আরবের ঊষার মরুর পূর্ব দিগন্তে স্বপ্নীল আগামী এবং সোনালী যুগের স্বপ্ন দেখে সন্তর্পনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন আরবের এক অনন্য তরুণ। অপেক্ষায় ছিলেন একটি সোনালী ভোরের। রোদেলা সকালের। পূর্বাকাশে সূর্য যখন তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে নতুন দিনের সূচনা করবে। আগামীকে কিছু দেওয়ার সুযোগ মিলবে। ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে কিছু চিন্তা ভাবনা করা হবে। সমাজ দেশ ও দশের উন্নয়নের স্বার্থে, পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে কিছু একটা করা হবে। এসব চিন্তা-ভাবনার আলোকে ঝুড়িহীন অনন্য প্রতিভার এই তরুণ মহা মানব জড়ো করলেন জ্ঞান পিপাষু ক’জন সাথী-সঙ্গীকে। মক্কার ঐতিহাসিক সাফা পর্বতের পাদদেশে। জ্ঞানাহরণকারী সাহাবায়ে কেরাম রা. সেদিন মহানবী সা.’র পবিত্র মুখনি:সৃত বাণীসমূহ শুনে আত্মার তৃষ্ণা নিবারণ করেছিলেন। রচনা করেছিলেন পৃথিবীর মানবেতিহাসে অনুষ্ঠানিক শিক্ষা ধারার শুভ সূচনা। দ্বীনের মশাল প্রজ্জলিত করতে, বাতিলের বিরোদ্ধে হুংকার ছুঁড়তে, মানবতা এবং মনুষ্যত্বের শিক্ষা দিতে, স্বচ্চরিত্র এবং সু-দক্ষ নাগরিক গড়ে তুলতে, পরকালীন সম্বল জোগাড় করতে তৈরী করা হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাধারার একটি কাফেলা- আসহাবে সুফ্ফা। এই আসহাবে সুফ্ফার প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে মাদারিসে কওমিয়্যার সর্ব প্রথম উৎস।
খেলাফতে রাশেদা, বনু উমাইয়া, আব্বাসিয়া, উছমানীয়া শাসনামল, এমনকি আটারো শতকের ঐতিহ্যবাহী দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত বিশ্বের আনাচে কানাচে, বিশেষকরে উপমাহাদেশ জুড়ে যে হাজার হাজার মাদারিসে কওমিয়্যা রয়েছে; এই মাদ্রাসাগুলোর আত্মার নিবিড় সম্পর্ক ওৎপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে সুফ্ফায়ে নববীর সাথে। ঐ মাদ্রাসা সমূহ বলতে গেলে সুফ্ফায়ে নববীর স্মারক বা নিদর্শন। ধারাবাহিকতা এবং সম্প্রসারণ। মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতিছব্বি। মূলত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা বিস্তারের কাজ তখনই শুরু হয়েছিলো। সেই যে শুরু। সেই-ই শুরু। সাড়ে চৌদ্দশো বছর পর আজো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে; কিয়ামত অবধি থাকবে। এ কথা বলার দৃঢ় বিশ্বাস আর কেউর থাকুক আর না থাকুক, আমার কিন্তু ষোল আনারচে’ও বেশি আছে।
সময় তার চিরায়ত নিয়মের মধ্য দিয়েই অতিক্রম করে চলছে। পৃথিবীর মতিগতির স্বাভাবিক পট পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। নবী পরবর্তী যুগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাধারা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। হিজরী প্রথম শতাব্দি থেকে সাড়ে অষ্টাদশ শতাব্দি পর্যন্ত মুসলমান শাষিত সমগ্র ভূ-খণ্ডগুলোতে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং জ্ঞাণী-গুণীদের যে অবাদ বিচরণ ছিলো, সে তো সবারই জানা। যে বিজ্ঞানীর মৌলিক আবিষ্কারের ওপর আধুনিক কালের বিজ্ঞান অধিষ্ঠিত, সেই মুসলিম বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়্যান তো এই কওমী পড়ুয়া মনীষী। এ সত্য কথাটি প্রখ্যাত অমুসলিম ঐতিহাসিক হিট্টি’ও স্বীকার করে নিয়েছেন। স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন আধুনিক কালের বিকৃত মানসিকতার কথিত ইতিহাসবেত্তারাও। আসলে পৃথিবীর মানবেতিহাসে প্রকৃত জ্ঞাণী-গুণী এবং বিজ্ঞানীদের অর্ধেকই যে তখন গুযয়ে গেছেন, সে সময়কার যুগটা ছিলো ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণালী যুগ। অতুলনীয় এক যুগ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতা সাধন করে তৎকালের মহামনীষীগণ পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্য যে অবদান রেখে গেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চির অমর, চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। তাঁদের এসব অবদানকে খাটো করে দেখা কিংবা অস্বীকার করা যাবে না। তবে আধুনিক কালের বিকৃত রুচীর কথিক ইউরোপীয় ইতিহাসবেত্তারা প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করে মুসলিম ইতিহাস- ঐতিহ্যকে ম্লান করতে, মিথ্যা পুঁজি দিয়ে নিজেদের ব্যাগ ভরতে এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মনগড়া, মিথ্যা অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়ে কওমী পড়ুয়া বিশ্ব বিখ্যাত, বিশ্ব নন্দিত ঐতিহাসিক মুসলিম মনীষীগণের কাষ্টার্জিত স্বার্ণালী অবদানকে তারা অত্যন্ত কূঁটকৌশলে নিজেদের করে নিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু সত্য চিরদিন চাঁপা পড়ে থাকে না। সত্যের উত্থান একদিন না একদিন ঘটবেই ঘটবে। এ কথা চির সত্য। তাই এসব মুসলিম মনীষীদের নাম এবং তাদের অবদানকে যতই বিকৃত করা হোক, যতই খাটো করে দেখা হোক, প্রকৃত সত্য একদিন বেরিয়ে আসবেই। আর তখনই সত্য এসব বিকৃত মানসিকতার ইতিহাসবিদদের প্রকৃত চেহারা প্রকাশ হয়ে যাবে। পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাদেরকে মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ বলে ধিক্কার জানাবে। নিক্ষেপ করবে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। ইতিহাস কিন্তু বড়ই নির্মম, বড়ই নিষ্ঠুর। সে কাউকে ছাড় দিতে চায়না।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূচনা যাদের হাতে হয়েছে, সে সব মুসলিম বিজ্ঞানীরা শুধু বিজ্ঞান নিয়েই বসে থাকেন নি; বরং ইহ জাগতিক প্রভূত পাণ্ডিত্য অর্জনের পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় তাদের বিচরণ ছিলো বলার মত। সেসব মুসলিম বিজ্ঞানীগণ এমন পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন যে, প্রতিটি বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ সমাধান এবং তাদের অসম মেধার বিকাশ ঘটিয়ে বাস্তবতার নিরিখে পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীদের ভুল ধারণা ও ভুল তথ্যগুলোকে নির্ভুলতার রূপ দিয়েছিলেন। এই অভূতপূর্ণ পা-িত্যের অধিকারী যারা, তারা হলেন এই মাদারিসে কওমীয়্যার সূর্য সন্তান। মুসলিম বিজ্ঞানীগণ। মুসলিম মনীষীগণ।
কওমী মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ইসলামী সভ্যতা বিকাশে বিশ্বের উন্নতির প্রতিটি সেক্টরে এমন সৃজনশীলতা ও অকল্পনীয় আশ্চর্যজনক আবিস্কারের যে অবদান রয়েছে, তা ঐতিহাসিক সত্য। যেমন- রসায়ন বিজ্ঞানের জনক এই কওমী পড়ুয়া মনীষী, আধুনিক বিজ্ঞানের জনক জাবের ইবনে হাইয়্যান। চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনা, আর এই চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণদাতা যিনি, তিনিও এই কওমী পড়ুয়া মনীষী ইবনুন্ নাফিস। সৌর বৎসরের প্রথম এবং নির্ভুল পরিমাপ করে যিনি আমাদের দেখিয়েছেন, তিনিও এই মাদারিসে কওমীয়্যার সন্তান- আল বাত্তানী। পদার্থ ও দর্শন বিজ্ঞানে আল-ফারাবি ও ইবনে রুশ্দ। বীজ গণিতের জনক হলেন ওমর খৈয়াম। দর্শনে ইমাম গাজ্জালী, আরবী সাহিত্য ও সমাজ বিজ্ঞানে ইবনে খালদু। কাব্য সাহিত্যে শেখ সা’দী প্রমূখ কওমী পড়ুয়া বিশ্ব নন্দিত বিজ্ঞানীগণকে আজ ইতিহাসের পাতা থেকে ছাঁটাইয়ের পায়তারা চলছে। তাদের নামকে বিকৃত করে খোলা বাজারে ছেড়ে দিয়ে নতুন প্রজন্মগুলোকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে। মুসলিম জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এবং প্রত্যেক সত্যানুসন্ধিৎসু ব্যক্তির জন্য যা লজ্জার ব্যাপার। তাই আমাদেরকে এই লজ্জা থেকে রেহাই পেতে হলে ইহুদ-খ্রীষ্টানদের নীল আগ্রাসনের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হবে। নইলে এক সময় আমরা আমাদের অস্থিত্ব হারিয়ে ফেলব। এখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মাদারিসে কওমীয়্যার সামান্য অবদানের কিঞ্চিত একটি চিত্র তুলে ধরা হল। পূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে গেলে বৃহদাকারের একটা পাণ্ডুলিপি যে হয়ে যাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও মাদারিসে কওমীয়্যার যে অবদান রয়েছে, তা কোন সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। এই পাক-ভারত বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশকে বৃটিশ বেনিয়াদের কবল থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন যারা, তারাও তো এই মাদারিসে কওমীয়ার সূর্য সন্তান। ওয়ালী উল্লাহী চেতনার অনুসারী বীর সেনানীগণ। উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য যখন অস্তমিত, তারা তখন দেখেছিলেন স্বাধীনতার সোনালি স্বপ্ন। দেখেছিলেন শোষণমুক্ত সমাজ। এই কওমী মাদ্রাসা পড়ুয়া সময়ের সাহসী সন্তান। কিতাবের পাঠশালায় যারা দক্ষ এবং যুগশ্রেষ্ঠ আলেম। আধ্যাত্মিতার জগতে জুড়িহীন ব্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক অঙ্গনে অনুস্বরণীয় মহান নেতা। যুদ্ধের ময়দানে বীর সিপাহসালার। কওমী পড়ুয়া এই সূর্য সন্তানরা উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্যোক্তা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর ওয়ালীউল্লাহী চেতনাকে লালন করে সাদা চামড়ার বৃটিশ বেনিয়াদের দীর্ঘ দু’শো বছরের গোলামীর জিঞ্জির থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে এই দূর্তদের মোকাবেলায় বেরিয়ে পড়লেন ময়দানে।
আটারো শতকের মধ্যাংশের কথা বলছি। সে সময়টা ছিল বড়ই নাজুক। ইংরেজদের নির্যাতনে মানুষ তখন অতিষ্ঠ। বাঁচার উপায় খুঁজছে মানুষ। কিন্তু এই বাচা’র স্বপ্নটি পর্যন্ত দেখার সাহস হারিয়ে ফেলেছে মানুষ। বুকভরা আশা নিয়ে অপেক্ষা করছে- আমাদের উদ্ধার করতে কেউ হয়ত এগিয়ে আসবে, নিয়ে আসবে সাহায্যের মশাল। অপরদিকে সাদা চামড়ার ধুরন্ধর দূর্তগুলো তখন তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ও কর্র্র্তৃত্ব ঠিকিয়ে রাখার জন্য একটি শয়তানী বুদ্ধি আবিষ্কার করে ফেলল। তাহল, উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক যারা, অর্থাৎ মেধাওয়ালা মাথাগুলোকে চিরদিনের জন্য খতম করে ফেলতে হবে। সেমতে ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত এই তিন বছরে প্রায় চৌদ্দ হাজার আলেমকে ফাঁসির কাষ্টে ঝোলানো হল। ৩ লক্ষ কপি কোরআন শরীফ পুড়িয়ে ফেলা হল। ধ্বংস করা হল সবগুলো দ্বীনি বিদ্যাপীঠ। সে সময়কার উপমহাদেশের অবস্থা ছিলো বড়ই করুণ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন প্রতিবাদ করছিলেন অনেকেই। কিন্তু সেটা শক্তিশালী বৃটিশদের মোকাবেলায় যথেষ্ট ছিল না। প্রয়োজন ছিলো ঐব্যবদ্ধ আন্দোলনের। ঠিক তখনই এক সঙ্গীন মুহূর্তে, ঐতিহাসিক প্রয়োজনে দেশ, মাটি ও মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে উপমহাদেশে জন্ম হয়েছিলো স্বাধীনতা সংগ্রামের ইস্পাত দৃঢ় দূর্গ দারুল উলূম দেওবন্দ নামক কওমী মাদ্রাসার। এই দারুল উলূম দেওবন্দের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের শেকড়কে আরো মজবুত করা হল। কিছু দিনের মধ্যেই দারুল উলূমের হতেগড়া একঝাঁক সাহসী সৈনিক বেরিয়ে এলেন। নেমে পড়লেন যুদ্ধের ময়দানে। স্বাধীনতার এই সংগ্রাম আরো বেগবান হল। যুগ হল নতুন মাত্রা। অবলীলায় দিতে থাকলেন প্রাণের পর প্রাণ। ইতিহাস স্বাক্ষী, দেওবন্দ তথা কওমী মাদ্রাসার সেই সূর্য সন্তানদের রক্তের জোয়ারে সাদা চামড়ার ঐ দানবগুলো তখন ভেসে গিয়েছিল বানের জলের মত। ঐক্যবদ্ধ এই আন্দোলনের মাধ্যমে দু’শো বছরের গোলামীর কবল থেকে মুক্ত করলেন উপমহাদেশ বাসীকে। আগ্রাসী বৃটিশদের থেকে। এ জন্য কম মূল্যও দিতে হয়নি আমাদের। মোট কথা, উপমহাদেশের স্বাধীনতার মূলে দারুল উলূম দেওবন্দের যে বর্ণালী অবদান রয়েছে, তা কষ্মীনকালেও অস্বীকার করা যাবে না। এমনকি উপমহাদেশের এই স্বাধীনতা আন্দোলনে যদি আলেম সমাজ তথা মাদারিসে কওমীয়্যার সন্তানরা এগিয়ে না আসতেন, ভারতবাসীকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত না করতেন, তাহলে হয়ত আমরা স্বাধীন নামক বাংলাদেশে জন্ম নিতামনা। আর বাংলা স্বাধীন না হলে হলে হয়ত মুসলমান মায়ের কোলেও জন্ম নিতাম না।
লেখক : সম্পাদক, দুরবীন