জুলফিকার মাহমুদী ::
প্রথম পর্ব লিখার পর অনেক বন্ধু ফোন করেন ৷ অনেকে মোবাইলে এসএমএস, ফেসবুক চ্যাটে অনেকে মোবারকবাদ জানিয়েছেন ৷ পেয়েছি লেখনির ক্ষেত্রে অনেক সাহস, অনেক শক্তি, অনেক প্রেরণা ৷ অনেকে আবদার করেছেন যেন পূর্ণাঙ্গ ব্ক্তব্যটি তুলে ধরি ৷ কিন্তু সময়ের অভাব ও শারিরীক অসুস্থতায় আমাকে যেন উঠতে দিচ্ছে না ৷
অনেক বন্ধুমহল থেকে গালিও পেয়েছি ৷ তবে গালির সংখ্যা অতীতের চেয়ে তুলনামূলক কম হলেও গালির ভাষা ব্যবহার দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারি না ৷ অনেক দ্বীনী ভাই যাদেরকে ভাল করেই চিনি; তাদের নিম্নমানের গালির ভাষা দেখলে মনে হবে যেন বস্তিতে লালিত, কলোনিতে পালিত ৷ তাদের গালিতে মোটেও দুঃখ পাইনি শুধু আফসুস করেছি যদি উনারা বুঝতেন বিষয়টি কি বা কোনো কমাশিসার প্রয়োজন ৷
এক ভাই বললেন “কমাশিসা নাকি আকাবির আসলাফের দুশমন” আমি উনাকে বললাম- ভাই! কমাশিসার কোন কথাটি আকাবির বিরোধী? কমাশিসা কি এমন কোন কাজ করেছে যে আকাবিরদের মত ও পথের উল্টো? আপনি আকাবির বলতে কাদের বুঝাচ্ছেন? উনি আমার মূল কথাটির উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে কথা বলেন! ব্যক্তি আক্রুশে কথা বলেন!
এক পর্যায়ে আমি উনাকে বললাম, ভাই! বাংলাদেশে আকাবির-আসলাফের দুটি সিলসিলা প্রসিদ্ধ আছে ৷ একটি হলো মাদানী রহ.’র সিলসিলা, আরেকটি হল থানভী রাহ.’র সিলসিলা ৷ তাঁরা দু’জনইতো সংস্কার ও ঐক্যের পক্ষে ৷ শিক্ষা সংস্কার বিষয়ে উভয়ই প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন ৷ মাদানী রহ. তো ভিন্নদেশী ও ভিন্নভাষী হওয়ার পরও বাংলার উলামায়ে কেরামের জন্য “নেসাবে তালিম” নামে আলাদা একটি রিছালা লিখেছেন ৷ এবং এ কথাও বলেছেন, আমার ঐ নেসাব পরিবর্তনযোগ্য ৷
আমাদের উলামায়ে কেরামের জন্য উচিত প্রতি তিন বছর (সময়ের চাহিদায় কম বেশি হতে পারে) অন্তর অন্তর যুগচাহিদায় পরিবর্তনযোগ্য ৷ তো আপনার অভিমত কি? আমার ঐ কথার উত্তর তাঁর কাছ থেকে পাই নি ৷ আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে পাব কী না সন্দেহ আছে। শিক্ষা সংস্কারে অনীহা কেন? ঐক্য প্রক্রিয়ায় বাধা কোন জাগায় ? বৃহত্তর স্বার্থে জন্য কি আমরা নিজ পদপদবীর ক্ষুদ্রতম স্বার্থকে বিসর্জন দিতে পারি না? ইসলাম ও মুসলমানের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে পারি না? ﻭﻻ ﺗﻔﺮﻓﻮﺍ এর ওয়াজ কি শুধু জনগণের জন্য ? আমরা করবো আর তারা শুনবে! তাহলে কি আমরা اتأ ﻤﺮﻭﻥ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﺑﺎﻟﺒﺮ ﻭﺗﻨﺴﻮﻥ ﺍﻧﻔﺴﻬﻢ এর মিসদাক নই ?
প্রিয় পাঠক! অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে কথাগুলো বললাম ইসলাম ও মুসলমানের বৃহত্তম স্বার্থকতা বিবেচনায় ৷ আল্লাহ আমাদের বুঝার তৌফিক দান করুন ৷ আমিন ৷
খতিবে আজম আল্লামা সিদ্দীক সাহেব রহ.’র দ্বিতীয় কথা ৷ মাদরাসা শিক্ষাকে জাগতিক শিক্ষাবিহীন সাজালে পুর্ণাঙ্গ ইসলামি শিক্ষার রূপ পাওয়া যাবে না ৷ ইসলামি শিক্ষাকে জাগতিক শিক্ষার সমন্বয়েই সাজাতে হবে ৷ হিযরতের পর মদীনাতে “তাবীরে নাখল” এর ঘটনাই প্রমাণ করে জাগতিক শিক্ষাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই ৷ তাই আমার মতে মাদরাসা শিক্ষার স্তরবিন্নাস করতে হবে ৷
আমার মতে বাংলাদেশ উলামায়ে কেরামকে মুসলমানদের চাহিদামাফিক তিনটি স্তর করা যেতে পারে ৷ একটি হবে যথাক্রমে (ক) প্রথমিক স্তর (খ) মাধ্যমিক স্তর (গ) উচ্চতর বা কামিল স্তর ৷৷ প্রথমিক স্তর হবে পাঁচ বছর মেয়াদী ৷ মাধ্যমিক স্তরও হবে পাঁচ বছর মেয়াদী ৷ উচ্চতর বা কামিল, এখানে দুটি শাখা থাকবে। একটি হবে স্নাতক সমমর্যাদার এটি হবে চার বছর মেয়াদী ৷ আরেকটি হবে স্নাতকোত্তর সমমর্যাদার ৷ এটি হবে দু’বছর মেয়াদী ৷মোট ষোল বছর মেয়াদীর এ শিক্ষাকার্যে কোনক্রমেই রাষ্ট্রীয় শিক্ষাকে এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। নিম্নে আমি তার একটি রূপরেখা পেশ করছি ৷
প্রথমিক শিক্ষার রুপরেখা :
(ক) পাঁচ বছরের কম কোন শিশুকে ভর্তি করা যাবে না ৷ (খ) সহজ-সরল শিশুবান্ধব নেসাব হতে হবে ৷ (গ) শিক্ষককে অবশ্যই আন্তরিকতার সাথে পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে ৷ (ঘ) ইসলামি বুনিয়াদি শিক্ষা তথা ফারাইজ শিক্ষা থেকে যেন একজন মুসলমান বাচ্চাও অপরিচত না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে ৷(এজন্য কমাশিসার দাবী হল অলিগলিতে টাইটেল না খুলে গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায় ইবতেদায়ী মাদরাসা গড়ে তোলা ৷ যাতে মুসলিম বাচ্ছাকে এনজিও সহ বিভিন্ন মিশনারিরা নিয়ে বিধর্মীদের শিক্ষা বা ধর্মহীন শিক্ষায় গড়ে না তোলে ৷ যে সমস্ত এলাকায় এসব প্রতিষ্ঠান নেই এ সমস্ত এলাকায় কওমি বোর্ড কর্তৃক কওমি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা ) (ঙ) কোনমতেই কুরআন শরীফ শুদ্ধ না হলে উপরের ক্লাসে তারাক্কী না দেয়া ৷ এজন্য প্রথমে হরফের পরিচয়, অত:পর শব্দাবলী যুক্ত করার নিয়ম ও উচ্চারণ শিখিয়ে নাযেরা পড়াতে হবে ৷ অত:পর প্রয়োজনীয় সুরাসমূহ মুখস্ত করাতে হবে ৷ (চ) নামায, রোযা অজু, গোসল, ইত্যাদির মাসাইলগুলো নিজ ভাষায়, সরল ও সহজ পন্থায় বুঝাতে হবে ৷ (ছ) ইসলামি ইতিহাসের প্রাথমিক পরিচয় ও নিজ দেশের পরিচয়, পরিবেশ পরিচিতি, ইসলামি শিস্টাচার এর প্রথমিক ধাপ সুন্দরভাবে পড়ানো ৷ اتأمرون الناس بالبر وتنسون انفسهم وانتم تتلون الكتاب (জ) আরবি সাহিত্যের জন্য আরবি প্রাথমিক শব্দাবলীর পরিচয় ও ব্যবহারবিধির সংক্ষিপ্ত নিয়ম, লিখনির মাধ্যমে পাঠদান ব্যবস্থা করতে হবে ৷ (ঝ) সময় ও চাহিদা মোতাবিক মেধা বিবেচনায় তাদের “মননশীল পরিবেশ” গড়তে হবে ৷ প্রয়োজনে বিনোদনমূলক খেলা বা শরীরচর্চার ব্যবস্থা করতে হবে ৷ (ঞ) গব়িব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা রাখা উচিৎ ৷ (ট) ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা ইউনিফর্ম, পরিচয়পত্র করা উচিত বলে মনে করি ৷ (ঠ) শিশুদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে ৷ (ড) শিশু-কিশোরদের উপর বদ আসর পড়বে এমন আচরণ উস্তাদ মহতারামকে পরিহার করতে হবে ৷ (ঢ) ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য মেধা বিবেচনায় হালকা তৈরী করতঃ নিয়মিত সবক পড়া, অনুশীলন, লিখার ব্যবস্থা করা ৷ (ণ) সাপ্তাহিক/মাসিক/সাময়িক পরীক্ষা নিয়ে উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পুরস্কার ব্যবস্থা করা ও অকৃতকার্য ছাত্রদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে তাদের অকৃতকার্যের কারণ নির্ণয়ের পর সংশোধনীর ব্যবস্থা করা ৷ (ত) নিয়মিত উপস্থিতি তদারকীর জন্য শ্রেণিশিক্ষক নিয়োগ করা ও এর জন্য উস্তাদ-অভিভাবক সমন্বয় মতবিনিময় করা ৷ কারো কোন অপরাধ সংগঠিত হলে ইজতেমায়ীভাবে সংশোধনীর ব্যবস্থা এমনভাবে করা যাতে একজনের ওসিলায় আরো অনেকে সংশোধন হয়ে যায় ৷ এবং ছাত্রদের আত্মমর্যাদায় আঘাত আনে এমন কাজ পরিহার করা ৷ সকল ছাত্রদের প্রতি ইনসাফ ও আন্তরিকতার সাথে আদব শিক্ষা দেয়া ৷
(বাকি অংশটি পড়ুন তৃতীয় পর্বে ৷)
লেখক : বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও গবেষক