খতিব তাজুল ইসলাম::
কমাশিসার পক্ষ থেকে প্রথম সিরিজে দেয়া হয়েছিলো ১৯টি দফা। পরবর্তিতে আরও ২টি দফা বাড়ানো হয়। এখন দফা মোট ২১টি। আসলে দফায় কিন্তু রফা হয় না। নিছক ধারণা বা কাজের প্রাথমিক একটি লিস্ট মাত্র। সংস্কারের জন্য সহায়ক বিষয়গুলো ১৯ এবং ২১ এ উল্লেখ করা হয়েছে। দফা বাড়িয়ে ৭১ করলেও কোন অসুবিধা নেই; কিংবা ‘তিলকা আশারাতুন কামিলা’ বললেও নো প্রবলেম। বস্তুত কাজ হোক। অগ্রগতি শুরু হোক। উন্নতির দিকে হোক ধাবমান। সময়ের অপচয় যেন আর না হয়। প্রতিটি ক্ষণ, সপ্তাহ, মাস, বছর খুবই মুল্যবান।
এবার স্বীকৃতির বিষয়ে আসি তাহলে। ২০০৯ সাল। আমি তখন হাদিসের উস্তাদ। হাসনাবাদ ছাতক মাদরাসার শাইখুল হাদিস আল্লামা আব্দুল হান্নান সাহেব রাহ. ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলার বেফাকের আহ্বায়ক। সেই সুবাধে আমিও আমন্ত্রিত মেহমানের সংগে ঢাকায় সকল বোর্ডের মিলিত মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলাম। বৈঠকে উপস্থিত থেকে যা বুঝলাম, স্বীকৃতি সবাই চান। পরিবর্তন সকলের কাম্য; কিন্তু কিভাবে?
হঠাৎ একজন দাঁড়িয়ে বললেন, ‘না, এগুলো আলোচনা করে কোনো লাভ নেই; কারণ সবাই এক হবে না, স্বীকৃতিও আসবে না। বেফাকের সভাপতি আহমদ শফী সাহেব দা.বা. মেনে নিবেন না বসুন্ধরার মুফতি আব্দুর রাহমান সাহেবকে আর উনি মেনে নিবেন না আল্লামা আহমদ শফী সাহেবকে। তাহলে আমরা এখানে আলোচনা করে কি লাভ’? অবশ্য কিশোরগঞ্জের মাওলানা আনওয়ার শাহ সাহেব তখন দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো মিটিংয়ের আলোচ্যসূচি থেকে বাদ দেয়ার ঘোষণা দেন। কারণ এভাবে প্রকাশ্যে নাম নেয়াটা ঠিক হয় নি।
যাক, নানা কেচ্ছা-কাহিনীর পর সরকার একটা ফর্মুলা দিলো যে, ১০জনের কমিটিতে মাত্র একজন থাকবেন সরকারের প্রতিনিধি আর বাকি ৯জন কওমি বোর্ডের প্রতিনিধি। ১৯টা বোর্ডের মাঝে কেবল বেফাকের মাদরাসা সংখ্যা ৭-৮ হাজার। বাকি বোর্ডগুলোর মধ্যে কোনোটির ২০০ টি মাদরাসা আবার কোনোটির ৩০০ টি। কোনোটির সর্বোচ্চ ৫০০ মাদরাসা আছে। এখন ৯ জনের সদস্য পদে কোন বোর্ড কতটি করে সদস্য পদ নিবেন তা নিয়ে শুরু হলো বাকযুদ্ধ। যাকে বলে চেয়ারের কাড়াকাড়ি, গদির লড়াই।
বেফাকের দাবী হলো ৬ জন সদস্য হবেন বেফাক বোর্ড থেকে আর বাকি বড় তিন বোর্ড থেকে ৩ জন। কিন্তু অন্য বোর্ডগুলোর দাবী হলো তাদের সদস্য সংখ্যাও হবে অর্ধেক। মানে সাড়ে চারজন করে। অর্থাৎ বেফাক ৪.৫ জন, বাকিরা ৪.৫ জন। মোট ৯জন। মানে একজন সদস্যকে কর্তন করে ২পিছ করা লাগবে। তখন এই খুনের দ্বায় নিবে কে বলুন? একদিকে আহমদ শফীর বেফাক, অন্যদিকে মুফতি আব্দুর রাহমানের বাকী সম্মিলিত কওমি মাদরাসা বোর্ডের সদস্যবৃন্দ।শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিতভাবেই যাওয়া হলো প্রধানমন্ত্রীর দরবারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘আপনারা একই দারুল উলূম দেওবন্দের উত্তরসূরী। হুসাইন আহমদ মাদানীর ভক্ত। আপনাদের মাঝে এতো বিরুধিতা কেনো? এতো মতপার্থক্য কেনো? যান, সবাই মিলে এক হয়ে আসেন; আমি স্বীকৃতি দিয়ে দেবো!
দুই দুইবার মিটিং হলো; কিন্তু ফল জিরো। তাই শেখ হাসিনা বাধ্য হয়ে এক পর্যায়ে বললেন যে, বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতিবিদরা আসলে জিরো টলারেন্স!
খালেদার দোয়ারে দোয়ারে ঘোরা হলো, রাস্তায় অবস্থান ধর্মঘট হলো; কিন্তু ফলাফল শূন্য। আর যখন সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো তখন শুরু হলো চেয়ার দখলের লড়াই।’
এই কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনছিলাম আমার এক সহপাঠির কাছ থেকে। তিনি অনুরোধ করলেন নাম উল্লেখ না করতে। আমি তার কাছ থেকে বার বার একটা বিষয় জানতে চাচ্ছিলাম যে, কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতির মূল অন্তরায় সরকার না সংশ্লিষ্ট আলেম-ওলামাগণ? তিনি স্পষ্ট করে বললেন, আমাদের ক্ষমতার লিপ্সা মসনদের খাহিশ-গদির মহব্বত, জাগতিক চাহাতই দায়ী। আজ কওমি অঙ্গনের গোটা ছাত্রসমাজ বঞ্চিত হলো কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা বুজুর্গের ব্যক্তিগত বিরোধ আর জিঘাংসায়। তারা কি ক্ষণিকের তরে জাতীয় স্বার্থের খাতিরে সকল ভেদাভেদ ভুলে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি দৃষ্টান্ত রেখে যেতে পারতেন না?
প্রশ্ন হলো, এখন কি আমরা আশাহত হবো? স্বপ্ন আর দেখবো না? উন্নয়নের পথ খুঁজবো না? উজ্জল ভবিষ্যতের কথা আর ভাবা যাবে না? না তা হতে পারে না। উনাদের বিরোধকে পুঁজি করে আমরা একটি সম্ভাবনাময় মেধাশক্তি উত্থান, অর্জন ও বিজয়কে জলাঞ্জলি দিতে পারি না। তাই কমাশিসা এখন মাঠে। চারিদিকে তুলছে ঐক্যের আওয়াজ। সংস্কারের ধ্বনি।
সংস্কারের বিষয়েও আমাদের কিছু পরামর্শ, সতর্কতা আছে। ঢালাওভাবে স্বীকৃতির জিম্মাদারী সরকারকে দিলে আমাদের আমও যাবে সাথে যাবে ছালাও। আলিয়ার পরিণতি আমাদের চোখের সামনে। আমাদের পরামর্শ হলো; প্রথমে আমাদের নিজস্ব অবকাঠামোকে মজবুত করা। চলমান আরবি সিলেবাসে বাস্তবতা ফিরিয়ে আনা। লেখাপড়ার মান বাড়ানো। গলিতে গলিতে টাইটেল মাদরাসা না করে প্রতি ১৫ থেকে ২০মাইল অন্তর বা জেলাভিত্তিক টাইটেল মাদরাসা করুন। মক্তব ও ইবতেদায়ী বিভাগকে যথাক্রমে গ্রাম-ইউনিয়ন ও থানাভিত্তিক গণহারে স্থাপন করুন। এ সমস্ত মাদরাসায় সরকারি সিলেবাসের অনুসরণে বাংলা, গণিত, বিজ্ঞান, সমাজ পাঠ ও ইংরেজি পড়ান। সরকারি বোর্ডে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিন। সর্বোচ্চ ১০ম পর্যন্ত সরকারি সিলেবাস ফলো করা যথেষ্ট হবে। সানোভী এবং মুতাওয়াসসিতা ও টাইটেল জামাতগুলোতে কেবল কওমি সিলেবাস বা আরবি মাধ্যমই বলবত থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে কেউ পড়তে চাইলে পড়ুক, প্রতিষ্ঠানের কোনো জিম্মাদারি রাখা এবং থাকার দরকার নেই।
এভাবে যখন কওমি মাদরাসাগুলো এগিয়ে যাবে তখন স্বীকৃতির একটা পর্যায় আসবে। বা সেই স্বীকৃতির কোনো প্রয়োজন আছে কিনা তখনকার কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবেন। এখন বিনা আয়োজনে দুর্বল পরিস্থিতিতে স্বীকৃতি সাপেবর করার মতো হবে বলে আমারদের আশংকা।
দেশে সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার দৌরাত্ম্য! তা চলতে থাকুক আর মুসলমানের বংশধররা নাস্তিক হতে থাকুক; তা কিভাবে আপনারা মেনে নিবেন? তাই সেই সমস্ত জাগায় প্রভাব বিস্তার করে স্যেকুলার শিক্ষাকে বাতিল করে ইসলাম ও মুসলমানবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা চালু করাও আমাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার একটি অংশ। পাঁচ, দশলক্ষ মাদরাসার ছাত্র-উসতাদের কথা শুধু ভাবলে কি চলবে; যদি না ভাবি কোটি কোটি স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষকের কথা। তখন দেশের পরিস্থিতি কি দাড়াবে? আর এখন কি কম খারাপ?
তাই চিন্তাকে গভীর করুন। বিবেককে জাগ্রত করুন। ভালবাসাকে প্রসারিত করুন। গোটা দেশ ও জাতির কল্যাণ ও মুক্তির পথ উন্মুচিত হোক। এটাই আমাদের কামানা ও বাসনা।
ছবি: জামেয়া ইসলামিয়া এশাআতুল উলূম ভারত Jamia Islamia Isha’atul Uloom india। আল্লামা গোলাম মুহাম্মদ দাস্তানভী হাফিজাহুল্লাহ। যিনি এই মাদরাসা শুরু করেছিলেন মাত্র ২০জন ছাত্র এবং ২জন শিক্ষক দিয়ে। আল্লাহর রহমতে এখন ৮৯ টি আবাসিক স্কুল ২৯,৫২৭ ছাত্র। ২,৬৮৫ মকাতিব, ১,২০,৭৩৫ জন ছাত্র। ১২টি কলেজে ১,৬১,২২৭ জন ছাত্র। ৫৬০০ মসজিদ। সুবহানাল্লাহ !
“والذين جاهدوافينا لنهدينهم سبلنا وإن الله لمع المحسنين”
জাগতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার সন্বয়ে পরিচালিত পূর্ণাঙ্গ দ্বীনী প্রতিষ্টান। বোখারী শরীফ থেকে মেডিকেল কলেজের সাবজেক্ট সমানভাবে পড়ানো হয়। কমাশিসা তা-ই স্বপ্ন দেখে। উল্লেখ্য যে, আল্লামা গোলাম মুহাম্মদ দাস্তানভী দারুল উলুম দেওবন্দের সম্মানিত মুহতামিমও ছিলেন।