আতিকুর রহমান নগরী ::
আমাদের দেশের রাজনীতির গতিধারা স্বতন্ত্র। রাজনীতিবিদরাও স্বতন্ত্র। স্বতন্ত্র এখানকার মানুষের প্রকৃতি ও পরিবেশ। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রকৃতির গতি প্রবাহমান। ঋতরু আবর্তনে পাল্টে যায় এখানকার প্রকৃতির রূপ। প্রকৃতির বিরূপে আমার দেশের মানুষরা মনোবল হারায়না। কাল বৈশাখী ঝড়ের কালো থাবা কিংবা জলোচ্ছ্বাসের করালগ্রাসেও দুর্গত দুর্ভলরা আশা না হারিয়ে বুকে আশা বাঁধে। ধ্বংসস্তুূপের ওপর শীশাঢালা শক্ত প্রাচিরের ন্যায় মাথা উঁচু করে দাঁডায়। যালিম শাহির নির্যাতনে এখানকার মানুষ প্রতিবাদের হুংকার ছুড়তে ভয় করে না। স্বাধীনচেতা এখানকার মানুষ। আত্মনির্ভর ও স্বাধীন থাকাটাই এ জনপদের মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস। আমাদের দেশের রাজনীতি আত্মনির্ভরশীলতার, পরাধীনতার নয়। সীমাহীন বঞ্চনা ও দারিদ্রতার কষ্ট সহ্য করেও বাংলাদেশের মানুষ পরাধীন ও দাসত্বকে স্বীকার করে না। বাংলাদেশের রাজনীতির অশ্র“ভেজা এই অভিব্যক্তির কথা সবার মনে আছে। মনে আছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলনকারী বীর যোদ্ধাদের কথা। সাতই নভেম্বরের বিপ্লব আরেকবার সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এই বিপ্লব দেশপ্রেমি সিপাহি-জনতার সম্মিলিত প্রয়াস। এ বিপ্লব ছিল জাগ্রত চেতনার। পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার এক দীপ্ত প্রেরণার। পরাস্ত করা হয় সকল ষড়যন্ত্র। সাতই নভেম্বর সেই থেকে ঐতিহাসিক বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবময় হয়ে আছে। সাতই নভেম্বরের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সূচিত হয় রাজনীতির নতুন আরেক ধারা। রাজনীতির প্রকৃত অর্থ স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এক কথায় সাতই নভেম্বরের পরে থেকে বাংলাদেশে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে দু’টি দিন সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল। এ দু’টি দিন সম্পর্কে আশা করি সবার কমবেশি জানা আছে। তন্মধ্যে সাতই নভেম্বর হচ্ছে অন্যতম দিন। অপরটি ২৬ মার্চ। এ দুটি দিন জাতির এক সময় ক্রান্তিকাল ছিল। আর এ ক্রান্তিকালে একজন বীর সেনানীর নাম নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। তিনি হলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে তাঁর সুনাম-সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে সৈনিকদের মাঝে তাঁর সুনাম-সুখ্যাতি ও মর্যাদা ছিল ঈর্ষনীয় ও অবর্ণনীয়। কারণ এ দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি ছিল তাঁর গভীর মমত্ব ও স্নেহবোধ। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাঁর ভূমিকা ছিল অতন্দ্র প্রহরীর মতো। এটাই সময় ও কালের যাতাকলে বিরূপ হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হন। ইতিহাস ও যুগের ধারাবহিকতায় বাংলাদেশে রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র চলে আসছিল। নবাব সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে মীর জাফরের ষড়যন্ত্র যুগান্তকারী ঘটনা। ১৯৭৫ খৃস্টাব্দের ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান একটি পূর্ব-পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ছিলেন এর মূল নায়ক। সেদিনকার অভ্যুত্থানে জনপ্রিয় জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে রাখা সম্ভব হয়নি।
সাতই নভেম্বরের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান এর সফল অভ্যুত্থান। এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব দিগন্তে উদিত হয় লালিমা মাখা এক নতুন সুর্য। ব্যবধান ছিল মাত্র চার দিন। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ খৃস্টাব্দে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আংশিক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ছলে-বলে কৌশলে তিনি দখল করে নেন রাষ্ট্রক্ষমতা। জনগণ বুঝতে পারে এ অভ্যুত্থান জনস্বার্থে, সার্বভৌম ও স্বাধীনতা-বিরোধী। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয় ভারতের বেতার থেকে খালেদ মোশাররফকে বাহ্বা জানানোর মাধ্যমে। আমজনতা হতবাক হয়ে পড়ে ৪ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের ভাই রাশেদ মোশাররফ ও তাঁর নেতৃত্বে রাজপথে মিছিল করতে দেখে। জাগ্রত-জনতার চেতনার অনুভূতিতে আঘাত হানল ঘটনপ্রবাহ। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌম রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে গর্জে উঠল জাতীয় ঐক্য। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তাতে উদ্বুদ্ধ হল। সকলের একই কণ্ঠ দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আজ আবার বিপন্ন হতে চলেছে। আমাদের জাতীয় চেতনা ও অস্তিত্ব এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এমন পরিস্থিতি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। দেশদরদী সিপাহী-জনতার সংহতি এ সময়ের সাহসী পদক্ষেপ। এক অমিত শক্তিতে জাতি রুখে দাঁড়াল। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেশপ্রেমিক সিপাহীরা বেছে নিল নেতৃত্ব দেয়ার জন্য স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষক জিয়াউর রহমানকে। খালেদ মোশাররফের শিকল চূর্ণ করে বীরদর্পে মুক্ত করা হল জিয়াউর রহমানকে। সফল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খর্ব হল খালেদ মোশাররফের পরিকল্পিত সকল ষড়যন্ত্র। তিনি এখন সিপাহী-জনতার কাতারে। জাতির আশা-আকাংখার সঙ্গে তিনিও একাকার হয়ে গেলেন। জনতা তাঁকে গ্রহণ করে নিল জাতির কর্ণধার হিসেবে। সাতই নভেম্বর উৎকণ্ঠিত জাতি আবার শুনতে পেল সেই উদাত্ত কণ্ঠস্বর( “প্রিয় দেশবাসী! আসসালামু আলাইকুম। আমি মেজর জিয়া বলছি।” ৭১-এর ২৬ মার্চ জাতি এ কণ্ঠেই শুনেছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। সাতই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। বিজয় মিছিলে সিপাহীরা ট্যাংক ব্যবহার করে। উৎফুল্ল জনতা ট্যাংকে ফুলের মালা পরে নিয়ে ট্যাংকে উঠে নেচে-গেয়ে আনন্দ-উল্লাস করে। সেদিন সমস্বরে শ্লোগান দেয়া হয় “নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার, বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।” সেদিনকার উচ্ছ্বসিত আনন্দ শহর, বন্দর, গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। সে এক অভূতপূর্ব আনন্দ। সাতই নভেম্বরের ঘটনাক্রম নিঃসন্দেহে বিপ্লবাত্মক। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি তাহজিব-তমদ্দুনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে। সাতই নভেম্বরের পূর্বেকার বাংলাদেশ সাতই নভেম্বরের পর থেকে স্বতন্ত্র হয়েওঠে। এই স্বতন্ত্র সুস্পষ্ট হয় অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে। সুস্পষ্ট হয় আন্তর্জাতিক পর্যানিয়েও। সাতই নভেম্বরের পূর্বে বাংলাদেশে একদলীয় শাসন-শোষণের যে দোর্দাণ্ড প্রতাপ ছিল তার অবসান ঘটে। পর্যায়ক্রমে রাজনীতি হয়েওঠে বিকশিত। সকল দল মতের লোক স্বতন্ত্রভাবে স্ব স্ব মতার্দশ প্রচার প্রসারের সুযোগ পায়। কণ্ঠরুদ্ধ সংবাদপত্রের সংখ্যা যেমন বিস্তার লাভ করে তেমনি মুখে ফোটে নানান কথা। পায় অবারিত স্বাধীনতা। সংকীর্ণ বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সামাজিক পর্যায়ে বৃহৎ পরিধিতে পরিশীলিত হয় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। ধর্ম-নিরপেক্ষতার জায়গায় এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের বোধ-বিশ্বাসের বাণী উচ্চারিত হয় সংবিধানে ‘সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ নামে আরম্ভ করছি।’ সংবিধান থেকে বিদায় নেয় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির। একদলীয় শাসনের পরিবর্তন ঘটে। প্রতিষ্ঠিত হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র। সাতই নভেম্বরের পর থেকে বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের মান-মর্যাদা, শান-শওকত হয় উর্ধ্বগামি। ইঙ্গ-সোভিনিয়েত বলয় থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের সবখানে আলাদা মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। আঞ্চলিক পর্যায়েও বাংলাদেশের অবস্থান খুবই শক্ত। দক্ষিণ-এশিয়ার সহযোগি সংস্থা ‘সার্ক’-এর রূপকার বাংলাদেশ। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের রয়েছে সীমাহীন গুরুত্ব। জনকল্যাণের লক্ষ্যে যারা সমাজ পরিবর্তনের উদ্যোগি, জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে আগ্রহী, তাদের কাছে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস নতুন করে উৎসাহ যোগাবে। আর এই উৎসাহের বাতিঘর থেকে আলো সঞ্চয়ী ভাবনাময়, দেশপ্রেমী তরুণদের দিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের শত কোটি জনতা। তুমি পারবে হে তরুণ দেশ ও জাতিকে তার লক্ষ্যপানে পৌছিয়ে দিতে। তবে তোমাকে এগুতে হবে দুর্দান্ত গতিতে। দেশ তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পেছনে তাকাবার সময় নেই। এসো হে তরুণ আমি ও তুমি এবং আমরা সব তরুণ মিলে দেশ ও জাতির পাশে দাঁড়াই।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট