শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৩:২৪
Home / কওমি অঙ্গন / কওমী সিলেবাস ও স্বীকৃতি: কিছু কথা

কওমী সিলেবাস ও স্বীকৃতি: কিছু কথা

azan-2আ ম আবুবকর : কওমী মাদরাসা। এক তৃপ্তিময় উচ্চারণ। হৃদয়ের শিরা উপশিরার বীণায় শিহরণের মওজ উঠে। চোখের সামনে বিভাসিত হয় আসহাবে সুফফার বৈভব। কল্পনার বড়পর্দায় সীরাতের চ্যানেল চালু করলেই নয়ন জোড়ায় বিশ্বশিক্ষক প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-র বিচরণ দেখে সেখানে। হাতে-কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন প্রিয় সাহাবীদের। সাহাবারা প্রশ্ন করছেন, হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় উত্তর দিচ্ছেন প্রিয়নবী।

সেই ইলমে নবুওতের জিঞ্জির যুগকড়ার কল্যাণে আজ আমাদের সামনে আপন গৌরব নিয়ে ঝলঝল করছে। সঠিক ইলমে নবুওতের প্রহরী যারা, তারা উচ্চারিত “কওমী মাদরাসা”র সন্তান। সেখানে গেলে দেখা যায় নায়েবে রাসূলদের বিচরণ এবং নায়েবে সাহাবাদের বিহঙ্গন। ক্বালা ক্বালা রাসূলুল্লাহর গুণগুণ রব মুখরিত করে তোলে মাটি ও আরশের মধ্যস্থল। ভিতরের আমি তখন গর্বের ফেস্টুন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দেশে দেশে। ইতিহাসের হাত ধরাধরি করে পৌঁছে যায় সেই নূরকানন আসহাবে সুফফার মজলিসে। রাসূলের আলোকচ্ছটা চেহারা থেকে ঠিকরে পড়ছে নূরের বিভব। ছিঁড়া তাসবীহের দানার মতো অনর্গল ঝরছে হাদিসের মুক্তা। সকল সাহাবী সনদ নিচ্ছেন রাসূলের কাছ থেকে। ছড়িয়ে পড়ছেন পৃথিবীর গেহে গেহে। ইখলাসমাল্য গলায় পরিয়ে দিয়ে পাঠাচ্ছেন সনদদাতা শাগরীদে আল্লাহ প্রিয় রাসূল।

সবখানে তাঁরা লাভ করেছে সম্মান ও মর্যাদা। দলে দলে আশ্রিত হয়েছে মানুষ যাঁদের জ্ঞানাঙিনায়। মূর্খতাকে ঝাঁজরা করে দিয়েছে যাঁদের জ্ঞানের রাইফেল। তাঁদের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি নবীর মোহরকৃত ইলমে নববীর সনদ। হয়েছি ইলমে নবুওতের ধারক-বাহক। কিন্তু তাঁদেরকে শুনতে হয় নি কূপমুণ্ডক, কাঠমোল্লার মতো আরো কতো কি নির্লজ্জ শব্দাবলী। তাঁদের সমাজ বলে নি যুগের চাহিদা পূরণে অপারগ। বরং তাঁদের তাবুতে যুগচাহিদা পূরণলক্ষ্যে মানুষ আশ্রিত হতো। আর তাঁরা এই ইলমে হাদীস, এই ইলমে কোরআন মানুষের কাছে বিতরণ করেছেন। পঙ্গপালের মতো তাঁদের কাছে ছুটে এসেছে মানুষ। তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে করেছে প্রস্থান। তাঁদের প্রগতির আহবানে সাড়া দিয়েছে সারা পৃথিবী। আমরাও তো সেই কোরআন, সেই হাদীস, এই ফিক্বাহ এই বালাগাত পাঠদান করি তবে কেনো শুনি কূপমুণ্ডক আর কাঠমোল্লা গালি?! কেনো শুনতে হয় ইসলাম প্রগতির অন্তরায়! তাহলে মানুষ পরিতৃপ্ত নয় আমাদের ঢালা জ্ঞানজল পান করে?

হে, মানুষ পরিতৃপ্ত নয়। তাঁদের জ্ঞান বিতরণ যুগের চাহিদা মিটিয়েছে। মানুষ যেমন পেয়েছে কোরআনের হাদীসের আলো তেমনি পেয়েছে পার্থিব পথে চলার পাথেয়। আখেরাত যেমন চিনেছে তেমনি জেনেছে কীভাবে খাবে, পরবে, গাইবে, বলবে পৃথিবীতে। তাঁরা মানুষের চাহিদাকে কোরআন ও হাদীসের মাধ্যমে পূর্ণ করেছেন। তাঁরা মানুষকে বুঝাতে পেরেছেন কোরআন ও হাদীসে রয়েছে উভয় জগতে চলার পাথেয়। তাই মানুষ তাঁদের উপাধি দিয়েছে জ্ঞানের সাগর। মহত্বের স্রোতবহা। প্রগতির আহবায়ক ইত্যাদি।

আর আমরা! আফসোস আফসোস … আমরা পারি না যুগের চাহিদা পূরণ করতে কোরআন হাদীসের মাধ্যমে। পারিনা প্রগতির সেই আহবানকে পুনরুজ্জীবিত করতে। কেমনে পারবো বলুন? যুগ বলছে: চাঁদে যাও, বিহার করো মহাশূন্য, ঘুরে আসো শুক্র বৃহস্পতি শনি ইউরেনাস, গবেষণা করো আকাশ নিয়ে,বাতাস নিয়ে, জলবায়ূ নিয়ে, সাগর, মহাসাগর, মহাদেশ নিয়ে। আরো কতো কি চাহিদা ছিঁড়া তাসবীহের দানার মতো পড়তেই আছে। বরঞ্চ সেগুলোর বিরুদ্ধে আমরা পাহাড়সম অটলতা নিয়ে নিজেদের মাঝে মতবিরোধের মল ছোঁড়াছুঁড়ি করছি।

আচ্ছা, কোরআন কিম্বা হাদীসে কি নিষেধ করা হয়েছে যুগের এসব চাহিদা পূরণ করতে? রাসূলের মাধ্যমে কি আল্লাহ “হারাম” করেছেন এগুলো? আমরা তো খুঁজে একটি আয়াতের কীয়দাংশ বা হাদীসের একটি পংক্তিও পাই না। তবে পেয়েছি- “তাফাক্কারূ ফী-খালক্বিল্লাহ, ওলা তাতাফাক্কারূ ফিল্লাহ” র মতো যুত্সই বাণী। এই একটি বাণীই তো আমাদের মস্তিষ্কে লালিত গোঁড়াযুক্তিসমূহের জবাব দিয়ে দেয়।

ছরফ-নাহু পড়ে কোরআন হাদিস বুঝতে পারি। বালাগাত পড়ে কোরআন-হাদিসের অলঙ্কারসমৃদ্ধ বাণীগুলো আয়ত্ত্ব করতে পারি। কিন্তু পরিত্যক্ত সাবজেক্ট মানতিক, মিরকাত, দূর্বোধ্যগ্রন্থ শরহে তাহযীব ও শরহে আক্বাঈদ পড়ে কি “তাফাক্কুর” তথা বিজ্ঞানে-দর্শনে বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ হতে পারি? সিরাজীর অঙ্ক কি বীজগণিতের প্রয়োজন পূরণ করে দেয়?

আমরা যখন বিজ্ঞান পাড়ায় যাই তখন দেখি বীজগণিত-ই সে পাড়ার প্রধান ফটক। আমরা কি বীজগণিত জানি? না জানি না। অথচ আমরা ছাত্রদের পড়াই-তাফাক্কারূ ………. আকাশ আল্লাহর সৃষ্টি জমিন আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি বলছেন তাফাক্কুর করো। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করতে বীজগণিত লাগে। তা কি আমরা শিখছি? শিখাচ্ছি? না আমরা বরং এসব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছি করছি। ফলে দস্যুদের কবলে পড়ে বিজ্ঞান পাড়া বিধ্বস্ত। আল্লাহর সৃষ্টির চলছে অপব্যাখ্যা।

আমরা আরবী শিখি এবং শিখাই। আর তা বোধয় শুধুই এজন্য যে বউ তালাকের মাসলা খুঁজতে- আলমগীরী, বাহরুর রায়েক, হেদায়া, ফতহুল কাদীর প্রভৃতি কিতাবাদি মুতা’আলা করতে হবে! অথচ এই আরবী ভাষা নেতৃত্ব দিয়েছে সমগ্রবিশ্ব। হাজার হাজার বৈজ্ঞানিকগ্রন্থ, হিস্টোরীবুক লিপিবদ্ধ হয়েছে সে ভাষায়। বর্তমান অভিজাত(!) শ্রেণীরা আরবী শিখার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দরোজায় সিজদা করেছে। সে সংবাদ কি আমরা জানি? জানি। তবে সিলেবাসে আমাদের সেই বৈজ্ঞানিকগ্রন্থ, ঐতিহাসিকগ্রন্থগুলোর সংযোজন কেনো হয় না? কেনো গাজালী, ইবনে সিনা, আল হাইশাম, যাবির ইবনে হাইয়ান, আল বাত্তানী, আল বেরুনী, তাবারী, ইবনে খালদুন, ওয়ালী উল্লাহদের নিয়ে গর্ব করি? আমাদের লজ্জা করে না। তাঁদের জ্ঞানভাণ্ডারকে জলাঞ্জলি দিয়ে মুখে নেই তাঁদের নাম। শ্লোগান দেই আমার তাদের উত্তরসূরী!

কোরআন হাদীস কি চিকিৎসাশাস্ত্র নিষিদ্ধ করেছে? মানবসেবা তবে কাকে বলে? কবজের ভিতর তাবিজ ভরে দিলেই কি অপারেশন সাকসেসফুল? তাহলে কেনো আমাদের সিলেবাসে চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো সাবজেক্ট নেই? কোরআন বুঝি কি তাহলে মানবসেবা থেকে দূরে থাকার জন্য? কোরআনের কোন্ বাণী হাদীসের কোন্ অংশ চিকিত্সাজ্ঞান বর্জনের কথা বলে?

পৃথিবীতে বসবাসকারী জীব-জন্তু নিয়ে গবেষণা করতে আল্লাহ ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিষেধ করেছেন? আছে কি কোনো টেকসই উত্তর? তবে কেনো জীববিজ্ঞান নেই আমাদের পাঠ্যবইয়ের তালিকায়? হায়াতুল হাইওয়ান কেনই বা লিখা হলো?

গণিতশাস্ত্র শিখতে এবং শিখাতে প্রতিবন্ধক হয় এমন কোনো আয়াত আছে? হাদীস আছে? যদি না থাকে তবে কেনো ক্লাস এইট পর্যন্তই পাটিগণিতের সীমানা? কেনো অবহেলিত, জীবনের সর্বাঙ্গে দরকারী এমন শাস্ত্র? কেনো সিহাহ সিত্তার পাশে তার ও তাদের স্থান হয় না? সিহাহ সিত্তার কোথায়ও কি নিষিদ্ধের কথা বর্ণিত আছে?

আরবী, বাংলা, ইংরেজী, উর্দূ সকল ভাষাই তো আল্লাহর সৃষ্টি। কিন্তু ক্লাস এইট-ই হয় কেনো আরবী পরে সবভাষার শেষস্থল? আরবী ভাষায় উচ্চতর জ্ঞানার্জনের জন্য যদি শরহে যামীর মতো দূর্বোধ্য আরবী ব্যাকরণ পড়ানো হয়, তবে কোনো যে ভাষাগুলো দিয়ে আমরা জ্ঞান বিতরণ করবো-মাতৃভাষা,আন্তর্জাতিক ভাষা-সে ভাষাগুলোতে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের নেই সু-ব্যবস্থা? কেনো অবজ্ঞা করি এই ভাষাগুলোকে? মনে হয় খুব লাভ করছি!

কওমী সিলেবাস প্রণেতা নিযামুদ্দীন রহঃ কি বলেছেন আমার প্রণিত সিলেবাসে অন্যকোনো শাস্ত্র সংযোজন করা যাবে না? অথচ বর্তমানে আমরা ক্লাস এইট পর্যন্ত বাংলাশাস্ত্র ইংরেজীশাস্ত্র ভূগোলশাস্ত্রের সামান্য ছিটেফোটা লাগিয়েছি সেগুলোর প্রণেতা তো তিনি নন! আমরাই এগুলো সংযোজন করেছি। ক্লাস এইট পর্যন্ত পারলে টাইটেল পর্যন্ত কেনো পারবো না? যদি এগুলো সংযোজন করতে পারি বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান,জ্যোতির্বিজ্ঞান,চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ বীজগণিত পাটিগণিত ইত্যাদি কেনো সংযোজন করতে পারি না?

দ্বীনীশিক্ষা ও জাগতিকশিক্ষার সমন্বয়ে আমরা কি পারি না ভিন্নধারার নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে? যে শিক্ষাব্যবস্থায় থাকবে কোরআন, হাদীস, সরফ, নাহু, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত-বীজগণিত, ব্যবসা-মানবিক, বাংলা, ইংরেজী, ইতিহাসসহ পৃথিবীর সকল জ্ঞানের সমারোহ। আমরা একসাথে তৈরী করবো আলেম, হাফেজ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, গণিতবিদসহ সবধরণের জ্ঞানী। এগুলো করতে যদি ভাবী ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে তাহলে শুনুন-বাংলার সতেরকোটি মানুষ কি দ্বীনের জন্য আমাদের এ উদ্যোগ প্রত্যাখান করবে! সতেরকোটি বাদদেন; দশকোটি জনতা কি আমাদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে না! তারা কি আমাদের শিক্ষকদের জন্য প্রতিমাসে একটাকা বা দু’টাকা দিতেও পারবে না! তারা একটাকা কেনো নিজের সমস্ত সম্পত্তি দিতে রাজি হবে। তবে, তা বাস্তবায়নের জন্য সবাইকে আসতে হবে একপ্লাটফর্মে। ঐক্যের মজলিসে বসতে হবে দৃঢ়ভাবে। ভেঙে দিতে হবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায়ঊনিশটি শিক্ষাবোর্ড। গঠণ করতে হবে একটি বোর্ড, যা পরিচালনা করবে সমগ্র বাংলাদেশের কওমী মাদরাসা।

কিন্তু এর আগে আমাদের আত্মাকে বিধৌত করতে হবে ইখলাস ও নিষ্ঠার দুধ দিয়ে। খেতে হবে উম্মাহর জন্য খেদমতের মাখন। ঝেড়ে ফেলতে হবে নেতৃত্বের লোভ-লালসার ধূলোবালি। গোসল করতে হবে আল্লাহ ও রাসূলের প্রেমসাগরে। আত্মাকে পোড়াতে হবে জান্নাতকামনাগ্নিতে। তবেই সম্ভব একটি স্বতন্ত্র সর্বশিক্ষাসমন্বয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন।

যদি করতে পারি এমন আয়োজন, বিস্ফূরিত হবে আমাদের মেধা। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে সকল মূর্খতা। অকেজো হয়ে পড়বে আমাদের সামনে দুনিয়ার অন্যসব শিক্ষাব্যবস্থা। ঝাঁকেঝাঁকে জড়ো হবে জ্ঞানপিপাসুরা আমাদের ছায়ায়। সঠিক শিক্ষার ডানা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বময়। আর তখন সরকার নিজ থেকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ধরনা দিবে আমাদের অফিসে। স্বীকৃতি নেয়ার জন্য আমাদের যেতে হবে না তাদের পায়ের কাছে।

আসুন, শুরু করি ঐক্যের আন্দোলন। সর্বাগ্রে এগিয়ে আসি আমরা যারা সচেতন যুবক-যুবতী। বড়দের গঠনমূলক পরামর্শ দানের মাধ্যমে জাগিয়ে তুলি ঝিমিয়ে পড়া সচেতনতা। তাঁদের চোখে আসো পরিয়ে দেই প্রাগুক্ত ভাবনার চশমা। ধরে ধরে বলি দেই তাঁদেরকে ঘিরে থাকা স্বার্থান্বেষী সবক’টি শৃগালকে।

২২-০৮-২০১৬ প্রদত্ত লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে জরুরী কিছু কথা!

কমাশিসা ডেস্ক: শুক্রবার ২৫সেপ্টেম্বার ২০২০. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনি যখন কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির ...