লিখেছেন: মাওলানা হাফেজ ফখরুযযামান
কওমি মাদরাসা শিক্ষা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও জাতীয়ভাবে এশিক্ষাব্যবস্থার সনদের স্বীকৃতি নেই। কিন্তু এ জাতীয় হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এর সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ ছাত্র-শিক্ষক ও তাদের অবদানকে অস্বীকার করারও সুযোগ নেই। কারণ এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পড়–য়াদের মাধ্যমে জাতি বিভিন্ন সময় দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে রক্ষা পেয়েছে। এদের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় জাতির ক্রান্তিকালে। এদের ঢেলে দেওয়া রক্তে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। ব্রিটিশ বেনিয়ারা এ উপমহাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল এদের ত্যাগ-তিতিক্ষায়। তারাই হাসিমুখে বরণ করেছিল ফাঁসির কাষ্ঠ। আযাদি আন্দোলনের বাকে বাকে নেতৃত্ব দিয়েছিল এরাই। বালাকোট, শামেলি, বাঁশের কেল্লা, সিপাহি বিপ্লব, ফরায়েজি আন্দেলন কোথায় নেই এরা? এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সংশ্লিষ্টরা জাগতিক মোহমুক্ত থেকে চারিত্রিক উৎকর্ষতা অর্জনের মাধ্যমে জাতির তরে স্বর্বস্ব বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ফলে সাধারণ জনতার কাছে এরা শ্রদ্ধার পাত্র। সমাজে রয়েছে এদের অসম্ভব প্রভাব। এ সবের পেছনে মূল ভূমিকা রয়েছে এই শিক্ষাব্যবস্থার। কওমি শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যসূচি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে,যথাযথভাবে সঠিকভাবে পাঠদান হলে কুরআন হাদিস তথা দ্বীনের সকল শাখায় যোগ্য ব্যক্তি গড়ে ওঠার সাথে সাথে একজন চরিত্রবান ব্যক্তি হিসেবেও বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এ নিয়েই মানব জীবন। এ তিন কালের মধ্যেই সবকিছু আবর্তিত। যারা অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের ওপর সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি রেখে ভবিষ্যতের জন্যে সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত, সুবিন্যস্ত এবং সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারাই ইতিহাস সৃষ্টি করে; টিকে থাকে যুগ থেকে যুগান্তরে। তাদের ইতিহাস আলোচিত হয় কাল থেকে কালান্তরে।তারা আন্দোলিত করে মানবতাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী। কিন্তু যারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়-তারা সময়ের ঘূর্ণাবর্তে, কালের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। ইতিহাসের আস্থাকুঁড়ে নিক্ষেপিত হতে বেশি কিছুর আয়োজন পড়ে না। তাইতো দেখা যায়, কোন কোন সভ্যতা শতাব্দীর পর শতাব্দী আপন ঔজ্জ্বল্য প্রদর্শন করে চলছে। তার প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে। তা গ্রহণ করছে। এতেই খুঁজে নিচ্ছে আপন ঠিকানা। আবার কোনো কোনো সভ্যতা দেখা যায়- ঝড়ের বেগে এসে আবার বাদলের ন্যায় চলে গেছে। যেন বর্ষার বানের পানি। সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। একটি জাতির উন্নতি-অবনতি, অগ্রগতি-পশ্চাদ্ভবতা, উত্থান-পতন, প্রভাব-প্রতিপত্তি এসব কিছু নির্ভর করে তার শিক্ষার ওপর। যে জাতি শিক্ষার ক্ষেত্রে যত অগ্রগামী তারা সর্বদিক দিয়ে মাথা উঁচু করে থাকে। আর শিক্ষার মান নির্ভর করে শিক্ষা কারিকুলামের ওপর। যে জাতির শিক্ষা কারিকুলাম যত উন্নত,যুৎসই, সময়ের চাহিদার সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ। সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি ও সাধারণ মানুষের মন-মানসিকতার দিক বিবেচনা করে তৈরি; তারাই শিক্ষা দ্বারা উপকৃত হয়। এ ধরনের শিক্ষার মাধ্যমেই যোগ্য লোক সৃষ্টি হয়।বেরিয়ে আসে জাতির বিবেক, সমাজ হিতৈষী, জ্ঞানতাপস ব্যক্তিত্ব। যাদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হয় সঠিক পথে।সমাজ পায় আপন লক্ষ্যপানে পৌঁছার দিশা। এজন্যেই দেখা যায় সময়ের সাথে সাথে দুনিয়ার তাবত জাতি আপন শিক্ষাক্রমকে পরিবর্তন করে, পরিমার্জন করে, সংযোজন-বিয়োজনের ধারা অব্যাহত রাখে। আর না রেখে উপায়ই বা কি? আমরা নিজেরাই তো আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে সময়ের গতির সাথে কত সব পরিবর্তন করি। নতুনের আগমন ও পুরাতনের গমনই হচ্ছে দুনিয়ার সাধারণ রীতি। এর মধ্যেই আমরা আবর্তিত। তাই বলে পুরাতন সব সময়ই পরিত্যাজ্য, অপ্রয়োজনীয় তা কিন্তু নয়। আজ যেটাকে বিয়োগের খাতায় নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা যে কোনদিনই উপকারী ছিল না- তা কিন্তু নয়। এটাকে সর্বৈব সমালোচনা করার সুযোগ নেই; বরং একথা স্বীকার করতে হবে যে, তৎকালে এটাই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। এটাই ছিলযোগ্য লোক তৈরির মাধ্যম। এটাই ছিল সময়ের চাহিদা। তাই যেমন পুরাতনের সমালোচনা করা যাবে না, তেমনি নতুনকেও অস্বীকার করার জো নেই; বরং নতুন ও পুরাতনের সুসমন্বয় ঘটিয়ে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়াস চালাতে হবে। তবে ‘ শব্দটি উচ্চারণ করা য‡তv সহজ বাস্তবে প্রতিফলিত করা ততো কঠিন। বলতে গেলে দুর্গম গিরি কান্তার মরু ও কন্টকাকীর্ণ পিচ্ছিল পথ মাড়ানোর চাইতেও অনেক অনেক কষ্টকর ও দুঃসাধ্য। তবে এ সমন্বয়ে যারা য‡তv বেশি পারদর্শিতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করেছে, তারা ততো সফল, ততো অগ্রগামী। তারাই নেতৃত্বের আসনে সমাসীন। তারাই পথ নির্দেশকের পদে অধিষ্ঠিত। তারাই হয়ে থাকে অনুসরণীয়-অনুকরণীয় এবং সর্বক্ষেত্রে বরণীয়। মোটকথা, যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে শিক্ষাক্রমে সংস্কার সাধন সময়ের অপরিহার্য দাবি। তাই এ সংস্কার সাধনে বাধা হয়ে দাঁড়ানো যেমন অনুচিত, তেমনি সংস্কারের নামে যথেচ্ছা হস্তক্ষেপ ও অনভিপ্রেত; বরং সর্বক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বনই কাম্য। আমাদের এ উপমহাদেশে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসার সাহাবায়ে কেরামের যুগেই সূচিত হয়। কারণ,দেখা যায় হিজরি ২৩ সনেই আরবরা সিন্ধুতে আক্রমণ পরিচালনা করে সাহাবায়ে কেরামের আমলে; যদিও সার্বিক ও চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল তাবেঈনদের কালে। তবে অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ উপমহাদেশ প্রাক ইসলামি যুগে অনেক অনেক অগ্রগামী ছিল। এ অঞ্চল পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার তুলনায় মোটেই পিছিয়ে ছিল না।বরং বলতে গেলে অন্যান্য জাতির মতো এদেরও সম্মানজনক অবস্থান ছিল। এসব বাগানের ফুটন্ত গোলাপসমূহ আপন সৌরভ ছড়িয়ে দিতে যেমন ছিলেন উদগ্রীব, তেমনি তাদের মাতোয়ারাকারী সুগন্ধি গ্রহণেও সব সময় একদল লোক আগ্রহী ছিল।
দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য
যে জাতি আপন ঊষা©কালে اقرأ (পড়ো) ও علم بالقلم দ্বারা সম্বোধিত। সে জাতির জন্যে ১৪০০ শতাব্দী পরে দেওবন্দের মতো পাড়া গাঁয়ে একটি প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র লেখা-পড়ার লক্ষ্যে খোলার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই; বরং দেওবন্দ যে পড়া-পড়ানো ছাড়া মুসলিম জাতিসত্তার এক বৃহৎ ও মহান পরিকল্পনা নিয়ে শুভ যাত্রা করেছিল তা আমরা শায়খুল হিন্দের জবানিতেই শুনি। যিনি ছিলেন দেওবন্দের প্রথম সূর্যসন্তান, যার পৃষ্ঠপোষকতায়ই দেওবন্দ এক মহা মহীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। যার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দেওবন্দকে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যোগ্য করেছিল। যার আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে দেওবন্দ মুসলিমবিশ্বের আন্তর্জাতিক বিদ্যাপীঠের মর্যাদা লাভে সক্ষম হয়। তিনি বলেন; “হযরতুল উস্তাদ (হযরত কাসিম নানুতবি) এ মাদরাসা (দেওবন্দ)-কে কি শুধু দারস-তাদরিস, তালিম-তা’আল্লুমের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? মাদরাসা আমার সামনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।আমি যতটুকু জানি ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে পরাজয়ের পর এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এর উদ্দেশ্য এমন একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যার তত্ত্বাবধানে এমন একদল লোক তৈরি করা, যাদের দ্বারা ৫৭ এর অপূরণীয় ক্ষতি কিছুটা হলেও লাঘব করা যাবে। আমি ওই সব লোকদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না যারা দারস-তাদরিসকে একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে স্থির করে নিয়েছে। তবে আমি সেই পথই নির্বাচন করেছি যার জন্যে উস্তাদজি দারুল উলুম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্থাৎ বহুমুখী প্রতিভা সৃষ্টি। সেই প্রতিভার চাহিদা কি সব সময় এক থাকে? না সময়ের পরিবর্তনে চাহিদার পরিবর্তন হয়? আর পরিবর্তিত চাহিদা কি পূর্বতন সিলেবাস দ্বারা সৃষ্টি করা সম্ভব? দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে “দারসে নেযামি” আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেভাবে পূর্ণজন্ম লাভ করেছিল। তেমনি বর্তমান কওমি মাদরাসার সিলেবাসে যুগ চাহিদা ও বর্তমান প্রজন্মের মন-মানসিকতার প্রতি লক্ষ্য রেখে, পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতির দিকে নজর দিয়ে, ইসলাম ও মুসলমানদের ভবিষ্যৎ পানে তাকিয়ে, ইসলামকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে, বিজ্ঞান ও কম্পিউটারভিত্তিক বিশ্বকে নিজেদের আয়ত্বে আনার মানসে- বিস্তর সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন রয়েছে কি না? তা ভেবে দেখার সকরুণ আকুতি রইল।
“দারসে নেযামির ত্রুটি ও এর প্রতিকার”
আমার বুকের এমন পাটা নেই যে, দারসে নেযামিতে কী কী Îæটি রয়েছে তা নির্ণয় করে ব্যবস্থাপত্র দিব। তা হবে পাগলের প্রলাপ মাত্র। তবে যে সব মনীষীদেরকে আল্লাহ সে যোগ্যতা দিয়েছেন। যাদেরকে আমরা এর যোগ্য বলে ভাবি। যাদের কাছে জাতি সময়ের চাহিদানুযায়ী ব্যবস্থাপত্র পেতে চায়। তাদেরই কিছু উক্তি আমি নিম্নে উল্লেখ করছি মাত্র। আশা করি এতে দোষের কিছু নেই। ওইসব উক্তিকারী ব্যক্তিগণ যেমন আমাদের বাংলাদেশের অধিবাসী, তেমনি রয়েছেন আমাদের পাশ্ববর্তী ভারত পাকিস্তানেরও। আমি প্রথমেই আমাদেরই স্বজাতি, স্বদেশী আলিম, যার নামের সাথে বাংলাদেশের আলিমসহ প্রায় সকল নাগরিক কমবেশি পরিচিত। সেই আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরি রাহ. উক্তিটিই উল্লেখ করছি। তিনি বলেন, আমি দারসে নেযামির পক্ষপাতি, তাছাড়া অন্য কোন শিক্ষা ধারার পক্ষপাতি নই, কিন্তু দারসে নেযামির হাকীকত আজকাল লোকেরা বুঝছে না। পূর্ব যামানার একটি শখছিয়াত (ব্যক্তিত্ব)-কে হাকীকত মনে করছে। দারসে নেযামির হাকীকত এই যে, শুধু gvKzjvZ অর্থাৎ যুক্তি ও তর্ক শাস্ত্র বা জ্ঞান-বিজ্ঞান অথবা শুধু মানকূলাত অর্থাৎ কুরআন-হাদিস পড়ানো উচিত নয়। বরং মানকূলাত ও মাকূলাত একত্রে পড়নো উচিত। মাকূলাতের কোনো সীমা নেই। যামানা যেমন বাড়তে থাকবে, মাকূলাত তেমন বাড়তে থাকবে- যা দ্বারা আকল বাড়ে। আল্লাহমুখী বিজ্ঞানই বিজ্ঞান। নাস্তিকতার বিজ্ঞান বিজ্ঞান নয়, ধৃষ্ঠতা ও অন্ধত্ব বৈ আর কিছু নয়। কাজেই হাদিস ও কুরআনের আলোর দ্বারা আলোকিত সমস্ত মাকূলাত (যুক্তি-তর্কশাস্ত্র) ও সাধারণ বিজ্ঞানকে আলোকিত করতে হবে এবং হাল ধরে রাখতে হবে।এ-তো গেল ফরিদপুরি সাহেবের দারসে নেযামি সম্পর্কে তাঁর ইজমালী মন্তব্য। এখন আমি দেওবন্দের প্রথম সারির সূর্য সন্তানদের এ ব্যাপারে বিষয়ভিত্তিক মন্তব্য পেশ করছি। প্রথমেই আমি আল্লামা ইউসূফ বিন্নুরির কথা উল্লেখ করছি। তিনি বলেন, দ্বীনি মাদরাসাগুলোতে বর্তমানে যে নেসাব চালূ রয়েছে, হাদিস ও ফিক্হের কিতাবাদি বাদ দিলে অধিকাংশই হিজরি সপ্তম শতাব্দী ও তার পরের যুগের স্মারক। যখন থেকে প্রকৃত অর্থে মুসলমানদের অধঃপতন ও নিম্নগামিতা শুরু হয়, উম্মতের প্রথম যুগের মনীষীদের যেসব গ্রন্থাদিতে ইলমের প্রাণ শক্তি বজায় ছিল, ভাষা ছিল সাবলীল ও স্বচ্ছ, সূত্র ও নিয়ম ছিল সুস্পষ্ট, যাতে বাক্যগত দুর্বোধ্যতা ছিল না; অপ্রয়োজনীয় আলোচনা ছিল না; যা অধ্যয়ন করলে সঠিক অর্থেই মন মস্তিষ্ক প্রভাবিত হত; সময় নষ্ট হত না; মস্তিষ্কে চাপ পড়ার আশঙ্কা ছিল না; সে সবের জায়গায় এমন সব কিতাব এসেছে যাতে বেশি নৈপুণ্য মনে করা হয়েছে সংক্ষেপকরণকে। বেশি জোর দেওয়া হয়েছে শাব্দিক আলোচনার ওপর, শাব্দিক চুলচেরা বিশ্লেষণ শরু হয়েছে। এরূপ বললে অত্যুক্তি হবে না যে, কাগজ যদিও অল্প ব্যয় করা হয়েছে, কিন্তু তা আয়ত্ত করতে সময় ও মেধা বেশি ব্যয় করা হয়েছে। এটিকে বিরাট দক্ষতা মনে করা হয়েছে যে, পাঠ এতই সুক্ষ্ম ও গভীর হতে হবে যার জন্যে ব্যাখ্যা ও টীকা টিপ্পনির প্রয়োজন পড়ে। কয়েকটি ব্যাখ্যা ছাড়া তা উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না। এ যদি বিদ্যা বিলাসিতা না হয়, তাহলে আর কি হতে পারে? আমার স্থুল চিন্তায় এ ছিল ইলমের সবচেয়ে বড় বিপদ।এতে ইল্ম ও ইসলামি জ্ঞানের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। আমাদের বর্তমান পাঠ্যসূচির গুরুত্বপূর্ণ নাহবের কিতাব শরহে জামি ও কাফিয়া সম্পর্কে তার মন্তব্য শুনি। তিনি বলেন, ইবনে হাজিবের কাফিয়ার কথাই ধরুন। এর পঞ্চাশের অধিক ব্যাখ্যা গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এ সবের মধ্যে অন্যতম মুল্লা জামীর শরাহ আর এর টীকা গ্রন্থসমূহের তালিকা তৈরি করতে পূরো এক খাতা “চিন্তার বিষয়” এই প্রাথমিক বিষয়াবলি কি এতই মনোযোগের হকদার ছিল? অবশ্য যা কিছু হয়েছে, তা এক বিশেষ যুগের চাহিদা ছিল। মানুষের আগ্রহের বিষয়ও ছিল। তা পূরণও হয়েছে। এভাবে অন্যান্য শাস্ত্র ও গ্রন্থের কথা অনুমান করুন।এখন সেই উদ্যম নেই, নেই পরিশ্রম ও সাধনার মতো মস্তিস্কের যোগ্যতা। সেই সময় সুযোগ স্বস্তি নেই। সবচেয়ে বড় কথা প্রয়োজন নেই। জটিলপ্রিয়তার প্রতি মনের অনীহা এসেছে, নতুন নতুন গ্রন্থ রচিত হয়েছে। রচনা ও সাহিত্যের পদ্ধতি ও ধারা বদলে গেছে। পূর্ববর্তী মনীষীদের কিতাবসমূহ প্রেসে আসতে শুরু হয়েছে। সমকালীন লেখকরা সাহস করে যুগের তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে নতুন ধাচে মনোরঞ্জনের জন্যে সুন্দর সুন্দর রচনা পেশ করছেন। এমতাবস্থায় যদি আমরা এখনো এসব অগুরুত্বপূর্ণ উপকরণসমূহ আঁকড়ে ধরে থাকি, তাহলে ইসলামি বিষয়সমূহ থেকে মনোযোগ সরে যাবে এবং আমাদের এ কর্মপদ্ধতি আমাদের পূর্বসূরী ও মুরব্বীদের সেই গর্বীয় উত্তরাধিকার ও সেই ইলমি সম্পদ ও পূঁজি নিঃশেষ করে ফেলবে। এটি প্রকৃতপক্ষে ইলমের কল্যাণকামিতা নয়; বরং নির্বোধ বন্ধুর মতো কাজ হবে। এবার দারসে নেযামির ফেকাহ শাস্ত্রের কিতাবাদি সম্পর্কে তার মন্তব্য লক্ষ্য করি। তিনি বলেন- ফিকাহ শাস্ত্রেকানযুদ্দাকায়েক, বেকায়া, শরহে বেকায়া ও নেকায়ার উত্তম বিকল্প পূর্ববর্তী মনীষীদের কিতাবসমূহে কি পাওয়া যায়না? জামে সগীর, জামে কবীর ইত্যাদি। ইমাম মুহাম্মদ, ইবনুল হাসান শায়বানির সরাসরি লেখা কিতাবসমূহ কি সকল দিক দিয়ে সঠিক নয়? তাতে যে ইলম ও বরকত হবে, তা পরবর্তীকালের লেখকদের কিতাবসমূহে কোথায় পাওয়া যাবে? আমার ক্ষুদ্র মতে ফিকহে নূরুল ইযাহ, কুদুরী ও হেদায়া ব্যতীত অবশিষ্ট সকল কিতাব পরিবর্তন যোগ্য। আমরা যদি আমাদের পাঠ্যসূচির মধ্যে বালাগতে ‘মুখতাছার’ আকাঈদে, ‘শরহে আকাঈদ’ উসূলে ফেকাহের‘হুসামি’ ইত্যাদিকে পরিবর্তন না করি তাহলে এসব বিষয়ে কি আমাদের ছাত্ররা দক্ষ হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে?এসব কিতাবের কোন বিকল্প কি আমাদের সামনে নেই? এভাবে র্সাফ-নাহু, মায়ানী, ফালসাফা, ফিক্হ, তাফসির,আদব ইত্যাদি সম্পর্কে যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে সবগুলোর সারকথা এই দাঁড়াবে যে, প্রচলিত নেসাবে এমন কিতাব রয়েছে যাতে সুক্ষ্মতার নৈপুন্য দেখানো হয়েছে এবং সংক্ষেপকরণে রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে মেধার প্রখরতা, সুক্ষ্মদৃষ্টি ও চুলচেরা বিশ্লেষণে দক্ষতা অর্জনের জন্যে এগুলো সবচেয়ে উপযুক্ত হলে হতেপারে; কিন্তু তা গ্রহণীয় নয়। “আমাদের কওমি মাদরাসা সিলেবাসের আরো একটি ত্র“টির প্রতি আঙ্গুলি প্রদর্শন করে আল্লামা বিন্নুরি বলেন- বর্তমান যুগে সাহিত্য ও ইতিহাসের গুরুত্ব বেশি। এজন্যে আমাদের সিলেবাসে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি স্তরে সীরাতুন্নবী সা. তারীখে ইসলাম এরপর সাধারণ ইতিহাস ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসের প্রতি মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। নাস্তিক্যবাদ ও ধর্মহীনতা যেমন ইসলামি বিষয়সমূহ বিকৃত করার চেষ্টা করেছে, তেমনি ইসলামের ইতিহাস ও ধর্মহীন প্রচেষ্টা অনেক বিকৃত করে দিয়েছে। এজন্যে ইসলামের ইতিহাসে গবেষণাসূলভ জ্ঞান অর্জন করা খুবই প্রয়োজন। পরিতাপের বিষয় হল, আমরা একদিকে নবী-প্রেমের দাবিতে সর্বাগ্রে অথচ নবীচরিত পাঠে মোরা সবার পিছনে।আমাদের সিলেবাসে “সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া” ছাড়া আর কি কোন সীরাত গ্রন্থ আছে? তাই বলি নবী প্রেমের দাবি কি অবান্তর নয়? আমি সিলেবাস সংক্রান্ত আলোচনাটি শায়খ মাদানির একটি উক্তি দ্বারাই শেষ করতে চাই। শায়খ মাদানির কোন পরিচিতি না তুলে ধরেই উক্তিটি বিবৃত করছি “আমার শিক্ষা জীবনে আমি দারুল উলুমে দেওবন্দের পাঠ্যসূচিকে উন্নতির সোপান এবং ইহাকে যথার্থ বলিয়া মনে করিয়াছি- স্বীয় যোগ্যতানুসারে তাহা হইতে উপকৃত হইয়াছি। কিন্তু পরবর্তীতে মদিনায়, মিশরের জামে আযহার, ইস্তাম্বুল ও বুখারা ইত্যাদির পাঠ্যসূচি হইতে ইহাকে প্রাচীন মনে হইয়াছে।” তা আজ থেকে কতকাল পূর্বের কথা। আর এখন? তা কি বলতে হবে?
কওমি মাদরাসা শিক্ষার প্রতি অনীহার কারণ
কোনো একটি শিক্ষা তখনই গ্রহণযোগ্যতা ও সার্বজনীনতা লাভ করে যখন তা মানবজীবনের সফলতার সোপান হয়। মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখে। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সকল ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শন করে। সর্বোপরি একজন মানুষকে সর্বদিক দিয়ে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলে। সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়ে দেয়। আর যে শিক্ষায় এসব বিষয় অনুপস্থিত, তা গ্রহণযোগ্যতা ও সার্বজনীনতা লাভ কনা তো দূরের কথা উল্টো এর প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। অনীহা প্রকাশ করে। সর্বশেষ বিরোধীতায় লিপ্ত হয়। বর্তমানে কওমি মাদরাসাগুলো বহুলাংশে মানুষের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ। কারণ বর্তমানে কওমি মাদরাসাসমূহে আগের ন্যায় দ্বীনের সর্বক্ষেত্রে যোগ্য মানুষ তৈরি হচ্ছে না এবং আমলি দিকও একবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মাদরাসা ছাড়া অধিকাংশ মাদরাসার লেখাপড়ার মান ও শিক্ষকদের যোগ্যতা ও পাঠদান পদ্ধতি প্রশ্ন সাপেক্ষ। আর সিলেবাসের দুর্বলতা তো রয়েছেই। পুরনো আমলের অপ্রচলিত ও পরিত্যাজ্য অনেক বিষয় আঁকড়িয়ে ধরার মানসিকতা ও যুগোপযোগী বিষয়য়াবলির প্রতি অনীহা ও এগুলো থেকে নিরাপদ দূরে থাকার আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। এগুলোই হচ্ছে বর্তমান সময়ে কওমি মাদরাসাশিক্ষার প্রতি অধিকাংশ মানুষর অনীহার মূল কারণ।
যুগ চাহিদার কি কোন মূল্য নেই?
ইসলামি শরিয়তে কি যুগ চাহিদার কোনো মূল্য নেই? সব সময় কি প্রাচীনকে আঁকড়িয়ে ধরতে হবে? তা যদি হয়,তাহলে মুতাকাদ্দিমীন ও মুতাআখখিরীন নামে দু’দলের সৃষ্টি কেন? আর ইসতেসহাবে হাল বলে উসূলে ফেকাহ- এ একটি বিষয় কেন রাখা হল? সাহাবায়ে কেরাম প্রথম থেকেই কেন হাদিসকে লিখিতভাবে সংরক্ষণ করতে গেলেন না।পরবর্তীতে তাবীরা কেন এ জিনিসটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আপন মেধা ও শ্রম এতে ব্যয় করলেন? ফুকাহায়ে কেরাম ও মুজতাহিদগণ কেন মাসাইলকে বাব ও ফাসল আকারে বিন্যস্ত করলেন? ইমাম গাযালি-রাযিরা কেন যুক্তিবিদ্যা ও গ্রীক দর্শন আয়ত্ব করলেন? তাফতাযানী ও নূরুদ্দীন বুখারিরা আকাঈদের কিতাবাদিকে কেন গ্রীক দর্শনের আলোকে প্রণয়ন করলেন? এসব ব্যতিরেকে আমাদের নিকট অতীতের আকাবিরগণ কি নিজ নিজ সময়ের সামাজিক চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসেননি? শাহ ওলিউল্লাহ ও থানবি কেন ইবাদতসমূহের দর্শন নিয়ে মাতামাতি করলেন? মোটকথা, কোনো জাতি বা গোষ্ঠী নিজেকে জীবন্ত করে রাখতে হলে যুগ সচেতন থেকে সময়ের চাহিদা পূরণে এগিয়েআসতে হবে। মানুষের মন-মেযাজের সাথে সঙ্গতি রেখে দ্বীনকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। এবং ওই আলোকে নিজেকে দ্বীনের প্রতিটি শাখা-প্রশাখার যোগ্য হিসাবে গড়ে তোলে সমাজের সার্বিক সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। আর এর জন্যে প্রয়োজন আকাবিরদের ন্যায় সময়ের চাহিদানুযায়ী বাস্তবতার আলোকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও এর বাস্তবায়ন। আমাদের পাঠ্যসূচি কি যুগ চাহিদা পূরণে সক্ষম? আমরা যদি আমাদের সিলেবাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে, তা বর্তমান যুগ চাহিদার প্রেক্ষিতে দ্বীনকেসার্বিকভাবে উপস্থাপনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। তা হয়ত অনেকের কাছে কটুবাক্য বলে মনে হতে পারে। তবুও তা বাস্তব। আর এ কথা আমার নয় বরং তা পূর্বের যুগশ্রেষ্ঠ অনেক মনীষীগণ-যারা আমাদের সবার কাছে স্মরণীয় বরণীয় এবং অনুস্মরণীয় তাদেরই উক্তি- যাদের বিচরণ বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র। যাদের চিন্তা-চেতনা ব্যাপৃত বিশ্বব্যাপী। আমি এ সম্পর্কে নিম্নে কয়েকটি উক্তি উল্লেখ করছি।
ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফোরাম লণ্ডন এর চেয়ারম্যান ঈসা মানসূরী মাদাসায়ে দারুর রাশাদ এর নতুন বিভাগ সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবির রাহ. এডুকেশন সেন্টার এর উদ্বোধন উপলক্ষে ১লা জানুয়ারি ২০০৪ ঈসায়ী, রোজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ইসলামিক ফাউণ্ডেশন মিলনায়তনে নতুন শতাব্দীর চাহিদা ও উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব শীর্ষক সেমিনারে পাশ্চাত্যের বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও ইসলামের ওপর তাদের সাঁড়াশী আক্রমণে আমরা যে শুধু অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখছি কোনো ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি না, এ প্রসঙ্গে বলেন, “কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সময়ের এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আঞ্জাম দেওয়ার পরিবর্তে আমাদের উলামায়ে কেরামের একটি শ্রেণী দেড়শত বছর পূর্বের পুরাতন ও বিলুপ্ত, চিন্তু-চেতনা ও দর্শন সংক্রান্ত অনর্থক আলোচনায় লিপ্ত। ইসলাম ধর্ম আত্মপ্রকাশের সময় যেমন খ্রিস্টান আলিমগণ গ্রীক দর্শন চর্চার অনর্থক কাজে লিপ্ত ছিল।”আমাদের পশ্চাদ্ধাবনকে আবুল হাসান আলী নদবি রাহ. দেওবন্দের উলামায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে এভাবে উল্লেখ করেন “আপনাদের নিকট গ্রীক দর্শনের প্রাণী বিদ্যা, রসায়ন ও জ্যোতির্বিদ্যার নির্দিষ্ট বুলি সম্বলিত যে কয়েকটি পাতা রয়েছে তার বিপরীত পশ্চিমাদের নিকট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষ দর্শনের এক বিরাট জগত রয়েছে। ফলে আজ আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষ পশ্চিমাদের দর্শনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। এর আসল কারণ আমাদেরই দুর্বলতা। আজ যেখানে আমরা ইসলামের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করে শ্রেষ্ঠ হিসাবে গড়ে ওঠে ইসলাম সম্পর্কে সর্বশ্রেণীর মানুষের সন্দেহ-সংশয়ের অপনোদন করে ইসলামকে কার্যকরী ও শক্তিশালী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ছিল।আমরা সেখানে আজ ফেকাহের মুস্তাহাব-সুন্নাত সম্পর্কিত, শাফেয়ী-হানফিদের মধ্যে বিতর্কিত কিছু বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে এগুলোকে প্রমাণাদিসহ উপস্থাপন করে এর পেছনে নিজেদের মেধাকে ব্যয় করাকে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় বলেন মনে করছি এবং তা করতে পেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি। অথচ হাজার হাজার লক্ষ-লক্ষ বনী আদম আজ ঈমান হারাচ্ছে, সন্দেহ-সংশয় তাদের নিত্যসঙ্গী। তাদেরকে সঠিক পথে আনার আমাদের কোন ফিকির নেই। এ সম্পর্কে আমাদের সবার মধ্যমণি যার জ্ঞান গরীমা সবার কাছে স্বীকৃত, যার বাণীকে কেউ বিনা বাক্যে মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করেনা- সেই মহান ব্যক্তিত্ব আল্লামা কাশমিরী রাহ.র কথাটিই আমি এখানে উল্লেখ করছি “আল্লামা কাশমিরী রাহ. একবার লাহোরের আমরোদ শাহ সফর করেন। তাঁর নাম শুনে সাধারণ, ছাত্র-শিক্ষক প্রফেসর সকল ধরনের লোক সমবেত হয়ে সাক্ষাৎ করতে আসে। তারা তাঁর সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের মনে যত প্রকার খটকা ছিল, প্রশ্ন ছিল, সবই মাওলানার সামনে পেশ করলেন। এগুলো শুনে মাওলানা কাশ্মিরির অন্তরে এমন ব্যথা জাগল, মুফতি শফী সাহেব বর্ণনা করেন, তাঁর সফর সঙ্গী আমিও ছিলাম। সকালে আমি সাক্ষাতে গেলে তিনি একটি বাক্য বার বার বলছিলেন; যিন্দেগী বরবাদ গায়ে, যিন্দেগী বরবাদ গায়ে”। (আমার জীবন বৃথা গেল, আমার জীবন বৃথা গেল।) মাওলানা শফী সাহেব তখন বললেন, হযরত! আপনি কি বলছেন? আপনি তো গোটা জীবন হাদিসের খেদমত করেছেন, আপনার লাখ লাখ ছাত্র রয়েছে। তাঁদের কেউ মুফাসসির, কেউ মুহাদ্দিস,মুফতি, লেখক, গবেষক ইত্যাদি। দেশে-বিদেশে সর্বত্র তাঁরা ছড়িয়ে রয়েছেন। এইতো আপনার কর্মসূচি। তো আপনার জীবন কী করে বৃথা গেল? প্রত্যুত্তরে আল্লামা কাশ্মীরী বলেন; আমরা হাদিস পড়াচ্ছি, কিতাব পড়াচ্ছি। এ মাসআলার মধ্যে হানফিদের পক্ষে এ দলীল আছে, শাফেয়ীদের পক্ষে এই দলীল রয়েছে। প্রত্যেক মাযহাবের দলীল পেশ করে হানফি মাযহাবের প্রাধন্য প্রমাণ করি অথচ এসব মাসআলা সুন্নাত ও মুস্তাহাব পর্যায়ের। কিন্তু আমি আজ বাইরে বের হয়ে জনসাধারণের সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে বুঝতে পারলাম। তাঁদের কেউ আল্লাহকে অস্বীকার করছে,নবীকে অস্বীকার করছে, শিরক করছে, কেউ কুরআনকে অস্বীকার করছে। তাদের মধ্যে সুন্নাত-মুস্তাহাব মাসআলার বিরোধ নিয়ে আলোচনা চলছে না। তাঁরা সমাজের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে,তাদের জন্যে আমি কি কর্মসূচি দিয়েছি? তাদের সন্দেহ নিরসনের জন্যে কী কী ধারা বর্ণনা করেছি? আল্লাহকেঅস্বীকার না করার জন্যে আমি কী মূলনীতি উপস্থাপন করেছি? বর্তমানে আমাদের জরুরি বিষয় হল- জনসাধারণের প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে বের করা। তাদেরকে দ্বীনের প্রতি ফিরিয়ে আনার জন্যে মূলনীতি, কর্মসূচি ও কর্মধারা প্রণয়ন করে তাদেরকে এহেন কাজ থেকে সরিয়ে এনে ইসলামের গণ্ডির ভেতরে প্রবেশ করাতে হবে। এ ছিল আল্লামা কাশ্মীরীর তাঁর সময়কালের অনুভূতি। আমরা বর্তমান সময়ে অবস্থান করে কি এতটুকু বুঝছি বা বুঝার চেষ্টা করছি। সেই বাস্তব অবস্থাকে অস্বীকার করে, বর্তমানের সমস্যবলির সমাধানকল্পে এগিয়ে না এলে বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষার ভবিষ্যৎ কুয়াশাচ্ছন্ন। আর এসবের বাস্তবতা স্বীকার করে কর্মসূচি প্রণয়ন করে ওই আঙ্গীকে সিলেবাস প্রণয়ন করে আগামী প্রজন্মকে এর উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে আমাদের ইসলামি শিক্ষার ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আজ যেখানে আমরা ইসলামের প্রতিটি বিভাগে গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার কথা ছিল। সেখানে দেখা যায় পাশ্চাত্যবিদরা, অভিশপ্ত ইহুদিরা ইসলামের নামে গবেষণা ইনষ্টিটিউট খুলছে। তারা তাদের ইউনিভার্সিটিগুলোতে ইসলামি স্টাডিজ নামে আলাদা বিভাগ খুলছে এবং তাতে মুসলমানের সন্তানদের পাঠদান করছে। কী আশ্চর্যের কথা! মুসলিম সন্তানরা ইসলাম শিখছে ইহুদি-খ্রিস্টানদের কাছ থেকে। এরা তাদেরকে কী শিখাচ্ছে? ইসলামের নামে গোমরাহী বৈ কী? এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কানাডাতে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। তা হচ্ছে মেকেগালইউনিভার্সিটি। এই ইউনিভার্সিটির কার্যক্রম ও এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাকিস্তানের প্রাক্তন চিফ জাস্টিজ মুফতি তাকী উসমানি তাঁর ঐতিহাসিক সফরনামা জাহানে দীদা তে উল্লেখ করেছেন যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ সমগ্র বিশ্বে প্রসিদ্ধ। বর্তমান যুগের অনেক প্রসিদ্ধ “মুসতাশ্রিক” (প্রাচ্য বিশারদ) এখান থেকেই ডিগ্রি লাভ করেছে। অনেক মুসলমান পণ্ডিতও এখান থেকে ইসলামিয়াতে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে গর্ববোধ করে।সুতরাং মুসলিম বিশ্বের অনেক আধুনিকমনা লেখক যারা মুসতাশরিকদের ন্যায় চিন্তাধারার অধিকারী তারা এই প্রতিষ্ঠানের ফসল।
এখানে শিক্ষা দেওয়া হয়-
১. মধ্যপ্রচ্যের ইতিহাস।
২. বিংশ শতাব্দীর আরবদের চিন্তাধারা।
৩. মুসলিম ভারতের ইতিহাস।
৪. ইতিহাস-ঐতিহ্য। এতে পবিত্র কুরআন, পবিত্র সীরাত, আকাঈদ এবং বিভিন্ন সংস্থার ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত।
৫. ইসলামি সভ্যতার আদর্শ যুগের ইতিহাস।
৬. ফাতেমিদের ইতিহাস।
৭. মধ্যযুগীয় ইসলামি সভ্যতার ইতিহাস।
৮. ইসলামি চিন্তাধারার উত্থানের নিরীক্ষা।
এ ছাড়া তাফসির, ইসলামি দর্শন, উসূলে ফিকাহ, তাসাউফ, শিয়া মতাদর্শ, ইসমাঈলী চিন্তাধারা, ইরান ও পাকিস্তানে ইসলামের উত্থানের, ইসলামের পুনর্জাগরনের আন্দোলনসমূহ, মৌলবাদের আন্দোলন। মুসলিম দেশসমূহের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মতো বিষয়বস্তু ও বিভিন্ন শ্রেণীতে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মুফতি সাহেব বলেন, এ বিষয়তো পরিস্কার যে, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ইসলামকে সত্য ধর্ম মনে করে তারহিদায়াত ও শিক্ষানির্দেশ দ্বারা উপকৃত হওয়া নয়। এখানকার বেশিরভাগ অমুসলিম। যারা নিজেদের গবেষণা ও সন্ধানের বিষয়বস্তু ইসলাম ও মুসলমানকে বানিয়েছে। এখন যদি আমরা একটু অনুসন্ধিৎসু নয়নে চিন্তা করি যে,তাদের সুবিন্যস্ত এসব কার্যক্রমের বিপরীত আমাদের কতটুকু প্রস্তুতি রয়েছে। আমাদের আজ অসহায়ের মতো তাকানো ছাড়া আর কি আছে। বিধর্মীদের বুদ্ধিভিত্তিক এসব সাঁড়াশি আক্রমণের বিপরীত আমরা সেই কবেকার পরিত্যক্ত বিষয়াবলিকে আঁকড়িয়ে ধরে নিজেদেরকে দ্বীনের মহান রক্ষক ও সেবক ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি আর নিশ্চিন্তে আরামে ইসলামি শিক্ষার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়ার নীল ও রঙ্গীন স্বপ্ন দেখছি। আমাদের সেই স্বপ্নীল মোহ কখন যে ভঙ্গ হবে। তা আল্লাহ মালুম। আমাদের চিন্তা-গবেষণা, আকিদা আমল ইত্যাদি শিক্ষা ক্ষেত্রে যে দৈন্যতা রয়েছে তা কি অস্বীকার করতে পারব?এছাড়া ইসলামি অর্থনীতি শিক্ষার ব্যাপারে যদি আমরা একটু খেয়াল দিয়ে তাকাই তাহলে আমাদের অসহায়ত্ব কত নগ্নভাবে প্রকাশ পাবে; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একেতো আধুনিক অর্থনীতির বিষয়াবলি- শেয়ারবাজার,কোম্পানি ব্যবসা, বীমা, ব্যাঙ্কিং ইত্যাদির ওপর যেমন আমাদের পাঠ্যসূচিতে কোনো বই নেই। তেমনি পুরাতন ধাঁচের কিতাবাদিতে এ সম্পর্কে যেসব আলোচনা রয়েছে, এর প্রতিও আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। হেদায়া ও মুসলিম শরিফের ব্যাবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত অধ্যায় পড়ানোর সময় আমাদের কী ভূমিকা থাকে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বিষয় যেন অন্য জগতের কোনো কিছু। আর ইসলামি রাজনীতিতো আজকাল নির্ধারিত কিছু ফ্যাশন ও কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ। শরহে আকাঈদ ও হেদায়ার আদাবুল কাযী তে এ সম্পর্কিত যা কিছু রয়েছে তা বৎসরের শেষে পৃষ্ঠা উল্টানোর মাধ্যমে আঞ্জাম দেওয়া হয়। আর অনেক মাদরাসায় তো পৃষ্ঠা উল্টানোরও সুযোগ হয় না। তাইতো আজ ইসলামি রাজনীতির নামে কত রকম নোংরা খেলা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে।
প্রত্যেক যুগের অনিষ্ট সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি
মানবজীবন পরিচালনার জন্যে যেমন উপকারী বিষয়াবলি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া করুরি- তেমনি অপকারী ও অনিষ্টকারী বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়া অত্যাবশ্যক। তা নাহলে নিরাপদ থেকে নিজের ঈমান আমলকে রক্ষা করা দুরূহ। অথচ আমরা আজ এ সম্পর্কে গাফেল। তাই সহজে আমরা বাতিলের বেড়াজালে আবদ্ধ হই। আজ আমাদের সিলেবাসসমূহে তা উপেক্ষিত। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। এ সম্পর্কে আমি পাকিস্তানের অন্যতম ইসলামি ব্যক্তিত্ব,মাদরাসা নুসরাতুল উলুম এর শায়খুল হাদিস, পাকিস্তানের গুজরানওয়ালা শরীয়া একাডেমির ডাইরেক্টর মাওলানা যাহেদ রাশেদী সাহেবের একটি উক্তি উল্লেখ করছি; তিনি বলেন; আমরা অন্যায় অনিষ্ট ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয়ের জ্ঞানার্জন ছেড়ে দিয়েছি। আমরা শুধু ভালো ভালো উপকারী ইতিবাচক বিষয়ের জ্ঞানার্জনকে যথেষ্ট মনে করে বসে আছি। অথচ আমাদের ক্ষতিকারক, অনিষ্টকর ও প্রতিপক্ষীয় বিষয়ের জ্ঞানার্জন ও জরুরি ছিল। আমাদের শিক্ষা সিলেবাসে যে সমস্ত ক্ষতির বিষয় সম্পর্কে পড়ানো হয়; তা হাজার বছর পূর্বের বা তার চেয়েও পুরনো। বর্তমানে নতুন যুগের নতুন ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কে আমরা একবারে অজ্ঞ। ক্ষতি, অপকর্ম ও অপতৎপরতা কারা করছে?কিভাবে করছে? এর প্রতিকার কী? এ সবের মোকাবালা কী করা যেতে পারে? এগুলো আমরা কিছুই জানি না।জানার চেষ্টাও করি না।
বিষয়ভিত্তিকভাবে যোগ্য হিসেবে গড়ে ওঠা জরুরি
আমাদের বর্তমান সিলেবাস দ্বারা কারো পক্ষে কোনো বিষয়ে যোগ্য বা গভীর জ্ঞানের অধিকারী হওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ আমাদের সিলেবাসে সব বিষয়ের সংমিশ্রণ। ফলে কারো পক্ষে আপন যওক ও মেধা অনুযায়ী কোনো একটি বিষয়ে পারদর্শী হওয়া দুরূহ। অথচ আমরা যদি পূর্বসূরীদে সময়কালের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, তারা ছিলেন বিষয়ভিত্তিক পারদর্শী। আমরা হলাম মেধা মনন ও পরিশ্রমের ক্ষেত্রে মারাত্মক দুর্বল। ফলে আমাদের জন্যে এটা আরো অত্যাবশকীয়। এদিকে সুনজর দেওয়ার মতো অনুগ্রহ কি দেখাব?
এ সিলেবাস দ্বারা মেধার অপচয় ঘটছে
আমাদের বর্তমান সিলেবাস দ্বারা একজন প্রখর মেধাসম্পন্ন ছাত্র যেমন আপন চাহিদানুযায়ী খোরাক পাচ্ছে না।তেমনি দুর্বল ছাত্ররা তা কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তাই আমাদেরকে ভবিষ্যতের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে মেধার অপচয় রোধ কল্পে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা দ্বীন তথা ইসলামি শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি
আমরা দ্বীন তথা ইসলামি শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি; আমরা আলিম সমাজ শুধুমাত্র ইলম অর্জন ও ইলম সম্পর্কিত গবেষণায় লিপ্ত থাকি। আমরা দুনিয়ার অন্যান্য খবরাখবর জানতে বা সংশোধন করতে প্রায় অক্ষম।আমরা আলিম উলামারা যেসব বিষয় নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছি- সে বিষয়েও আমাদের নিকট জিজ্ঞাসা করা হলে আমাদের অনেকেই সরাসরি উপস্থিত কোনো একটা সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম নই। আর ইসলামের আমল আখলাক ও বিশ্বাসগত যে সমস্ত দিক নিয়ে বেশি আলোচনা ও ওয়াজ- নসীহত করা হয় সেসব বিষয়ের অবস্থা যদি দেখা হয় তবে দেখা যাবে, এ সমস্ত ওয়াজ-নসীহত দ্বারা আমরা ইসলামকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। এ সীমারেখা পার হতে আমরা প্রস্তুত নই। যেমন, আজ আমরা ইসলামকে বিবাহ, তালাক, মীলাদ, জন্ম, মৃত্যু ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। যদিও এসব ক্ষেত্রে আবার পুরোপুরি ইসলামকে অনুস্মরণ করি না। আর বিচারালয়ের দিকে তাকালে দেখতে পাই, সেখানে দণ্ডবিধির মধ্যে ইসলামি আইনের কোনো নাম-গন্ধ পর্যন্ত রাখা হয়নি।
ইসলামি হুকুমাত হলে আমাদের অবস্থা কী হবে?
আজ আমাদের শিক্ষা নীতি দ্বারা একজন ছাত্রের পক্ষে ইসলামি দণ্ডবিধি সম্পর্কে অভিজ্ঞ হওয়া কি সম্ভব? ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠা হলে আমাদের পক্ষে ইসলামি দণ্ডবিধির আলোকে বিচারকার্য পরিচালনা করা কি দুরূহ নয়! তাই আমাদের সিলেবাসে ইসলামি দণ্ডবিধি ও এর সাথে সাংঘর্ষিক প্রচলিত দণ্ডবিধির ধারাগুলোকে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। এর সাথে জাতিসংঘ ও দেশীয় আইনের কোন্ কোন্ ধারা ইসলাম সমর্থন করে না, তা হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে; যাতে একজন আলিম আপন কর্মজীবনে বিভ্রান্তি থেকে বেঁচে থেকে সাধারণ মানুষকে দিক নির্দেশনা দিতে পারে। এতে আমরা ক’জন সক্ষম তা তো আমাদের জানা আছে? দারুল উলুম দেওবন্দ তো সময় সময় তার সিলেবাসে সংস্কার সাধন করে। তাই এটা আকাবির কর্তৃক প্রদর্শিত পথ।এতে দোষের কিছু নেই। বর্তমান সময়ের ছাত্ররা আগের মতো পঠনে মনোযোগী নয়। আগের মতো নয় কঠোর পরিশ্রমী। ফলে কঠিন কিতাবাদি আয়ত্ত করা তাদের জন্যে দুরূহ হয়ে ওঠে। ফলে লেখা-পড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে। যার কারণে কেউ পড়া ছেড়ে দেয়, নয় তো নামে মাত্র লেখা-পড়া চালায়। এ ছাড়া আগের তুলনায় মেধারও ক্রমোবনতি ঘটছে। সাথে পরিবেশগত অনেক বাধা। যা একজন ছাত্রকে আগেকার যুগের মতো একাগ্রচিত্ত হতে বাধা দেয়।তাই আমাদের উচিত, অভিজ্ঞ দরদি গবেষকগণ দ্বারা সময় সময় সিলেবাস সংস্কার করা। যাতে আগের মতো বর্তমানেও যোগ্য ব্যক্তি সৃষ্টি হয়। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। এর প্রতি আমরা যত তাড়াতাড়ি মনোযোগী হব তাতে মঙ্গল। আমার কওমি মাদরাসা সংস্কার সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখা দ্বারা অনেকেই মনে করতে পারেন যে, আমি মনে হয় ওই শিক্ষা দ্বারার মৌলিক বিষয়ের সংস্কার চাই- তা কিন্তু নয়। কারণ কওমি মাদরাসার মূল টার্গেট কিন্তু কুরআন হাদিস ও ফেকহে ইসলামি তথা দ্বীন বুঝা ও সংরক্ষণের ব্যবস্থাকরণ। আমি নয় কোন পাগলও একথা বলবে না যে,কওমি মাদরাসা থেকে কুরআন হাদিস তথা ফেকহে ইসলামিকে উঠিয়ে দেওয়া হউক। বরং আমি একথা বলতে চাচ্ছি কুরআন হাদিস তথা ফেকহে ইসলামি বুঝতে সহায়ক বিষয়াবলিতে পরিবর্তন করতে। যাকে علوم آلية বলা হয়।علوم أصلية তথা মৌলিক বিষয়াবলিতে পরিবর্তন নয়, তবে হ্যাঁ, علوم أصلية এর পাঠদান পদ্ধতিতে অবশ্যই সংস্কার প্রয়োজন। আর علوم آلية এর কিতাবাদিতে আনতে হবে পরিবর্তন। বর্তমান সময়ে লিখিত সহজ সরল কুরআন-হাদিস নির্ভর অনুশীলনীওয়ালা পুস্তিকাদি নেসাবের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর অর্থ এটা নয় যে, কওমি মাদরাসাসমূহের নেসাব থেকে সারফ, নাহব, বালা গত মানতিক এসব বিষয়াদি তুলে দেওয়া হবে। তবে এসব বিষয়াবলির পুরাতন লিখিত কিতাবাদির পরিবর্তে নতুন নতুন লিখিত কিতাবাদি যা বর্তমান সময়ের মন মেযাজের উপযোগী, তা লাগাতে হবে; যেখানে স্বয়ং আরবি বিশ্ব তাদের দেশসমূহের পাঠ্যসূচিতে নতুন ভাবে লিখিত সহজ সরল কিতাবাদি সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করছে। সেখানে আমরা কি এখনো সেই পুরনো কিতাবাদিকে আকড়িয়ে ধরব। পরিশেষে বলতে চাই, আমাদেরকে বর্তমান সময়ের দ্বীন বিরোধী চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে দ্বীন ও ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে হলে দ্বীনের মৌলিক বিষয়াবলিকে যথাযথভাবে আয়ত্ব করে সঠিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে নেসাবে আংশিক সংস্কার যা মৌলিক বিষয়াবলিতে নয়; বরং উপকরণসমূহে করেতে হবে। যা প্রায় শতাব্দীকাল পূর্বে বলে গেছেন শায়খ মাদানি রাহ.। দয়া করে আমরা তার নাম ব্যবহার করে ফায়দা লুটার চিন্তা না করে তার নির্দেশিত পথ ও মতকে ধীর-স্থিরভাবে সুস্থ মনে বুঝার চেষ্টা করে অনুসরণ করতে এগিয়ে আসি। পরিশেষে বিনীত অনুরোধ ভারত ও পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় মাদরাসাগুলোর নেসাবসমূহ দেখে পর্যালোচানা করে আমরা আমাদের ভবিষ্যত চলার পথ ঠিক করি। আমরা যাদের অনুসরণ করি। যাদের নামে উচ্চকণ্ঠ তারা যদি নেসাবে পরিবর্তন করতে পারে তাহলে আমরা কেন পারব না? দারুল উলুম দেওবন্দ যদি বর্তমান বিশ্বের তাগুতি শক্তির মোকাবেলার লক্ষ্যে যদি ইংরেজি বিভাগ খুলতে পারে তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব। তারা যদি অনেক অনেক বিষয়ে সংস্কার করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না? দারুল উলুমের শায়খুল হাদিস সাহেব যদি কাফিয়ার মতো কিতাব পড়ানোর জন্যে নতুন পদ্ধতিতে শরাহ লিখতে পারেন তাহলে আমরা কেন পুরাতন পদ্ধতিতে পড়ানো বাদ দিতে পারি না।সংস্কার সম্পর্কে যারা লেখালেখি করে, আলোচনা করে তারা কিন্তু কওমি মাদরাসার শত্র“ নন। আপনাদের নয় দুশমন। তাদের কথা একটু ধীরস্থিরভাবে বুঝার চেষ্টা করে তাদের সাথে আলোচনা পর্যালোচনা করে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে কওমি মাদরাসাসমূহের ঐতিহ্য রক্ষায় এগিয়ে আসি। অন্যথায় আমার আপনার দ্বারা যদি দ্বীনের সামান্যতম ক্ষতি সাধিত হয়, তাহলে অবশ্যই এর জন্যে কাল কিয়ামত দিবসে আমাদেরকে জবাবদিহী করতে হবে।আল্লাহ সঠিক পথে পরিচালনাকারী। ভুলত্র“টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আকুতি রেখে বিদায় নিচ্ছি। আল্লাহ আমাদেরকে এখলাসপূর্ণ কাজ করার তাওফিক দিন। আমীন।
কওমী মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার নেসাব তথা পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস সম্পর্কে পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের আওয়াজ বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্নভাবে বার বার ধ্বনিত হচ্ছে। যেসব লোক এই সমস্ত দ্বীনি মাদরাসাসমূহের নিয়মনীতির সাথে সরাসরি জড়িত নন এবং যাঁদের এ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই, তাদের পক্ষ থেকেও এহেন অনধিকারচর্চামূলক বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি এতই জোড়েশোরে আলোচিত হচ্ছে যে, এ ক্ষেত্রে অনেক কওমীপড়ুয়া নবীন আলেমগণও এই শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশেষত্ব, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে তাদের সুরে সুর মিলিয়ে সিলেবাসে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের আওয়াজ তুলে ধরছেন। এই নাজুক পরিস্থিতিতে কওমী মাদরাসার সিলেবাসের ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশেষত্ব, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে মৌলিক চিন্তা-ফিকিরের প্রয়োজন পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বলে অনুভূত হচ্ছে। কওমী মাদরাসা সিলেবাসের ইতিহাস-ঐতিহ্য : কওমী মাদরাসায় প্রচলিত সিলেবাস বা পাঠ্যক্রমের গোড়াপত্তনকারী মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী (রহ.)। তিনি ১০৮৮/৮৯ হিজরী মোতাবেক ১৬৭৭/৭৮ ঈসাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহালী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী স্বীয় পিতা মোল্লা কুতুবুদ্দীন শহীদ (রহ.)-এর নিকট প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১১০৩ হিজরী মোতাবেক ১৬৯১ ঈসাব্দে সাহালী শহরের দুষ্কৃতিকারীরা মোল্লা কুতুবুদ্দীনকে শহীদ করে তাঁর গ্রন্থাগার ও সমূদয় সম্পদসহ বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। তখন মোল্লা নেযামুদ্দীন (রহ.)-এর বয়স ছিল ১৩ কিংবা ১৪। কৈশোরের এই বয়সে তিনি চলে যান লাক্ষেœৗ। অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে ২৪ বছর বয়সে শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং ৪০ বছর বয়সে শাহ আব্দুর রাযযাক (রহ.) (মৃত্যু-১১৩৬ হিজরী/১৭২৩ ঈসাব্দ)-এর নিকট কাদেরীয়া তরীকায় বায়’আত হন। তিনি ৭৫ বছর বয়সে ৯ জুমাদাল উলা, বুধবার ১১৬১ হিজরী মোতাবেক ১৭৪৮ ঈসাব্দে ইন্তেকাল করেন। (সূত্র : ইসলামী বিশ্বকোষ, চতুর্দশ খ-, পৃষ্ঠা-১১৭) উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান হলো, তিনি ইলমে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে ইলম অর্জনপূর্বক গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো এমন পর্যায়ক্রমিকভাবে বিন্যস্ত করেন, যার ফলে উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা পদ্ধতি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। এই কারণে আজো এই পদ্ধতিকে ‘দরসে নেযামী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী (রহ.) কর্তৃক প্রবর্তিত ‘দরসে নেযামী’ সিলেবাস ষোলো কলায় পূর্ণতা পায় শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) (জন্ম : ১৭০৩ ঈসাব্দ, মৃত্যু : ১৭৬৫ ঈসাব্দ)-এর তত্ত্বাবধানে। দরসে নেযামী সিলেবাসের শেষ বর্ষকে দাওরায়ে হাদীসের বর্ষ নাম দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সিহাহ সিত্তাহসহ মুয়াত্তা মালেক, মুয়াত্তা মুহাম্মাদ ও তহাবী শরীফ। কালের বিবর্তনে ১৮৬৬ ঈসাব্দের ৩০ মে মোতাবেক ১৫ মুহাররম ১২৮৩ হিজরী ভারতের উত্তর প্রদেশে হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.) (জন্ম : ১৮৩২ ঈসাব্দ, মৃত্যু : ১৮৮০ ঈসাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ। তখন এই দারুল উলুম দেওবন্দে যে সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম গ্রহণ করা হয় তা ছিল ওই মোল্লা নেযামুদ্দীন সাহালবী (রহ.)-এর ‘দরসে নেযামী’ যা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ.) কর্তৃক পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছিল। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবী (রহ.) দেওবন্দ মাদরাসায় উক্ত দরসে নেযামী সিলেবাসকে আরো সুসংহত ও যুগোপযোগী করার প্রয়াস পান। তিনি হিজরী ত্রয়োদশ শতক অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় ্ঊনবিংশ শতাব্দীতে দিল্লি, লাক্ষেèৗ ও খায়রাবাদে যে তিন ধরনের ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল সেগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করেন। দিল্লি কেন্দ্রের তাফসীর ও হাদীস চর্চা, লাক্ষেèৗয়ের ফিকহ চর্চা এবং খায়রাবাদের কালাম ও দর্শন চর্চার সমন্বিত পাঠ্যক্রম দারুল উলুম দেওবন্দে প্রবর্তন করা হয়। দারুল উলুম দেওবন্দে প্রবর্তিত পাঠ্যক্রমই বর্তমানে বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাসমূহে নেসাব বা সিলেবাস হিসেবে বিদ্যমান। (সূত্র : ইসলামী বিশ্বকোষ, ত্রয়োদশ খ-, পৃষ্ঠা-৫৫৩) কওমী মাদরাসা সিলেবাসের বিশেষত্ব : কওমী মাদরাসা সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য : কওমী মাদরাসা সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মৌলিক অর্থে দারুল উলূম দেওবন্দের ৪টি বুনিয়াদ তথা বুনিয়াদে আরবাআ’র মাঝে প্রতিফলিত হয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দের ৪টি মৌলিক ভিত্তির প্রথমটি হলো : তাওহীদে খালিস (বিশুদ্ধ একত্ববাদ)। তাই, কওমী মাদরাসা সিলেবাসের মৌলিক একটি উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদেরকে খাঁটি একত্ববাদে দীক্ষিত করা। তাওহীদকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় এখানকার শিক্ষার্থীরা তাওহীদের শিক্ষা বুকে ধারণ করে ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। দারুল উলূম দেওবন্দের দ্বিতীয় মৌলিক ভিত্তি হলো : ইত্তিবায়ে সুন্নাত (সুন্নাতের অনুসরন)। তাই, কওমী মাদরাসা সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীরা যেন ইলম অর্জনের সাথে সাথে সুন্নাতে নববীরও অনুসারী হয়। দারুল উলূম দেওবন্দের তৃতীয় মৌলিক ভিত্তি হলো : তায়াল্লুক মা’আল্লাহ (আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক)। তাই কওমী মাদরাসার সিলেবাসে একজন শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জন করার পর কেবল মাত্র তখনই পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম হতে পারবে, যখন ওই শিক্ষার্থী ইলম অর্জনের পর কোনো আহলুল্লাহ তথা কোনো আল্লাহ ওয়ালার সোহবতে (সান্নিধ্যে) থেকে ইলমে তাসাউফের গভীর সাগরে ডুব দিয়ে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হবে। দারুল উলূম দেওবন্দের চতুর্থ মৌলিক ভিত্তি হলো : ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহ (আল্লাহর বিধান সুউচ্চকরণ)।
তাই, এই সিলেবাসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো, একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে নিজের জানমাল ও সময় কুরবান করে জান্নাতে আল্লাহর দীদার লাভে ধন্য হবে। বিজ্ঞানী, গণিতবিদ কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া উদ্দেশ্য নয় : আমাদের অনেক হিতাকাক্সক্ষী ভাইদের পক্ষ থেকে অনেক সময় এ ধরনের প্রস্তাব আসতে থাকে যে, এ সমস্ত মাদরাসার সিলেবাসে ‘বিজ্ঞান’ ‘গণিত’ ও ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ ইত্যাদির মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা হওয়া চাই। তাহলে যে সকল আলেম এ সমস্ত মাদরাসা থেকে বের হবেন, তাঁরা দ্বীনি ইলমের সাথে সাথে এ সমস্ত বিষয়েও পুরোপুরি দক্ষতা ও দূরদর্শিতার অধিকারী হবেন। এ মতটি যত ভালো নিয়তেই পেশ করা হোক না কেন, এটা একেবারেই অপরিণামদর্শী মত। যার ভিত্তি মূলত দ্বীনি মাদরাসার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতপক্ষে দ্বীনি মাদরাসাসমূহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো : এমন যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম তৈরি করা, যারা কুরআন-সুন্নাহ ও এতদসংশ্লিষ্ট জ্ঞানসমূহে বিজ্ঞ ও পারদর্শী হবেন। আর এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য যে মানসিক একাগ্রতা ও পূর্ণ মনোযোগের প্রয়োজন, তাতে এক ব্যক্তি একই সময়ে উঁচুমানের আলেমে দ্বীনও হবেন আবার সাথে সাথে যোগ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী অথবা অর্থনীতিবিদও হবেন, এটা আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। আজ যদি কোনো ব্যক্তি ডাক্তারি বিদ্যাকে নিজের নির্দিষ্ট বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করে নেয় এবং মেডিক্যাল সায়েন্সে নৈপূণ্য অর্জন করে, তখন কোনো বুদ্ধিমান তার সম্পর্কে এ আপত্তি করতে পারে না যে, সে ডাক্তার হওয়ার সাথে সাথে ইঞ্জিনিয়ার কেন হয়নি? অথবা যদি কোনো ব্যক্তি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ডিগ্রি লাভ করে, তখন তার ওপর কোনো বিবেকবান এ প্রশ্ন করে না যে, মেডিক্যাল সায়েন্সে সে কেন পড়েনি? (সূত্র : কওমী মাদরাসার নেসাব ও নেযাম-দরসে নেযামীর কিতাবসমূহের পাঠদান পদ্ধতি। মূল : আল্লামা তাকী উসমানী, অনুবাদ : মাওলানা মুহাম্মাদ ওমর ফারুক, পৃষ্ঠা-১৫) হস্তশিল্প অথবা কারিগরি শিক্ষা দেওয়াও উদ্দেশ্য নয় : কোনো কোনো ব্যক্তি কওমী মাদরাসাসমূহের হিতাকাক্সক্ষী ও সহমর্মী হয়ে এখানে হস্তশিল্প ও কারিগরি শিক্ষার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যাতে করে উলামায়ে কেরাম অর্থনৈতিক দিক থেকে সমাজের বোঝা না হয়ে নিজ যোগ্যতায় জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করে বিনিময় ছাড়া দ্বীনের খিদমত আঞ্জাম দিতে পারেন। এই মতামতটি যদিও অত্যন্ত সুনিয়তে পেশ করা হয় এবং বাহ্যিকভাবে খুবই সুন্দর মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে এই মতামতটিও সুচিন্তিত ও সুগভীর মতামত নয়। কেননা, কুরআন ও হাদীসের ন্যায় এমন একটি ব্যাপক বিষয়ের ওপর পারদর্শিতা অর্জনের পাশাপাশি হস্তশিল্প ও কারিগরি বিষয়ে সময় ব্যয় করা বাস্তবতার নিরিখে আসলে কোনো সুযোগ নেই। যেখানে চব্বিশ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে কুরআন-হাদীস ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যোগ্যতা অর্জন করা কঠিন, সেখানে হস্তশিল্প ও কারিগরি শিক্ষার পেছনে সময় ব্যয় করার সময় কোথায়? তা ছাড়াও অন্য কোনো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা অর্জনকারীদের বেলায় এমন পরামর্শ তো দেয়া হচ্ছে না! কারণ, তারা তাদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান থেকে সমাজে যে সেবা দিয়ে থাকেন, সেই সেবার মাধ্যমে তাদের জীবিকার চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। তাহলে উলামায়ে কেরাম যদি সমাজের দ্বীনি চাহিদাসমূহ পূরণ করে সমাজের সেবা দিয়ে থাকেন, এ ক্ষেত্রে সেই মাধ্যম থেকে তাদের আর্থিক সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টিকে ‘সমাজের বোঝা’ বা ‘সমাজের করুণার পাত্র’ বলে মন্তব্য করা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় নয় কি? যদি কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ বা বিজ্ঞানী নিজ বিভাগ থেকে সমাজে সেবা প্রদান করেন এবং এর ভিত্তিতে সমাজ তাকে আর্থিক সুবিধা প্রদান করে, তবে এটা না তার প্রতি কোনো করুণা, আর না এ কারণে তাকে ‘সমাজের বোঝা’ বা ‘সমাজের করুণার পাত্র’ বলে মন্তব্য করা ঠিক হবে। বরং সমাজের অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের সেবা সমাজের সব মানুষ সব সময় গ্রহণ করে না। কিন্তু উলামায়ে কেরামের দ্বীনি সেবা সমাজের সব মানুষের সব সময় প্রয়োজন। তাই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ওপর উলামায়ে কেরামের প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব অনেক অনেক বেশি। (সূত্র : কওমী মাদরাসার নেসাব ও নেযাম- দরসে নেযামীর কিতাবসমূহের পাঠদান পদ্ধতি। মূল : আল্লামা তাকী উসমানী, অনুবাদ : মাওলানা মুহাম্মাদ ওমর ফারুক, পৃষ্ঠা-১৭) বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বীকৃত একটি পন্থা এবং সময়ের দাবি : যদি কোনো বিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর পূর্ণ জোর দেয়া হয়, তখন কোনো ব্যক্তি সেখানে এ আপত্তি পেশ করে না যে, এ প্রতিষ্ঠানে সাহিত্য, কবিতা অথবা কমার্স বিষয়ের শিক্ষা কেন দেয়া হয় না? কোনো কমার্স কলেজে এ প্রশ্ন করা হয় না যে, এখান থেকে ইঞ্জিনিয়ার কেন তৈরি হয় না? কোনো ল’ কলেজের ব্যাপারেও এ মতামত শোনা যায়নি যে, এর মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যাও শিক্ষা দেয়া উচিত! তাহলে, তাফসীর হাদীস ফিক্বাহ ও দ্বীনসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কি এমন শিক্ষা নয় যে, এগুলোর শিক্ষাদানের জন্য নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান থাকবে, সে সমস্ত প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণরূপে এ বিষয়গুলোর ওপর চেষ্টা-মেহনত করে এগুলোর খিদমত আঞ্জাম দেবে এবং এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ উলামা তৈরি করবে? কওমী মাদরাসাসমূহের সিলেবাস অক্ষুণœ রেখে আপন গতিতে থাকতে দেয়া যৌক্তিক দাবি : যদি কওমী মাদরাসাসমূহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ইসলামী শিক্ষায় দক্ষ ব্যক্তি গঠনের প্রতি নিবদ্ধ হয়, আর সেখান থেকে কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ তৈরি না হয়, তবে এ নিয়ে আপত্তি ও হৈচৈ করার কিছু নেই। বরং যে পরিমাণ ইসলামী শিক্ষা শরীয়তের দৃষ্টিতে ফরজে আইন ওই পরিমাণ ইসলামী শিক্ষা প্রতিটি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা ফরজ। ইলমে দ্বীনের খিদমত সমাজের কোনো প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত নয় কি? মুসলিম সমাজে এমন আলেমের প্রয়োজন নেই কি, যারা তাদের দ্বীনি চাহিদাগুলো পূরণ করবে? সমাজের নিত্যনতুন সমস্যাগুলোর শরয়ী সমাধান দেবে? মুসলিম সন্তানদেরকে দ্বীনি শিক্ষা দেবে? তাদের ভবিষ্যত ইসলামী জীবনের সংরক্ষণের জন্য নিজের পুরো জীবন ওয়াকফ করবে? দ্বীনের ওপর আগ্রাসী ফিতনাসমূহের কার্যকর মোকাবিলা করতে পারবে? হ্যাঁ, অবশ্যই এমন একদল আলেম থাকা চাই। নতুবা ইসলাম ও মুসলিম সমাজের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই কওমী মাদরাসা সিলেবাসে পরিবর্তন বা পরিমার্জনের আওয়াজ না তুলে বরং দ্বীনি বিষয়ের সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে আধুনিক বিষয়াদির অবতারণা করে পাঠদান পদ্ধতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। উদাহরণস্বরূপ হেদায়া কিতাবের ‘কিতাবুল বুয়ু’ পাঠদান কালে আধুনিক অর্থনীতি ও ব্যাংকিংয়ের আলোচনা, মানতিক ও ফালসাফা পাঠদান কালে যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্রের পরিভাষাগত আলোচনা, মুখতাসারুল মা’আনী পাঠদান কালে বাংলা ভাষাতত্ত্ব ও অলংকারশাস্ত্রগত আলোচনা ইত্যাদি। আর আধুনিক বিশ্বে দ্বীন প্রচারের স্বার্থে প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি যেমনÑকম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদির শিক্ষা প্রয়োজন অনুসারে নিজ নিজ উদ্যোগে শিখে নিতে হবে।
সব বিষয়কেই সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন নেই। যে ব্যক্তি যে বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করতে চায়, কেবল সেই বিষয়কেই ওই ব্যক্তির জন্য সিলেবাসভুক্ত করা উচিত। সিলেবাসের দোষ নয়, দোষ আমাদের অলসতা ও অযোগ্যতার : আজ কওমী মাদরাসার সিলেবাসকে যুগোপযোগী মনে করা হচ্ছে না। এর কারণ যদি দ্বীনি বিষয় ছাড়া সমাজের অন্য বিষয়ের ওপর পারদর্শিতার কথা বলা হয়, তাহলে আপত্তিটা যথার্থ নয়। কেননা, কওমী মাদরাসার উদ্দেশ্যই হলো দ্বীনি বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করা। আর যদি দ্বীনি বিষয়ে পারদর্শিতার কথা বলা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দ্বীনি বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের ক্ষেত্রে কওমী মাদরাসার সিলেবাসের চেয়ে উত্তম কোনো সিলেবাস সত্যিই পৃথিবীতে বিরল। এই সিলেবাসে পড়ালেখা করেই নিকট অতীতেও বিশ্বসেরা ওলামায়ে কেরাম তৈরি হয়েছেন এবং হচ্ছেন। সুতরাং বলাই যায় যে, মৌলিক অর্থে সিলাবাসের দোষ নয়, দোষ আমাদের অলসতা ও অযোগ্যতার। অলসতা দুর ও যোগ্যতা তৈরি বর্তমান পরিস্থিতিতে সংস্কার প্রয়োজনীয়।
লেখক: মুহাদ্দিস, মুহতামিম, জামেয়া ফরিদাবাদ, ঢাকা