লিখেছেন: শরীফ মুহাম্মদ
তিনি চলে গেছেন, প্রায় দশ বছর হয়েছে। সিলেট-বালাগঞ্জের এক ছায়াশীতল জনপদ গহরপুরের ছায়ায় তিনি শুয়ে আছেন। বাংলাদেশের আলেম সমাজের অন্যতম এক রাহবার। জীবনের শেষভাগে প্রায় দশ বছর ছিলেন কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের সভাপতি। তিনি আল্লামা হাফেজ নূরউদ্দীন আহমদ গহরপুরী (রহ.)।
দেশজুড়ে বিস্তৃত ছোট-বড় প্রায় দশ হাজার কওমি মাদ্রাসার অভিভাবকত্ব ছিল তার কাঁধে। রাহনুমা ছিলেন লাখ লাখ আলেমের। দেশের অর্ধেক জনপদে আম মানুষের প্রত্যক্ষ আস্থা ও আশ্রয়ও ছিলেন। দিনের বেলায় চলত তার হাদিস-ফিকহের দরস। আর রাতের গহীনে ছুটতেন মাহফিল থেকে মাহফিলে। এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। শহর থেকে অজপাড়াগাঁয়। তার হাতে কেচ্ছার ঝুলি ছিল না, গলায় সুরের ঝঙ্কার ছিল না। তবুও গায়েবি অশ্বারোহীর মতো তিনি ছুটে চলতেন। হৃদয়ে উম্মাহর দরদ আর চোখে বুক ভেজানো পানি নিয়ে। তার কণ্ঠে উচ্চারিত আল্লাহর কালাম আর হাদিসে নববির ধ্বনিতে ‘মালামাল’ হয়ে যেত মানুষের হৃদয়ের দহলিজ।
১৯২৪ সালের ২৪ জুলাই তার জন্ম। বালাগঞ্জের গহরপুর গ্রামের মোল্লাপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত দীনদার পরিবারে। অল্প বয়সে তিনি এতিম হয়ে যান। মমতাময়ী মায়ের আঁচল ধরে কৈশোরে চলে যান গোলাপগঞ্জের বাঘায়। এরপর দারুল উলুম দেওবন্দ। সেখানে ১৯৫০ সালে দাওরায়ে হাদিসের শেষ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। ’৫২ সালে তার কর্মজীবনের শুরুই হয় শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। সোনালি যৌবন থেকেই জীবনে জমতে থাকে পুণ্যের প্রাচুর্য। বয়স যখন তার সত্তর পার হয় হয়, তখন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সারা দেশের আলেমদের আস্থাভাজন রাহনুমায় পরিণত হন। ১৯৯৬ সালে তার কাঁধে তুলে দেয়া হয় দেশের কওমি মাদ্রাসা ও কওমি আলেম সমাজের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব। ২০০৫ সালের ২৬ এপ্রিল ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত এ গুরুদায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত ছিল।
অনুচ্চ গঠন, বিশেষত্বহীন দেহাবয়ব ও সাদামাটা পোশাক-আশাক। মাথায় সাদা পাগড়ি, গায়ে ছোট্ট আচকান আর হাতে একটি লাঠি। এই ছিল তার চমক-গমকহীন বাহ্য রূপ। এর মধ্যে দুটি ব্যাপার ছিল লক্ষণীয়। শ্যামল মুখাবয়বে প্রশান্ত গভীর দুটি চোখ। নিঃসীম গভীরতায় ডুবে থাকা সে দুটি চোখের উজ্জ্বলতা ও প্রখরতা ছিল বর্ণনাতীত। আর তার গলার স্বরে থাকত প্রত্যয় ও দৃপ্তির আভাস। শঙ্কাহীন, দ্বিধাহীন স্বরে গন্তব্য নির্দেশ করতেন। দ্বিধা-জড়তা কিংবা আড়ষ্টতা নিয়ে তাকে কথা বলতে শোনেননি কেউ, অনুকূল মুহূর্তেও নয়, প্রতিকূল সময়েও নয়।
কিছুটা অন্তর্মুখী ছিলেন। তার স্বভাবে মজযুব আল্লাহর অলিদের বৈশিষ্ট্য ছিল। মিডিয়া তাকে সেভাবে জানত না। তাকে জানতেন সারা দেশের আলেম সমাজ। মানতেন অর্ধেক জনপদের সব শ্রেণীর মানুষ। বড় আলেম ছিলেন। বড়রা বলেন, তিনি আল্লাহর অলি ছিলেন। আম মানুষ দেখত তাকে ঘিরে বহু অলৌকিক ঘটনা। তিনি ছিলেন তাওয়াক্কুল ও হিম্মতের প্রতীক। আর ছিলেন বিনয় ও নিঃস্বার্থতার পরাকাষ্ঠা। বহু বরেণ্য আলেমের কাছেও তিনি বরেণ্য ছিলেন তার এ গুণগুলোর কারণে। জীবনের শেষ পঁয়ত্রিশ বছর রাজনীতির কোনো মঞ্চে ওঠেননি। কিন্তু রাজনীতির কোনো ইস্যু যখন ইসলাম, দেশ ও উম্মাহর সঙ্গে জড়িয়ে যেত, তখন নির্বিকার ও অবিচল ভঙ্গিতে রাস্তায় এসে দাঁড়াতেন। কোনো হিসাব-নিকাশ করতেন না। তার অবস্থান কোন মহলের পক্ষে-বিপক্ষে গেল সেটা আমলেই নিতেন না। তারপরও তিনি রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক কোনো পক্ষ ও মহলের কাছেই অশ্রদ্ধাভাজন ছিলেন না। ছিলেন বরেণ্য ও সর্বজনগ্রহণীয়।
গত দেড় যুগের বাংলাদেশে নিঃস্বার্থ, সাহসী ও তোয়াক্কাহীন অরাজনীতিক আলেম অভিভাবকদের তিনি ছিলেন অন্যতম। যে কোনো ক্রান্তিকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আল্লামা সিরাজুল ইসলাম বড় হুজুর (রহ.), জাতীয় মসজিদের সাবেক খতিব আল্লামা উবায়দুল হক (রহ.) ও আল্লামা নূরউদ্দীন আহমদ গহরপুরীর (রহ.) ভূমিকা ছিল প্রায় একই রকম। আল্লাহর প্রতি সমর্পিত অন্তর নিয়ে ‘আল্লাহ ভরসা’ করেই তারা কথা বলতেন, কাজ করতেন, পথ চলতেন। দুঃশাসক ও অশুভ শক্তির ধারালো অস্ত্রশস্ত্র তাদের সামনে ভোঁতা হয়ে যেত।
দেশ ও স্বাধীনতাপ্রিয় সব দেশবাসীর মতোই আলেম সমাজের জন্যও সময়টা বড় প্রতিকূল যাচ্ছে। অনৈক্য আর আঘাতের ঝড় চারদিকে। ক্ষমতাদর্পীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে অশুভ মিডিয়া। অবস্থান ও ইমেজ সঙ্কটের অনাহুত ছকে টেনে নামানো হচ্ছে সবাইকে। এসময় তাই সত্তরোর্ধ্ব বয়সের অভিভাবকতুল্য শীর্ষ আলেমদের চেহারায় তাওয়াক্কুল ও হিম্মতের উদ্ভাস দেখার অপেক্ষায় আছেন দেশের লাখ লাখ আলেম। সঙ্গত কারণেই তাওয়াক্কুল ও হিম্মতের মূর্ত প্রতীক হজরত গহরপুরীর কথা খুব মনে পড়ছে আজ।
লেখকঃ সম্পাদক মাসিক আল কাউসার,
সহ সম্পাদক,দৈনিক আমারদেশ