বিভিন্ন ইস্যুতে স্বঘোষিত রুল জারি করে সব সময় আলোচনা সমালোচনার শীর্ষে থাকা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সেই বিচারপতি সদ্য অবসরে গিয়েছেন। অবসরে গিয়ে এবার প্রকশ্যেই প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে এক হাত নিলেন।
বেসরকারি ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমান ও সাবেক বিচারপতিদের এমনকি মন্ত্রী-এমপিদের অবমাননা করার অভিযোগ আনলেন।
বেসরকারি টেলিভিশন ইনডিপেনডেন্ট টিভিতে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে রবিবার রাতে সুপ্রিম কোর্টের এই সাবেক বিচারপতিই জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধু ও কর্নেল তাহের হত্যাকারী, ক্ষমতা অপদখলকারী এবং পাকিস্তানপন্থী হিসেবেও অভিহিত করেন।
বিচারপতি এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর মুখোমুখি অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক খালেদ মুহীউদ্দিন।
সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল-
প্রধান বিচারপতির অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে আপনি চিঠি দিয়েছিলেন তবে, চিঠি পাওয়ার বিষয়ে বঙ্গভবন থেকে কিছু বলা হয়নি
চিঠি যে তারা পেয়েছেন এটা নিশ্চিত। এ ব্যাপারটি খুব শিগগিরই জাতির সামনে খোলামেলাভাবে তুলে ধরব।
বৃটিশ পাসপোর্ট থাকার কারণে বিচারপতি হিসেবে আপনাকে নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল এবং অবসর নেওয়ার পরে সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতি আপনাকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়নি
বৃটিশ পাসপোর্টধারী লোকের বিচারপতি হওয়ার বিষয়ে সংবিধানে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আমি ছাড়াও এখনো আরও তিনজন বিচারপতি রয়েছেন যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য রয়েছে। তারা নেহায়েতই রাজনৈতিক কারণে আমাকে সংবর্ধনা দেয়নি। এ ছাড়া আমি পরে আরও বিস্তারিত বলব। মাননীয় প্রধান বিচারপতি আমাকে শেষ সাত দিন কোর্টে বসতে দেননি। সে কারণে আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। এটা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। প্রধান বিচারপতি কোন বিচারপতিকে কোন বেঞ্চে দেবেন সে এখতিয়ার তার। কিন্তু একজন বিচারপতিকে তার বিচার কাজ থেকে কখনো বঞ্চিত করতে পারেন না।
৯ম সংসদে আপনাকে বিচারপতি পদ থেকে অপসারণের জন্য কয়েকজন সংসদ সদস্য দাবি তুলেছিলেন-
তারা অনেকটা না জেনে এ দাবি তুলেছিলেন। তাদের সংখ্যা খুবই সীমিত। যদি সংখ্যাধিক্য হতেন তাহলে আমি তো থাকতেই পারতাম না।
সড়ক ভবনের জায়গা নিয়ে শুনানীকালে আপনি বলেছিলেন স্পিকারের অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল-
আমার মনে হয় না রাষ্ট্রদ্রোহের মতো কোনো কথা আমি বলেছি। স্পিকার সাহেব, যিনি এখন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ আগেও ছিল, এখনো আছে। আমার আপিল বিভাগে বিচারপতি হওয়ার বিষয়ে উনিই সই করেছেন। এ ছাড়া উনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পরে তার সঙ্গে দেখা করেছি বঙ্গভবনে। উনি আমাকে নিবিড়ভাবে আপ্যায়ন করেন। এতো কিছুর পরও তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে, মমতার সাথে আপ্যায়ন করেন। এরপর থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বহুগুণ বেড়ে গেছে।
মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে বলতে শোনা গেছে যে টেলিফোন শুনে রায় দেওয়ার রেওয়াজ ছিল বা আছে-
‘মাননীয় প্রধান বিচারপতি তার সকল উত্তরসূরি সাবেক প্রধান বিচারপতিদের অবমাননা করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন তার আগে যারা প্রধান বিচারপতি ছিলেন প্রত্যেকই টেলিফোন পেয়ে রায় দিতেন। শুধু তাই না, তিনি এমপি মন্ত্রীদেরও অবমাননা করেছেন। বুঝিয়েছেন উনি আসার আগে টেলিফোন আসার পরেই রায় হতো। তাই তিনি সবাইকে অবমাননা করেছেন। যেটা মারাত্মকভাবে আপত্তিকর। কোনো অবস্থাতেই এটা বলা উচিত হয়নি। আমার সঙ্গে অনেক মন্ত্রী-এমপির সখ্যতা ছিল। কিন্তু তারা কোনোদিন বিচারের ব্যাপারে টেলিফোন করেননি, সামাজিক অনুষ্ঠানেও কেউ বলেননি যে, এই রায় এইভাবে হবে। উনি তার আগের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও প্রাক্তন বিচারপতিদের অবমাননা করেছেন। বর্তমান বিচারপতিদেরও অবমাননা করেছেন। উনি আসার পরে এটি বন্ধ হয়েছে। আর উনি আসার আগে সবাই টেলিফোনে রায় দিতেন। যিনি নাকি নিজে স্বীকার করেছেন যে আসামির অনুরোধে বেঞ্চ গঠন করেছেন। তার মুখে এই ধরনের কথা শোভা পায় না।
আপনি তো অনেককেই আদালত অবমানার জন্য আদালতে ডেকেছেন? এটিকে আপনি কিভাবে দেখবেন।
অবমাননার বিষয়ে বলেন, দেখুন আমি আদালত অবমাননার জন্য অনেক রুল দিয়েছি। কিন্তু, আদালত অবমাননার জন্য কাউকে জেল দিয়েছি বা সাজা দিয়েছি এ রকম কোনো উদাহরণ নেই। চরম অবমাননাকর পরিস্থিতিতে তাদেরকে ডেকে সতর্ক করে ছেড়ে দিয়েছি। আদালত অবমাননার বিষয়টি সতর্কতার সাথেই ব্যবহার করা উচিত। এখানে কথা আছে যদি কেউ সত্য কথা বলে বা লিখে এবং তা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে কিন্তু আদালত অবমাননা হয় না।
জিয়াউর রহমান একজন বীরোত্তম, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দিয়েছিল। সম্প্রতি আপনি একটি অনুষ্ঠানে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মানতে নারাজ-এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। এটি রাজনৈতিক বক্তব্য কি না-
এটা আদৌ কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। কারণ, ৫ম ও ৭ম সংশোধনীর রায়ে আমরা বলেছি জিয়া ছিলেন বেদখলদার। সুতরাং আমরা তাকে আইনতভাবে রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখি না। তিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছেন। কর্নেল ফারুক, রশিদের (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি) স্টেটমেন্টে এটা ছিল এবং মওদুদ সাহেবের (ব্যারিস্টার মওদুদ) বইয়েও এ ধরনের কথা আছে যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ছিল। তা ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্লোগান ছিল জয় বাংলা। যে ব্যক্তি ক্ষমতায় গিয়েই জয় বাংলাকে টুঁটি চেপে হত্যা করল, তাকে কি করে মুক্তিযোদ্ধা বলা যায়?
ক্যাপ্টেন নুরুল হক নামে জিয়াউর রহমানের একজন্য ঘনিষ্ঠজন, তিনি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় ছিলেন। আমি এটিকে মন্ত্রিসভা বলব না, যেহেতু এটি ছিল বেদখলদার। উনি একটি বইয়ে লিখেছেন, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরোধীদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলেন। মওদুদ আহমেদের বইয়েও আছে। মওদুদ সাহেবকে শ্রদ্ধা করি এ জন্য যে উনি সত্য কথা লিখেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী কার্যক্রমে বুঝা যায় জিয়াউর রহমান আদতেই পাকিস্তানপন্থী লোক ছিলেন।
২০১২ সালে লন্ডনে আপনার ওপর হামলা হয়েছিল। সর্বশেষ অবস্থা কি সে ঘটনার…?
ওই এলাকায় কোনো ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) ছিল না। এ কারণে পুলিশ আইডেন্টিফাই করতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে দূতাবাস সূত্রে জানতে পেরেছি তারেক জিয়া এই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। একই জায়গায় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ওপর হামলা করা হয়েছিল। এরপর খবর পেয়েছি হামলাকারী দুইজনই গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের একজন জামিনে বেরিয়েছেন।
কর্নেল তাহের হত্যার রায়ে আপনি জিয়াউর রহমানকেই…
মওদুদ সাহেব তার বইয়ে লিখেছেন ফাঁসি (কর্নেল তাহের) হওয়ার এমনকি ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জিয়াউর রহমান পাকিস্তান ফেরত কয়েকজন জেনারেলের সাথে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেবেন।
মওদুদ সাহেবতো অস্বীকার করেছিলেন যে বইটি জাল করা হয়েছে
‘এই মামলা (কর্নেল তাহের) যখন চলে মওদুদ সাহেব হঠাৎ আমার কোর্টে আসলে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- এই বইটিতে যা লিখেছেন সব সত্য কি না। তিনি বলেছেন অফকোর্স সত্য। এই লেখাগুলো কি আপনার? তিনি বলেছিলেন-হ্যাঁ।’
আপনি অবসর নেওয়ার পরে কি করছেন?
আমি ইংল্যান্ডে চাকরি করেছি। ১৯৯৩ সালে সেখান থেকে দেশে ফিরে এসেছি। কোর্টে সেখানে প্র্যাকটিস করতাম। আবার ওখানেই আমাকে যেতে হবে।
রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা আছে কি না?
রাজনীতে আসার ইচ্ছে নেই। তবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমি একজন বাঙালী। বঙ্গবন্ধুর একজন একনিষ্ঠ সৈনিক। আমি নিজে একাত্তর সালে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। সেই আদর্শ থেকে আমি কোনোদিন বিচ্যুত হব না। আমি জয় বাংলার আদর্শে বিশ্বাস করি। আমি স্বাধীনতার চেতনায় একশ’ ভাগ বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাস নিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। কিন্তু সরাসরি রাজনীতিতে আসতে চাই না। একাত্তর পরবর্তীতে ছাত্রলীগের যুক্তরাজ্য শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। নতুন করে রাজনীতিতে আসার ইচ্ছে নেই।
অবসর নেওয়ার পরে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন কি না?
না। নিরাপত্তার বিষয়টি আমার সরকার দিচ্ছে।
সূত্র : আমার দেশ