শাহ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম ::
নবীজি ও তাঁর পূর্বে আরবরা রোমান, পারসিক ও অন্যান্য পঞ্জিকা ব্যবহার করতো। তাদের নিজস্ব কোন পঞ্জিকা ছিল না। বিভিন্ন ঘটনার দ্বারা তারিখ, সন বলা হতো। যেমন আসহাবে ফীলের ঘটনার অত বছর পূর্বে/পরে…। ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা আমীরুল মুমিনীন হজরত উমর রা.’র খিলাফতকাল; ৩য়/৪র্থ বছর চলছে। সাহাবী হযরত আবু মূসা আশআরী রা. ছিলেন ইরাক ও কুফার গভর্ণর। তিনি খলীফার কাছে আবেদন পাঠালেন, রাষ্ট্রীয় ফরমান এবং দিকনির্দেশনায় কোনো সন-তারিখ উল্লেখ থাকে না, এটা কোন দিনের আদেশনামা তা অবগত হওয়া যায় না, ফলে তা কার্যকর করতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এজন্য পত্রাবলী ও সরকারী ফরমানে দিন, মাস, সন ব্যবহার করা প্রয়োজন।
খলীফা উমর রা. পত্রপাঠ অনুধাবন করলেন যে, আবূ মূসা আশআরী প্রকৃত অর্থেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করেছেন। সুতরাং তিনি বিলম্ব না করে মজলিসে শূরার বৈঠক ডাকলেন। তিনি পত্রের প্রেক্ষিতে মুসলিম উম্মাহ’র সুবিধার্থে একটি সন নির্ধারণ করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সভায় উপস্থাপন করলেন। আলোচনার পর উপস্থিত সবাই এতে সম্মতি প্রকাশ করলেন। তারা দিন, তারিখ ও সন নির্ধারণে নিজ নিজ অভিমতও ব্যক্ত করলেন। কেউ রোমান আবার কেউ পারসিক, আবার কেউ কেউ নিজস্ব ক্যালেন্ডার প্রণয়নের কথা বললেন। আলোচনান্তে সর্বসম্মতিক্রমে নিজস্ব ক্যালেন্ডার প্রণয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সৌর বছর না চন্দ্র বছর হবে এই আলোচনায় চান্দ্র বছরের পক্ষেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।
তবে কখন বছর গণনা করা হবে? এ প্রশ্নে কেউ বললেন, নবীজির জন্ম সাল থেকে, আবার কেউ বললেন, নবুওয়াত লাভের বছর থেকে, আবার কেউ কেউ বললেন, হিজরতের বছর থেকে। হিজরতের পক্ষে হযরত আলী রা. জোরালো বক্তব্য পেশ করলেন। ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ মহিমান্বিত ও ঐতিহাসিক ঘটনা হিজরতের সময় থেকে এর গণনা শুরু হোক; প্রস্তাবটি হযরত উমর রা. সহ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় এবং ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। উমর রা. দেখলেন, হিজরতের দ্বারা সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য সূচিত হয়েছে। এজন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ, তিনি এ প্রস্তাব সমর্থন করলেন। পরে হিজরত থেকে গণনা শুরু করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কোন মাস থেকে গণনা হবে তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়। রাসূল সা.-এর মদীনায় হিজরতের সময় ছিল রবিউল আউয়াল মাস। বিস্তারিত আলেচনার পর শুরা ঐক্যমতে সিদ্ধান্ত করলো যে, মুহাররাম থেকে হিজরী সন গণনা শুরু হবে। কারণ মাসের ধারাবাহিকতা ও সার্বিক সুবিধার কথা চিন্তা করে মহররমকেই হিজরী সনের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়। এ ছাড়া ইসলামপূর্ব যুগে মহররম মাস আরবে বিশেষ সম্মানিত মাস হিসেবে বিবেচিত ছিল। সেই থেকে হিজরী সন বিশ্ব মুসলিমের ঐতিহ্য। হিজরী সনের তারিখ স্মরণ রাখা, দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার করার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশের বিষয়। কেননা হিজরত ছিল মুসলমানদের গৌরবময় অভিযাত্রার এক বিপ্লবী অধ্যায়। এই হিজরতের মধ্য দিয়েই নিগৃহীত, নির্যাতিত উম্মতে মুহাম্মদী একটি আত্মপ্রতিষ্ঠিত জাতিতে পরিণত হয়েছিল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মদীনায় আগমনের সাথে সাথেই মদীনার মান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের অপরিমেয় মান, খ্যাতি, ধারাবাহিক সাফল্য ও বিজয় বয়ে আনায় প্রিয়নবী সা.-এর সাহাবিরা বুঝেছিলেন এই হিজরতের মর্ম ও গুরুত্ব কত বেশি। সুতরাং তাঁরা এই ঐতিহাসিক হিজরতকে চিরস্মরণীয় করে রাখেন এবং ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা. হিজরী সালের প্রবর্তন করে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন।
নবীজী সা. নবুওত পরবর্তী ১৩ বৎসর মক্কায় নিরবচ্ছিন্নভাবে ইসলামের প্রতি মানুষকে দাওয়াত দিয়ে যান। প্রাথমিকভাবে নিজ পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবকে ইসলামের পথে আহ্বান করার জন্য নির্দেশিত হন। সে মতে প্রথমদিকে স্ত্রী খাদিজা, ভাই আলী, বন্ধু আবু বকর রা. এবং পরে আরো অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলমানদের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, তাদের প্রতি মক্কার কাফির-মুশরিকদের নির্যাতনও বেড়ে যেতে থাকে। নবীজী সা. নিজেও অনেকবার নির্যাতিত হন, কিন্তু উম্মতের প্রতি তাঁর প্রবল মমতার কারণে তিনি সবকিছু সয়ে যান। তায়েফে তাঁর সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হওয়ার পর জিব্রীল আ. যখন তায়েফকে উল্টিয়ে ধংস করে ফেলার অনুমতি চেয়েছিলেন, তখন নবীজী সা. তাঁকে বলেছিলেন, ‘ওরা অবুঝ। বুঝতে পারলে নিশ্চয় তারা এমনটি করত না, তিনি সিজদায় পড়ে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ আমার জাতিকে ক্ষমা করে দিন, তারা বুঝতে পারছে না।’ কিন্তু তাঁর সাহাবাদের প্রতি অমানবিক নির্যাতন তার জন্য মহাকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে আল্লাহর অনুমতিতে প্রথমে হাবশায় এবং পরে মদীনায় সাহাবীদের হিজরত করার নির্দেশ দেন।
নবুওতের ১৩তম বৎসর হজ্জের পর আকাবায় মদীনাবাসীর দ্বিতীয় শপথ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বহু মদীনাবাসী এসে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁরা প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা. এবং ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণকারীদের মদীনায় নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মদীনায় গেলে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাসও দেন তাঁরা। এরপর মহান আল্লাহর ইচ্ছায় নবীজী সা. তাঁর সহচরবৃন্দকে মদীনায় হিজরত করার অনুমতি দেন। এভাবেই মদীনায় হিজরতের সূচনা হয়। সাহাবায়ে কিরাম রা. একজন-দু’জন করে মদীনায় চলে যেতে থাকেন। এরই ভেতর আরো অনেক নির্যাতনের খবর আসতে থাকে। কাফিররা দ্বীনের দাওয়াতকে অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং আল্লাহর প্রিয় বান্দাদেরকে নানাভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন অব্যাহত রাখে। ফলে মুসলমানদের ইবাদত ও দাওয়াতী কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হয়।
তাঁদেরকে মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করার, এমনকি হত্যা করার চক্রান্ত চলতে থাকে। অনেক সাহাবার উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। কাফিররা অনেককে সমস্ত সম্পদের বিনিময়ে মক্কা ত্যাগ করার অনুমতি দেয়। এভাবে বহু সাহাবী নিজ ঘর-বাড়ি, এলাকা, সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজনের মায়া-বন্ধন ছিন্ন করে সবকিছু ছেড়ে কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য মক্কা ত্যাগ করেন। মক্কায় তখন কেবল নবীজী সা., আবু বকর ও আলী রা. অবশিষ্ট ছিলেন। কাফিররা সবকিছু টের পেয়ে যায়, তখন রাসূল সা. কে মেরে ফেলার ব্যাপারে তারা নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। কুরাইশদের উম্মত্ততা সীমাহীন আক্রোশে পরিনত হলো। এদিকে মহান আল্লাহ অহির মাধ্যমে নবীজীকে সব জানিয়ে দেন। নবীজী সা. আবু বকর রা. এর ঘরে চলে যান এবং একসাথে রওয়ানা হন। রওয়ানা হওয়ার মুহূর্তে বাইতুল্লাহর দিকে করুণ দৃষ্টি ফেলে নবীজী বললেন, ‘হে মক্কা! আল্লাহর কসম, তুমি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শহর, আমার মাওলার কাছেও বেশি পছন্দের শহর তুমি। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিতো, আমি কখনো বের হতাম না (সুনানে তিরমিযী)।
এদিকে কাফিররা রাসূলকে জীবিত বা মৃত ধরে আনার জন্য ১০০টি উট পুরস্কার ঘোষণা করলো। মক্কার দুর্দান্ত কাফির ঘোড়সওয়াররা বেরিয়ে পড়ে রক্তের নেশায় পুরষ্কারের আশায়। রাসূল সা. ও আবু বকর রা. কাফেরদের গতিবিধি লক্ষ্য করে সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় গুহার কাছে গিয়েও না পেয়ে ফিরে আসে কাফিররা। গুহা থেকে মদীনার পথে রওয়ানা হওয়ার সময় সুরাকা বিন মালিক অনেক কাছে চলে আসেন। আবু বকর রা. ভয় পেয়ে যান। কিন্তু নবীজী সা. নির্ভয়ে বলেন, ভয় পেও না, ‘আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। ইতোমধ্যে সুরাকা কয়েকবার ঘোড়া থেকে পড়ে যান। কাছে এসে তিনি নবীজীকে ধরার পরিবর্তে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে যান। পরবর্তীকালে হুনাইন যুদ্ধের পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
আমাদের বছর গণনা : বছর গণনায় আমরা মূলত তিনটি সনের সাথে পরিচিত, যদিও পৃথিবীতে আরো বহু সন রয়েছে। প্রসিদ্ধ তিনটি সন হলো, ইংরেজি সন, বাংলা সন এবং হিজরী সন। ইংরেজি সন মূলত খ্রিস্টধর্মীয় সন। ঈসা আ.-এর জন্মের প্রায় ১৬০০বছর পরে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে ৮ম পোপ গ্রেগরি প্রাচীন রোমান জুলিয়ান ক্যালেন্ডার (Julian Calendar) সংশোধন করে এ ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন। এ গণনায় ঈসা আ.-এর জন্ম সালকে গণনার শুরু ধরা হয়। এ ক্যালেন্ডারকে গ্রেগরি বা খ্রিস্টান ক্যালেন্ডার বলে। এতে যিশু খ্রিস্টকে প্রভু হিসেবে বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা বছরকে আন্নো ডোমিনি (anno domini) বা অ.উ বলে। এর অর্থ আমাদের প্রভুর বছরে (in the year our Lord)। এজন্য ইসলাম বিশেষজ্ঞরা যথাসম্ভব এ গণনাকে পরিহার করার জন্য পরামর্শ দেন।
বাংলা সন, এটা মূলত হিজরী সনেরই একটি সৌররূপ। প্রাচীন ভারতে হিজরী সন ব্যবহার করা হতো। হিজরী সন চান্দ্রমাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্রবছর, সৌরবছর থেকে ১১/১২ দিন কম হয়। চন্দ্রবছর ৩৫৪ দিনে এবং সৌরবছর ৩৬৫ দিনে হয়। সম্রাট আকবর চন্দ্রপঞ্জিকাকে সৌরপঞ্জিকা করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহুল্লাহ সিরাজিকে দায়িত্ব দেন। ৯৬৩ হিজরী সন থেকে এ গণনা শুরু হয়। এতেও নবীজির জন্ম সালকে গণনার শুরু ধরা হয়। ৯৬৩ হিজরীতে মুহাররম মাস ছিল বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখকে বাংলা সনের শুরু ধরা হয়। বর্তমানে ১৪৩৭ হিজরী সন শুরু হয়েছে আর বাংলা হলো ১৪২২। সৌর বছর, চন্দ্র বছরের চেয়ে ১১/১২ দিন বেশি হওয়ার ফলে প্রতি ৩০ বছরে চন্দ্রবছর ১ বছর বেড়ে যায়।
উৎসব পালনের ইসলামী রীতি
নববর্ষ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য উৎসব পালন করার প্রবণতা বিশ্বব্যাপী দিনে দিনে বাড়ছে। আমাদের দেশেও বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষ স্বাড়ম্বরে পালন করা হয়। ইসলাম পৃথিবীর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এতে উৎসব পালনের নির্দেশনাও আছে। তবে অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে ইসলাম সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন-মদীনায় হিজরত করার পর নবীজী দেখলেন, মদীনাবাসী বছরে দু’দিন ইচ্ছামত রং-তামাশা, গান বাজনা ও লাগামহীন উচ্ছৃঙ্খলতায় মেতে ওঠে এবং উৎসব পালন করে। তখন মহান আল্লাহ মুসলমানদের জন্য বছরে দু’টি ঈদের ব্যবস্থা করে দেন। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।
হিজরী নববর্ষ পালন উৎসবের অস্তিত্ব ইসলামের সোনালী যোগে ছিল না। এখনো ইসলামী পরিম-লে এর কোন কার্যক্রম নেই। ইসলামী বিধানে কোন বৈধ উৎসবে অবৈধ কাজ হলে সেটাও অবৈধ হয়ে যায়। এছাড়াও সম্মানিত মাসসমূহে অন্যায় হতে দূরে থাকার জন্য বলেছে ইসলাম। আমরা নতুন বছরে প্রবেশ করেছি, এ উপলক্ষে একে অপরকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। এক্ষেত্রে ইসলামী রীতি হলো, দু’আ করা। বিগত বছরের পাপাচার অন্যায় অনাচারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, আর আগামীর জন্য কল্যাণ কামনা করা। আমরা দু’আ করবো নতুন বছরের সফলতার জন্য। স্রষ্টার ও সৃষ্টির প্রতি আমাদের যেসব দায়িত্ব রয়েছে তা পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় করার জন্য। আমাদের দ্বারা কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমাদের প্রতিটি দিনই নতুন দিন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَهُوَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ بِاللَّيْلِ وَيَعْلَمُ مَا جَرَحْتُمْ بِالنَّهَارِ ثُمَّ يَبْعَثُكُمْ فِيهِ لِيُقْضَى أَجَلٌ مُسَمًّى ثُمَّ إِلَيْهِ مَرْجِعُكُمْ ثُمَّ يُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
“তিনিই রাতে তোমাদের (নিদ্রারূপ) মৃত্যু ঘটান এবং দিনে তোমরা যা করো তা তিনি জানেন। অতঃপর তিনি দিনে তোমাদের জাগিয়ে তুলেন একটি নির্দিষ্ট সময় পূরণের জন্য। এরপর তাঁর দিকেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অনন্তর তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে তিনি অবহিত করবেন।” (কুরআন মাজীদ, সূরা আন’আম- ৬/৬০)।
ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে প্রতিদিন সকালে আল্লাহর প্রশংসা করতে আর সারাদিনে ভালো ভালো কাজ করার জন্য দু’আ করতে। আর সন্ধ্যায় ভুলের জন্য অনুতপ্ত হতে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতে। আগে বাংলা নববর্ষে হালখাতাসহ নানা অনুষ্ঠান করা হতো। এর সাথে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দু’আ-দুরূদ ও মিলাদ মাহফীলের আয়োজন করা হতো। এখন আমরা অনেক উৎসব দেখছি যাতে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নগ্নতা, বেপর্দা ইত্যাদিতে মত্ত হচ্ছে। অনেক ঘটন-অঘটনও হচ্ছে। ইসলাম অবাধ মেলামেশাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। আর অবাধ মেলামেশার কুফল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বর্তমান পৃথিবীর মানুষ হাড়ে হাড়ে ঠের পাচ্ছে। একদিন বাঙ্গালিপনা আর সারাবছর ইংরেজিপনা, আবার একদিন ইংরেজিপনা আর সারাবছর বাঙ্গালিপনা এভাবেই চলছে আমাদের বর্ষবরণ উৎসব। কোন বছরকে বিদায় জানাতে ও বর্ষবরণে আমরা পূর্বের বছরের ভালো কাজের প্রশংসা করতে পারি, না পাওয়া বিষয়গুলো পাওয়ার জন্য নব উদ্যমে কাজ করতে পারি এবং ভুলের জন্য মালিকের কাছে করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারি; আর নতুন বছরে ভালো ভালো কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি।
বাংলাদেশে হিজরী সনের ব্যবহার
বাংলাদেশে মুসলমানদের জীবনে হিজরী সনের ব্যবহার খুব কম। তবে দেশের কওমী শিক্ষাবোডসমূর্হ ও এগুলোর অধীন মাদরাসাগুলোতে এখনো শিক্ষাবছর, শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রী হাজিরা, শিক্ষা ও পরীক্ষা কার্যক্রম, ছুটি ও নিয়োগ ইত্যাদি হিজরী সন অনুযায়ী সম্পাদিত হয়ে থাকে।
বাংলাদশে সরকারীভাবে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৪ জেলাসহ কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিমাসে নিয়মিত চাঁদ দেখা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। ঐ চাঁদ দেখা কমিটির মাধ্যমেই বাংলাদেশে হিজরী সনের হিসাব রাখা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিবছর যে ডাইরি প্রকাশ করে থাকে তাতে হিজরী সনের ব্যবহার গুরুত্বের সাথে করা হয়। এক সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশন হিজরী ক্যালেন্ডার ও ডাইরি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রকাশও করেছিল। কিন্তু তা খুব একটা জনপ্রিয় না হওয়ায় অব্যাহত থাকেনি।
বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশণ সরকারীভাবে বাংলা ও ইংরেজি সনের সাথে হিজরী সন তারিখের ঘোষণাও দিয়ে থাকে। অন্যান্য কিছু চ্যানেলও এ ধারা অনুসরণ করে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত প্রায় সকল পত্র-পত্রিকাতে বাংলা সনের পরেই হিজরী সনের ব্যবহার করা হয়। দেশের সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত ক্যালেন্ডারসমূহের মধ্যে প্রায় ৬০% ক্যালেন্ডারে হিজরী সন তারিখ থাকে।
আমাদের বিয়ে শাদি ওয়ালিমা আকীকা কুলখানী ওয়াজ তাফসীর ও সীরাত মাফিলের দাওয়াতপত্র ও প্রচারপত্রে হিজরী সনের তারিখ দেখা যায়। (আগামী পর্বে সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি : গবেষক, আলেম ও বহুগ্রন্থ প্রণেতা।
আরও পড়ুন-
হিজরী সন : ইসলামী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ : ১ম পর্ব