শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:০৫
Home / অনুসন্ধান / আমাদের স্বাধীনতার লড়াই, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (৩য় পর্ব)

আমাদের স্বাধীনতার লড়াই, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (৩য় পর্ব)

হাকীম সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ 01সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::

গত পর্বে আমরা জানতে পারি শায়খুল হিন্দ ভারতের স্বাধীনতা ও হিন্দুস্তান থেকে ইংরেজকে বিতাড়িত করতে স্বাধীনতার যুদ্ধ করার জন্য জমিয়তুল আনসার এর সদস্য ও আরো কিছু বিপ্লবী স্বাধীনতাকামীদের কে নিয়ে একটি বেসামরিক বিশেষ বাহিনী তৈরি করে তার নাম দিয়েছিলেন ‘জুনদে রববানিয়াহ।’ জুনদে রব্বানিয়াকে তিনি আরো ব্যাপক করে তুলতে যে স্বাধীন সরকার গঠনের লক্ষ্য সর্বভারতীয় জননেতাদের নিয়ে “আযাদ হিন্দ মিশন” নামে আরেকটি গণমূখী প্লাটফর্ম তৈরি করেন। বিপ্লব ও স্বাধীনতার লড়াইকে দেওবন্দ আন্দোলন ও আলেমদের ভিতর সীমাবদ্ধ না রেখে শায়খুল হিন্দ তার উদার নীতি ও দূরদর্শি চিন্তারদ্বারা গণমূখী বিপ্লবে রূপ দিয়েছিলেন। যে মিশনে স্বাধীনতার প্রশ্নে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, নেতাজী সুভাষ চন্দ্রসহ সর্বভারতীয় হিন্দু নেতারা পর্যন্ত এসে শামিল হয়েছিলেন। শায়খুল হিন্দের এই বিপ্লবী চিন্তা জানতে হলে রাওলেট আ্যাক্ট কমিটির রিপোর্ট ও বিখ্যাত ‘গালিবনামা’ জানতে হবে। তার এই নীতি, দশর্ন ও বিপ্লব ইংরেজদের কাছে ফাঁস হলে এবং তিনি ইংরেজদের হাতে গ্রেপ্তারের পরেও নীতি থেকে সরে দাঁড়ান নি। ফলে ৩ বছর মাল্টার কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে যখন দেখলেন তার কতিপয় শিষ্য তার গনমুখী বিপ্লবী চেতনা থেকে সরে আলেমদের নিয়ে আলাদা প্লাটফর্ম তৈরি করেছেন “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ” নামে। তারা এই দল থেকে ভারতের পূর্ণাঙ্গ প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণার কথা শুনেও খুশি হতে পারেন নি শায়খুল হিন্দ। তিনি শুধু আলেমদের নিয়ে গঠিত “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ” দলে না এসে সরাসরি মহাত্মা গান্ধীর সাথে কংগ্রেস দলে যোগ দিলেন গণমুখী স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য। এবং খেলাফতের সাথে কংগ্রেসকে মিলিয়ে খেলাফত-অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন।

(শাহ ওয়ালী উল্লাহর রাজনৈতিক চিন্তাধারা, উবায়দুল্লাহ, কাবুল মে সাত সাল, মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি। রাওলাট কমিটি রিপোর্ট, লাহোর,কাশমীর প্রেস, ১৯২৮, পৃষ্টা ২২৬)

রাওলেট অ্যাক্ট কমিটি অবিভক্ত ভারত থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করে ভারত স্বাধীন করা এবং এখানে পুনরায় ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যেই শাহ ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালিত হয়। শাহ আবদুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলভী থেকে শুরু করে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান পর্যন্ত কয়েকটি বিপ্লব ঘটে যায়। বাংলা-পাক-ভারতের আলেমসমাজই ছিলেন এসব বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোধা। ১৮৩১ খৃঃ বালাকোট জিহাদ ও ১৮৫৭ সালের রক্তাক্ত সংগ্রামের পর বিপ্লবী আলেমগণ পরিবর্তীত অবস্থার প্রেক্ষিতে একান্ত গোপনীয়ভাবে এ আন্দোলন পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে যান। শত্রুপক্ষ প্রথম এর কিছুই টের পায় নি। ফলে ইংরেজ সরকারকে বহু ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদ বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত হতে হয়। এখাতে ইংরেজ সরকারের বহু কোটি টাকা ব্যয় হয় এবং ক্ষয় হয় অসংখ্য সৈন্য। ইংরেজগণ নির্বিঘ্নে টিকে থাকতে পারে এমন উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে তারা বিভ্রান্ত ও হতবুদ্ধি হয়ে এসব বিপ্লবের মূল তথ্য উদঘাটন ও এর মূলোচ্ছেদের লক্ষ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এটাই হচ্ছে “রাওলেট অ্যাক্ট কমিটি”। ১৯১৩ খৃষ্টাব্দে উক্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট পেশ করতে সক্ষম হয়। কমিটি মাওলানা শায়খুল হিন্দের আনসারুল্লাহ’ সংস্থার বিপ্লবী শাখা “আজাদ হিন্দ মিশন” আন্দোলনের অনেক ঘটনারই তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি। যে কয়টি বিষয়ের আবিস্কার করেছে তাও অসম্পূর্ণ। তাতে আলেমগণ ও তাদের বিপ্লবী সহকর্মীদের কর্মতৎপরতা এবং রাজনীতি ও যুদ্ধনীতির ক্ষেত্রে যে অদম্য সাহস ও দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়, সেটা আধুনিক শিক্ষিত যুবকদের কাছে অবাকই মনে হবে। মনে করার কারণও রয়েছে। কেননা, ঐ সকল সংগ্রামী আলেমের শিষ্য-শাগরিদদের অনুসৃত নীতিকে সেই সংগ্রামী ভাবধারার যথাযথ প্রতিফলন তারা মাঝখানে দীর্ঘদিন দেখতে পায়নি।

যাহোক, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও পরিবেশে লালিত শিক্ষিত কতিপয় যুবক তাতে হতবাক হলেও একথা সত্য যে, বৃটেন, আমেরিকা, রাশিয়া প্রভৃতি উন্নত রাষ্ট্রসমূহের কর্মকর্তা এবং ঐ সকল দেশের বিশিষ্ট  রাজনীতিক ও কুটনীতিকরা বিদেশ সম্পর্কে রাজনীতি, সমরনীতি, রাজ্য পরিচালনায় অগাধ জ্ঞান ও দক্ষতার বিষয়ে সচেতন ছিলেন। বিশেষ করে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের “আজাদ হিন্দ মিশনের” দুর্দমনীয় সতর্কতাপূর্ণ আন্দোলনের নামে বৃটিশ সরকার যে আতঙ্কিত থাকতো, তাদের লেখকদের লেখাই তার বড় প্রমাণ। অবিভক্ত ভারতের আলেমসমাজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে কীরূপ বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন, প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক ইউলিয়াম হান্টার লিখিত ‘আওয়ার ইন্ডিয়ান মুসলমান’ গ্রন্থে তাঁর আক্ষেপ থেকেও সেটা আঁচ করা যেতে পারে। তা হচ্ছে এই- “এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারত গভর্নমেন্ট যদি পূর্ব থেকেই ষড়যন্ত্র আইনের ৩নং ধারা অনুযায়ী ভারতে আলেমদের কঠোর হস্তে দমন করতো, তা হলে ভারত গভর্নমেন্টকে ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে মুজাহিদ আলেমদের আক্রমণের ফলে এত দুঃখ ভোগ করতে হতো না। কতিপয় প্রসিদ্ধ আলেমকে গ্রেফতার করা হলে আম্বালা ঘাটিতে আমাদের এক সহস্র সৈন্য হতাহত হতো না এবং লক্ষ লক্ষ পাউন্ড অর্থও বেঁচে যেতো। এমন কি উক্ত লড়াইর পরও যদি কঠোর হস্তে আলেমদেরকে দমন করা হতো, তবে অন্ততপক্ষে ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে কালাপাহাড় অভিযান হতে রক্ষা পাওয়ার আশা ছিল”।

এমনিভাবে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান প্রমুখ বিপ্লবী আলেমের ইংরেজ খেদাও আন্দোলন ও ষড়যন্ত্রের বিবরণ তাদের লেখায় প্রকাশ পায়। ঐ সকল বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ১৯১৬ খৃষ্টাব্দের আগস্ট মাসে ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে। ইংরেজ সরকারের ফাইলে তাকে ‘রেশমী রুমালের চিঠি’ নামে অভিহিত করা হয়। কারণ, ইংরেজ বিরোধী পরিকল্পনা সম্বলিত লেখা চিঠিটি রেশমী কাপড়ে লেখা ছিল। তাতে- “ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রমণ চালাবার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ আছে এবং ভারতের মুসলমানদের পূর্ণোদ্যমে অগ্রসর হয়ে বৃটিশ হুকুমতকে উচ্ছেদ করার কথাও ছিল। “উক্ত পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যে মওলভী ওবায়দুল্লাহ নামক এক ব্যক্তি ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে তার সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করে। মওলভী ওবায়দুল্লাহ পূর্বে শিখ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে প্রথমতঃ সাহারানপুর জেলার অন্তর্গত দেওবন্দে মুসলমানদের ধর্মীয় মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করে ফাযিল ডিগ্রী লাভ করেন এবং কতিপয় মওলভীকে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও আক্রমণ পরিচালনার পক্ষে তাঁর মতাবলম্বী করে তোলেন। তন্মধ্যে মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা মাহমুদুল হাসান ছিলেন প্রধান নায়ক। মওলভী ওবায়দুল্লাহ একান্ত ইচ্ছা ছিল, দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেমদের সহযোগিতায় সারা ভারতে ইসলামী হুকুমাতের প্রেরণা জাগ্রত করে মুসলমানদেরকে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জোর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুক করা”। বস্তুতঃ এসব কারণেই বৃটিশ ভারতের মুসলমান তাদের প্রিয় সংগ্রামী নেতা শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে কেন্দ্র করে রণোন্মাদনামূলক গান গেয়ে গেয়ে কুখ্যাত ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলিম যুবসমাজের উষ্ণ রক্তে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করতো। সেদিন কেবল সিন্ধু, মাদ্রাজ, ইউপিতে নয়; বাংলার পথে-ঘাটে, গঞ্জে-বাজারে, বন্দরেও এই ধ্বনি উচ্চারিত হতে শোনা যেতো যে, – “মুসলমানের শায়খুল হিন্দ আছে মাল্টাতে, চল খেলাফত উদ্ধারে মুসলমানী যেতে বসেছে”।

যাহোক, এই সিংহদিল মহান সংগ্রামী নেতা মাল্টার কারাজীবন শেষে ভারতে এসে যখন খেলাফত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন তাঁর কারাক্লান্ত দেহ অধিক পরিশ্রম হেতু আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশ্য এই দুর্বলতা নিয়েও তিনি আন্দোলন করে যান। এমনকি তাঁর জীবদ্দশাতেই যখন অসহযোগ আন্দোলন দেখা দেয়, তখনও তাঁকে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের অনুরোধে দুর্বল শরীর নিয়ে সরকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিল্লীর বিখ্যাত “জামায়ায়ে মিল্লিয়া’র দ্বারোদঘাটন করতে দেখা যায়। কিন্তু বার্ধক্যপীড়ার মধ্যে অস্বাভাবিক পরিশ্রমের দরুণ শেষ পর্যন্ত তাঁর শরীর বেশীদিন…

শায়খুল হিন্দের মূল পরিকল্পনা ছিল ইংরেজ বলয়ের বাইরে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের ‘ইয়াগিস্তান’ এলাকায় ‘আযাদ হিন্দ মিশনে’র কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে জেহাদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র, অর্থ ও সৈন্য সংগ্রহ ইত্যাদি সর্বপ্রকার আয়োজন চলতে থাকে। তখনই ইউরোপের কতিপয় শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তুর্কী খিলাফতের অন্তর্ভূক্ত কয়েকটি এলাকা আক্রমণ করে এবং ইংরেজগণ তুর্কী সরকারের দু’টি যুদ্ধ জাহাজ আটক করে ফেলে। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ভারত সহ সমগ্র মুসলিম জাহানে নতুন করে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিক্ষোভ বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ে।

এসব অবাঞ্ছিত কারণে তুর্কী সরকারও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ ঘোষণা করে। এদিকে বৃটেন, রাশিয়া প্রমুখ শক্তিবর্গ তুর্কী খেলাফতের উপর বিভিন্ন দিক হতে চতুর্মূখী আক্রমণ  করে বসে। ইসলাম ও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে ভূপৃষ্ঠ থেকে চিরতরে মুছে ফেলাই ছিল তাদের আসল লক্ষ্য। দেওবন্দী মুজাহিদগণ ইংরেজদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এহেন সংকটকালে হযরত শায়খুল হিন্দ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা হতে বিপ্লব করার পরিকল্পনা নেন। তিনি মাওলানা হাজী তোরঙ্গযয়ীর নেতৃত্বে ইয়াগিস্তান কেন্দ্র থেকে বৃটিশ সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুজাহিদগণ বীরবিক্রমে শত্রুবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ইংরেজ শক্তি পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত পশ্চাদ্ধাবন করে। তাতে বহু ইংরেজ সৈনিক হতাহত হয়। কিন্তু কুচক্রী ইংরেজগোষ্ঠী মুজাহিদের দুর্দমনীয় আক্রমণের ঝক্কি সামলাতে না পেরে একদিকে কতিপয় স্বার্থপর ভাড়াটিয়া শিক্ষিতকে হাত করে নেয়, অপরদিকে সরকারী তল্পীবাহক জনৈক মওলভীর দ্বারা জেহাদের বিরুদ্ধে ফতওয়া প্রচার করতে থাকে। কিন্তু কাবুলের বাদশাহ আমীর হাবীবুল্লাহ খানকে প্রচুর অর্থ ও নানান প্রলোভনে তার দ্বারা ইংরেজরা কাবুল সীমান্তের উক্ত জিহাদী আন্দোলনকে বানচাল করে দিতে প্রয়াস পায়।

এই মহাবিপর্যয় ও সংকটমুহূর্তে বিপ্লবীগণ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। হিজরী ১৩৩৩ সনে শায়খুল হিন্দ হিজাজ অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু ইংরেজদের কড়া দৃষ্টি এড়িয়ে বাইরে সফর করা তাঁর পক্ষে মুশকিল ছিল। তবুও তিনি আল্লাহর প্রতি ভরসা করে রওয়ানা হন। কিন্তু সে খবরটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। যুদ্ধকালীন অবস্থায় শায়খুল হিন্দের বিদেশ সফর করা হলে বিশৃংখলার সম্ভাবনা রয়েছে ভেবে বোম্বাই ঘাটে স্টীমারে আরোহণকালে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা নেয়। ইউ.পি সরকার বোম্বাইয়ের গভর্নরের নিকট এই মর্মে তারবার্তা প্রেরণ করেন। কিন্তু বার্তা পৌঁছার পূর্বেই জাহাজ ছেড়ে দেয়া হয়। যাহোক, হিজাজের তুর্কী প্রতিনিধি গালিব পাশার মাধ্যমে আরবের উক্ত এলাকার তুর্কী কর্মকর্তা জামাল পাশা ও সেনাবাহিনী প্রধান আনোয়ার পাশার সঙ্গে শায়খুল হিন্দের চুক্তি হয় যে, আনোয়ার পাশা ও জামাল পাশার স্বাক্ষরিত প্রতিশ্রুতি অনুরোধপত্র ও নির্দেশাবলী ভারতের বিভিন্ন কেন্দ্রে পৌঁছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে এবং তিনি নিজে যে কোন প্রকারে হোক সংগ্রামের ঘাটি ইয়াগিস্তানে চলে যাবেন। সেখান থেকে ভারতে ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে পূর্ণোদ্যমে সক্রিয়ভাবে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন চালানো হবে। তুর্কী কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিটির নাম ছিলো ‘গালিব নামা’। রাওলেট এ্যাক্ট কমিটির রিপোর্টে সেই চুক্তির সংগ্রামী ভূমিকার বিশেষ অংশ হলোঃ “হে ভারতবাসী! এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মুসলমানগণ সর্বপ্রকার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আল্লাহর অনুগ্রহে তুর্কী সেনাবাহিনী এবং মুজাহিদগণ সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন। সুতরাং হে মুসলমান, তোমরা যে ইংরেজ শক্তির লৌহজলে আবদ্ধ রয়েছো, সংঘবদ্ধভাবে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রকার চেষ্টা ও সামর্থ্য নিয়ে পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে আসো। দেওবন্দ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে একমত হয়ে তাকে আমরা ঐ বিষয়ে পরামর্শ দান করেছি; ধন, জন ও সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় সমর উপকরণ দ্বারা তাঁর সহযোগিতা করো। এতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করো না”।

কিন্তু এ পরিকল্পনা নিয়ে মাওলানা মাহমুদুল হাসান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবেন; ঠিক এমন সময় (১৯১৬ খৃঃ) ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করে মক্কার ইংরেজ-তাবেদার শাসক শরীফ হোসাইনের দ্বারা তাঁকে গ্রেফতার করে। শরীফ হোসাইনের সমর্থনসূচক বক্তব্য এবং “আরবদেশ শাসনকারী তুর্কী খলীফা ও তুর্কীগণ কাফের ও খেলাফতের অযোগ্য” এই মর্মে লিখিত একটি ফতওয়ায় দস্তখত করতে তাঁকে চাপ দেওয়া হয়। তিনি ঘৃনাভরে তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। অতঃপর তাঁর শিষ্য মাওলানা মাদানীসহ কতিপয় বিপ্লবী আলেমকে গ্রেফতার করে মাল্টা দ্বীপে প্রেরণ করা হয়। উল্লেখ্য, তখন মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। মক্কা- মদীনা ছিল তুরস্ক খেলাফতের অধীন আরব প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত। শরীফ হোসাইন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন।

শায়খুল হিন্দ যখন জেলে তখন বৃটিশ ভারতের মুসলমান তাদের প্রিয় সংগ্রামী নেতা শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে কেন্দ্র করে রণোন্মাদনামূলক গান গেয়ে গেয়ে কুখ্যাত ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলিম যুবসমাজের উষ্ণ রক্তে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করতো। সেদিন কেবল সিন্ধু, মাদ্রাজ, ইউ.পির নয়; বাংলার পথে-ঘাটে, গঞ্জে-বাজারে, বন্দরেও এই ধ্বনি উচ্চারিত হতে শোনা যেতো যে, –“মুসলমানের শেখুল হিন্দ আছে মাল্টাতে, চল খেলাফত উদ্ধারে মুসলমানী যেতে বসেছে”।

তিন বছর পর ১৯২০ সালের মার্চে মাল্টা থেকে ছাড়া পেয়ে বোম্বে পৌঁছে দুর্দমনীয় স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে সরাসরি কংগেস যোগ দেন। পরে মাাওলানা আজাদের আমন্ত্রনে খেলাফত কন্ফারেন্সে শরিক হন। এসময় সেখানে আজাদ তাকে ‘শায়খুল হিন্দ’ উপধিতে ভূষিত করেন। সেই সমাবেশে তিনি ওলামাদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন;

” ﺍﺳﻼﻡ ﺻﺮﻑ ﻋﺒﺎﺩﺕ ﮐﺎ ﻧﺎﻡ ﻧﮩﯿﮟ . ﺑﻠﮑﮧ ﺗﻤﺎﻡ ﺩﯾﻨﯽ، ﺳﯿﺎﺳﯽ، ﺍﺧﻼﻗﯽ، ﺗﻤﺪﻧﯽ ﺿﺮﻭﺭﺗﻮﮞ ﮐﮯ ﻣﺘﻌﻠﻖ ﺍﯾﮏ ﮐﺎﻣﻞ ﻭ ﻣﮑﻤﻞ ﻧﻈﺎﻡ ﮨﮯ . ﻣﻮﺟﻮﺩﮦ ﺩﻭﺭ ﮐﯽ ﮐﺸﻤﮑﺶ ﻣﯿﮟ ﺣﺼﮧ ﻟﯿﻨﮯ ﺳﮯ ﺟﻮ ﻟﻮﮒ ﮐﻨﺎﺭﮨﮑﺸﯽ ﺍﺧﺘﯿﺎﺭ ﮐﺮﺗﺎ ﮨﮯ، ﺍﻭﺭ ﺻﺮﻑ ﺣﺠﺮﻭﮞ ﻣﯿﮟ ﺑﯿﭩﮭﮯ ﺭﮨﻨﮯ ﮐﻮ ﻓﺮﺍﺋﺾ ﺍﺳﻼﻡ ﮐﯽ ﺍﺩﺁﺋﮕﯽ ﮐﮯ ﻟﺌﮯ ﮐﺎﻓﯽ ﺳﻤﺠﮭﺘﺎ ﮨﮯ، ﻭﮦ ﺍﺳﻼﻡ  ﮐﯽ ﭘﺎﮎ ﺻﺎﻑ ﺩﺍﻣﻦ ﭘﺮ ﺑﺪﻧﻤﺎ ﺩﺍﮒ ﻟﮕﺎ ﺭﮨﯽ ﮨﯿﮟ.“

“ইসলাম কেবলমাত্র ইবাদত-বন্দেগীর নাম নয়; বরং ধর্ম, রাজনীতি, আখলাক এবং সংস্কৃতির যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপাদান সংবলিত এক ব্যবস্থার নাম ইসলাম। সময়ের চাহিদায় সাড়া না দিয়ে যারা একে পাশ কাটাতে চায় এবং যারা কেবল হুজরায় বসে থাকাকে ইসলাম প্রদত্ত কর্তব্য সম্পাদনে যথেষ্ট মনে করে৷ তারা ইসলামের পুতপবিত্র আঁচলে কালিমা লেপন করে”।

সুত্র:  শাহ ওয়ালী উল্লাহর চিন্তাধারা, উবাযদল্লাহ সিন্ধী। সফরনামায়ে আসসীরে মাল্টা, শায়খুল ইসলাম সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী। সররগুজশতে মুজাহিদ, গোলাম রসুল,কিতাব মন্জল, লাহোর। তাহরিকে রেশমী রুমেল, মাওলানা আব্দুর রহমান, ক্লাসিক, লাহোর।

আরও পড়ুন

প্রথম পর্ব :: আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত

আমাদের স্বাধীনতার লড়াই, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (২য় পর্ব)

কৈফিয়ত : কেন জমিয়তিদের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর হাসিমুখে ফুলের মালা গলায় দেওয়ার নিন্দা করলাম? সৈয়দ মবনু।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...