শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সকাল ১০:৩২
Home / অনুসন্ধান / শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রাহ’র অনবদ্য গ্রন্থ ‘আল-ইনসাফ’

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রাহ’র অনবদ্য গ্রন্থ ‘আল-ইনসাফ’

‘আল-ইনসাফ ফি বায়ানি আসবাবিল ইখতিলাফ’- বই এর পাঠপ্রতিক্রিয়া

আব্দুল্লাহ আল-মাসুদ::

 ‘আল ইনসাফ’ হচ্ছে ভারতরত্ন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবি রাহ, এর অনবদ্য গ্রন্থ। বিভিন্ন মাসআলায় ইমামদের মধ্যে মতানৈক্য কেন হয়- সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। বইয়ের নাম থেকেই বিষয়টি বুঝে আসে।

আরবি ভাষায় লেখা বইটার পৃষ্ঠা সংখ্যা একশর কাছাকাছি। বৈরুতের ‘দারুন নাফাইস’ এটি প্রকাশ করেছে। ঝকঝকে প্রচ্ছদের এই বইটির আরবি ভাষাটা খুব কঠিন না। আবার খুব সহজও না। বলা যায়, সহজ-কঠিনের মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে লেখক এটি রচনা করেছেন।

শুরুতেই তিনি সাহাবা ও তাদের ছাত্রবৃন্দ তথা তাবেয়িদের মধ্যে শাখাগত মাসআলাতে মতানৈক্য হওয়ার কিছু কারণ সংক্ষিপ্ত ভাষায় তুলে ধরেছেন। এবং তাদের মতানৈক্যের ধরণগুলো কি কি সেটাও তিনি সুবিন্যস্ত আকারে সাজিয়েছেন। প্রতিটি বিষয়ের সাথে উদাহরণ টেনে বক্তব্যটাকে আরো সুস্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন।12990995_1057844497622552_2570839018138150605_n

পরবর্তী অধ্যায়ে বিভিন্ন মাযহাবের ইমামদের মধ্যে যেসব মতানৈক্য হয়েছে তার পেছনে কি কি কারণ লুকিয়ে আছে তা তিনি আলোচনা করেছেন। তবে এই অধ্যায়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ৩৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত একটা কথা। তা হল, কোন মাসআলাতে যদি সাহাবি বা তাবেয়িদের মধ্যে মতানৈক্য হয়ে যেতো তবে পরবর্তী উলামায়ে কেরাম নিজ নিজ দেশে প্রচলিত ও উস্তাদদের অনুসৃত রীতি অবলম্বন করতেন। এটা আজকালকার অনেক মাযহাব-বিরোধী ভাইয়েরা মানতে চান না। তারা অনেক মাসআলায় সৌদিআরবে গৃহীতটা এদেশে চালু করতে চেষ্টা চালান। এটা সুস্পষ্টভাবে সালাফদের মানহাজের পরিপন্থী।

পরবর্তী অধ্যায়ে তিনি ইসলামি আইনশাস্ত্রের দুটি ধারার কথা আলোচনা করেছেন। যাদের মধ্যে একটি ধারা “আহলুল হাদিস” আর আরেক ধারা “আহলুর রায়” হিসেবে অভিহিত হয়ে থাকেন। এই দুই ধারার পরিচয়, উদ্ভব, ক্রমবিকাশ, বিস্তৃতিলাভ ইত্যাদি ইতিহাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা খুবই জরুরি। বিশেষকরে যারা মাযহাব সংক্রান্ত আলোচনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন তাদের জন্য। অথচ আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অধিকাংশজনেরই এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। উল্লেখ্য যে,এখানে আহলুল হাদিস বলতে আমাদের দেশের প্রচলিত আহলে হাদিসদের বুঝানো উদ্দেশ্য নয়। বিষয়টা তার কিতাবের পুরো আলোচনা পড়রে স্পষ্ট হয়। ৫৯ পৃষ্ঠায় তিনি আল্লামা খাত্তাবির বরাতে উল্লেখ করেছেন,
“আহলুল হাদিসদের মূল কাজ ছিল হাদিস বর্ণানা করা, সনদসমূহ একত্র করা এবং গরীব ও সায প্রকারের হাদিসগুলো অন্বেষণ করা।”
আর এটা তো সুস্পষ্ট যে, এগুলো বর্তমানে সেসব সাধারণ লোকদের, যারা নিজেদের আহলে হাদিস বলে দাবী করে অথচ হাদিসের সংজ্ঞাটাও ঠিকমতো জানে না তাদেরকে কোনভাবেই নির্দেশ করছে না।

এখানে শাহ সাহেব একটা চমৎকার বিষয় তুলে ধরেছেন ৫৯ পৃষ্ঠায়। সেটা হল,
“অধিকাংশ মুহাদ্দিসদের কাজই ছিল সনদ নিয়ে। তারা মতন বা হাদিসের মূল বক্তব্য নিয়ে অতোটা ভাবতেন না। হাদিসের ভেতর থেকে মাসআলা উদ্ভাবন তাদের কাজ ছিল না। তারা অনেক সময় ফকীহদের, যারা হাদিসের মতন নিয়ে ভাবতেন এবং হাদিস থেকে মাসআলা উদঘাটনই ছিল যাদের মূল কাজ, তাদের অহেতুক সমালোচনা করতেন। ক্ষেত্রবিশেষ তাদের প্রতি সুন্নাহের বিরোধিতার দোষও আরোপ করতেন। অথচ তাদের জানা ছিল না যে, তাদেরকে যে ইলম প্রদান করা হয়েছে সেটা পূর্ণাঙ্গ নয়।বরং সনদের সাথে মতন থেকে মাসআলা উদঘাটন করতে পারাটাও জরুরি। ফলে তারা এমন সমালোচনার কারণে গুনাহগার হবেন।”

পরবর্তী অধ্যায়টা হল সবচে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে তিনি হিজরি চতুর্থ শতকের আগে সাধারণ মানুষদের অবস্থা কেমন ছিল সেটা তুলে ধরেছেন। সেই সাথে মুজতাহিদ বিষয়ক মোটামুটি বিস্তারিত আলোচনা পেশ করেছেন।

এই অধ্যায়ের প্রথম বাক্য হল,
“জেনে রাখো, প্রথম দুইশত হিজরি পর্যন্ত নির্দিষ্টভাবে এক মাযহাব অনুসরণের উপর লোকেরা একমত ছিল না।”
এই লাইনটা মাযহাব-বিরোধী প্রায় সকল বইতে কমবেশ উল্লেখ করা হয়ে থাকে। তারা শাহ সাহেবের বক্তব্য টেনে মাযহাব মানা যাবে না, তাকলিদ পরবর্তী সময়ে সৃষ্টি হয়েছে ইত্যাদি বক্তব্য প্রমাণীত করতে চান। এবং শাহ সাহেবকে আহলে হাদিস দাবী করতে চান। যেমনটা রাজশাহী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড, আসাদুল্লাহ গালেবসহ আরো অনেকে তাদের বইতে উল্লেখ করেছেন। তবে মজার কথা হল, উক্ত উক্তির কয়েক পৃষ্ঠা পরেই শাহ সাহেব বলেন,
“নির্দিষ্ট ইমামের তাকলিদ বা অনুসরণ অত্যাবশ্যক। তাকলিদ কখনো অত্যাবশ্যক হয় কখনও হয় না। ভারতে বা তৎসংশ্লিষ্ট এলাকা, যেখানে শাফেয়ি-মালেকি-হাম্বলি কোন মাযহাবেরই আলেম বা সেসব মাযহাবের গ্রন্থাদি তেমন পাওয়া যায় না সেসব এলাকার ধর্মীয় শিক্ষায় অশিক্ষিত ব্যাক্তিদের জন্য আবু হানিফার মাযহাব অনুসরণ অত্যাবশ্যক। এই মাযহাব ছেড়ে অন্য মাযহাব গ্রহণ করা তার জন্য হারাম। কারণ তখন সে শরীয়তের জাল ছিন্ন করে একে অনর্থক বিষয়ে রূপান্তরিত করবে।”
লেখক বুঝালেন, এমতাবস্থায় সে বিভিন্ন মতানৈক্যপূর্ণ মাসআলাতে যেটা খুশি সেটা গ্রহণ করে শরিয়তকে একটা খেলনার বস্তুতে রূপান্তর করবে।
তারপর তিনি বলছেন,
“এর বিপরীতে যদি সে মক্কা-মদীনায় থাকে তখন সেখানে যেহেতু সব মাযহাবের আলেমদের দেখা পাওয়া সহজ তাই ভিন্ন মাযহাব গ্রহণে অসুবিধা নাই।”

শাহ সাহেবের বক্তব্য দিয়ে যারা মাযহাবকে কলুষিত করার চেষ্টা চালান তাদের জন্য কথাগুলো ভাবনার বিষয়।

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, মাযহাবের পক্ষে-বিপক্ষে উভয় শ্রেণির লোকেরাই শাহ সাহেবের বই থেকে প্রমাণ পেশ করে থাকেন। প্রথমদিকে আমি খুব পেরেশানিতে পড়তাম। মাযহাব মানার পক্ষেও উনার বই থেকে প্রমাণ প্রদান করা হচ্ছে। আবার মাযহাব বাদ দেওয়ার পক্ষেও উনার বই থেকেই প্রমাণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যখন থেকে সরাসরি তার বইগুলো পড়ার সুযোগ হল তখন বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে গেছে।
আশা করি পাঠকদের কাছেও কিছুটা ক্লিয়ার হয়েছে।

পরবর্তী অধ্যায়ে তিনি হিজরি চতুর্থ শতকের পরের আলোচনা এনেছেন। মাযহাবগত দ্বন্দ্ব ও এর কারণ বিশ্লেষণ করেছেন।

৮৪ পৃষ্ঠায় তিনি বলতে চেয়েছেন, হানাফি মাযহাবের আলেমরা “হাদিসে মুসাররাত” এর উপর আমল না করার কারণ হল,
এই হাদিস তাদের একটা মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। মূলনীতিটা হল, ফকিহ অর্থাৎ ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ নয় এমন সাহাবি কর্তৃক কিয়াস-বিরুদ্ধ কোন হাদিস বর্ণিত হলে সেটা অগ্রহনযোগ্য বিবেচিত হবে। আর এই হাদিসের বর্ণনাকারী হলেন আবু হুরাইরা রা,। তিনি ফকিহ ছিলেন না। আর এই হাদিসটাও কিয়াস-বিরুদ্ধ। তাই এটা গ্রহণ করা হবে না।
কথাটা মোটেও ঠিক নয়। মূলত হানাফি ফিকহের মূলনীতি বিষয়ক গ্রন্থ “নুরুল আনওয়ার” এর মধ্যে এমন বক্তব্য থাকায় শাহ সাহেব এই ধরণের বক্তব্য প্রদান করেছেন। পরবর্তীতে তার মতো আরো অনেকেই এটা বলেছেন। অথচ বাস্তবতা হল, এই হাদিসের উপর আমল না করার কারণ হল, এটা শরীয়তের সর্বজনস্বীকৃত কিছু মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। নুরুল আনওয়ারের বক্তব্যটা একান্তই লেখকের নিজের। বিস্তারিত জানার জন্য পাকিস্তানের জাস্টিজ আল্লামা তকি উসমানির লেখা মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম’ থেকে হাদিসে মুসাররাতের আলোচনা দেখে নিতে পারেন। তাছাড়া মুসলিম শরিফের প্রসিদ্ধ উর্দু ব্যখ্যা গ্রন্থ ‘আল-মুলিম’ও দেখতে পারেন। এটার বাংলা অনুবাদও পাওয়া যায় বাজারে। এই বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়।

আরেকটা চমৎকার বিষয়ের উল্লেখ করেছেন তিনি এই অধ্যায়ে। সেটা হল, আবু হানিফা অনেক মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন কুরআন-হাদিস থেকে। আবার তার মৃত্যুর পর হানাফি উলামায়ে কেরাম তার মূলনীতির আলোকে অনেক মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন। এই দুই জাতীয় মাসআলার ব্যবধান বুঝাতে বলা হয়, “আলা কওলি আবি হানিফা কাযা” মানে হল, এই মাসআলা আবু হানিফার মত অনুসারে এমন। আর আরেকটা হল, আলা আসলি আবি হানিফা কাযা” মানে হল, এই মাসআলা আবু হানিফার মূলনীতির আলোকে এমন। তারমানে তিনি নিজে এটা বলে যান নি। তবে তার মূলনীতির আলোকে পরবর্তী আলেমরা তা উদ্ভাবন করেছেন। এই দুই প্রকারের মধ্যে অনেকেই পার্থক্য করেন না। তারা সব মাসআলাই সরাসরি আবু হানিফার দিকে সম্পৃক্ত করে দেন। এটা অবশ্যই সঠিক নয়।

তবে হ্যা, তাকলিদে জামেদ বা জমাটবদ্ধ অনুসরণ, যেখানে সঠিক-বেঠিকের দিকে না তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে অন্যের সব কথা মেনে নেওয়া হয় তাতে তিনি আপত্তি জানিয়েছেন। আর এমন তাকলিদের সমালোচনা মাযহাবের আলেমরাও করে থাকেন। যেমন, প্রসিদ্ধ হানাফি আলেম, বহু গ্রন্থপ্রনেতা আবদুল হাই লাখনৌবি তার “আত-তালিকুল মুমাজ্জাদ” এর মধ্যে করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন,
“কেউ কেউ মনে করে, তার গ্রহণ করা মাযহাবের প্রতিটা মাসআলা আপত্তিমুক্ত। আবার কেউ কেউ প্রসিদ্ধ মাযহাবগুলো বিনাশ করতে ব্যস্ত এবং অনুসরণীয় ইমামদের ব্যাপারে কটুবাক্য ব্যবহারে অভ্যস্ত। উভয় দল থেকেই আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। এদের একদল ‘তাকলিদে জামেদ’ এর কারণে গোমরাহ হয়েছে আর অপরদল ভ্রান্তধারণা এবং কুচিন্তার কারণে গোমরাহ হয়েছে।”
মোটকথা, তাকলিদে জামেদ যে হারাম সেটা সবাই মানেন।

সর্বশেষ অধ্যায়ে তিনি চার মাযহাবের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। শুরুতেই তিনি বলেছেন,
“আমাদের যুগ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ চার মাযহাবের অনুসরণ জায়েয হওয়ার বিষয়ে ঐক্যমত্য পোষণ করেছে। এর মধ্যে সুবিধা রয়েছে তা কারো কাছে অজানা নয়। বিশেষকরে বর্তমান যুগে; যখন কিনা মানুষের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাদের অন্তরে কুপ্রবৃত্তি জায়গা করে নিয়েছে এবংপ্রত্যেকে নিজের সিদ্ধান্তে খুশি হওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। ”
তারপর ৯১ পৃষ্ঠায় তিনি মাযহাবের বিরুদ্ধে আল্লামা ইবনে হাযমের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন এই বলে যে, “তাকলিদ করা নিষেধ তার জন্য যার মধ্যে ইজতিহাদের যোগ্যতা পাওয়া যায়। যদিও সেটা একটা মাসআলাতেই হোক না কেন।”

মোটকথা, একশত পৃষ্ঠার এই বইতে তিনি চমৎকারভাবে অনেক বিষয় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। ইমামদের মতানৈক্যের কারণ বুঝার ক্ষেত্রে বইটি অনন্য ও অসাধারণ।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...