আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় সাধিত সিলেবাস প্রণয়ন করুন।
শিরোনামটা এভাবে হওয়া উচিত বলে মনে করি যে, ‘আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়সাধিত পূর্ণাঙ্গ ইসলামি সিলেবাস প্রণয়ন করুন।’
ইসলাম শুধু আধুনিক নয়; সর্বাধুনিক। আনাগত সকল কাল ও যুগের জন্য ইসলাম মানানসই ও যুৎসই। তাইতো কুরআন নিজেই ঘোষণা করছে যে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন বা জীবন চলার পথকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। আরো পরিপূর্ণ করে দিলাম আমার আবারিত নিয়ামত-কল্যাণসমূহকে। আর একমাত্র ইসলামকেই তোমাদের জীবনবিধান হিসেবে মনোনীত করলাম।’
সময় এবং যুগের পরিবর্তনে ওসাইল বা জানার পথ ও পন্থার পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক। স্কুল-কলেজ, ভার্সিটির সিলেবাসের দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে বিশ্বব্যাপী আমূল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। আমাদের আশপাশের স্কুলগুলোতে গিয়েও আমরা পরখ করে দেখে নিতে পারি।
১. জীবনে চলা এবং জানার উপকরণসমূহের ক্ষেত্রে ব্যক্তিজীবনে কে এমন আছেন যিনি এড়িয়ে চলেছেন বা চলতে পারছেন? ঘড়ি, মোবাইল, কম্পিউটার, ঘোড়া, সাইকেল, রিকশা গাড়ি, পানির জাহাজ, উড়ুজাহাজসহ ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটের বেলায় আমরা এই পরিবর্তনকে আপন করে নেই। ইন্টারনেট, ইলেক্ট্রিসিটি, গ্যাস, ইত্যাদি তো আমাদের জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে আজ।
কই, কেউ কি কোথাও বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে? বরং আধুনিক এই সুযোগ-সুবিধার জন্য মিছিল-মিটিং, আন্দোলন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় অহরহ। মসজিদ-মাদরাসা, খানকাহ দরসগাহ-দরগাহ, কবর-মাজার কোথাও আজ এই আধুনিকতার ছোঁয়ার বাইরে নেই। এখনতো অধিক নিরাপত্তার জন্য জায়গায় জায়গায় বসানো হচ্ছে সিসিটিভি বা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। প্রতিটি মুহূর্ত চলছে রেকর্ড। কোথাও বাঁধা দেখছি না। কুঁড়েঘর থেকে পাকা মুজাইকে আজকাল মসজিদ-মাদরাসাগুলো চকচক করছে। কারো আপত্তি চলছে না বা কেউ করছে না। কারো বাচ্চা স্কুল-কলেজে পড়ছে। পিতা-মাতা, অভিভাবকগণ স্বভাবতই জানতে চান যে, গতবাঁধা চলছে নাকি নিত্যনতুন পাঠের সংযোগ ঘটেছে!
কিন্তু সমস্যা একটি জায়গায়; কওমি মাদরাসার সিলেবাস! পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা যাবে না। কেন যাবে না? আকাবিরের দোহাই! পিতার রেখে যাওয়া সম্পদে করাত লাগানোর মতো দুঃসাহস কার? আর তা শুধু ভারত-বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোকে কেন্দ্র করেই। আফ্রিকা, আমেরিকা, ই্উরোপ, এশিয়ার পাকিস্তান, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় প্রভুত পরিবর্তন এসেছে। ভারত, মালেশিয়া, পাকিস্তানে এমন উদাহরণ মজুদ আছে যাদের সুরত এবং সীরত দেখলে বাংলাদেশের কওমির ছাত্র-উস্তাজগণ লজ্জিত না হয়ে পারবেন না।
সুন্নতে নববীর উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তারা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, ইসলাম আজন্ম আধুনিক। ইসলাম মানেই পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। জাগতিক ও ধর্মীয় জ্ঞানের একত্রে সমাহারের মাধ্যমে।
২. মুসলমানদের যেদিন থেকে খেলাফত থেকে আলাদা করা হয়েছে সেদিন থেকে আজ অবধি ধর্ম এবং জাগতিক দুই শিক্ষাকে আলাদা করে দেখা শেখানো হয়েছে। নতুবা ‘নামায কায়েম করো যাকাত আদায় করো’ কিংবা ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং হারাম করেছেন সুদকে’ অথবা ‘যদি তারা আপনাকে প্রশ্ন করে যে, কি খরছ করবে? বলেদিন যা অতিরিক্ত তাই ব্যয় করবে’ হয়তোবা যখন আমরা দোয়া করি ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের দুনিয়াতে কল্যান দান করো এবং আখেরাতেরও’। কালামুল্লাহর এসব ওয়াজ, নির্দেশ বা পরামর্শ আলোচনা কি ইসলামের বাইরের?
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিশন কি ছিলো? মানুষের দুনিয়াকে দ্বীনের মতো করতে; দ্বীনকে দুনিয়ার মতো নয়। একজন মুমিনের গোটা দুনিয়াই দ্বীন। ‘বৈরাগ্যবাদিতা ইসলামে নেই’ যদি হাদিসের ভাষ্য তা-ই হয়, তাহলে শুধুশুধু মাসআলা-মাসাইল, পাক-নাপাকি অজু-গোসলের হিসাব কষে নামায রোযায় মজে থাকলেই কেল্লাহ ফতেহ হয়ে যেত; তবে কেনো এই জিহাদ? এই দ্বীন কায়েমের কসরত? এই ইসলামী অর্থনীতি? সমাজনীতি, রাজনীতি, মুয়ামালাত মুয়াশারাত?
ইসলামকে খণ্ডবিখণ্ড করে দেখতে শুরু করার কারণেই এই সমস্যা। তাই আজ বলতে হচ্ছে আধুনিক শিক্ষার সাথে সমন্বয় সাধনের কথা।
হেদায়া, কুদুরি, নূরুল-ইজাহ, নূরুল-আনওয়ার, সারফ, নাহু, কাফিয়া, হেদায়েতুন্নাহু, এগুলো ওহীর মারফতের কোন কিতাব ছিলো না। আপনার-আমার মতো মানুষরাই গবেষণা করে তখনকার জামানার জন্য তারা তৈরী করে গিয়েছিলেন।
সাব‘আয়ে মুয়াল্লাক্বার মতো যৌনউত্তেজক নির্লজ্জ আরবি কবিতাসমূহ পড়তে-পড়াতে যখন আমাদের কোনো আপত্তি থাকে না তখন সিলেবাসকে নবায়ন করতে অসুবিধা কোথায়? দুরুসুল-বালাগত, জালালাইন, বায়যাভী, উসূলুশ-শাশী, ফুসুলে আকবরি, পান্দেনামা, করীমা, মসনভী কি সাহাবাগণ তৈরী করে গিয়েছিলেন? না, না, না, মোটেই না! সময়ের প্রয়োজনে তা এসেছে, সময়ের প্রয়োজনে এখন নতুন কিতাব আসা দরকার। বান্দী-গোলাম আর কত আযাদ করবেন? কুয়া থেকে কত বালতি পানি তুললে তা পাক হবে এই সূত্রতো এখন অপ্রয়োজনীয়। যখন জরুরত হবে তখন ব্যবস্থাও হবে। তাই বলবো, আগে ছিলো বাগদাদী ক্বায়দা তারপর আসলো নাদিয়া ক্বায়দা। এখন নূরানী ক্বায়দা। আরো অনেক ফর্মুলা বের হয়েছে যা এখানে বলতে গেলে শেষ হবার নয়। আর বেশি বলার প্রয়োজনও নেই।
৩. সমন্বয় বলতে আমরা বুঝাতে চাচ্ছি যে, একটি মানানসই যুগোপযুগী সিলেবাস প্রণয়ন করুন। সেদিন এক জাদরেল মুহাদ্দিস সাহেবের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা হলো। তিনি আলোচনার একপর্যায়ে এসে বললেন যে, এই আমি বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা লিখলাম। আজকের আরবি এবং আমার লিখা আরবির মধ্যে রাতদিন তফাত হয়ে গেছে। কারণ আহলে লেসানের সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ-সংযোগ বা সম্পর্ক নেই। এখন প্রতিটি মাদরাসা কর্তৃপক্ষের উপর লাযিম; তারা যেনো আহলে লেসান বা আরবের শিক্ষাঙ্গনের সাথে জানাজানির ব্রীজ তৈরি করেন।
আমরা বলবো পুরো বিষয়টাকে একবার নজরেসানি বা পুণর্মুল্যায়ন করুন। কওমি মাদরাসার নাম আরবি, কাজও চলছে আরবির নামে; কিন্তু আরবির বংশ বিনাশের পথে। না বাংলা, না আরবি, না উর্দু, ইংরেজিতো নয়-ই। এক খিচুড়িপনার উপর দিয়ে আমরা আমাদের সময়কে অতিবাহিত করছি। এই অসম বেইনসাফী তরিকা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
৪. বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? শুরুটা হবে কিভাবে? আসলে অনেক মাদরাসায় আলহামদুলিল্লাহ শুরু হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হওয়া আর ইজতেমায়ীভাবে শুরু হওয়া দু’টোর ফলাফল সম্পূর্ণ আলাদা। কচ্ছপের গতিতে যদি আগাই তাহলে গোটা দেশটা কুফরের লুক্বমায়ে আজলে গ্রাস করে নিবে। আমাদের সাড়ে চার ডজন বোর্ড আছে চাইলে একত্রে বসে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।
আপাতত আমাদের পুরো নজর থাকতে হবে আরবি, ফিক্বহ, তাফসির, হাদিস, আক্বাইদ ইত্যাদি বিষয়ের পুণর্বিন্যাসের দিকে। বাংলা, গণিত, ইংরেজি, সমাজপাঠসহ স্কুলের মৌলিক বিষয়ে প্রাথমিক বিভাগ থেকে ১০ম পর্যন্ত তাই গ্রহণ করা, যা তাদের বতর্মানে আছে। তাতে একনম্বর লাভ হলো আমাদের সন্তানগুলোর শিক্ষার একটা পাঠের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি থাকলো। ধীরে ধীরে উপযুক্ত লোক যখন তৈরি হয়ে যাবে তখন সময়ই বলে দেবে আপনার-আমার কী কর্তব্য এখন। বাংলাদেশের সতের কোটি বনিআদমের গুটিকতেক শুধু দ্বীন শিখবে বাকিরা থাকবে কুফরের চঙ্গলে তা একজন ঈমানদার হিসেবে কিভাবে বরদাশত করে নিবো?
কষ্ট করে হলেও আগে নিজেদের মাঝে সামর্থ্ যোগাড় করা। অর্থনৈতিক, সামাজিক পারিপার্শিক প্রাধান্যতা বিস্তার লাভ করতে চাইলে, এদেশের ভবিষ্যত হবে ইসলাম; এই ধারণা বাস্তবে রূপায়িত করতে চাইলে মসজিদ-মাদরাসার মর্যাদা, ইসলামের সুমহান শিক্ষার মর্যাদা রক্ষা ও অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইলে সিলেবাস সমন্বয় ও পুণর্মুল্যায়নের বিকল্প নেই।
লেখক : খতিব ও চিন্তক
আরও পড়ুন
কমাশিসার ১ম দফা : একক কওমি মাদরাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করুন।
কমাশিসার ২য় দফা : আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় সাধিত সিলেবাস প্রণয়ন করুন।