(১ম পর্ব) ইসলামে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা : যেহেতু ইসলামের অন্যতম আলোচ্য বিষয় মানুষ, মানুষের পৃথিবী ও সামগ্রিক জীবন। অতএব মানবস্বভাবের স্বাভাবিকতা, পৃথিবীর প্রতিটি পরিবর্তন ও জীবনের প্রতিটি পর্যায় নিয়ে ইসলাম আলোচনা করে। এই আলোচনা আংশিক নয়, বরং পরিপূর্ণ, স্থানিক নয়; বরং বৈশ্বিক এবং কালিক নয় বরং সর্বকালীন।
এ কারণে পৃথিবীর পরিবর্তন, বিশেষ করে সাম্প্রতিক পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক উন্নতি, বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বব্যবস্থা, যোগাযোগ উপকরণ, জীবনযাপনের মান ও মাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে যেসকল অভুতপূর্ব সম্ভাবনা ও নয়া আবির্ভূত সংকট ও সমস্যা দেখা দিয়েছে, এক্ষেত্রে চৌদ্দশত বছর পূর্বের ইসলাম সমস্যাসমূহের সমাধানে ও জীবন ব্যবস্থার পরিচালনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না বলে যে প্রচারণা, আমরা তাকে অবান্তর সাব্যস্ত করতে চাই। কেননা ইসলামের আলোচ্য বিষয় মানুষ ও তার প্রকৃতি, যা অপরিবর্তনীয়।
বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও বিশ্বায়নের অভিঘাতে পরিবর্তন হয়েছে জীবনোপকরণে, জীবনযাপনের মাধ্যম ও পন্থায়। কিন্তু মানবস্বভাব ও মানুষের মানবিক প্রকৃতি চির অপরিবর্তনীয়। আর ইসলাম মাবস্বভাবেরই ধর্ম। অতএব পৃথিবী যতই আধুনিক হোক মানুষকে যেহেতু তার স্বভাব ও প্রকৃতি নিয়েই জীবনযাপন করতে হবে, সুতরাং ইসলাম তার জন্য অনিবার্য প্রতিটি প্রসঙ্গে। মানবস্বভাবের স্বাভাবিকতা ও তার চিরন্তন চেতনার মধ্যেই ইসলামের বসবাস। বস্তুগত ও উপকরণগত পরিবর্তনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তনটি হয়েছে, তা হচ্ছে জ্ঞান ও শাস্ত্রগত। জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, দর্শনসহ বিশ্বব্যবস্থায় সুবিপুল যে পরিবর্তন হয়েছে, তা আগেকার পৃথিবীতে ছিল অকল্পনীয়, অভাবনীয়। অতএব, ইসলামের আওতা এবং ইসলামের কার্যকারিতা জ্ঞান বিজ্ঞানের এতসব বিস্তৃত শাখা, অর্থনীতি, রাজনীতির অভিনব উদ্ভাসন ও ভাবধারা এবং বৈচিত্রময় সংস্কৃতি ও অভূতপূর্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞান- যার সাথে ইসলামের কোন পরিচয় নেই, ইসলাম তাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং কিভাবে তার সাথে সহাবস্থান করবে? এই প্রশ্ন স্বাভাবিক হলেও এর উৎস কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে বিস্তৃত জ্ঞান ও সুস্পষ্ট ধারণার অভাব। কেননা ইসলাম সম্পর্কে পারদর্শী ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়, রাষ্ট্রনৈতিক ও অর্থব্যবস্থাপনা, বিচার ও শাস্তিবিধান, সমর ও জাতীয় নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র ও আভ্যন্তরীন কর্মপদ্ধতি, কর্মকৌশল, বৈশ্বিক শান্তি সহযোগিতা ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা এবং রাষ্ট্র ও ব্যক্তির সম্পর্ক, ব্যক্তির সাথে
ব্যক্তি, ব্যক্তির সাথে সমাজ, ব্যক্তির সাথে বিশ্বজগত এবং ব্যক্তির সাথে তার আত্মার সম্পর্ক, তথা সকল বিষয়ের মৌলিক নীতি ও
পদ্ধতি ইসলাম সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে। জীবনঘনিষ্ট এমন কোন বিষয় নেই যার পূর্ণ সমাধান ইসলাম পেশ করেনি। ইসলাম প্রদত্ত সমাধান সর্বজনীন, সর্বব্যাপী। যা বর্তমান উন্নতি ও উৎকর্ষতার স্রোতধারাকে পরিচালনা করতে পারে এবং জীবনের মাঠের প্রতিটি পরিস্থিতি ও সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম।
ইসলামী আইন সুদীর্ঘ এগার বারোশত বছর পৃথিবীর সবচেয়ে আলোকিত ও বৃহত্তম ভূখণ্ড শাসন করেছে। বিভিন্ন বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও রাজনৈতিব চিন্তানৈতিক মতাদর্শের সাথে পরিচয় লাভ করেছে। কিন্তু ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞান উদ্ভাবন ও গবেষণা, শিল্প ও আবিস্কারে প্রতিবন্ধক হবে তো দুুুরের কথা, বরং তার পৃষ্টপোষকতা করেছে, সৃষ্টি করেছে নবতর গতিশীলতা । অতএব ইসলাম এ যুগের জ্ঞানগত প্রণোদনা ও সভ্যতার সীমাহীন গতিময়তাকে পরিচালনা করতে পারে এবং এ কাজে সে পুরোটাই সক্ষম। ইসলামের এই সম্ভাব্য ভূমিকায় ধর্মনিরপেক্ষতার যুক্তি আনা অবান্তর। কেননা ইসলাম নিছক ইবাদত বন্দেগী কেন্দ্রিক কোন ধর্ম নয় । বরং জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে এবং প্রতিটি তৎপরতাকে কেন্দ্র করে ইসলাম আবর্তিত। অতএব প্রতিটি ক্ষেত্রে সমাধান ও পথনির্র্দেশের যে অভাব, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিদ্যমান কিংবা অন্য ধর্মসমূহে বর্তমান, ইসলামের বেলায় তা নয়। আর ইসলাম মানতে হলে মুসলমানদেরকে তা মানতে হয় পরিপূর্ণভাবে।
ইসলামী আইনে অন্যধর্মের অনুসারীদের অধিকার খর্ব হওয়ার কোন প্রশ্ন নেই। কারণ ইসলাম অনিবার্যভাবেই তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অন্যান্য মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করে। ইসলাম মানবজাতিকে মানুষ হিসেবে খণ্ডিতভাবে দেখেনা। মানবজাতিকে সার্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাই ইসলামী চিন্তাধারা। এ কারণেই আল্লাহর পরিচয়ে ইসলাম বলে রাব্বুল আলামিন, নবীর পরিচয়ে রাহমাতুল্লিল আলামীন আর কুরআনের পরিচয়ে যিকরা লিল আলামিন। মানুুষের এখতিয়ার আইন নয়; কিন্তু আইন যেহেতু জীবনকে একটি কাঠামো ও পদ্ধতির ভেতর স্থিত রাখতে চায়, আর অপরদিকে জীবন যেহেতু প্রতিনিয়ত নতুন অভিব্যক্তি, বৈচিত্রময় ভাবধারা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেতে চায় – অতএব উভয়ের মধ্যে সমন্বয় অপরিহার্য। এই সমন্বয়ের চাহিদা থেকেই আইনের ইতিহাসের সাথে সংস্কারের ইতিহাসও সমান্তরালভাবে প্রবাহিত। জীবনের সাথে আইনের সহযোগিতা নিশ্চিত করা কিংবা আইনের ছাদের নিচে জীবনের জায়গা করার অঙ্গীকার ব্যবিলনে প্রবর্তিত হামুরাবি কোর্টে পরিবর্তন ও সংস্কার এনেছে, রোমান ল এম্পায়ারে সংস্কার ও পরিবর্তন এনেছে, পরিবর্তন ও সংস্কার এনেছে ইউরোপীয় আইনে। ফরাসী বিপ্লবের পর সেই আইনে ব্যাপক রদবদল এনে তার আধুনিক পরিণতি নিশ্চিত করা হলেও সংস্কারের ধারা থেমে নেই, তা আজও অব্যাহত। পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আইনসমূহের মূল কাঠামো উলটপালট হয়েছে, নীতিমালা হ্রাস বৃদ্ধি ঘটেছে, অন্য আইনের সাথে দান গ্রহণের ঘটনাও ঘটেছে। এমনও হয়েছে যে, সংস্কারের পরে আইনের যে চেহারা দাড়ালো, তা যেন সম্পূর্ণ নতুন এবং সংস্কারপূর্ব অবস্থার সাথে কোন পূর্ব পরিচয় নেই।
কোন কোন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতায় এমনও ধরা পড়েছে যে, সংস্কারের আগেই আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাটি অপেক্ষাকৃত উত্তম ছিল। কিংবা সংস্কারের মাধ্যমে যে ধারাটি প্রবর্তন করা হলো, তা নিছক জাতিবিশেষের জন্য উপযোগি, বৈশ্বিক ক্ষেত্রে এর কোন উপযোগিতা নেই। বিংবা অন্য জাতির জন্য তাকে গ্রহণ করা ক্ষতির কারণও হতে পারে। এমনও দেখা গেছে যে, আইন প্রণেতাদের ব্যক্তিগত ঝোক ও পছন্দ অপছন্দ আইনের বিভিন্ন ধারার মর্যাদা অধিকার করেছে, কিংবা সময় এবং পরিস্থিতির প্রণোদনা তাদেরকে তাড়িত করেছে এমন ধারা প্রবর্তন করতে, পরিস্থিতির পরিবর্তনে যা একান্তই অকার্যকর বিবেচিত হয়েছে। এ কারণে দেখি গ্রিক দার্শনিক জ্যানুফ্যানিস আইনাদর্শ স্থির করলেন বিশ্বের সমস্ত বস্তুর একত্ব ও অপরিবর্তনীয়তার স্বপ্নোকল্পিত দর্শনকে। এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিল হেরাল্কিতুসের দর্শনে তিনি আইনাদর্শ স্থির করলেন প্রতিটি বস্তুর আপেক্ষিকতাকে। তিনি সৃষ্টির সর্বত্রই প্রত্যক্ষ করলেন বিপরীতমুখিতা। অথচ এ উভয় আইনাদর্শ মূলত প্রান্তিক। এলেন পারমেনিদেস। তাই আইনও হবে অজর, অমর।
অত:পর এলেন এমপিদোকিস। তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিন্তা পেশ করলেন। তার মতে পানি, আগুন, মাটি ও বাতাস এই চার উপাদানের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় বস্তুনিচয় আবর্তিত এবং আত্মা কর্মঅনুযায়ী দেহ ভ্রমণ করে। সুতরাং পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী একই আত্মার আধার। বাস্তবিক অর্থে এই দর্শনের আলোকে জীবন পরিচালনার কোন আইনী ভিত্তি দাড়াতেই পারে না। এই চরম প্রান্তিকতা ও একদেশদর্শীতা দেখা গেছে প্রোতাগোরাসের মধ্যে (৫০০-৪৩০ খৃ, পূর্ব) দিমাক্রিতোস (৪৬০-৩৭০ খৃ, পূর্ব) পিনদার (৫১৮-৪৫৬ খৃ, পূর্ব) স্কাইলাস (৫২৮-৪৫৬ খৃ, পূর্ব) সক্রেটিস (৪৭০-৩৯৯ খৃ, পূর্ব)
এমনকি বিশ্বখ্যিাত রিপাবলিক ও ল’জ এর প্রণেতা মহামতি প্লেটো কিংবা অবিসংবাদিত আইন প্রণেতা এরিষ্টোটলের আইনাদর্শেও । কেননা তাদের কাছে জীবন জিজ্ঞাসার কোন সদুত্তর ছিল না। যার উপর আইনাদর্শের কাঠামো দাড়াবে। আধুনিক পৃথিবীতে দেওয়ানী আইনের জনকখ্যাত বারটোরাস, আন্তর্জাতিক আইনের প্রোটিইয়াস, ফরাসী আইনের পোথিয়ার, জার্মান আইনের স্যাভিগনি, বৃটিশ সাধারণ আইনের কোক, আমেরিকার সংবিধান আইনের মার্শাল- প্রত্যেকেই মূল্যবোধ আইনাদর্শের প্রশ্নে সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে আবদ্ধ। আইন প্রণেতাদের জন্য এমনতরো পরিণতি এড়ানো সম্ভব ছিল না। সম্ভব ছিল না এজন্যই যে, যেহেতু তারা মানুষ, এবং মানুষ একই সাথে চতুর্দিক পরিদর্শন করতে পারে না। যে অতীত ভুলে যায়, বর্তমান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে অনুমান এবং ধারণা ছাড়া কার্যত তার কোন জ্ঞানই নেই। প্রবৃত্তির তাড়না থেকে মানুষ যেহেতু নিরাপদ থাকতে পারেনা, অতএব আইন প্রবর্তনের গুরুদায়িত্ব তার হাতে দিলে আইনের নানা পর্যায়ে প্রবৃত্তি তার উপর জয়ী হওয়া স্বাভাবিক, ফলে সেই আইন পৃথিবীর জন্য নতুন বিপর্যয়ের জন্মদাত্রী হতে বাধ্য। যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় দগদগে ক্ষতের মতো মানবতার দুঃখরূপে বর্তমান। আজকের পৃথিবীতে সভ্যতার সংকট, জীবনাদর্শের দারিদ্র, মানবাত্মার হাহাকার ও জীবনজিজ্ঞাসার জবাবের অনুপস্থিতির উৎসমূলে রয়েছে বস্তুবাদী দর্শন ও আইন। এমনকি এই আইনে মানুষ কতটা মানুষ- এই মীমাংসা না থাকা ভয়াবহ জটের সৃষ্টি করেছে। এর সবই মানুষের সীমাবদ্ধতা না বুঝা এবং যে কাজটি সৃষ্টিকর্তার, সেটা সৃষ্টির হাতে তুলে দেয়ার অনিবার্য পরিণতি। (চলবে)
লেখক : কবি গবেষক