শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ দুপুর ২:০৬
Home / প্রতিদিন / কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার পথ ও পদ্ধতি : দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার পথ ও পদ্ধতি : দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট

দেওবন্দ-মাদ্রাসা(প্রথম পর্ব) সাত সাগর তেরো নদীর ওপাড় থেকে বনিক বেশে আগমনকারী ইংরেজরা ছলে বলে কৌশলে ধীরে ধীরে এ উপমহাদেশের রাজদণ্ড কুক্ষিগত করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পরাজিত করে তারা বাংলা বিহার উড়িস্যার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৭৯৯ সালে শেরে মহিশুর টিপু সুলতানকে পরাজিত করে মহিশুরের কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়। ১৮০৩ সালে মোগল সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে জোরপূর্বক দিল্লীর মসনদ দখল করে। মুসলমানদের হাত থেকে রাজক্ষমতা দখল করার ফলে স্বভাবত মুসলমানরা ইংরেজদের প্রতি ছিল ক্ষুব্ধ। হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায় প্রথম দিকে এটাকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছিল। তাই ইংরেজদের দমন নিপীড়নের মূল টার্গেট ছিল মুসলিম সম্প্রদায়।

১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে শাহ আব্দুল আযীয রহ. ভারতবর্ষের ওলামায়ে কেরামের পক্ষে এক বিশেষ ফতোয়া জারী করেন। এতে তিনি ভারতবর্ষকে দারুল হরব ঘোষণা করেন। এ ফতোয়ার ফলে মুসলমানরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। বিভিন্ন স্থানে ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে মুসলিম জনসাধারণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হন। ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশীয় শক্তিগুলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়। ওলামায়ে কেরামের প্রচেষ্টায় মুসলিম, হিন্দু , মারাঠা ও রোহিলাদের সমন্বয়ে ইংরেজবিরোধী সম্মিলিত বাহিনী গড়ে ওঠে। ১৮০৮ সালে এ বাহিনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান শুরু করে। কিন্তু ইংরেজদের কুটচালের মোকাবিলায় এ অভিযান সফলতা লাভ করতে পারেনি। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ. ইংরেজদের মিত্র রাজা রঞ্জিত সিং এর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে পেশোয়ার দখল করেন। ১৮৩১ সালে ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে বালাকোটের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু এখানে মুসলমানরা বিজয় লাভে ব্যর্থ হন। এরপর ১৮৫৭ সালে শুরু হয় সর্বাত্মক আজাদি আন্দোলন। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সবাই এ আন্দোলনে যোগ দেয়। ব্রিটিশ বাহিনীর অনেক হিন্দু ও মুসলিম সৈন্য সরকারপক্ষ ত্যাগ করে আজাদি আন্দোলনে শরিক হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এ আজাদি আন্দোলনও ব্যর্থ হয়ে যায়।

এ আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে গেলেও এ আন্দোলনের কারণ খুঁজে বের করতে ইংরেজ সরকার একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি এ মর্মে রিপোর্ট পেশ করে যে, ‘এ সশস্ত্র বিপ্লব ও আন্দোলনের পেছনে ভারতবর্ষের ওলামায়ে কেরাম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। তারাই ভারতীয় মুসলিন সমাজের মধ্যে জিহাদী স্পৃহা জাগিয়ে ইংরেজ বিরোধী শসস্ত্র বিপ্লব সংঘটিত করেছেন।…’ এ রিপোর্টের ভিত্তিতে ইংরেজ সরকার ওলামায়ে কেরামের বিরোদ্ধে সর্বাত্মক সাড়াঁশি অভিযান শুরু করে আজাদী আন্দোলনের অপরাধে কমপক্ষে ১৪ হাজার আলেমকে ফাসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। গুলি করে সহীদ করে অগণিত ওলামায়ে কেরামকে। জেলখানায় প্রহৃত হয়ে শহীদ হন আরো অসংখ্য আলেম। নিখোঁজ হন আরো অনেক। জেল-জুলুমও নির্যাতনের যাতাকালে নিষ্পেষিত হন লক্ষ লক্ষ ওলামায়ে কেরাম। ধ্বংস করা হয় লক্ষ লক্ষ দীনি প্রতিষ্ঠান। এভাবে ইংরেজরা ভারত বর্ষকে ইসলাম ও ওলামা শূন্য করার এক ঘৃণ্য নীল নকশা বাস্তবায়িত করতে শুরু করে। মুসলমানরা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধর্মপরায়ণ মুসলমানদের ওপর ইংরেজদের জুলুম নির্যাতন ও বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে। শুধু তাই নয় তাদের দীন ও ধর্ম নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।  সাথে সাথে ইংরেজরা এদেশ থেকে ইসলামকে মিটিয়ে দেওয়ার বহুমুখি ষড়যন্ত্র শুরু করে। ওয়াকফের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে  ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। ফলে ভারতবর্ষ থেকে দীনি ইলমের আলো নিভে যেতে শুরু করে। মুসলমানদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দীনবিমুখ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে দেওবন্দের কয়েকজন আকাবির আশার আলো হয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হন।  তারা অক্লান্ত পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্প, নিষ্ঠাও ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে শিরিক ও নাস্তিকতার প্রবল ঝড়ের মধ্যে  ১৮৬৬ সালের ৩০ মে ভারতবর্ষের মুসলমানদের ঈমান আকিদা রক্ষার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নতুন প্লাটফর্ম হিসেবে এবং ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞানের সংরক্ষণকল্পে এমন এক আলোকবর্তিকা  দেওবন্দে প্রজ্বলিত করেন যা পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশের আসমান ও জমিনকে হেদায়েতের আলোতে আলোকিত করে রেখেছে। এ প্রসঙ্গে মাওলানা কাসিম নানুতবি রহ বলেন, ‘ময়দানের সশস্ত্র আন্দোলনকে আমরা প্রতিষ্ঠানের নিরাপদ পোশাকে আচ্ছাদিত করে দিয়েছি।’

এ মাদরাসাকেই কেন্দ্র করে পরবর্তিতে মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলন আবর্তিত হয়েছে। এ মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকরাই পরবর্তিতে ১৯১৭ সালে রেশমী রুমাল আন্দোলনের জন্ম দিয়েছেন। এ দেওবন্দ মাদরাসার ওলামায়ে কেরামের সহযোগিতায় গান্ধীজী ১৯৩০ সালে স্বাধীনতার দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন। ফলে গান্ধীজীসহ মুফতী কিফায়াতুল্লাহ, খান আব্দূল গাফফার কারারূদ্ধ হন। ১৯৪২ সালের ইংরেজ বিরোধী ‘‘ভারত ছাড়’’ আন্দোলনের সঙ্গে ওলামায়ে কেরাম প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন। এর ফলে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। (চলবে)

মূল : আল্লামা তকি উসমানি

ভাষান্তর : কাজী মোহাম্মদ হানিফ

শাইখুল হাদিস, জামিয়া আরাবিয়া মারকাজুল উলুম, কাঁচপুর, নারায়ণগঞ্জ

 

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...