মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৪:৩৭
Home / অনুসন্ধান / শবে বরাত মানে লাইলাতুন নিস্ফি মিন শা‘বান!

শবে বরাত মানে লাইলাতুন নিস্ফি মিন শা‘বান!

শবে বরাত সম্পর্কে কোনো সহিহ হাদিস নেই?

Mohiuddin Kashemi সাহেবের ওয়াল থেকে:

অজ্ঞ, নির্বোধ কিংবা জ্ঞানপাপী কিছু লোক বলে বেড়ায়, শবে বরাত সম্পর্কে কোনো সহিহ হাদিস নেই। দুর্বল ও জাল হাদিস দ্বারা শবে বরাত প্রমাণিত। এ কথা ঠিক যে, শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত সব হাদিসই সমমানের সহিহ নয়। কিছু দুর্বল হাদিসও রয়েছে। এমনকি কিছু জাল হাদিসও আছে। অনেক বিষয়েই এমন দুর্বল ও জাল হাদিস থাকতে পারে; যদিও ওই বিষয়টি ¯^তঃসিদ্ধ ও প্রমাণিত। মনে করুন, জামাতে নামায আদায় করার ফজিলত ও গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন হাদিসে এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বিধৃত হয়েছে। এখন জামাতের ফজিলতের বিষয়ে কিছু দুর্বল এমনকি জাল হাদিস থাকার দ্বারা কি জামাতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যকেই অস্বীকার করা যাবে? এমন আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে যে, বিষয়টি সুপ্রমাণিত হওয়া সত্তে¡ও ওই বিষয়ে কিছু জঈফ বা জাল হাদিস রয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।
তাছাড়া দুর্বল বা জঈফ হাদিস কি সর্বত্র পরিত্যাজ্য? আহলে হাদিসের কথা শুনলে বোঝা যায়, জঈফ হাদিস মানেই পরিহারযোগ্য ও বাতিল। জঈফ হাদিসের সাথে তারা জাল হাদিসের আচরণ করে থাকে। এটি একটি মারাত্মক ভ্রান্তি। অথচ জঈফ হাদিস সবখানে পরিত্যাজ্য হয় না। একটি জঈফ হাদিস বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হলে এবং অনেক কিতাবে উল্লেখ থাকলে তা সহিহ হাদিসের পর্যায়ে চলে যায়। উসুলুল হাদিসের কিতাবে জঈফ হাদিসের সংজ্ঞার সাথে এর হুকুমও বিধৃত হয়েছে। বিস্তারিত সেখানে দেখা যেতে পারে।
আমরা শুধু বলতে চাচ্ছি, শবে বরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। উম্মাহর ইজমাও এর বড় দলিল। হ্যাঁ, এ সম্পর্কে জঈফ এমনকি মওজু হাদিসও রয়েছে। মওজু হাদিসগুলো অবশ্যই বাতিলযোগ্য। জঈফ হাদিসের ব্যাপারে বিস্তারিত কথা রয়েছে। সে অনুপাতে আমল করা হবে।
এটা ঠিক যে, শবে বরাতকে কেন্দ্র করে অনেক বিদআত ও কুসংস্কার মুসলিম সমাজে পালিত হচ্ছে। সেগুলো অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
শবে বরাতের ব্যাপারে সহিহ হাদিস রয়েছে– এ বিষয়ে দুজন বিখ্যাত আহলে হাদিস আলেমের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। তিরমিযি শরিফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াযির লেখক আল্লামা আবদুর রহমান মুবারকপুরি রহ. বলেন :
اعلم أنه قد ورد في فضيلة ليلة النصف من شعبان عدة أحاديث مجموعها يدل على أن لها أصلا فمنها حديث الباب.
এ কথা বলার পর তিনি এ বিষয়ে পাঁচ/ছয়টি হাদিস উদ্ধৃত করার পর বলেন :
فهذه الأحاديث بمجموعها حجة على من زعم أنه لم يثبت في فضيلة ليلة النصف من شعبان شيء والله تعالى أعلم
অর্থ : এসকল হাদিসের সমষ্টি তাদের বিরুদ্ধে দলিল, যারা বলে বেড়ায় যে, শবে বরাতের ফজিলতের বিষয়টি প্রমাণিত নয়। [খ. ৩, পৃ. ৩৬৫-৩৬৭]

কট্টরপন্থী আলেম হিসেবে পরিচিত শায়েখ নাসির উদ্দিন আলবানি রহ. এর মতামত এক্ষেত্রে সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। কারণ, অনেক আহলে হাদিস ভাই তাঁর অনুসরণের দাবি করেন। তিনি বলেন :
و جملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب و الصحة تثبت بأقل منها عددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث ، فما نقله الشيخ القاسمي رحمه الله تعالى في ” إصلاح المساجد ” ( ص ১০৭ ) عن أهل التعديل و التجريح أنه ليس في فضل ليلة النصف من شعبان حديث صحيح ، فليس مما ينبغي الاعتماد عليه ، و لئن كان أحد منهم أطلق مثل هذا القول فإنما أوتي من قبل التسرع و عدم وسع الجهد لتتبع الطرق على هذا النحو الذي بين يديك . و الله تعالى هو الموفق .

একই কিতাবে তিনি আরো বলেন :
يطلع الله تبارك و تعالى إلى خلقه ليلة النصف من شعبان ، فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن ” .
قال الألباني: حديث صحيح ، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا و هم معاذ ابن جبل و أبو ثعلبة الخشني و عبد الله بن عمرو و أبي موسى الأشعري و أبي هريرة و أبي بكر الصديق و عوف ابن مالك و عائشة .
[সিলসিলাতুস সহিহা : খ. ৩, পৃ. ২১৮]

শবে বরাত : কিছু ভ্রান্তি নিরসন
মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

আলকাউসারের শাবান ১৪২৬ হি. (সেপ্টেম্বর ’০৫ ঈ.) সংখ্যায় ‘বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শাবান ও শবে বরাত’ শিরোনামে, শাবান ১৪২৭ হি. (সেপ্টেম্বর ’০৬ ঈ.) সংখ্যায় ‘উলামায়ে সালাফের উক্তির আলোকে শাবান শবে বরাত’ শিরোনামে এবং রজব ১৪২৮ হি. (আগষ্ট ’০৭ ঈ.) সংখ্যায় ‘অজ্ঞতা ও রসম-রেওয়াজের কবলে শাবান-শবে বরাত : নববী নিদের্শনাই মুক্তির উপায়’ শিরোনামে শাবান ও শবে বরাত সম্পর্কে অনেকগুলো প্রয়োজনীয় কথা পাঠকের সামনে এসে গেছে। ওয়াল হামদু লিল্লাহি তাআলা আলা যালিকা হামদান কাছীরা।
এ সংখ্যায় শুধু কিছু ভুল ধারণা চিহ্নিত করে দিতে চাই। কেননা এগুলো সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন এসে থাকে।

প্রশ্ন ১ : আমি এক কিতাবে পড়েছি যে, শবে বরাত বিষয়ক সকল হাদীস ‘মওযু’। ইবনে দিহয়ার উদ্ধৃতিতে কথাটা ওই কিতাবে লেখা হয়েছে।

উত্তর : এটা একটা ভুল কথা। ইবনে দিহয়া কখনো এমন কথা বলতে পারেন না। যিনি তার উদ্ধৃতিতে এ কথা লিখেছেন তিনি ভুল লিখেছেন। ইবনে দিহয়া শুধু এটুকু বলেছেন যে, শবে বরাতে বিশেষ নিয়মের নামায এবং সে নামাযের বিশেষ ফযীলতের যে কথাগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত, তা মওযু। তাঁর মূল আরবী বক্তব্য তুলে দিচ্ছি :
أحاديث صلاة البراءة موضوعة
‘শবে বরাতের বিশেষ নামায সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো মওজু।’
(তাযকিরাতুল মওজুআত, মুহাম্মাদ তাহের পাটনী পৃ. ৪৫)
আল্লামা লাখনৌবী রাহ. ‘আল আছারুল মারফুআ ফিল আখবারিল মওজুআ’ (পৃ. ৮০-৮৫)তে পরিষ্কার লিখেছেন যে, ‘শবে বরাতে রাত্রি জেগে ইবাদত করা এবং যেকোনো নফল আমল যাতে আগ্রহ বোধ হয় তা আদায় করা মুস্তাহাব। এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই। এ রাতে মানুষ যত রাকাআত ইচ্ছা নামায পড়তে পারে, তবে এ ধারণা ভুল যে, এ রাতের বিশেষ নামায রয়েছে এবং তার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। যেসব বর্ণনায় এ ধরনের কথা পাওয়া যায় সেগুলো ‘মওযু।’ তবে এ রাত একটি ফযীলতপূর্ণ রজনী এবং এ রজনীতে ইবাদত-বন্দেগী করা মুস্তাহাব-এ বিষয়টি সহীহ হাদীস থেকেও প্রমাণিত। মোটকথা, এ রাতের ফযীলতকে অস্বীকার করা যেমন ভুল তদ্রূপ মনগড়া কথাবার্তায় বিশ্বাসী হওয়াও ভুল।’
আল্লামা শাওকানীও ‘আল ফাওয়াইদুল মাজমূআ’ পৃ. ৫১)তে এই ভুল ধারণা সংশোধন করেছেন।

প্রশ্ন ২ : একজন আলিমের কাছে শুনেছি যে, শবে বরাতে কবরস্থানে যাওয়া ‘মাসনূন’ নয়। আর আজকাল যেভাবে এ রাতে কবরস্থানে মেলা বসানো হয় এবং মহিলারাও বেপর্দা হয়ে সেখানে গিয়ে ভিড় করে, তা তো একেবারেই নাজায়েয।
প্রশ্ন এই যে, যতটুকু নাজায়েয তা তো অবশ্যই নাজায়েয, কিন্তু যদি মহিলারা বেপর্দা না হয় এবং কোনো গুনাহর কাজও সেখানে না হয় তবুও কি এ রাতে কবর যিয়ারত মাসনূন বলা যাবে না? হাকীমুল উম্মত ‘ইসলাহুর রুছূম’ কিতাবে একে ‘মাসনূন’ লিখেছেন।

উত্তর : মহিলাদের জন্য যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কবরস্থানে যাওয়া এমনিতেও নিষেধ। এরপর যদি পর্দাহীনতা ও অন্যান্য আপত্তিকর বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত হয় তবে তা আরো কঠিন হয়ে যায়। আর কবরস্থান যদি নিকটবর্তী হয় এবং মাযার না হয় আর সেখানে শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর কাজকর্ম না হয় তাহলে পুরুষের জন্য এ রাতে সেখানে গিয়ে যিয়ারত করার বিধান কী? হাকীমুল উম্মত রাহ. প্রথমে একে মাসনূন লিখেছিলেন। পরে আরো চিন্তা-ভাবনা ও উলামায়ে কেরামের সঙ্গে মত বিনিময় করার পর ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করেন এবং লেখেন যে, আমি কবরস্থানে যাওয়া থেকে বারণ করাকেই অধিক সতর্কতার বিষয় মনে করি। (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/২৮) শরীয়তের নীতিমালার আলোকে হযরত থানভী রাহ-এর দ্বিতীয় মতই অগ্রগণ্য।

প্রশ্ন ৩ : সুনানে ইবনে মাজাহ-তে (হাদীস নং : ১৩৮৮) পনেরো শা‘বান রাত সম্পর্কে এই হাদীসটি উল্লেখিত হয়েছে :
قوموا ليلها وصوموا نهارها
এই রাত জেগে ইবাদত কর এবং দিনে (অর্থাৎ পনেরো শা’বান) রোযা রাখ।
এই হাদীসটি থানভী রাহ. ‘খুতবাতুল আহকাম’-এ উল্লেখ করেছেন এবং ‘ইসলাহুর রুসূম’-এ পনেরো শাবান-এর রোযাকে মাসনূন বলেছেন। কিন্তু এক ব্যক্তি আমাকে বলেছেন যে, শায়খ আলবানী এই হাদীসটিকে মওযু বলেছেন। এরপর হযরত মাওলানা মুহাম্মদ তকী উছমানী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর ‘ইসলাহী খুতবাত’-এ দেখলাম যে, সেখানে এই হাদীসটিকে ‘জয়ীফ’ লেখা হয়েছে এবং এই রোযাকে ‘সুন্নত’ মনে করা ভুল বলা হয়েছে। প্রকৃত বিষয়টি বুঝে আসছে না। আশা করি সাহায্য করবেন।

উত্তর : ইবনে মাজাহর উপরোক্ত হাদীসটি ‘মওজু’ তো কখনোই নয়। তবে সনদের দিক থেকে ‘জয়ীফ’। যেহেতু ফাযাইলের ক্ষেত্রে ‘জয়ীফ’ গ্রহণযোগ্য তাই আলিমগণ শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে এ হাদীস বয়ান করে থাকেন।
শায়খ আলবানী ‘সিলসিলাতুয যয়ীফা’ (৫/১৫৪) তে এই বর্ণনাকে ‘মওজূউস সনদ’ লিখেছেন। অর্থাৎ এর ‘সনদ’ মওজূ। যেহেতু অন্যান্য ‘সহীহ’ বর্ণনা উপরোক্ত বর্ণনার বক্তব্যকে সমর্থন করে সম্ভবত এজন্যই শায়খ আলবানী সরাসরি ‘মওজূ’ নাবলে‘মওজূউস সনদ’ বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। তথাপি শায়খ আলবানীর এই ধারণা ঠিক নয়। সঠিক কথা এই যে, এই বর্ণনা ‘মওজূ’ নয়, শুধু ‘জয়ীফ’। ইবনে রজব রাহ. প্রমুখ বিশেষজ্ঞদের এই মতই আলবানী সাহেব নিজেও বর্ণনা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আলবানী সাহেব যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তা এই যে, এ বর্ণনার সনদে ‘ইবনে আবী ছাবুরা’ নামক একজন রাবী রয়েছেন। তার সম্পর্কে হাদীস জাল করার অভিযোগ রয়েছে। অতএব এই বর্ণনা ‘মওজু’ হওয়া উচিত। তবে এই ধারণা এ জন্য সঠিক নয় যে, ইবনে আবী সাবুরাহ সম্পর্কে উপরোক্ত অভিযোগ ঠিক নয়। তার সম্পর্কে খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায় যে, জয়ীফ রাবীদের মতো তার স্মৃতিশক্তিতে দুর্বলতা ছিল। রিজাল শাস্ত্রের ইমাম আল্লামা যাহাবী রাহ. পরিষ্কার লিখেছেন যে, ‘স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণেই তাকে জয়ীফ বলা হয়েছে।’ দেখুন সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/২৫০
সারকথা এই যে, উপরোক্ত বর্ণনা মওজু নয়, শুধু জয়ীফ।
পনেরো শাবানের রোযা সম্পর্কে থানভী রাহ. যে ‘মাসনূন’ বলেছেন তার অর্থ হল মুস্তাহাব। আর ইসলাহী খুতবাতের আলোচনা মনোযোগ দিয়ে পড়া হলে দেখা যায় যে, তা এ কথার বিপরীত নয়। ওই আলোচনায় ‘জয়ীফ’ হাদীসের ওপর আমল করার পন্থা বিষয়ে একটি ইলমী আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে। হযরত মাওলানা পনেরো তারিখের রোযা রাখতে নিষেধ করেননি। তিনি শুধু এটুকু বলেছেন যে, একে শবে বরাতের রোযা বলবে না। গোটা শাবান মাসেই শুধু শেষের দুই দিন ছাড়া, রোযা রাখা মুস্তাহাব। তাছাড়া প্রতিমাসের ‘আয়্যামে বীজ’ (চাঁদের ১৩,১৪,১৫ তারিখ) রোযা রাখা মুস্তাহাব। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ দিনের রোযা রাখা হলে ইনশাআল্লাহ ছওয়াব পাওয়া যাবে।

প্রশ্ন ৪ : আমি একটি পুস্তিকায় পড়েছি যে, শবে বরাত সম্পর্কে যেসব রেওয়ায়েত পাওয়া যায় তন্মধ্যে সনদের বিবেচনায় সবচেয়ে উত্তম রেওয়ায়েতটিই হল ‘জয়ীফ।’ তাহলে অন্যগুলোর অবস্থা খুব সহজেই অনুমেয়। এ কথা কি সঠিক?

উত্তর : এ কথাটা একেবারেই ভুল। শবে বরাত সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদীস এসেছে। তার মধ্যে একটি হাদীস ‘সহীহ’, কিছু হাদীস ‘হাসান’ আরকিছু‘জয়ীফ’। এ জন্য শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস জয়ীফ-একথা ঠিক নয়। সনদের বিচারে সবচেয়ে উত্তম বর্ণনা সেটা যা ইবনে হিববান ‘কিতাবুস সহীহ’ তে (হাদীস ৫৬৬৫) বর্ণনা করেছেন।
عن معاذ بن جبل عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان، فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن.
হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতপর শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া তার সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন।’
আরো একাধিক হাদীসে এ বিষয়টি এসেছে। যেগুলোর সনদ ‘হাসান লিযাতিহী বা হাসান লিগায়রিহী।’ যথা মুসনাদে আহমদ এর ৬৬৪২ নং হাদীস, এবং মুসনাদুল বাযযার (২০৪৫)-এ আবু বকর সিদ্দীক রা. থেকে বর্ণিত হাদীস।
এছাড়া এ রাতের আমল সম্পর্কে ‘শুআবুল ঈমান’ বায়হাকীর নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষণীয়।
হযরত আলা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়তো মৃত্যু বরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন-
هذه ليلة النصف من شعبان، إن الله عز وجل يطلع على عباده في ليلة النصف من شعبان، فيغفر للمستغفرين ويرحم المسترحمين ويؤخر أهل الحقد كما هم.
‘এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৩/৩৮২-৩৮৩
ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন-
هذا مرسل جيد
এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য।
এধরনের বেশ কয়েকটি সহীহ ও হাসান হাদীস বিদ্যমান থাকা অবস্থায় কি এ কথা বলা উচিত যে, এ বিষয়ে সর্বোত্তম হাদীসটি সনদের বিচারে জয়ীফ? ভালোভাবে না জেনে কথা বলা থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নিরাপদ রাখুন।

প্রশ্ন ৫ : লোকেরা বলে, এ রাতের ফযীলত শবে কদরের সমান। কুরআন মজীদে ‘লায়লাতিন মুবারাকা’ বলে শবে বরাত বোঝানো হয়েছে। এ কথাটা কি সঠিক?

উত্তর : দুটো কথাই ভুল। শবে বরাতকে শবে কদরের সমান মনে করা ভুল। কুরআন-হাদীসে শবে কদরের যত ফযীলত এসেছে শবে বরাত সম্পর্কে আসেনি। বিশেষত কুরআন মজীদ নাযিল হওয়ার মতো বরকতময় ঘটনা শবে কদরেই সংঘটিত হয়েছে। এই ফযীলত অন্য কোনো রজনীতে নেই।
‘লায়লাতিন মুবারাকা’ বলে শবে কদরকেই বোঝানো হয়েছে, যা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সূরা কদরে। এজন্য এখানে শবে বরাত উদ্দেশ্য হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরনের প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক অবস্থানে দৃঢ়পদ থাকার তাওফীক দান করুন। ইমাম ইবনে রজব রাহ. এর ভাষায় : ‘মুমিনের কর্তব্য এই যে, এ রাতে খালেস দিলে তওবা করে যিকির, দুআ ও ইস্তেগফারের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যাবে। যত্নের সঙ্গে নফল নামায পড়বে। কেননা কখন মৃত্যু এসে যায় বলা যায় না। তাই কল্যানের মওসুম শেষ হওয়ার আগেই তার মূল্য দেওয়া কর্তব্য। আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে ছওয়াব লাভের আশা নিয়ে পনেরো তারিখের রোযাও রাখবে। তবে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হল, ওইসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, যেগুলো এ রাতের সাধারণ ক্ষমা ও দুআ কবুল হওয়া থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়। যথা : শিরক, হত্যা, হিংসা-বিদ্বেষ। এগুলো সবগুলোই কবীরা গুনাহ। আর হিংসা-বিদ্বেষ তো এতই গর্হিত বিষয় যে, এটা অধিকাংশ সময়ই মানুষকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
যেকোনো মুসলমান সম্পর্কেই বিদ্বেষ পোষণ করা অত্যন্ত মন্দ প্রবণতা। তবে সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীন সম্পর্কে অন্তরে হিংসা ও বিদ্বেষ বিদ্যমান থাকা অত্যন্ত ভয়াবহ ও গর্হিত অপরাধ। এজন্য মুসলমানদের কর্তব্য হল সর্বদা অন্তরকে পরিষ্কার রাখা এবং হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পাক-পবিত্র রাখা। বিশেষত উম্মাহর পূর্বসূরী ব্যক্তিদের সম্পর্কে অন্তর পুরোপুরি পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য, যাতে রহমত ও মাগফিরাতের সাধারণ সময়গুলোতে বঞ্চিত না হতে হয়।’ -লাতাইফুল মাআরিফ পৃ. ১৫৫-১৫৬#
.
[ মাসিক আলকাউসার » শাবান-রমযান ১৪২৯ . আগস্ট ২০০৮ ]

 

“আমার এই সাহীহ হাদীসটা অস্বীকার করতে সাহস হয়নি। তাই তার কথাটা আমি মানিনি।” 
Abdus Salam Azadi

শা’বানের ১৫ই রাতের ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীসই নেই?
=======================================
২০০৪ সালে লন্ডনে দারুল উম্মাহতে একটা সেমিনার হয় শা’বান মাসের প্রথমে। আমার বড়ভাই ও বন্ধু উস্তায মুমিনুল ইসলাম ফারুকী প্রায় ত্রিশ পৃষ্ঠার একটা প্রবন্ধ লেখেন যেখানে তিনি কয়েকটি বিষয় নিখুঁত ভাবে প্রমান করেনঃ

১- শা’বান মাসের মধ্যরাত ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান’ নিঃসন্দেহে একটি ফাজিলাত পূর্ণ রাত। এব্যাপারে উম্মাতের কোন দ্বিমত নেই। ইবন তাইমিয়্যাহ বলেছেনঃ “আম্মা লায়লাতুন নিসফ মিন শা’বান ফা ফিহা ফাদল, অথবা ‘লা শাক্কা আন্না লায়ালাতান্নিস্ফ মিন শা’বান মিনল লায়ালী আল মুফাদ্দ্বালাহ’ অর্থাৎ শা’বানের মাঝের রাতটা ফজিলাতপূর্ন। উস্তায ফারুকী সেইটা বিভিন্ন ইমামগণের বক্তব্য এনে প্রমান করেন।

২- তিনি এ সংক্রান্ত যাবতীয় হাদীস গুলো ইবন মাজাহ, তিরমিযী সহ অন্যান্য কিতাব থেকে চয়ন করে একত্রিত করেন। যেখানে থেকে তিনি এই রাতের মাহাত্ম্য প্রমান করেছেন। তিনি প্রমান করছিলেন, মুআয ইবন জাবাল সহ আরো সাত আট জন সাহাবীর বর্ণিত হাদীস টা এই বাপারে অত্যন্ত সহীহ। তিনি বলেছিলেন সমস্ত মুহাদ্দিসগণ মনে করেন মুআজ এর হাদীস রদ্দ করার মত নয়, এদের মধ্যে কেও এইটাকে সাহীহ লিগাইরিহী বলেছেন, কেও কেও এটাকে সাহীহ লিযাতিহী বলতে দ্বিধা করেন নি, এবং হাদীস কে হাসান এর নিচে নামানোর কোন সুযোগ নেই। তিনি আমাদের একটু হাসায়ে ছিলেন যখন দেখালেন আমাদের উস্তায শায়খ আলবানী এক যায়গায় হাদীস টাকে হাসান বলেছেন, আরেক যায়গায় সাহীহ বলেছেন।

যাহোক, সেই হাদীস টা হলো এইঃ
يَطَّلِعُ اللَّهَ عَلى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ
ইয়াত্তালি’উ আল্লাহ আলা খাল্ক্বিহি ফী লায়লাতিন নিসফি মিন শা’বান, ফায়াগফিরু লিজামীই খাল্কিহি, ইল্লা লিমুশরিক আও মুশাহিন, অর্থাৎ শা’বানের ১৫ তারিখ রাতে আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি দেন, ফলে তিনি মুশরিক ও মুশাহিন ছাড়া সবাইকে মাফ করে দেন। মুশরিক তো আমরা জানি, মুশাহিন সম্পর্কে ইমাম আওযাঈ বলেনঃ সাহিবুল বিদআহ আলমুফারিক লিজামাআতিল উম্মাহ, বিদআতী ও উম্মাতের জামাআত ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তি।

৩- আরেকটা ব্যাপারে আমাদের বড়ভাই উল্লেখ করেছিলেন, তাহলো এই রাত পবিত্র রাত, কাজেই গাফলতিতে থাকা উচিৎ না, বরং ব্যক্তিগত ইবাদাত, দান সাদকাহ করা, নফল ইবাদাত করা, কারো প্রতি হিংসা ও রাগ না রাখা ইত্যাদির মাধ্যমে কাটানো উচিৎ।

৪- তিনি এটাও প্রমান করেন যে এক ধরণের আলিমগণ যে এইটাকে ভাগ্য রজনী বলে প্রচার করেন ঐটা ইবনে আব্বাস থেকে বর্নিত হলেও মেনে নেয়া যাবেনা, কারণ এটা সুস্পষ্ট কুরআন বিরোধী। কুরআনে বলা হয়েছে যে রাতে ভাগ্য বন্টন হয় তা লায়লাতুন মুবারাকাহ। ঐ রাত কে লাইলাতুল ক্বাদর বলে। আর নিসঃন্দেহে লায়লাতুল ক্বাদর রমাদান মাসে।

৫- তার বক্তবে জোরালো নাহলেও আরেকটা সাজশান আসে, যে ঐ রাতে সবাই মিলে মসজিদে ইবাদাতের মাধ্যমে কাটানো কাজ যদিও দুই একজন সালাফ থেকে প্রমানিত আছে, কিন্তু মেইন স্টীম মুসলিম স্কলার সেটা গ্রহন করেনি।

আমি তার এই বক্তব্য লন্ডন থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত ‘ইউরোবাংলাতে’ পাঠায়েছিলাম। তারা আমার বক্তব্যের অর্ধেক কেটে কিছু ছাপায়ে দেন। তাতেই ক্ষেপে ওঠেন আমাদের একজন শায়খ। তিনি বলেনঃ ১৫ শা’বান সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস ই নেই, সেখানে আপনারা এইভাবে একটা প্রেস রিলীজ দিলেন?!
আমার এই সাহীহ হাদীসটা অস্বীকার করতে সাহস হয়নি। তাই তার কথাটা আমি মানিনি।

শবেবরাত নিয়ে ইত্তেফাক রিপোর্ট:

এই শবেবরাত পালন নিয়ে আলেম-ওলামা ও ধর্মচিন্তাবিদদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশে ঘটা করেই পালিত হয়ে আসছে। একটি মাত্র ‘হাসান’ হাদিসে এটাকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়েছে। এই রাতকে লাইলাতুল বরায়াতও বলা হয়। মুহাক্কিক আলেম ও ইসলামের বিশেষজ্ঞগণ এই রাতে বিশেষ কোনো ইবাদতের নির্দেশ নেই বলে মনে করেন।

কেবলমাত্র বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরানসহ কয়েকটি দেশে শবেবরাত পালনের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। সৌদি আরবে শবেবরাতের কোনো অস্তিত্ব নেই। ইরানে শবেবরাত শিয়া মাজহাবের দ্বাদশ ইমাম হযরত ইমাম মাহদির জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। এই রাতে ইরানের সর্বত্র আলোক সাজসজ্জা করা হয় ও বিশেষ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

হাদিস জগতের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম গ্রন্থ বুখারি ও মুসলিম শরিফে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান নিয়ে কোনো হাদিস পাওয়া যায় না। তবে সিহাহ সিত্তার অন্যান্য গ্রন্থে এ সম্পর্কে একাধিক হাদিস পাওয়া যায়। যেমন ইবনে মাজাহর ১৩৮৮ নম্বর হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রজনী আসে, তখন তোমরা রাতে দণ্ডায়মান থাকো এবং দিবসে সিয়াম পালন করো। কারণ, ওই দিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিক তালাশকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। কোনো দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করব। এভাবে সুবহে সাদিক উদয় পর্যন্ত চলতে থাকে। হাদিসের ইমামদের মত অনুযায়ী, এই হাদিস অত্যন্ত দুর্বল।

কিন্তু বুখারি ও মুসলিম শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমাদের প্রতিপালক প্রতি রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন, আমাকে ডাকার কেউ আছে কি? আমি তার ডাকে সাড়া দেবো। আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে তা প্রদান করবো। আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো।

বুখারি ও মুসলিমের এই সহিহ হাদিস দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, মুমিনের প্রতি রাতই ফজিলতপূর্ণ। অনুরূপভাবে সিহাহ সিত্তার অন্যতম হাদিস গ্রন্থ তিরমিজি শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহে ওয়া সাল্লামকে খুঁজে পেলাম না। তখন বের হয়ে দেখি তিনি জান্নাতুল বাকিতে আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে রয়েছেন। তিনি বললেন, তুমি কি আশঙ্কা করছিলে যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার ওপর অবিচার করবেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাহে ওয়া সাল্লাম আমি ধারণা করেছিলাম যে আপনি আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট গমন করছেন। অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চয়ই মহিমান্বিত পরাক্রান্ত আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। অতঃপর তিনি ‘কালব গোত্রের মেষপালের পশমের অধিক সংখ্যককে ক্ষমা করেন।’

ইমাম বুখারি (রা) ওই হাদিসটিকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ রাতের বিষয়ে চার ইমামের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। ইমাম মালেক (র) ও তাঁর অনুসারী ফকিহ ও ইমামগণ ওই রাতে বিশেষ ইবাদত পালন করতে নিষেধ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী (র)-এর মতে, এ রাতে ব্যক্তিগতভাবে একাকী নিজ গৃহের মধ্যে ইবাদত ও দোয়া মোনাজাতে থাকা মুস্তাহাব। ইমাম আবু হানিফা (র) ও ইমাম আহমদ (র) এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেননি।

কিভাবে এলো শবেবরাত?

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, শবেবরাত বলে ৪০০ হিজরির আগে কিছু ছিল না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাহে ওয়া সাল্লাম এর দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুওয়াতী জীবনে, এমনকি সাহাবীদের যুগেও এই ধরনের কোনো দিবস পালনের কথা ইসলামের ইতিহাসে নেই। শবেবরাত সর্বপ্রথম চালু হয়েছিল ৪৪৮ হিজরিতে বায়তুল মুকাদ্দাসে (মাসজিদুল আকসায়)। তত্কালে সেখানকার ইমামগণ বাদশার কাছে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করার জন্য শাবানের রাতে মসজিদে উপস্থিত লোকদের মাঝে বহু ফযিলতের ওয়াজ ও নামাযের অশেষ নেকী পাওয়ার বানোয়াট বিবরণ পেশ করতেন। যে ইমাম শবেবরাতের যত বেশি বানোয়াট ওয়াজ ও তাফসীর করতে পারতেন সে মসজিদে তত বেশি লোক জমা হতো। ইমামদের এই ভিড় বাড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল বাদশাহর নিকট তাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করা। বাদশাহ গদির স্বার্থে জনপ্রিয় লোকদের হাতে রাখতে চাইতো। তাই ইমামদের মধ্যে জনপ্রিয়তার লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে এই শবেবরাতকে নির্বাচিত করেছিল। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ইমামদের মর্যাদা বিচার করতো বাদশাহ। সে সময়ের বাদশা ছিলেন ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন। বাদশার সমর্থন থাকায় শবেবরাত উদযাপন আরো জাঁকজমক ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে সে যুগের হক্বপন্থি আলেমগণ এ নতুন বিদ’আত বা নতুন আবিষ্কৃত ইবাদত পালনের বিরুদ্ধে নিজেদের সাধ্যানুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। কিন্তু সমাজের অজ্ঞ লোকেরা হক্বপন্থি আলেমদের কথা শ্রবণ না করে বিদ’আতীদের অনুসরণ করতে থাকে। এ বিদ’আতটি পৃথিবীতে বেশিদিন টিকতে পারেনি। বিদ’আতটি সৃষ্টির পর মাত্র ৩৫২ বছর চালু ছিলো। জনপ্রিয়তা পাবার পরও একসময় তা জেরুজালেম, সিরিয়া, মিশর, ইরাকসহ প্রায় সকল দেশেই আবার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে ইরানের শিয়াদের কিছু অঞ্চলে তা চালু থেকে যায়। সেই সময় ভারতবর্ষে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছিল। ভারতের কিছু নও-মুসলিম ইরানে বিস্তার লাভ করা এই শবেবরাত ভারতেও প্রচলন করলো। এই নও-মুসলিমরা পূর্বে ছিল হিন্দু। তারা হিন্দুদের দীপালি পূজার মতো শবেবরাতের রাতে মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালাতো। তারপর তা ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তারা সলাতুর রাগায়েব নামে চালু করে একটি নামায। এই নামায ১০০ রাকাত। এটাই শবেবরাতের নামায বলে খ্যাত।

বাংলাদেশে হালুয়া-রুটির প্রচলন যেভাবে—

শবেবরাতের অন্যতম অনুষঙ্গ হালুয়া-রুটি। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন তার গবেষণায় জানাচ্ছেন, ১৯শ শতকের শেষের দিকে ঢাকার নবাবরা বেশ ঘটা করেই শবেবরাত পালন করতেন, সে সময়ে ঢাকার নবাবরা শবেবরাতের আলোকসজ্জা করতেন। এরপর পাশাপাশি মিষ্টি বিতরণ করতেন। সে সময়ে যেহেতু মিষ্টির দোকান খুব একটা প্রচলিত ছিল না, সেজন্য মিষ্টি জাতীয় খাদ্য বানানোর উপাদান দিয়ে বাড়িতে হালুয়া তৈরির প্রচলন শুরু হয়। ধীরে-ধীরে এর বিস্তার ঘটতে থাকে। মূলত সে সময়ে হিন্দুদের আধিপত্য থাকার কারণে সেটিকে মোকাবেলার জন্য ঢাকার নবাবরা শবেবরাত খুব ঘটা করে আয়োজন করতেন। সেই সিলসিলা এখনো চলছে।

ইত্তেফাক/ইউবি

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...