(আকাবির আসলাফ -৯)
মানব কাননে ফুটে ওঠা প্রতিটি মানবরূহ একটি পুষ্পের ন্যায় প্রস্ফুটিত হয়। সবুজের সমারোহে সুরভিত হয়। নশ্বর এ ধরায় প্রতিটি মানুষই একটি সুন্দর ও বাস্তব জীবনের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে ঊদিত হয়। সময়ের চক্রাবর্তে, যুগের আবর্তনে কেউবা আবার নিজেকে আলোকিত করেন সদ্য ফোটা গোলাপের মত। আপন জীবন ব্যয় করেন সমাজের তরে। একটি স্থিতিশীল পরিবেশ গড়ে তুলেন সমাজে। সবাইকে আহবান করেন একটি অপরূপ বাস্তবতার দিকে। শাশ্বত বিধান পালনে উদ্বুদ্ধ করে, চারিত্রিক মাধূর্যতার মাধ্যমে একদিন হাসতে হাসতে পাড়ি জমান পরপারে, ফিরে না আসার দেশে। কিন্তু রেখে যান পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক মহান আদর্শ। মহানুভব প্রভুর সান্নিধ্য লাভের জন্য উত্তম এক জীবনাদর্শ। তারাই হলেন ‘ওরাসাতুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের উত্তরসুরী।
যে সকল পীর বুযূর্গের আবির্ভাবে ধন্য হয়েছে বাংলার ভূমি, যারা নিজেদের সর্বস্ব মানব কল্যাণে উৎসর্গ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন, আধ্যাত্মিক জগতে যারা অমর আসন দখল করে নিয়েছেন, তা’লীম-তায়াল্লুমের পাশাপাশি দ্বীনের দা’ঈ হিসেবে তাবলীগ জামাতে অঢেল সময় ব্যয় করেছেন, নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আদায় করে সর্বমহলে স্বীকৃত ও সমাদৃত হয়েছেন- আমার প্রিয় উস্তায হযরত শায়খে চিছরাকান্দি হুজুর রাহ. নিঃসন্দেহে তাদেরই একজন।
তিনি ছিলেন নববী চরিত্রের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আকাবির-আসলাফের পদাঙ্ক অনুসারী। সাহাবী আদর্শের উজ্জ্বল নমুনা। সরল-সঠিক পথের গগণচুম্বি মিনারা। দৃঢ় সংকল্প আর হিম্মতের উপর পর্বতসম অটল। ভ্রষ্টতার আঁধারে আচ্ছন্ন সমাজে প্রদীপ্ত মশাল। তাক্বওয়া ও আত্মশুদ্ধির মূর্তপ্রতীক। মোটকথা, তিনি ছিলেন আলিম সমাজের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র।
জন্ম :
মহান এ বুযূর্গ ১৯৫০ ইং সনের ১৫ জুন দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বর্তমান মোগলাবাজার থানাধীন শাহাদতপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম আব্দুল লতিফ। জন্মভূমি শাহাদতপুরে হলেও পরে পার্শ্ববর্তী চিছরাকান্দি গ্রামে স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেন।
শিক্ষাজীবন :
শায়খে চিছরাকান্দি রাহ’র প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি আপন পিতা-মাতার কাছেই। একাডেমিক শিক্ষার জন্য গ্রামে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান না থাকায় মাওলানা আরকান আলী রাহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গায় ভর্তি হন। এখানে ইবতেদাইয়্যাহ ১ম জামাত থেকে আলিয়া ছুওম পর্যন্ত একাধারে ১২ বছর অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া করেন।
তিনি প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। তাঁর উত্তম চরিত্র মাধুর্যতায় উস্তাযগণ ছিলেন বিমুগ্ধ। তিনি জামেয়া রেঙ্গায় অধ্যয়নের সময় অত্র এলাকার আলোর দিশারী, মুসলিহে উম্মাহ, খলিফায়ে মাদানী আল্লামা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র নেক নজরে পড়েন। ছোটবেলা থেকেই হুজুরের মমতাময়ী মাতা ছিলেন অসুস্থ। তাই মাদরাসায় লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংসারিক কাজকর্ম, পিতার কাজে সহযোগিতাও তাঁকে করতে হয়েছে।
শিক্ষার্জনে পাকিস্তান সফর :
১৯৬৯ সালের রমজান মাসে পিতার মাধ্যমে হযরত শায়খে রেঙ্গা’র কাছ থেকে মাদরাসা থেকে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য শায়খে রেঙ্গা ও পিতা-মাতার দোয়া নিয়ে ১৯৬৯ সালের রমজান মাসে অপর সহযাত্রী, জামেয়া রেঙ্গার বর্তমান শিক্ষাসচিব ও মুফতি হযরত মাওলানা গোলাম মোস্তফা দা.বা.’র সাথে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
পাকিস্তানে প্রথমে তিনি হায়দারাবাদ মাদরাসায় জালালাইন জমাত পড়েন। সেখানে তার অন্যতম উস্তায হলেন মাওলানা যফর আহমদ উসমানী রাহ.। পরের বছর হায়দারাবাদ থেকে চলে যান লাহোর আশরাফিয়া মাদরাসায়। এখানে মিশকাত ও দাওরায়ে হাদীস পড়েন। আল্লামা ইদ্রিস কান্ধালভী, আল্লামা রসুল খান রাহ. প্রমুখ উস্তাযের কাছ থেকে ইলমে হাদীসের ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
দেশে প্রত্যাবর্তন :
ইতিহাসের নির্মম থাবায় ১৯৭১ সালে উভয় পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় সেখানে থাকা আর সমুচিৎ মনে হয়নি, তাই ১৯৭৩ সালের রমজান মাসে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
কর্মজীবন :
পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পরই হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ. তাঁকে মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। কয়েক বছর পর তাঁকে সহ শিক্ষাসচিব পদে পদোন্নতি করা হয়। সেই থেকে মৃত্যু অবধি সহ শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ নাসায়ী শরীফ, মিশকাতুল মাসাবীহ, হেদায়া সহ আরো অনেক কিতাবাদি তিনি পড়িয়েছেন। এছাড়াও কর্মজীবনের শুরুর দিকে দীর্ঘদিন চিছরাকান্দি জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব ছিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত চিছরাকান্দি ঈদগাহের খতীব ও রেঙ্গা হাজীগঞ্জ বাজার জামে মসজিদের খতীব ছিলেন।
দ্বীনের দাওয়াত :
চিছরাকান্দি হুজুর রাহ. শুধু দারস-তাদরীসে মশগুল ছিলেন না; মাদরাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি আম জনসাধারণকে নিয়ে আজীবন কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। পথভোলা পথিকদের সঠিক পথের দিশা দিতে ঘুরেছেন গ্রামে-গঞ্জে, দেশের আনাচে-কানাচে। তাবলীগের কাজে আত্মনিবেদিত মহান এ বুযুর্গ সিলেট খোজার খলাস্থ তাবলীগের মারকাজ মসজিদে বৃহস্পতিবারেও বয়ান করতেন।
বিবাহ : তিনি শ্রীরামপুর নিবাসী জনাব মনীর উদ্দিন সাহেবের ৫ম কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বৈবাহিক জীবনে তিনি ৫ ছেলে ও ৫ মেয়ের জনক। পাঁচ ছেলে- মাও. শরফুদ্দিন, মাও. যয়নুদ্দিন, নজমুদ্দিন, হাফিজ জসিম উদ্দিন ও ইমামুদ্দিন ।
বিদেশ সফর :
দ্বীনের প্রচার-প্রসারে শায়খে চিছরাকান্দি হুজুর রাহ. পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়াসহ আরো অনেক দেশ সফর করেছেন। এছাড়া পবিত্র হজ্ব পালনার্থে সৌদি আরবও সফর করেছেন।
আখলাক চরিত্র :
তাঁর আদব-আখলাক ছিলো অত্যন্ত উঁচুমানের। আসাতেযায়ে কেরাম, সহাপাঠি ও ছাত্রদের সাথে বিনয় ও নম্র আচরণ করতেন। ইলম ও আসবাবে ইলমের প্রতি তাঁর সীমাহীন ভক্তি ছিলো। পোষাক-পরিচ্ছেদেও ছিলো সুন্নাতের পূর্ণ অনুসরণ। তাঁর কথা বলার ধরণ ছিলো ছন্দের সাথে। ছন্দ মিলিয়ে কবিতার মত করে কথা বলতেন।
দায়িত্ববোধ :
চিছরাকান্দি হুজুর রাহ. ছিলেন নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্বাভাবিক আলোচনায় তাঁকে অত্যন্ত হাসি-খুশি মেজাজে থাকতেন। কিন্তু দায়িত্ব পালনের সময় দেখা যেত অন্য এক চিছরাকান্দি হুজুরকে। অন্যায় দেখলেই যেনো তাঁর চেহারা মোবারক লাল হয়ে যেত।
আমল :
তাহাজ্জুদ, ইশরাক, আওয়াবীন, চাশতের নামায তিনি নিয়মিত পড়তেন। প্রতি রাতে নির্দিষ্ট পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। এছাড়াও দৈনন্দিন অন্যান্য আমলের প্রতি খুব যত্নবান ছিলেন। আমাদের জানামতে মারাত্মক অসুস্থতা ছাড়া হুজুরকে কখনো মসবুক হতে দেখা যায়নি।
জীবন প্রবাহে মৃত্যু এক অনিবার্য বিষয়। মৃত্যু আছে বলেই মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। মানুষ বেঁচে থাকার আশা করতেই পারে। তাই বলে কি কেউ যুগ-যুগান্ত বেঁচে থাকতে পেরেছেন? মৃত্যু নামক পাষাণ দানবটার নিশ্চিত আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছেন? না! বরং এই মৃত্যু নামক দানবটিই ছোবল বসিয়েছে প্রত্যেক মানুষের জীবনে। তিনি যেই হোন না কেনো! যত ক্ষমতাই তার থাকুক না কেনো! কেউ কোনদিন রেহাই পায়নি এবং পাবেও না মৃত্যুর ভয়ানক হস্তক্ষেপ থেকে। আর এটাই সৃষ্টিকর্তা মহান মাওলার এক অমোঘ বিধান।
মানুষ মরণশীল জীব। তাকে মরতেই হবে। মৃত্যু মানুষকে হারিয়ে ফেললেও অনেকেই আবার নিজ কর্মগুণে সবার হৃদয় মন্দিরে চির স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকেন। ইতিহাসে হয়ে থাকেন অমর।
কর্মই মানুষের জীবন। যারা এই ধরাধম থেকে চলে যায় না ফেরার দেশে, তারা কেউই আর ফিরে আসতে পারে নি। কিন্তু বেঁচে থাকে তাঁর সুমহান কর্মগুলো। জন্ম-মৃত্যুর মধ্যবর্তী সংক্ষিপ্ত এই সময়ে যদি ব্যক্তি, মানব সভ্যতার উন্নয়ন ও উজ্জ্বল কর্মকা-ে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন, তখন তা দিয়েই মূল্যায়ণ করা হয় তাঁকে। তাঁর অতীত জীবনকে।
জন্মিলে মরিতে হয়- কথাটা সর্বজন স্বীকৃত। ‘মৃত্যু’ কথাটা চির বাস্তব সত্য। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা বিধিবদ্ধ নিয়মে চলছে এবং চলবে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মৃত্যু বরণ করছে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু এসবের মধ্যে কিছু মৃত্যু এমন; যা মানব সমাজকে অপুরণীয় ক্ষতির সম্মুখিন করে। এসব মৃত্যুকে মানুষ সহজে মেনে নিতে পারে না। হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে স্মরণ করতে থাকে আজীবন।
শায়খ মাওলানা আলাউদ্দিন রাহ.। আহ! চিছরাকান্দি হুজুর রাহ. আজ তাঁকে মনে পড়ছে খুব। তাঁর শূন্যতা অনুভব করছি হৃদয়ের পরতে পরতে। কলজে চিরে বেরিয়ে আসছে- আহ! চিছরাকান্দি হুজুর রাহ!
“এসেছিলে যেদিন হেসেছিলো সবে
মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে সবে”
শ্লোকটির স্বার্থকতা চিছরাকান্দি হুজুর নিজেই। পৃথিবীর বুকে তাঁর আগমন যেদিন হয়েছিলো, তখন ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই যেন হেসে হেসে তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছিলো। আরশ অধিপতিও হয়ত সেদিন তাঁর মাখলুকের এমন খোশ মেজাজ দেখে মুচকি হেসেছিলেন।
“হারানো দিনগুলো মনে পড়ে যায়
পুরনো স্মৃতিগুলো আমাকে কাঁদায়,
কেন হায়! হায়!! হায়!!!
অতীতের কাছে মন ফিরে যেতে চায়।”
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ইং মঙ্গলবার। হুজুর অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাকে নর্থইষ্ট মেডিকেল হসপিটালে নেওয়া হয় এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল পর্যন্ত আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ২৪ তারিখ মঙ্গলবার বিকালে সিলেট নগরীর মাউন্ট এ্যাডোরা হসপিটালে স্থানান্তর করা হয়। অতঃপর সেখানেই বিকাল ৫.২০ মিনিটের সময় আমাদেরকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন পরপারে। না ফেরার দেশে। মহান মাওলার সান্নিধ্যে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিলো ৬৫ বছর।
হুজুর আর এখন আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। কিন্তু বেঁচে আছে ৬৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের ইতিহাস। আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর কর্মময় আল্লাহওয়ালা জীবনের সোনালী ইতিহাস। আজ এর সব কিছুই শুধু স্মৃতি। স্মৃতি আর স্মৃতি। তিনি চলে গেলেও রেখে গেছেন তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের ছাপ, মহব্বতের অনুপম লক্ষণ। আজীবন খেদমত করে গেছেন দ্বীনের তরে। ঝপিয়েছেন আমাদের ওয়াবিহী কালা হাদ্দাছানা…..। তাঁর এসব মহান কীর্তি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- তিনি মরেও অমর। তিনি দুনিয়াতে বেঁচে নেই, কিন্তু বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে।
আল্লাহ তায়ালা যেনো তাঁকে জান্নাতের সুউচ্চ মাক্বাম দান করেন। আমীন।
বি.দ্র. শীঘ্রই হুযুরের পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ হচ্ছে।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, কমাশিসা
আরও পড়ুন :
আকাবির আসলাফ-১, শায়খুল হাদীস আল্লামা ইসহাক রাহ.
আকাবির আসলাফ-২, আলোর দিশারী : মাওলানা জমশেদ আলী
আকাবির আসলাফ-৩, আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহ.
আকাবির আসলাফ-৪, হযরত মাওলানা কুতুবুদ্দীন রহ.
আকাবির আসলাফ-৫, শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম রহ.
আকাবির আসলাফ-৬, আল্লামা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী রাহ.