কওমি মাদরাসা নেসাব সংস্কারের কথা বলেছে কমাশিসা প্রথম কয়েকটি দফায়।আমরা সবাই আঁতকে উঠি। আমাদের আকাবিররা গণিত,ইংলিশ নেসাবে তালিকাভুক্ত করেন নি। আমরা কোন সাহসে আকাবিরদের রেখে যাওয়া আমানতে হাত দিব?
আপনার কথা মেনে নিলাম। দাওরা-মিশকাতে গণিত, ইংলিশ পড়ানোর প্রয়োজন নেই! কিন্তু আমাদের আকাবিরদের মানহাজ ঠিক রেখেও তো নেসাব সংস্কার করতে পারি। উদাহরণস্বরুপ: বর্তমান যুগে প্রতি মূহূর্তে কওমির আলেমরা দলীলের মুখাপেক্ষি। এখন কোন মাসআলা বললেই জনসাধারণও হাদিসের দলীল জানতে চায়। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ আলেম-ছাত্র মুখ খোলতে পারে না। অথচ দাওরাযে হাদিসে আমাদের দিন-রাত আবর্তিত হয় হাদিসকে ঘিরে।কারণ আমরা প্রসিদ্ধ ছয় কিতাব পড়ি,সেগুলোর একটিও আমাদের মাযহাবের নয়।আমাদের মাযহাবের তাহাবী শরীফ পড়ানো হয়; কিন্তু তা এমন অবহেলার স্বীকার যে,স্বয়ং যিনি পড়ান তিনিও বলতে পারেন না যে, কিতাবটির পূর্ণ নাম কি এবং কোন বিষয়ে লিখিত! আথচ তাহাবী হল ফিকহে হানাফীর দলীলের অনেক বড় খাজানা।
কেউ যদি তাহাবী শরীফ নিয়মিত মুতালায় রাখে,তাহলে মতভেদপূর্ণ মাসআলায় দলীলের জন্য দেয়ালে মাথা মারার প্রয়োজন পড়বে না। আমরা বুখারী শরীফ পড়িয়ে শায়খুল হাদিস হই। যারা বুখারী পড়ান,তারা তাহাবী পড়ালে সমস্যা কি? নিজের মাযহাবকে তাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপন করবেন ছাত্রদের সামনে।
দাওরা হাদিসে ইবনে মাজাহ শরীফ পড়ানো হয়।তাও আবার “কিতাবুত তাহারাত” পর্যন্ত।চল্লিশ পাতার মত পড়ানো হয় সারা বছরে। এর ভিতরে রয়েছে অনেকগুলো জাল হাদীস!যেগুলো পড়াতে উস্তাদদের কত কসরত! আমরা কি পারি না ইবনে মাজাহকে বাদ দিয়ে ইমাম আবু হানিফা লিখিত “কিতাবুল আছার” পড়াতে? উক্ত কিতাবটি হল ইসলামের ইতিহাসে অধ্যায় এবং পরিচ্ছেদ আকারে সুবিন্নস্ত করে লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ।এছাড়া আমরা যার তাকলীদ করি, তাঁর লেখা কিতাব পড়লে তার মাযহাব সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যাবে।
পুরো দরসে নিজামীতে উসূলে হাদিসের একটিমাত্র কিতাব পড়ানো হয়। হাফেজ ইবনে হাজার আসক্বালানী রহ. লিখিত “শরহু নুখবাতির ফিকার”। অথচ হাফেজ ইবনে হাজার হানাফীদের ক্ষেত্রে তাআসসুবের স্বীকার ছিলেন। কেউ যদি উনার লিখিত “লিসানুল মিজান” থেকে হানাফী কোন ইমামের জীবনী পড়েন, তাহলে বুঝতে পারবেন। বিশেষ করে আপনি ইমাম আবু হানিফার অন্যতম শিষ্য হাসান বিন যিয়াদের জীবনী খোলে দেখেন-হাফেজ ইবনে হাজার তার ব্যাপারে কি বলেছেন!
এজন্য “শরহে নুখবার” জায়গায় জায়গায় হাফিজ ইবনে হাজার পদস্খলনের স্বীকার হয়েছেন এবং হানাফীদের নামে ভুল কথা চালিয়ে দিয়েছেন।
আমরা কি পারিনা “শরহে নুখবাহ” বাদ দিতে।তার পরিবর্তে হানাফী কোন ইমামের লিখিত “উসূলে হাদীসের” কিতাব পড়াতে। আমরা যদি মোল্লা জিওনের নূরূল আনওয়ার দুই বছরে পড়াতে পারি, তাহলে শরহে নুখবার জায়গায় হানাফী মাযহাবের স্বীকৃত ইমাম আবু বকর জাসসাসের লিখিত ‘আল ফুসুল ফিল উসূল” দুই বছরে পড়াতে সমস্যা কোথায়?
ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে প্রতিনিয়ত প্রপাগান্ডা চলছে আহলে হাদিসদের পক্ষ থেকে। আমরা যার তাকলীদ করি, হাদিস শাস্ত্রে কি তার মাকাম? তা সম্পর্কে আমাদের অধিকাংশ ছাত্র কিছুই জানে না।
আমরা কি মিশকাত জামাতে ইমাম আবু হানিফার মানাক্বিব সংক্রান্ত কোন কিতাব যোগ করতে পারি না? এ বিষয়ে তো লিখিত গ্রন্থের অভাব নেই। ইমাম ইবনে আবদিল বার,যাহাবী,সুয়ূতি,ইবনে হাজার হাইতামী হানাফী মাযহাবের অনুসারী না হয়েও ইমাম আবু হানিফার মানাক্বিব সংক্রান্ত কিতাব লিখেছেন।আমরা এগুলো না পড়ে/পড়িয়ে সারাবছর শুধু ইখতেলাফ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করি।
আরবি সাহিত্য শিখার জন্য আমরা মিশকাতে পড়াই “সাবয়ে মুয়াল্লাক্বাত”। উক্ত কিতাবের দূর্ভেদ্য সাহিত্য বর্তমান আরবি সাহিত্যে অচল।আপনি আলী তানতাবী,শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা,ড.সাইদ বাগদাস অথবা অন্য কোন আরবি সাহিত্যিকের লেখা কোনো কিতাব পড়ুন, তাহলে বুঝতে পারবেন বর্তমান আরবি সাহিত্যে কতটুকু গতি সঞ্চারিত হয়েছে!
এছাড়া “সাবয়ে মুয়াল্লাকাতের” কিছু গল্প হল একেবারে অশ্লীল এবং হারাম প্রেমের রসে টইটুম্বুর। আমরা কি পারি না “সাবয়ে মুয়াল্লাকাত” বাদ দিয়ে আধুনিক আরবী সাহিত্যের গ্রহণযোগ্য কোন কিতাব যোগ করতে?
নেসাবে গণিত,ইংলিশ রাখা জায়েয কিনা- এ বিষয়ে অনেক কিছু লিখার আছে,বলার আছে।কিন্তু সাহস হচ্ছে না। কারণ তখনোই বেয়াদব ফতোয়া জারী হয়ে যাবে। আকাবিরদের শত্রু হয়ে যাব। অথচ আমাদের আকাবিররা কারো গিবত করতেন না। রাজেনৈতিক বিরোধিতার কারণে কারো বিরোদ্ধে মুনাফিক, পথভ্রষ্টের ফতোয়া দিতেন না।কারো উপর জুলুম করতেন না। আমরা এগুলো চোখে দেখি না।
যখন বিতর্কিত কোন কাজ করি,অথবা কেউ ভালো কোন পরামর্শ দেয়, তখনই আকাবিরদের দোহাই শুরু হয়ে যায়!শাহবাগে গেলেন কেন? আকাবিরদের দোহাই! মন্দিরে পূজা দেখতে গেলেন কেন? আকাবিরদের দোহাই! নারীর সাথে জোট করলেন কেন? আকাবিরদের দোহাই! জামাতের বিরোধিতার নামে আওয়ামীলীগের দালাল হলেন কেন? আকাবিরদের দোহাই! লাখো জনতাকে গুলির মুখে ফেলে লন্ডন পলায়ন কররেন কেন? আকাবিরদের দোহাই! সত্যি আমাদের আকাবিররা বাংলাদেশের আলেমদের কাছে বড্ড অসহয়!আপনি এগুলো নিয়ে কলম ধরলে বেয়াদব! আল্লাহ তুমি আমাদেরকে রক্ষা কর।
লেখক : মুফতী ও মুহাদ্দিস,জামেয়া আবু বকর সিদ্দীক রা.,যাত্রাবাড়ী,ঢাকা।
Moinbashar@yahoo.com