বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সকাল ৭:২৮
Home / আকাবির-আসলাফ / মুসলিহে উম্মাহ বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা রাহ.
শায়খে রেঙ্গা রাহ.

মুসলিহে উম্মাহ বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা রাহ.

শায়খে রেঙ্গা রাহ.
শায়খে রেঙ্গা রাহ.

(আকাবির আসলাফ-১১)

এহতেশামুল হক ক্বাসিমী ::

যে সকল পীর বুযুর্গের আবির্ভাবে ধন্য হয়েছে বাংলার জনভূমি, যারা নিজেদের জীবন-সম্পদ সর্বস্ব মানব কল্যাণে উৎসর্গ করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, আধ্ম্যাতিক জগতে যারা অমর অসন লাভ করেছেন, হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ. নিঃসন্দেহে তাদেরই একজন। তিনি ছিলেন নবী চরিত্রের বাস্তব প্রতিচ্ছবি, সালফে সালেহীনের পদাঙ্ক অনুসারী, সাহাবা আদর্শের অবিকল নমুনা, সরল পথের আকাশচুম্বী মিনারা, দৃঢ় সংকল্প আর হিম্মতের অটল পর্বত, ভ্রষ্টতার আঁধারে আচ্ছন্ন সমাজে প্রদীপ্ত মশাল, বাতিলের মুকাবেলায় উম্মুক্ত তরবারী, আহলে হকের রত্ম ছায়া ও ভাষ্যকার, তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধির মূর্তপ্রতীক, সর্বোপরি তিনি ছিলেন তাফসীরের জগতে এক উজ্জল দিবাকর।

জন্ম
এই মহামনীষী ১লা বৈশাখ ১৩১৯ বাংলা রোজ শুক্রবার সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা থানাধীন হরিনাথপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা আরকান আলী রাহ.। পিতা ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলেম ও মাদরজাত ওলী। মাতাও ছিলেন খোদাভীরু ও পর্দানশীল মহিলা।

শিক্ষাজীবন
হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ. প্রাথমিক শিক্ষা আপন পিতা ও স্নেহময়ী মাতার কাছ থেকে লাভ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য এলাকায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান না থাকায় তাকে স্থানীয় কান্দিগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়। অতঃপর মাধ্যমিক শিক্ষা নিজ পিতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়ায় অর্জন শেষে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। তিনি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। চরিত্র ছিল সুন্নতে নববীর অনুপম দৃষ্টান্ত। তাঁর চরিত্র মাধুর্যে উস্তাদগণ ছিলেন বিমুগ্ধ। শায়খে রেঙ্গা রাহ. সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে দরজায়ে ফজিলতে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি উপমহাদেশের ইলমে নববীর প্রাণকেন্দ্র দারুল উলূম দেওবন্দের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে দুই বছর যাবত ইলমে হাদীস, তাফসীর ও আত্মশুদ্ধি অর্জন করেন। সেখানেও তিনি প্রখর মেধা ও চারিত্রিক মাধূর্যতায় নিজের স্থান করে নেন।

বায়আত ও খেলাফত
হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. ছাত্রদেরকে বায়আত করতেন না, সে জন্য শায়খে রেঙ্গা রা. দেওবন্দে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করে ১ বছর ইলমে তাফসীর পড়েন এবং মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. এর হাতে বায়াতের মনস্থ করেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন নবী সা. তাঁকে নির্দেশ করছেন মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.’র কাছে বায়আত হওয়ার জন্য। তিনি শায়খে মাদানী রাহ.’র কাছে বায়আত হলেন এবং নিজেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত রাখলেন। এক বছরে তিনি এ সাধনার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেন। এরপর দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কিছুদিন পর মাদানী রাহ. নয়া সড়ক জামে মসজিদে এক জনবহুল মজলিসে বায়আতের অনুমতি দিয়ে তাঁর হাতে হেদায়াতের ঝাণ্ডা তুলে দেন।

জামেয়া রেঙা
জামেয়া রেঙা

কর্মজীবন
শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র কর্ম জীবন ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। তিনি ছিলেন অন্তরদৃষ্টি সম্পন্ন চিন্তক ও একজন সমাজ সংস্কারক। প্রতিটি কাজ তিনি অত্যন্ত হেকমতের সাথে করতেন। তাঁর কর্মজীবনে দুটি বিষয়ের প্রাধান্য ছিল।
১। তাফসীরুল কুরআন।
২। জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়ার সামগ্রিক উন্নয়ন।
শায়খে রেঙ্গা রাহ. দেওবন্দ থেকে ফেরার পর স্বীয় পিতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠত জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়ার দায়িত্ব হাতে নেন এবং জামেয়ার উন্নয়ন কাজ শুরু করেন। এলাকাবাসীর সার্বিক সহযোগীতায় অল্প দিনের মধ্যেই জামেয়া তারাক্কীর পথে অগ্রসর হয়।

মাদরাসার কাজ চলতে থাকে মনোরম পরিবেশে। বাড়তে থাকে মাদরাসার ছাত্র সংখ্যা। ১৯৬৭ সালে চালু করেন দাওরায়ে হাদীস। শুরু হয় সর্বক্ষণ ‘ক্বালা-ক্বালা রাসুলুল্লাহ সা.’র আওয়াজ। মাদরাসাকে ঘিরে তৈরি হয় বেহেশতি আমেজ। প্রতি বছর মাদরাসা থেকে বের হতে থাকেন দ্বীনের সঠিক রাহবার। দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে মাদরাসার সু-নাম ও সুখ্যাতি। যার উপর ভিত্তি করেই জামেয়া আজ স্বগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজের দ্বীনি খেদমত। আজ স্বরণ করিয়ে দিচ্ছে শায়খে রেঙ্গার দূরদর্শী কর্মপন্থা। শায়খে রেঙ্গা রাহ. মাদরাসার দায়িত্ব চালানোর পাশাপাশি দৃষ্টি দেন এলাকার মানুষের প্রতি। তাদেরকে কিভাবে দ্বীন শিক্ষা দেয়া যায় এ ব্যাপারে ভাবতে থাকেন। এ চিন্তা থেকেই শুরু করেন এলাকায় প্রতি সপ্তাহে ওয়াজ মাহফিল ও মোগলা বাজার জামে মসজিদে তাফসীরুল কুরআন। তার এই প্রচেষ্টা জীবনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তিনি খুব সুন্দর ভাবে লোকদের কুরআন বুঝাতেন। এর সুবাদে আস্তে আস্তে বিদআ’ত ও কুসংস্কার দূর হতে লাগলো। দিন দিন মানুষও তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকলো। ফলে তার মাহফিল ছড়িয়ে পড়লো ফেঞ্চুগঞ্জ, কটালপুর, গহরপুর, খোজারখলাসহ বিভিন্ন স্থানে। তিনি শত বাঁধা ও প্রকিুলতার ভিতর দিয়ে সময় মত মাহফিলে হাজির হতেন। এ ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর সাহেবজাদা হযরত মাওলানা শামসুল ইসলাম খলীল সাহেব বলেন- ‘এক বর্ষাকালে আমাদের বড় ভাই মুহিব মরণাপন্ন থাকা অবস্থায়ও বাবা ডুমশ্রী মৌজায় মাহফিলে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়ে যান। তা দেখে আম্মু কান্নায় ভেঙে পড়েন। শত চেষ্টা করেও কেউ আব্বুকে আটকাতে পারেননি। অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর ভাইয়ার ইন্তেকালের সংবাদ পাঠানো হয়। সংবাদ শুনে বাবা সাথীদের বললেন, “নৌকা থামিয়ে লাভ কী! তাফসীর করেই ফিরে আসি।” অবশেষে সাথীদের পিঁড়াপীড়িতে ডুমশ্রী মৌজায় লোক পাঠিয়ে তিনি ফিরে আসেন।’ এভাবে তিনি মাহফিলে হাজির হওয়াকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। শায়খে রেঙ্গা রাহ. খোদাভীতি ও সুন্নতের অনুসরণ, পিতা-মাতার খেদমত, বড়দের শ্রদ্ধা, ছোটদের স্নেহ এবং আতিথিয়েতা প্রভৃতি গুণের জন্য তিনি সবার কাছে প্রিয় ছিলেন।

মাকবারায়ে শায়খে রেঙা রাহ.
মাকবারায়ে শায়খে রেঙা রাহ.

মুত্যৃ

১৯ চৈত্র ১৩৯১ বাংলা। ২ এপ্রিল ১৯৮৫ ঈসায়ী, রোজ মঙ্গলবার, দুপুর ১২ ঘটিকায় এই মহা-মনীষী যিকির করতে করতে প্রিয় মাওলার সাথে মোলাকাত করেন। ইন্নালিল্লাহি — রাজিউন। জামেয়া প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করা হয়।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...