচ্চতম প্রয়োগ ও অনুশীলন করে। অর্থাৎ একজন কৌমি মাদ্রাসার ছাত্রের ” বেআদব” হবার কোনো অবকাশ নাই।
দুই । এতায়াত ; বা আনুগত্য কৌমি মাদ্রাসায় একজন ছাত্রকে তার শিক্ষার প্রথম দিন থেকেই তাকে তার মাদ্রাসার নীয়ম কানুন, পড়ার সময়সূচী এবং তার শিক্ষকের প্রতি চরম আনুগত্য প্রকাশের ও সেমতে অনুশিলনের শিক্ষা কঠোর ভাবে নিশ্চিত করা হয়। শিক্ষার সময়সূচীর কথা আনলাম কারন কৌমি মাদ্রাসার শিক্ষার সময়সূচী অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা।
তিন । খেদমত; বা সেবা প্রদান। আমি যতটুকু শুনেছি কৌমি মাদ্রাসার ছাত্ররা নিজেরা মাদ্রাসার পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ নিজেরাই আনজাম দেয়। নিজেদের কাজও তারা নিজেরাই করে। বাড়তি হিসেবে তারা তাদের শিক্ষককেও সেবা প্রদান করে থাকে বা শিক্ষকের খেদমত করে ।
উপরে বর্ণিত এই তিনটি গুনের শিক্ষা একজন কৌমি মাদ্রাসার ছাত্র তার শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত অতীব নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করে থাকে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই সব ভালো কাজকে সমসমর্থন করি। কিন্তু সব সুন্দর বাড়ীর যেমন আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন থাকে যাদিয়ে ঐবাড়ীর ময়লা পানি এবং বর্জ নির্গত হয় যা চাক্ষুষ দেখা যায় না। তেমনি সব আপাত সুন্দর ব্যাবস্হারও অপপ্রয়োগের ফলে বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে অন্তর্নিহিত সুদুর প্রসারি কুফল ফলতে পারে যা সাদা চোখে দেখা যায় না। আখের রস থেকে চিনি উৎপাদনের সময় চিনিকলে বাইপ্রোডাকাট হিসাবে চিটাগুড় যেমন উৎপাদিত হয় তেমনি কৌমি মাদ্রাসায় আদব , এতায়াত ও খেদমত এর মতো অতীব সুন্দর ইসলামী জীবন ব্যবস্থার এই বিষয়গুলোকে কৌমি মাদ্রাসায় একটি কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখে ছাত্রদের অনুশীলন করানোর ফলে তার আত্মশক্তির বিকাশ রহিত হয়ে যায়। ফলে একজন কৌমি মাদ্রাসার ছাত্র ধীরে ধীরে তার স্বকীয়তা হারিয়ে নিয়মের দাসে পরিনত হয়ে একজন স্বকীয়তাহীন ও আত্মশক্তিহীন বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে একজন আলেম হয়ে বের হয়ে এসে সমাজে আত্মশক্তিহীন ব্যাক্তি হিসেবে তেমন জোরালো কোনো অবদান রাখতে পারেন না। সমাজের প্রতিষ্ঠিত অনিয়মকে ভাঙ্গতে হলে লক্ষিছাড়া হতে হয়। কৌমি মাদ্রাসায় পড়ুয়া লক্ষিছানা আলেমদের দিয়ে কি সেইকাজ করা সম্ভব? এর বিচারের ভার আপনাদের।
(খ)
একাওর এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করে বাংলাদেশের আলেম সমাজ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে প্রায় ক্ষেত্রে অসফল থেকেছেন। এনিয়ে আলেমদের মধ্যে কোনো সিরিয়াস আত্মবিশ্লেষন কখনো হয়েছে বলে মনে হয়না। বাংলাদেশের আলেম সমাজ শতধা বিভক্ত কেন? এর উত্তর তাঁদের কাছে আছে এমন মনে হয় না। বাংলাদেশের আলেমরা এঁরা নিজেকে এবং পরকাল নিয়ে ব্যস্ত। সব সময় চিন্তা করে অন্যে মসজিদ মাদ্রাসা তৈরী করবে আর আমরা সেখানে ইমামতী এবং শিক্ষকতা করবো। এটা একটা পরাজিত মনোভঙ্গিমুলক চিন্তা যার ভিত রচিত হয়েছে তাঁদের মনে আদব, এতায়াত ও খেদমত এর মতো বিষয়গুলির কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রোয়োগের মাধ্যমে।
(গ)
আমি সরকার সমর্থিত একটি মাদ্রাসা সেলেবাস প্রনয়ন কমিটির সদস্য ছিলাম। ঐ কমিটির প্রধান ছিলেন প্রাক্তন ভিসি ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ । অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মাসিক মদিনার মাওলানা মহিউদ্দিন খাঁন , সম্ভবত তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার মোহতামিম, প্রাক্তন সচিব শাহ মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান এবং আরো বেশ কয়েকজন সিনিয়র আলেম। আমার শত অনুরোধ শত্বেও ঐ কমিটি কৌমি মাদ্রাসার সেলেবাসে হাত দেননাই। তাঁদের অনেকের সাথে কথা বলে যা বুঝতে পেরেছিলাম সেটা হলো কৌমি মাদ্রাসার সেলেবাস পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় তা তারা বলেননি। তবে আমার মনে হয়েছে এখানে এমন এক শক্তি কাজ করে যাকে মোকাবিলা করা সহজ নয়। এরা পরিবর্তন করবে না পরিবর্তন চায় না।বাকী চিন্তার ভার আপনাদের উপরে ছেড়ে দিলাম।
(ঘ)
আমি যেমন আলিয়া মাদ্রাসার-তেমনি কৌমি মাদ্রাসারও ।
আমি উনিশ শত সাতষট্টি সালে ফাজেল পাশ করেছি যখন কৌমি এবং আলিয়া মাদ্রাসায় সেলেবাসের তেমন তফাৎ ছিলোনা। ঐসময় দেওবন্দ থেকে পাশকরা আলেমরা আলিয়া মাদ্রাসায় আমদের পড়াতেন। আমি যে মাদ্রাসা থেকে দাখিল, আলিম এবং ফাজেল পাশ করেছি ঐমাদ্রাসার প্রিন্সিপাল অজীবন দেওবন্দ পাশকরা হুজুর ছিলেন। ঐসময় দেওবন্দ থেকে পাশ করা আলেমদের আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতে কোনো বাধা ছিলোনা। আমার শিক্ষক মাওলানা আকবর আলী কাসেমী দিনাজপুর নুরজাহান আলিয়া মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল হিসাবে অবসর নিয়েছেন। তিনি এখনো জীবিত আছেন।কারো যদি তার সাথে দেখা করার ইচ্ছা থাকে আমি যা বলছি তা প্রমান করার জন্য আমাকে জানালে ঠিকানা দেব। আমার অনেক শিক্ষক দেওবন্দ থেকে পাশকরা আলেম ছিলেন। আমরা প্রায় দিন দেওবন্দী হজুরদের সাথে দেওবন্দ মাদ্রাসায় কি কি বিষয় তারা পড়েছেন এমন সব বিষয়ে আমাদের আলোচনা হতো। এবং বিশদ ভাবে আমরা তা জানতে চাইতাম। এবং জানতামও । যেমন মাওলানা আকবর আলী কাসেমী এও বলেছিলেন তিনি কিভাবে সেখানে লজিং থাকতেন এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিভাবে রুটি সংগ্রহ করতেন । তাঁকে তাঁর এক হুজুর ” সুসুন্দর কি বাচ্চা বলে ঠাট্টা করতো” তাও বলেছিলেন। আপনারা এই ইতিহাস জানেনা বলে আমার সম্বন্ধে ভুল ধারণা পোষন করছেন । আমি একাধারে আলায়া মাদ্রাসার এবং একই সাথে কৌমি মাদ্রাসারও। আমি উভয় ঘরানার শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছি। কাজেই আমি কৌমি এবং আলিয়া উভয় বিষয়ে ওয়াকিবহাল। হ্যাঁ এখন আলিয়া সেলেবাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে । কিন্তু আমার সময় তা ছিলোনা। আর আমি , আমার মরহুম পিতা এবং গ্রামের মুরুব্বিরা মিলে আমাদের গ্রাম দিনাজপুর সদর কোতোয়ালি থানার মোহনপুর গ্রামে একটি আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছি । ঐমাদ্রাসায় আমি অধমের অবদান কি একবার নিজে গিয়ে জেনে আসতে পারেন। আমি নিজে কিছু বলতে চাই না।
মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান । প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর ।
নোট: কমাশিসা কর্তৃপক্ষের সাথে মতের মিল অমিল থাকতেই পারে। উপরোক্ত কলামের সকল বিষয়ের দ্বায়ভার একান্ত ভাবে লেখকের।