তার ডাকনাম আবদুল্লাহ, উপনামের ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। কারও মতে, আবু আমর, আবার কেউ কেউ বলেন আবু রাওয়াহা, কেউ বা মোহাম্মদ বলেছেন। ল্বকব বা উপাধি, শায়িরুর রাসূল, রাসূলের (সা.) কবি। আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) তৃতীয় আকাবায় ৭০ জন মদিনাবাসীর সঙ্গে উপস্থিত থেকে ইসলাম কবুল করে রাসূলের (সা.) হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্মের সুশীতল ছায়ায় প্রবিষ্টের পরবর্তী জীবনে তিনি পবিত্র মদিনায় ইসলামের দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তার দ্বীনি দাওয়াত মদিনার লোকজন সাদরে গ্রহণ করে তারাও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন।
তিনি ছিলেন স্বভাব কবি। তৎকালীন যুগে উপস্থিত কবিতা রচনায় তার সমপর্যায়ের কেউ ছিল না। যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) বলেন, ঝটপট কবিতা বলার ক্ষেত্রে আমি আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) অপেক্ষা আর কাউকে দেখিনি। আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) ও কবি হাসসান (রা.) ছিলেন রাসূলবিদ্বেষী কবিদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তারা কবিতা রচনার মাধ্যমে ইসলাম ও রাসূল বিদ্বেষীদের দাঁত ভাঙা জবাব দিতেন। একবার আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) মসজিদে নববীতে উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (সা.) আগে থেকে সেই মসজিদে একদল সাহাবির সঙ্গে বসে দ্বীনি আলোচনা করছিলেন। রাসূল (সা.) আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) কে দেখে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, হে আবদুল্লাহ! তুমি আমাদের কিছু কবিতা শোনাও। তখন তিনি এ কবিতাটি আবৃত্তি করলেন, ‘সফল ও কৃতকার্য সেই ব্যক্তি, যে মসজিদ নির্মাণ করে। উঠতে-বসতে কোরআন পাঠ করে ও রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করে।’ রাসূল (সা.) গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কবিতা শুনলেন তার সঙ্গে কবিতায় সুর মেলালেন। রাসূল (সা.) তার কবিতা শুনে খুশি হলেন এবং মুগ্ধ হয়ে হাসি দিয়ে তার জন্য দোয়া করলেন। ‘আল্লাহ তোমাকে অটল রাখুন’। রাসূল (সা.) তার কবিতা আবৃত্তি করতেন।
অষ্টম হিজরির ‘জমাদিউল আওয়াল’ মাসে মুতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন যায়েদ ইবনে হারিসা (রা.)। রাসূল (সা.) যায়েদ (রা.) এর নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্য পাঠান। যুদ্ধে প্রেরণকালে রাসূল (সা.) তাদের উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে বলেন, এ যুদ্ধের সেনাপতি হলেন যায়েদ (রা.)। তিনি শহীদ হলে জাফর ইবনে আবী তালিব তার পদে আসীন হবেন। জাফর শহীদ হলে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এ যুদ্ধের সেনা অধিনায়ক হবেন। আর তিনিও যদি শাহাদতের পেয়ালা পান করেন তোমরা পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের আমির বানিয়ে নেবে।
রণক্ষেত্রে এসে কোরাইশদের সৈন্যসংখ্যা দেখে মুসলিম সৈন্যরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। তখন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) মুসলিম সৈনিকদের উদ্দেশে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, হে সৈন্যবাহিনী! তোমরা এখন শত্রুর মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছো; অথচ তোমরা সবাই শাহাদতের তীব্র কামনা-বাসনা নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে বের হয়েছো। আমাদের ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমরা শত্রুদের সৈন্যসংখ্যা ইত্যাদি দেখে ভয় পাব কেন? কারণ আমরা তো শত্রুর সঙ্গে শক্তি, সংখ্যা ও আধিক্যের দ্বারা যুদ্ধ করব না। আমরা যুদ্ধ করব ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে। আর শুনে রাখো; এখন আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে, হয় ‘বিজয় বা গাজি’। নয়তো শাহাদত’। এছাড়া তৃতীয় কোনো পথ আমাদের জন্য খোলা নেই। উপস্থিত সৈন্যদের উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। সবাই আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে ভয়ভীতি পেছনে ফেলে শাহাদতের জন্য আত্মনিয়োগ করেন।
লড়াই শুরু হলে প্রথম জায়েদ (রা.) শহীদ হন, এরপর জাফর (রা.) শহীদ হন। অতঃপর ইসলামের ঝাণ্ডা আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) নিজ হাতে তুলে নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে অসীম বীরত্বের সঙ্গে সামনে এগিয়ে চলেন। কয়েকজন কাফের সৈন্যকে তরবারির আঘাতে টুকরো করে ফেলেন। শত্রুরাও থেমে থাকে না। এক পর্যায়ে শত্রুপক্ষের কয়েকটি তীর তার শরীরে বিদ্ধ হয়। রক্তাক্ত অবস্থায়ও তিনি তার সৈন্যদের শত্রুদের মোকাবিলার আহ্বান জানান। তার দেহ থেকে রক্ত ঝরতে ঝরতে এক পর্যায়ে শরীর থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যায়। নিস্তেজ দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার শাহাদতের পরে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনেন।
লেখক : এহসান বিন মুজাহির : সাংবাদিক, কলাম লেখক, আলেম